‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সরসঙ্ঘচালক পরম্পরা
একশো বছরে সঙ্ঘের মধ্যে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। সঙ্ঘকে যুগানুকূল রাখা হয়েছে। এটি জীবন্ত সংগঠনের প্রতীক। তাই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ একটি জীবন্ত সংগঠন। স্বয়ংসেবকদের কাছে এটি গর্বের বিষয়।
বিজয় কুমার
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ এক বিকাশশীল সংগঠন। কেবল শাখা বা বিবিধ কাজই নয়, প্রেরণাদায়ী অনেক পরম্পরাও আপনা থেকেই বিকশিত হয়ে চলেছে।
পরিবারভিত্তিক সংগঠন হওয়ার কারণে এখানে প্রতিটি কাজের জন্য সংবিধান দেখতে হয় না। যাঁরা সঙ্ঘের কার্যপ্রণালী জানেন, তাঁদের কাছে এটা অতি সাধারণ কথা। যদি আমরা সরসঙ্ঘচালক পরম্পরা দেখি তো আদ্য সরসঙ্ঘচালক প্রাতঃস্মরণীয় ডাক্তারজীকে তাঁর সহযোগীরা তাঁর অনুমতি না নিয়েই তাঁকে সরসঙ্ঘচালক ঘোষণা করেছিলেন। ডাক্তারজী তখন বলেছিলেন, ‘আপনাদের আদেশ মনে করে আমি এই দায়িত্ব গ্রহণ করছি। কিন্তু যখনই আমার থেকে
যোগ্য কাউকে পাবেন, তাঁকেই আপনারা এই দায়িত্ব অর্পণ করবেন। আমি একজন সাধারণ স্বয়ংসেবক হিসেবে কাজ করে যাব।’ যখন ডাক্তারজীর শরীর খুব খারাপ হয়ে গেল তখন তিনি তাঁর অপারেশনের আগেই সহযোগীদের সঙ্গে পরামর্শ করে সবার সামনে শ্রীগুরুজীকে বলেছিলেন ‘আমার পরে আপনাকে সঙ্ঘের কাজ সামলাতে হবে।’ এভাবেই সঙ্ঘের দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালকের ঘোষণা হয়েছিল।
যখন শ্রীগুরুজীর মনে হয়েছিল তাঁর শরীর আর বেশিদিন সাথ দেবে না তখন তিনিও তাঁর সহযোগী কার্যকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেন এবং একটি পত্রে পরবর্তী সরসঙ্ঘচালক হিসেবে শ্রীবালাসাহেব দেওরসের নাম লিখে রাখেন। তাঁর প্রয়াণের পর সেই পত্র খোলা হয়েছিল। এতে জনমানসে ধারণা হয়েছিল যে,
সরসঙ্ঘচালকের দায়িত্ব আজীবনের এবং পর্ববর্তী সরসঙ্ঘচালকের ইচ্ছাতেই যে কাউকে এই পদে নিযুক্ত করা যেতে পারে। সঙ্ঘ বিরোধীরা এজন্যই সঙ্ঘকে গুপ্ত সংগঠন বলত এবং তারা এটাকে অগণতান্ত্রিকও মনে করত।
তৃতীয় সরসঙ্ঘচালক বালাসাহেব দেওরস তাঁর জীবদ্দশাই পরবর্তী সরসঙ্ঘচালক ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর শরীর ভীষণভাবে খারাপ হয়ে যাওয়ায়
অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভায় অধ্যাপক রাজেন্দ্র সিংহ (রজ্জু ভাইয়া)-কে তাঁর পরবর্তী সরসঙ্ঘচালক ঘোষণা করেছেন। রজ্জু ভাইয়া ও সুদর্শনজীও এমনটাই করেছেন।
