এসআইআর নিয়ে তৃণমূলের মাথাব্যথার কারণ আছে
সুদীপনারায়ণ ঘোষ
অবৈধ ভোটারদের নাম মুছে ফেলার জন্য নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত তৃণমূল কংগ্রেসকে মোক্ষম জায়গায় ঘা দিতে পারে। ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে আগে দলের অনুগত পরিযায়ী ও সংখ্যালঘু ভোটার ভিতকে গুরুতরভাবে জখম করতে পারে এই নির্বাচনী ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে বিহারে সদ্য সমাপ্ত বিশেষ নিবিড় সংশোধন (যদিও আবেদন পর্ব এখনো চলছে বিহারে) পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের অন্যত্র প্রসারিত হবে। এই ভোটার তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়া তৃণমূলের পক্ষে বিপর্যয়কর হতে পারে, কারণ এর ফলে তাদের লক্ষ লক্ষ অবৈধ ভোটারের নাম বাদ
যেতে পারে তালিকা থেকে। কমিশন ঘোষণা করেছে যে দেশব্যাপী নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধনে সেই সব ভোটারাদের নাম বাদ যাবে যারা ‘সাধারণভাবে সেই এলাকার বাসিন্দা’ নন কিন্তু তাদের আরও অন্যস্থানের তালিকায় নাম আছে। এর মানে যে ব্যক্তি পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজস্থানে কাজ করতে চলে গেছে, সেখানে থাকে এবং সেখানেই দীর্ঘকাল কর্মরত সে পশ্চিমবঙ্গের ভোটর থাকার যোগ্য নয়। রাজ্যের তালিকা থেকে নাম কেটে তার নাম সেই রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।
মুখ্য নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘সংশোধিত তালিকায় সেই ভোটারদের নাম বাদ দেবে যারা অন্যত্র চলে গেছে কিন্তু সেখানে নাম লেখাতে অনিচ্ছুক যাতে তারা তাদেরআদিরাজ্যে ও স্থানে তাদের ভোটদান করার অধিকার ধরে রাখতে পারে।’ যেমন যে ব্যক্তি সাধারণত দিল্লিতে থাকে কিন্তু পাটনায় তার একটা বাড়ি আছেতাকেদিল্লির ভোটার হিসেবে নাম লেখাতে হবে। এইটা জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ২০ নম্বর ধারায় করা হবে। এই ধারায় ‘সাধারণভাবে বাসিন্দা’
এই শব্দবন্ধর ব্যাখ্যা দেওয়া আছে যারা ‘সাধারণভাবে বাসিন্দা নয় তারা সেই রাজ্যে ভোটার থাকতে পারবেনা। কোনোজায়গায় সম্পত্তি থাকা মানেই সেই জায়গার সাধারণ বাসিন্দা নন। পশ্চিমবঙ্গে এর অর্থকী? এর মানে পশ্চিমবঙ্গের যে সব লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক দেশের অন্যান্য রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে,যারা সেখানে থাকে ও কাজ করে, তাদের নাম এরাজ্যের ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজস্ব পরিসংখ্যান অনুযায়ী এরাজ্য থেকে প্রায় ২১.৬৭ লক্ষ লোক অন্যান্য রাজ্যে থাকেও কাজ করে। তারা হয় বুকলার কর্মী বা নির্মাণও কৃষিকার্ষে নিযুক্ত। এই তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহির্গমন করা হোয়াইট কলারের কর্মী ও পেশাজীবীরা অন্তর্ভুক্ত নন, যারা দেশের অন্যান্য রাজ্যে বা বিদেশে কর্মরত ও সেখানে থাকে।কারণ তারা কেউই আর পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসে ভোট দিতে চায় না। চেষ্টাই করে না। তবে অর্থনীতিবিদরা বলেন
পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহির্গমনকারীদক্ষ ও অদক্ষকর্মীর প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি।ভারতের শ্রম কমিশনার, রেজিস্ট্রার জেনারেল ও সেন্সাস কমিশনারের মতো আরও নানা উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে নানা সংখ্যা জোগাড় করে এই ইঙ্গিত পাওয়াযায় যে, গত পাঁচ দশকে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক যারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্যান্য রাজ্যে সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজের জন্য গেছে তাদেরসংখ্যাতিনকোটির বেশি হবে। যারা এইতথ্য দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন কলকাতার স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটেরপরিসংখ্যানবিদ অরিন্দম বসু।
তিনি বলেছেন, ‘বেশিরভাগ পরিষায়ী শ্রমিক ওই সব রাজ্যেনাম লেখায় না।কারণ তারা নির্বাচন অফিস কোথায় আছে, কীভাবে নাম লেখাতে হয়তো জানে না বা তারা দীর্ঘকাল পশ্চিমবঙ্গে ফেরেনি অথবা তারা আদৌ ভাবিত নয়। কারণ এতে তাদের কোনো অর্থকরী লাভ নেই বা অন্য কোনো বস্তুগত লাভ নেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিজের পরিসংখ্যান অনুসারে বাইরে যাওয়া শ্রমিকদের বেশিরভাগ আধাদক্ষ বা অদক্ষ শ্রমিক, তারা মুর্শিদাবাদে থেকে গেছে। এর
পরেই আছে মালদা, নদীয়া, বীরভূম এবং উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা।
এই পরিযায়ীদের জনতাত্ত্বিক ভাগটা জানা নেই, তাই অনুমানে বলা যায় যে এদের অধিকাংশই মুসলমান। পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের বেশিরভাগই অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান।আমস্টার্ডামের আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার আধিকারিক সঞ্জীব গুপ্ত বলেছেন, ‘আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের ৭৫-৮০ শতাংশ মুসলমান।আর তাদের অনেকেই বাংলাদেশ থেকে আগত অবৈধ অনুপ্রবেশকারী।যারা
পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে জালিয়াতিও প্রতারণাকরে তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য দলিল ও প্রমাণপত্র জোগাড় করেছে। অন্য রাজ্যে পাড়ি জমিয়ে তারা গেছে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের কাজ করতে। ‘শ্রীগুপ্ত গত কয়েক দশক ধরে অভিবাসন নিয়ে কাজ করছেন বিশেষত অবৈধ অভিবাসন নিয়ে। আর এই সংস্থা অভিবাসন নিয়ে গবেষণারত সমাজতত্ত্ববিদদের একটা বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক। শ্রীগুপ্তের মতামতকে মান্যতা দিয়েছেন মুম্বাইতে অবস্থিত জনসংখ্যা বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক সংস্থার অধীন অভিবাসন ও শহর অধ্যয়ন দপ্তরের শিক্ষক এম শ্রীনিবাস রাও। এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের অধীনস্থ স্বশাসিত সংস্থা হিসেবে কাজ করে।
শ্রীরাও বলেছেন, ‘বাংলাদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের পশ্চিমবঙ্গে কোনোজমি বা অন্য সম্পদ নেই এবং যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে কাজ নেই তাই তাদের জীবিকার সন্ধানের জন্য রাজ্যে চলে যেতে হয়। কাজেই এই রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাওয়া কর্মীদের বেশিরভাগইবাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ
অনুপ্রবেশকারী। বাঙ্গালি মুসলমান যারা বঙ্গের মূলনিবাসী তারাও কাজের জন্য অন্য রাজ্যে অভিগমন করে কিন্তু যে সব অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী অন্য রাজ্যে কাজ করে তাদের সংখ্যার তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের মূলনিবাসী বাঙ্গালি মুসলমানদের সংখ্যাটা অত্যন্ত কম, এক সামান্য ভগ্নাংশ মাত্র।
