অরণ্যষষ্ঠীই পরিবর্তিত হয়েছে জামাইষষ্ঠীতে
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
জ্যৈষ্ঠমাসের শুক্লা ষষ্ঠীর দিনটিতে পালিত হয় আরণ্যক জীবনাভিজ্ঞতার এক অপরূপ কৃত্য ‘অরণ্যষষ্ঠী’। দিনটি জামাইষষ্ঠী, বাঁটাষষ্ঠী বা স্কন্দষষ্ঠী নামেও অভিহিত। অরণ্যের সঙ্গে এই দিনটি সম্পৃক্ত, সম্ভবত অরণ্যকেন্দ্রিক সভ্যতার সঙ্গে মানুষের হারানো যোগসূত্রের সাক্ষ্য-বহনকারী একটি পার্বণ। যখন অরণ্য-মাতাই ছিলেন মানুষের বেঁচে থাকার যাবতীয় রসদদার। মানুষ যে যুগ থেকে খাদ্য-বস্ত্র- বাসস্থান ও ভেষজের জন্য নির্ভর করতো অরণ্যের উপর, সেই যুগের বন-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উৎসব অরণ্যষষ্ঠী। কৃষি সভ্যতার যুগেও ছিল কৃষি-বন (Agroforestry)-এর ধারণা, বহাল ছিল অরণ্যের উপর প্রতিনিয়ত নির্ভরশীলতা। তাই যুগের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অরণ্যষষ্ঠীর কৃত্য ক্রমে ক্রমে বদলে গেল। নানান যুগের পলিমাটি সরিয়ে যে মূল রূপটি খুঁজে নিতে হয়, তাহলো, সভ্যতার যতই অগ্রগতি
হোক না কেন, অরণ্য ও তার বনস্পতি, তার অপরিমেয় জৈববৈচিত্র্য আজও আমাদের পরম আশীর্বাদ, কৃষিমাতার সঙ্গে বনদেবী আমাদের সতত রক্ষাকর্তা। ফুলে-ফলে-পল্লবে অরণ্য ভরে থাকুক আমাদের নানান প্রয়োজনে; এ তারই কৃতজ্ঞতার উপাসনা, অরণ্য-প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের অমোচ্য-সংযোগের চিরকালীন ইতিহাস।
ষষ্ঠী সর্বদা সন্তানের মঙ্গলময়ী মাতা। কেবল আপন সন্তান নয়, আপনার কন্যার স্বামীও যে তার সন্তান, এই বোধটি প্রকটিত হয়েছে জামাইষষ্ঠী নামের মধ্যে দিয়ে। ভারতীয় নারী তার পুত্র-কন্যার সমগ্র পরিবারটিকে একসূত্রে গাঁথতে চান, তার প্রকাশ ঘটেছে জামাই আদরের প্রেক্ষাপটে। গ্রীষ্মের দিনে অধিকাংশ ভারতীয় ফল পেকে ওঠে গাছের শাখায় শাখায়। আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, কলা, বুনো খেজুর, ফলসা, আঁশফল, কুসুম, গাব, কেন্দু, কামরাঙ্গা পেকে ওঠেছে অজস্র। এই সুখের দিনে ছেলে-মেয়ের
ভরা সংসার দেখতে চান হিন্দু নারী, নাতি-নাতনিদের হই-হুল্লোড়, গাছে গাছে দাপাদাপি। এরপর তো শুরু হবে বর্ষা, নদীনালা জলে পূর্ণ হয়ে যাতায়াত সুখের হবেনা। তাছাড়া আমন মরশুমি চাষে ব্যস্ত হয়ে পড়বে সবাই। তাই ফলের মরশুমে তাদের সকলের নিমন্ত্রণ। দল বেঁধে কৃষি জমির উপান্তে জঙ্গল ঘেরা ফল বাগিচার মধ্যে কোনো এক প্রাচীন বৃক্ষের তলায় অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর পুণ্যক্ষেত্রে পূজারিণীদের সমবেত পদচারণা।
এদিন ব্রতচারিণী হিন্দু রমণী তালপাতার এক পাখা বা ব্যজন, সঙ্গে দেবীপূজার নানান উপকরণ নিয়ে বনে প্রবেশ করেন। সেখানে বৃক্ষতলে অধিষ্ঠিত বিন্ধ্যবাসিনী অরণ্যষষ্ঠী দেবীকে আন্তরিক ভক্তিশ্রদ্ধায় পূজা করেন, সমবেতভাবে দেবীর উপাখ্যান শোনেন, তারপর নানাবিধ মরশুমি ফলমূল পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে বিতরণ করে নিজেরাও গ্রহণ করেন। সন্তানসন্ততির পরম কল্যাণ কামনাই এই ব্রতের মূলকথা। বৃহত্তর অর্থে মনুষ্য সমাজ সবাই যে অরণ্যের সন্তান। কামনা এই- দেবী অরণ্য, তুমি যাবতীয় সম্পদ ভরিয়ে দিয়ে আমাদের ঐশ্বর্যশালী করে