ভারত-আমেরিকা শুল্কযুদ্ধ
১৭৭৬ ও ১৯৪৭ সালে যথাক্রমে স্বাধীনতা লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি পরিণত গণতন্ত্র এবং ভারত হইল বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী পর্যায় হইতেই মিত্রশক্তি জোটের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি রূপে অভ্যুদয় ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির
জয় ঘোষণা মাত্রই বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি ও সামরিক শক্তি হইয়া ওঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৫ পরবর্তী পর্যায়ে পশ্চিমি বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রে
একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করে সমগ্র বিশ্ব। এই পর্বে রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ ফিরিয়া আসে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের রূপ পরিগ্রহ করিয়া। গ্যাট চুক্তি,
ডাঙ্কেল প্রস্তাবের দ্বারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব খর্ব হইয়াছে এই অভিযোগে বিশ্ব জুড়িয়া ব্যাপক আলোড়নও সৃষ্টি
হয়। এর পরবর্তী পর্যায়ে গঠিত হয় ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’। ইহার মধ্যে একটি বিষয় বিশেষ লক্ষণীয়। তাহার বিশ্বব্যাপী প্রভাব বজায় রাখিতে শুরু
হইতেই কয়েকটি বিশেষ নীতি গ্রহণ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাহাদের দেশীয় মুদ্রা হইল মার্কিন ডলার। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী, বিশ্বের সব
দেশের মধ্যে ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিনিময় মাধ্যম হইল মার্কিন ডলার। বিশেষত খনিজ তেলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ বা জ্বালানির ক্ষেত্রে মার্কিন
ডলারে আমদানি-রপ্তানি বাধ্যতামূলক। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সূচিত হইতেছে বিশ্বব্যবস্থা পরিবর্তন। মার্কিন আধিপত্যের বিপ্রতীপে পারস্পরিক
সহযোগিতা এবং জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিতেছে অধুনা বিশ্ব। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্রমশ গুরুত্বহীন হইয়া
পড়িতেছে মার্কিন ডলার। অর্থনীতির পরিভাষায় বর্তমান বিশ্বে ‘ডি-ডলারাইজেশন’-এর প্রক্রিয়া চলিতেছে। স্বাভাবিক নিয়মেই ডলারের অবমূল্যায়ন
রুখিতে এবং অর্থনৈতিক একাধিপত্য ধরিয়া রাখিতে ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে প্রতিটি ক্ষেত্রে আর্থিক অবরোধমূলক
নানা ব্যবস্থা তাহারা গ্রহণ করিয়াছে। কখনও কোনো দেশের সুইফট্ কোড বাতিল করিয়াছে, কখনও বিভিন্ন দেশ বা বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের
স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদি ফ্রিজ করিয়াছে, কখনও কোনো দেশের উপর অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করিয়াছে,
কখনও কোনো দেশকে বিশ্বব্যাংক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডারের ঋণদানে বাধা সৃষ্টি করিয়াছে, কখনও বা বিভিন্ন দেশ হইতে পণ্য-পরিষেবা আমদানির
ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত শুল্ক বা টারিফ আরোপ-পূর্বক সেই দেশগুলির অর্থনীতিতে সরাসরি আঘাত হানিবার প্রয়াস করিতেছে।
২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সূত্রপাত হইলে রাশিয়া হইতে খনিজ তেল আমদানিতে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা রাষ্ট্রসঙ্ঘ কর্তৃক জারি নয় বলিয়া রাশিয়া হইতে খনিজ তেল আমদানি অব্যাহত রাখে ভারত। ইহার পরিণামস্বরূপ, সম্প্রতি বিভিন্ন
ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা করেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। মনে রাখা প্রয়োজন যে, নিতান্তই কিছু সংখ্যা
কিংবা কাস্টমস্ ডিউটি বাবদ কিছু অতিরিক্ত ডলার প্রদান অথবা পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অর্থপ্রদানের হিসাব বা রসিদের বিষয় নহে এই শুল্ক। বৃহৎ
আমদানিকারী শক্তির দ্বারা প্রণীত এহেন শুল্কনীতি বা বিভিন্ন পণ্য ও পরিষেবার উপর আরোপিত এই মাত্রাতিরিক্ত শুল্ক বিশ্ব-অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক
ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রেক্ষিতে একটি অর্থনৈতিক ভূমিকম্পস্বরূপ। অর্থনীতির গণ্ডি অতিক্রম পূর্বক ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিবিধ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়াছে
ট্রাম্প-প্রশাসন প্রণীত এই শুল্কনীতি। ইহার অভিঘাতে শুধু ভারত নহে, অন্যান্য অনেক দেশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি হইয়া উঠিয়াছে বাণিজ্যবিমুখ।
উল্লেখ্য, বিশ্ব জুড়িয়া যুদ্ধাস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ হইল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। স্পেন ও সুইটজারল্যান্ডের মতো দেশের উপরেও নির্ধারিত হইয়াছে অতিরিক্ত
মার্কিন শুল্ক। ইহার ফলে মার্কিন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে দুইটি দেশ। কানাডা ও ভারত আমেরিকা
হইতে যুদ্ধাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় স্থগিত রাখিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে। শুল্কনীতি পর্যালোচনার অভাবে সমস্যার মীমাংসা সূত্র অদ্যাবধি
অধরা। কূটনৈতিক স্তরে আলাপ-আলোচনার অভাবে সহযোগী ও মিত্র দেশগুলির সঙ্গেও আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্রমাবনতি ঘটিতেছে।
দেশগুলি বর্তমানে যুদ্ধাস্ত্র ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিকল্প শক্তির সন্ধানরত। আন্তর্জাতিক সমরাস্ত্র সরবরাহ ব্যবস্থা বর্তমানে তাহার গতিপথ পরিবর্তন করিতেছে।
ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে ভুক্তভোগী বহু দেশ আমেরিকার প্রতি বিরূপ হইয়া উঠিয়াছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও নিরাপত্তা- দুই ক্ষেত্রেই ওয়াশিংটনের
নির্ভরযোগ্যতা প্রায় শূন্যে আসিয়া ঠেকিয়াছে। পক্ষান্তরে ‘মার্কিন শুল্কনীতি’ সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই প্রতিযোগীদের প্রতি বড়ো উপহারস্বরূপ
হইতে চলিয়াছে।