ওড়িশার বালাসোরের ফকির মোহন বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংখা দপ্তরের দেবেশ মহাস্তি বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের অন্য রাজ্যে কাজের সন্ধানে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই, ‘তারা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অবৈধভাবে অতিক্রম করে, অল্পদিনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে বাস করে শুধু ভারতের নাগরিকত্ব প্রমাশের তথাকথিত প্রমাণরূপে জাল ও প্রতারণামূলক দলিলের ভিত্তিতে সুসংগঠিত র্যাকেটের মাধ্যমে আধার কার্ড, ভোটার কার্ড ও রেশন
কার্ড জোগাড় করে। কয়েক মাসের মধ্যেই বা তার চেয়েও কম সময়ে এইগুলো সংগ্রহ করে তারা এবং তারপরে কাজের জন্য অন্যান্য রাজ্যে যায়। কারণ পশ্চিমবঙ্গে কোনো কাজ তারা পায় না।’
এটা তৃণমূল কংগ্রেসকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে? পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা এইসব পরিযায়ী শ্রকিদের একটাবিপুল অংশ তৃণমূলের অনুগত ভোটার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
অভীক সেন বলেছেন, ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী মুসলমানরা তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করে, কারণ শাসক দল তাদের তোষণ করে। তারা জানে যেযতদিন তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আছে ততদিন তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী মুসলমান খুবই সংবেদনশীল এবং তৃণমূল ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। পূর্বতন সিপিআইএমের মতো প্রতিটা নির্বাচনের আগে তৃণমূল কংগ্রেস এক বিরাট কর্মতৎপরতাচালায়। সেটা স্থানীয় পর্ষদহোক
(পঞ্চায়েত ও মিউনিসিপ্যালিটি), রাজ্য বিধানসভাবা লোকসভা হোক। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের পশ্চিমবঙ্গের যে জায়গায় ভোটার তাদের সেইখানে ফিরিয়ে আনে, যাতে তারা দলের জন্য ভোট দিতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘ট্রেনের টিকিটেরব্যবস্থাকরাহয়, বাস বুক করা হয় এবং আসা-যাওয়ার জন্য হাত খরচ পাঠানো হয়। এই পরিযায়ী শ্রমিকরা যাতে তারা যেখানকার ভোটার সেইখানে ফিরে আসতে পারে। একবার পৌঁছলে তাদের একটা ভালো রকমেরটাকা
দেওয়া হয়। এই শ্রমিকদের অনেকেই বিশেষত বাংলাদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারীমুসলমান, যারা ঘরে ফেরে তারা শাসক দলের গুন্ডাবাহিনীতে পরিণত হয়। এরাঅন্য দলের সমর্থকদের শাসায়, ভয় দেখায় ও আক্রমণ করে।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানেরশিক্ষক দেবেন হালদার বলেন, ‘২০১১ সালের আগে এইসব শ্রমিকরাসিপিআইএমের কাছে কৃতজ্ঞ থাকত আর এখন তারা তৃণমূলের কাজে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ। এর নানা কারণ আছে। বাংলাদেশিঅবৈধ অনুপ্রবেশকারীরাশাসকদলের কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকে যাতে তারা ভারতের নাগরিকত্ব প্রমাণ জোগাড় করতে পারে এবং অন্য রাজ্যে তাদের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পায়। কর্মস্থল ও আবাসস্থল থেকে পশ্চিমবঙ্গের স্পন্সর করা সফর, তার সঙ্গে শাসকদলের তরফে দেওয়া হাতখরচের টাকা তাদের তৃণমূল কংগ্রেসের অনুগত ভোটার ও ভয়ংকর মেঠো বাহিনীতে পরিণত করে।’
কাজেই তৃণমূল সর্বতো প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এই’সার’বাবিশেষ নিবিড় সংশোধন আটকাতে। সব বিরোধী গোষ্ঠী এদের সমর্থন দিচ্ছে। দেশে অরাজকতা ও গৃহযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করতে এদের চেষ্টার কোনো খামতি নেই।