তোলো। অরণ্যের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে আমরা পরিপুষ্ট হই এবং সুসন্তান লাভ করি, তোমাকে দোহন করেই আমরা সন্তানেরা দীর্ঘায়ু হই, ধনেজনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক জনপদ। তাই অরণ্যষষ্ঠী অরণ্যের উপান্তে গড়ে ওঠা জানপদিক লোকসংস্কৃতির এক অমূল্য সাধনা। অরণ্যেই ছড়িয়ে পড়ত গৃহীত ফলের বীজের প্রাচুর্য; তারপরেই আসতো বর্ষার ধারা, বীজের সুপ্তি কেটে চারাগাছ বেড়ে উঠতো আপন মনেই। অরণ্যের মাঝে ফলাহারের এ এক দারুণ উৎসব, অরণ্যকেই বর্ধিষ্ণু করে তুলতো। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের জঙ্গলবন্ধু যুগলপ্রসাদকে দেখি জঙ্গলের মধ্যেই তিনি বনস্পতির চারা লাগান, জঙ্গলেই বনসৃজন করেন। এ যে তেলা মাথায় তেল দেওয়া নয়! জঙ্গল কেটে ক্রমাগত বসতি স্থাপন করে, চাষাবাদ করে আমরা বনের রুখাশুখা মাটিকে নগ্ন করে দিয়েছি। বাদাবন কেটে ঝড়-ঝঞ্ঝার অবারিত দ্বার খুলে দিয়েছি। অরণ্য যে কেবল কেটে নেবার জিনিস নয়, লুঠপাটের ক্ষেত্র নয়, তা ভারতীয় জীবনবোধ চিরকালই দেখিয়ে এসেছে। বিদেশি কলোনিয়াল ও অন্যান্য লুঠেরা শক্তিই ভারতবাসীকে অরণ্য লুঠপাট করতে শিখিয়েছে। অথচ প্রাচীন সাহিত্যে অরণ্যকে বলা হয়েছে ‘দেবতার কাব্য’।
ষষ্ঠী দেবীর রূপকল্পনা কেমন? দেবী মানবীর মতোই দ্বিভুজা। বাম কোলে একটি শিশু। দেবীর বাহন একটি কালো বেড়াল। বাহন কল্পনার মধ্যে ফার্টিলিটি-কান্ট বা প্রজনন-সংস্কৃতিকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। বেড়ালের বংশবিস্তার সম্পর্কে মানুষ সচেতন। এই দিন বেড়ালকে ভালোমন্দ খেতে দেবার মধ্যে জীবসেবার আদর্শকে ব্রতের আঙ্গিকে প্রোথিত করে দেওয়া হয়েছে। ব্রতের শ্রেণীবিভাগের দিক থেকে একে অধুনা শাস্ত্রীয় ব্রত বলা হলেও তার মধ্যে লৌকিক ধারাটিও লুকিয়ে আছে। এটি নারীব্রত; বিবাহিত মেয়েরা এই ব্রত পালন করলেও কুমারী মেয়েরা মায়ের সঙ্গে গিয়ে বিবাহের আগে থেকেই পরিচিতি লাভ করে। অরণ্যষষ্ঠীকে শাস্ত্রীয় ও অশাস্ত্রীয় উভয় অনুষ্ঠানের যুগলমূর্তি বলা যেতে পারে। শাস্ত্রীয় এ কারণেই- এই ব্রতের আঙ্গিকে বৈদিক অনুষ্ঠানের গভীরতা ও সজীবতা- আচমন, স্বস্তিবাচন, ‘সূর্যঃ সোমো’ মন্ত্রপাঠ, কর্মারম্ভ সংকল্প, ঘটস্থাপন, আসনশুদ্ধি, মাতৃকান্যাস, বিশেষার্ঘ্য স্থাপন, গণেশ ইত্যাদি দেবতার পূজা, অঙ্গন্যাস, করন্যাস, ষষ্ঠীর ধ্যান করে তাঁর পূজা। পূজান্তে ব্রাহ্মণকে দান-দক্ষিণা ইত্যাদি।
ভবিষ্যপুরাণে অরণ্যষ্ঠীর ধ্যান ও প্রণামমন্ত্র পাওয়া যায়।
ষষ্ঠীধ্যান:
ওঁ দ্বিভুজাং যুবতীং ষষ্ঠী বরাভয়যুতাং স্মরেৎ।
গৌরবর্ণাং মহাদেবীং নানালঙ্কার ভূষিতাম্।।
দিব্যবস্তুপরীধানাং বামক্রোড়ে সুপুত্রিকাম্।
প্রসন্ন-বদনাং নিত্যং জগদ্ধাত্রীং সুখপ্রদাম্।।
সর্বলক্ষণসম্পন্নাং পীনোন্নতপয়োধরাম্।
এবং ধ্যায়েৎ স্কন্দষষ্ঠীং সর্বদা বিন্ধ্যবাসিনীম্।।
দেবীর প্রণামন্ত্র:
জয় দেবি জগন্মাতর্জগদানন্দকারিণি।
প্রসীদ মম কল্যাণি নমস্তে ষষ্ঠী দেখতে।।
অরণ্যষষ্ঠীর ব্রতকথার মূল বিষয় হলো, মা এবং পরিবার যে মানুষের কাছে স্বর্গসুখের চাইতে অধিক কাম্য, তার প্রকাশ। জননীকে হতে হয় সংযমশীলা, নির্লোভা, ভক্তিপরায়ণা- তাও দেখানো হয়েছে ব্রতকথায়।
এক গৃহস্থ রমণী লোভের বশবর্তী হয়ে নিত্যদিন ভাঁড়ারের
নানান খাদ্যবস্তু চুরি করে খেত, প্রশ্ন উঠলে বিড়ালের নামে অপবাদ দিত এবং এইভাবে ভোজনলালসা মেটানোর পরে আত্মরক্ষা করতো। এদিকে বিড়াল দেবী যষ্ঠীর বাহন। তাই দেবীর কোপে পড়ে সেই রমণীর একাদিক্রমে ছয় পুত্র জন্মানোর অব্যবহিত পরেই মৃত্যুমুখে পতিত হলো। এই ছয় পুত্র ছিল প্রকৃতপক্ষে শাপভ্রষ্ট বিদ্যাধর। ক্রমান্বয়ে মৃত্যুর ঘটনায় শ্বশুরবাড়িতে এবং সমাজে সেই রমণীর প্রবল বদনাম হলো। তারা তাকে সন্তানভোজী রাক্ষসী ঠাওর করলো। বুঝি নিজের সন্তান নিজেই খেয়ে ফেলে বধূটি! আত্মগ্লানিতে ওই রমণী গৃহ পরিত্যাগ করে বনে চলে গেল। বনে অজান্তে দেবীর থানে এক বৃক্ষতলে আশ্রয় নিলো সে। এদিকে গৃহে তার শাশুড়ি-মা ষষ্ঠীর আরাধনায় রত হলেন। বনে জন্ম নিল বধূর সপ্তম সন্তান। জন্মাতেই পূর্বের বিদ্যাধর ভ্রাতারা নবজাতককে এসে ডাক দিল, শিশুটিকে স্বর্গের যাবতীয় সুখের হাতছানি দিয়ে ডাকলো তারা। নবজাতক তার মা-কে জড়িয়ে ধরে বললে, মা কিংবা বোনকে ছেড়ে যাওয়া মোটেই সমীচীন নয়, যতই স্বর্গের ভোগ ও সুখ ডাক দিক না কেন! নবজাতক সেই ডাকে সাড়া দিল না। মায়ের ঘুম ভাঙিয়ে ডাকলো সেই সন্তান। সন্তানকে কোলে জড়িয়ে মা কেঁদে ফেলল; দেবী ষষ্ঠীকে একমনে ডাকতেও লাগলো। করুণাময়ী দেবীর সেই থান, দেবী আবির্ভূতা হলেন অনতিবিলম্বে; বললেন, বিড়ালের নামে অপবাদ দেওয়ার অপরাধে তিনি তাঁর সকল সন্তানকে লুকিয়ে রেখেছেন, তার প্রতিটি সন্তানই দেবতুল্য। বধূ দেবীর চরণ প্রার্থনা করলে, তিনি এক মরা পচা বিড়ালের উপর দই ফেলে জিভ দিয়ে চেটে তা তুলে আনতে নির্দেশ দিলেন। বধূ সে নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলে দেবীর কৃপায় বিড়াল-সহ হারানো ছয়পুত্র ফিরে পেল। সবাহন দেবীকে পূজা করে, সে সপুত্র গৃহে ফিরে এল। গৃহস্থ পরিবারে খুশির ঢল নামলো।
অবহেলায় পড়ে রয়েছে পাণ্ডুরাজার ঢিবি
দিতি ভট্টাচার্য
ইতিহাসের চক্রপথ ধরেই সভ্যতা এবং বিভিন্ন রাজবংশের উত্থান-পতন। সেই চক্রপথের গতিবিধি একটা রহস্যময় জলছবির মতো। বাস্তবতার সঙ্গে মিশে যায় রূপকথার গল্প। কল্পনা ও বাস্তবের মিশ্রণ থেকে প্রকৃত ইতিহাসের খোঁজে নিজেদের শশব্যস্ত রাখেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। তাঁদের নিরলস প্রচেষ্টায় বহু অজানা ইতিহাস উন্মোচিত হয় জনসমক্ষে। তাতেও যেন কিছুটা রয়ে যায় অন্ধকারের ঘেরাটোপে। আবিষ্কৃত প্রত্নস্থল অনেক সময় নিরন্তর অবহেলায় হারিয়ে যায় কালের গর্ভে। ক্রমে ক্রমে তলিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে। এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী প্রত্নক্ষেত্র পাণ্ডুরাজার ঢিবি প্রণিধানযোগ্য।
পাণ্ডুরাজার ঢিবি পশ্চিমবঙ্গের অজয় নদের তীরে পূর্ব বর্ধমান জেলার আউশগ্রাম অঞ্চলের প্রথম তাজ-প্রতুযুগীয় প্রত্নস্থল। মধ্যপ্রস্তর যুগীয় প্রত্নস্থল বীরভনপুরের প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে এর অবস্থান। ভৌগোলিক মানচিত্রে ঢিবিটির অবস্থান ২৩.২৫ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৭.৩৯ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ। ঢিবির বিস্তার পূর্ব-পশ্চিমে দৈর্ঘ্য বরাবর দুশো মিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে প্রস্থ বরাবর একশো সত্তর মিটার। ঢিবিটির প্রধান অংশ রাস্তা থেকে পাঁচ মিটার উপরে।
১৯৫৪-৫৭ সালের মধ্যে এইস্থানে প্রত্নতত্ত্ববিদ জবাসী লাল কর্তৃক খননকার্য পরিচালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের পুরাতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে খনন চলে তার ফলে বঙ্গের প্রাক-ইতিহাসের তাম্র-প্রত্ন যুগীয় সাংস্কৃতিক পর্যায় জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়।
পাণ্ডু রাজার ঢিবি পশ্চিমবঙ্গের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি তাম্র-প্রস্তর নিদর্শনের স্থান। এখান থেকে এই যুগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন রকম রঙিন মাটির পাত্র উল্লেখযোগ্য।
পূর্ব ভারতের তাম্রযুগীয় সভ্যতার সঙ্গে মধ্য ভারত ও রাজস্থান অঞ্চলের অনুরূপ সভ্যতার মিল পাওয়া গিয়েছে। সে যুগের লোকজন সুপরিকল্পিত শহর নির্মাণ করতে পারত। তারা শহরের পথে ফুটপাথ রাখত। তাদের অর্থনীতির ভিত্তি ছিল কৃষি ও বাণিজ্য। পাণ্ডু রাজার ঢিবিকে একটি বাণিজ্য নগরীর ধ্বংসাবশেষ মনে করা হয়। এখানকার মানুষের সঙ্গে যে শুধু ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল তাই নয়, এরা ক্রিট ও ম্যাসিডোনিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখত। এরা ছিল মূলত সমুদ্রচারী বণিক সম্প্রদায়। পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য থেকে তাম্র-প্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির ক্রমবিবর্তনের ধারা এবং লোহা ব্যবহারকারী মানুষ কীভাবে তাদের স্থান দখল করল সে সম্পর্কে জানা যায়।
খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত নিদর্শন:
ঢিবিতে একটি স্বর্ণমুদ্রার ভগ্নাবশেষ পাওয়া যায়। এর এক পিঠে মাছের প্রতীক আঁকা। ঢিবিতে প্রাপ্ত পোড়া মাটির নিদর্শন,
চিত্রশোভিত মাটির পাত্র এবং মাতৃদেবীর প্রতিকৃতি পাওয়া গেছে। ঢিবিটির ওপরের দিকে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে আগুনে পোড়া ইটের তৈরি স্থাপত্যকীর্তির যে সন্ধান পাওয়া গেছে তা দেখে অনুমান করা হয় এটি বৌদ্ধ অথবা হিন্দু উপাসনালয়ের ধ্বংসাবশেষ। পাথর ও হাড় নির্মিত হাতিয়ার পাওয়া গেছে। দুটি বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া গেছে। তবে একটি মূর্তির দু’পাশের নিম্নাংশে দুটি মূর্তি দেখে মনে হয় এরা লক্ষ্মী ও সরস্বতী।
এখানে আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলির ওপর
নির্ভর করে গবেষকরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, খ্রিস্ট জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। অজয় নদের পাশে অবস্থিত এই জায়গা পশ্চিমবঙ্গের একটি গর্বের স্থান। কিন্তু সে ভাবে পরিচিত নয়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা এই এলাকায় খননকার্য চালিয়ে হদিশ পেয়েছিল চার হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার। তারপর থেকে আউশগ্রাম-২ ব্লকের পাণ্ডুরাজার ঢিবি ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ সংস্থা অধিগ্রহণ করে। কিন্তু ১৯৮৫ সালে শেষবারের মতো খননের পর থেকে ক্রমেই অবহেলায় পড়ে রয়েছে এই এলাকা। ইতিহাস খ্যাত পাণ্ডুরাজার ঢিবির কিছু পুরনো ঐতিহাসিক মূর্তিরও উধাও হয়ে গিয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, স্থানটির ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হোক এবং পর্যটকদের কাছে এই জায়গাটির গুরুত্ব তুলে ধরা হোক।
ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার বিশ্বদূত
পরমহংস যোগানন্দ
সুব্রত বাঁশ
একবিংশ শতকের শুরুতে যখন বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্যের প্রতিযোগিতা তীব্রতর হচ্ছিল, তখন এক ভারতীয় সাধক নীরবে রচনা করছিলেন এক ভিন্ন বিপ্লবের ইতিহাস-আধ্যাত্মিক বিপ্লব। তিনি হলেন পরমহংস যোগানন্দ (১৮৯৩-১৯৫২), যিনি পশ্চিমি বিশ্বে ভারতীয় যোগ, ধ্যান ও আত্ম-উন্নয়নের দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়।
১৯২০ সালে আমেরিকার বোস্টনে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব রিলিজিয়াস লিবারালস্-এ ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে পরমহংস যোগানন্দ প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণে যান। এই যাত্রা ছিল তাঁর আধ্যাত্মিক আন্দোলনের সূচনা। একই বছর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সেল্ফ- রিয়ালাইজেশন ফেলোশিপ (এসআরএফ) একটি আধ্যাত্মিক সংগঠন। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল যোগ, ধ্যান ও আত্মোপলব্ধির শিক্ষাকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তাঁর মতে, ‘মানব জীবনের মূল উদ্দেশ্য হলো ঈশ্বরের সঙ্গে পুনর্মিলন, যা ধ্যান ও ক্রিয়া যোগের মাধ্যমে সম্ভব।’ এই বার্তা শুধু ধর্মীয় পরিমণ্ডলে সীমবদ্ধ থাকেনি, বরং তা ছড়িয়ে পড়ে বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষিত পশ্চিমি সমাজে। ১৯২৫ সালে তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসে এসআরএফের আন্তর্জাতিক সদর দপ্তর স্থাপন করেন। এখান থেকেই তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষা ও দর্শনের বিস্তার ঘটান। তিনি হাজার হাজার মার্কিন শিক্ষার্থীকে ‘ক্রিয়া যোগ’ চর্চার মাধ্যমে আত্মোপলব্ধির পথ দেখান। সেসময় সংবাদপত্রে তাঁকে ‘দ্য ফার্স্ট যোগা মাস্টার অব ইন্ডিয়া টু মেক আমেরিকা হিজ পার্মানেন্ট হোম’ নামে অবিহিত করা হয়। তাঁর বক্তৃতা ও লেখনীতে দেখা যায় হিন্দু দর্শনের সারাংশ, খ্রিস্টীয় আদর্শ এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তির এক সম্মিলিত প্রবাহ। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের
মধ্যে এক মনস্তাত্ত্বিক সেতুবন্ধনের প্রয়াস করেন। পরমহংস যোগানন্দের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা নিঃসন্দেহে তাঁর আত্মজীবনী ‘অটোবায়োগ্রাফি অব এ যোগী’। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত এই বইটি আজও বিশ্বজুড়ে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানকারীদের অন্যতম অনুপ্রেরণা। গ্রন্থটি ৫০ টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং নিয়মিতভাবে বেস্ট সেলার তালিকায় স্থান পেয়েছে।
অ্যাপল কর্পোরেশনের সহ প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জোবস এই বইটিকে তাঁর জীবনের অন্যতম দিকনির্দেশক বলে মনে করতেন। এমনকী তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত প্রতিটি অতিথিকে এই বইটি উপহার দেওয়া হয়েছিল। যোগানন্দ বিশ্বাস করতেন, সকল ধর্মই এক বৃহৎ সত্যের বিভিন্ন রূপ প্রকাশ করে। এই বিশ্বাস থেকেই তিনি রচনা করেন ‘দ্য সেকেন্ড কামিং ক্রাইস্ট’, যেখানে তিনি যিশুখ্রিস্টের শিক্ষাকে ব্যাখ্যা করেন যোগের আলোকে। এতে তিনি প্রমাণ করেন, খ্রিস্টান ও হিন্দু দর্শনের মধ্যে মৌলিক সংযোগ বিদ্যমান। এই ব্যাখ্যা ধর্মীয় সহনশীলতা ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। পশ্চিমি বিশ্বে একসময় যেভাবে সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করা হয়েছে, ঠিক তার বিপরীতে
পরমহংস যোগানন্দ স্থাপন করেন এক আধ্যাত্মিক মিলনের দর্শন। তবে এটি ছিল অহিংস, আত্মিক ও মানবিক। যেখানে আধিপত্য নয় বরং আত্মিক মুক্তি ছিল মূল লক্ষ্য। যোগানন্দ বলেন, ‘আমরা বিশ্বজয় করতে চাই না অস্ত্র দিয়ে, চাই না অর্থ দিয়ে; আমরা বিশ্বজয় করতে চাই ঈশ্বরের প্রেম ও আত্মজ্ঞানের আলো দিয়ে।’ ১৯৫২ সালে তাঁর শারীরিক প্রস্থানের পরেও এসআরএফ এবং ভারতের যোগাদা সৎসঙ্গ সোসাইটি (ওয়াইএসএস) যোগানন্দের শিক্ষা বিস্তারে নিয়োজিত রয়েছে। এসআরএফের সদর দপ্তর এখনো লস অ্যাঞ্জেলেসেই অবস্থিত এবং বিশ্বের ৬০ টিরও বেশি দেশে তাদের আধ্যাত্মিক কেন্দ্র রয়েছে। যোগানন্দের ‘হাউ টু লাইভ’ সিরিজের ৭ টি গ্রন্থ আজও মানুষকে ব্যক্তিগত সমস্যা, দুশ্চিন্তা, একাকিত্ব এবং জীবনের লক্ষ্যহীনতা থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে। বর্তমানেও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে যোগানন্দের দর্শন পড়ানো হয় ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন বিভাগের পাঠ্যক্রমে। তাঁর শিক্ষা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু পশ্চিমি যুবক ভারতীয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এবং ভারত ভ্রমণ করেছে সাধনার উদ্দেশ্যে। বর্তমান বিশ্ব যেখানে প্রযুক্তিগত উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছে, সেখানে মানুষ ক্রমশই মানসিক উদ্বেগ, একাকিত্ব ও আধ্যাত্মিক শূন্যতার শিকার। এই প্রেক্ষাপটে পরমহংস যোগানন্দের শিক্ষা আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিশ্বজুড়ে মাইন্ডফুলনেস, মেডিটেশন ও যোগ আজ যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, তার পেছনে পরমহংস যোগানন্দের দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টা ও নেতৃত্ব ছিল অন্যতম চালিকাশক্তি। আজ ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে আমরা যদি পরমহংস যোগানন্দের জীবনের দিকে ফিরে তাকাই, দেখি এক আশ্চর্য মানসিক শক্তির ইতিহাস। তিনি কেবল একজন সাধক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভারতীয় আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের বিশ্বদূত। তাঁর আধ্যাত্মিকতা ছিল যুক্তিনির্ভর, সার্বজনীন ও মানবকেন্দ্রিক। তিনি বিশ্বজুড়ে এমন এক আধ্যাত্মিক আন্দেলন শুরু করেছিলেন, যার শিকড় প্রোথিত ভারতে, কিন্তু ডালপালা বিস্তৃত সমগ্র মানবজাতির চেতনায়।