এভাবেই সঙ্ঘে এক নতুন পরম্পরা বিকশিত হয়ছে। এই ঘটাক্রমকে আর একভাবে দেখা যেতে পারে। যখন বালাসাহেব দেওরস দায়িত্ব থেকে মুক্ত হন,
তখন তাঁর শরীর খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাঁকে হুইল চেয়ারেই চলাফেরা করতে হতো। মুখ সবসময় লালায় ভরে যেত। সমস্ত কাজকর্ম অন্য কারও সহযোগিতায় করতে হতো। কথাও ঠিকমতো বলতে পারতেন না। বৈঠকে বা কার্যক্রমে তাঁর লিখিত বার্তাই পড়ে শোনানো হতো। সেজন্য তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি সকলেই সহজভাবেই মেনে নিয়েছিল।
অন্যদিকে রজ্জু ভাইয়া যখন দায়িত্বমুক্ত হন, তখন তিনি সম্পূর্ণভাবে সুস্থ ছিলেন না কিন্তু ঘোরাঘুরি করতে পারতেন। ভাষণ দিতে তাঁর অসুবিধা হতো কিন্তু স্বয়ংসেবকদের সঙ্গে সহজভাবে কথা বলতে পারতেন। দায়িত্বমুক্ত হয়েও তিনি সারা দেশে ঘোরাঘুরি করেছেন। অর্থাৎ তিনি যদি চাইতেন তাহলে আরও কিছুদিন এই দায়িত্ব পালন করতে পারতেন। কিন্তু যোগ্য ব্যক্তি পেয়ে গিয়ে তার ওপর দায়িত্বভার অর্পণ করেছেন।
পঞ্চম সরসঙ্ঘচালক শ্রীকুগ্গহল্লী সীতারামাইয়া সুদর্শন দায়িত্বমুক্তি পর্যন্ত যথেষ্ট সুস্থ ছিলেন। সারা দেশে ঘোরাঘুরি করতে এবং ভাষণ দিতেও তাঁর কোনা
অসুবিধা হতো না। কিন্তু যখন তাঁর মনে হলো যে মোহনরাও ভাগবতের মতো একজন সুযোগ্য ও প্রাণবন্ত কার্যকর্তা সামনে এসে গেছেন, তখন তাঁর হাতে দায়িত্ব অর্পণ করাটাই উচিত মনে করলেন। অর্থাৎ তিনি সেটাই করলেন যা প্রাতঃস্মরণীয় ডাঃ হেডগেওয়ার সরসঙ্ঘচালক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করার সময় করেছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, এই সঙ্ঘের জন্মদাতা তথা প্রতিষ্ঠাতা আমি নই, আপনারা সবাই। আপনাদের দ্বারা সৃষ্ট সঙ্ঘের, আপনাদের ইচ্ছায় ও আদেশে আমি ধাত্রীর কাজ করছি। যতদিন আপনাদের ইচ্ছা ও আদেশ হবে, ততদিন আমি সঙ্ঘের দায়িত্ব পালন করে যাব। এই কাজ করার সময় যতই সংকট আসুক, মান-অপমান সহ্য করার প্রসঙ্গ আসুক, আমি কখনো পিছু হঠবো না।
আমার যোগ্যতা না থাকার সত্বেও সকলের ক্ষতি হতে দেব না। আমার মনে হলো যোগ্য কার্যকর্তাকে এই পদের জন্য খুঁজে নেব। আপনাদের আদেশে যত আনন্দের সঙ্গে এই দায়িত্ব আমি স্বীকার করেছি, ততটাই আনন্দের সঙ্গে আপনাদের দ্বারা নিযুক্ত কার্যকর্তার হাতে দায়িত্বভার অর্পণ করে যাব। স্বয়ং সেবক হিসেবে তাঁর আজ্ঞাবহ রূপে কাজ করে যাবো। আমি যেনো মনে বলিষ্ঠ, যখন আমার থেকে যোগ্যতা কারো বেশী সামনে আসবেন তখন আপনারা তাঁকেই সরসঞ্চালকের দায়িত্বভার অর্পণ করবেন।’
পুরনো ভিও, নতুন নির্মাণ আরও একটাবাড়ী তৈরী করে যাতে পারে। প্রাতঃস্মরণীয় ডাক্তারজীও অন্তিম সংস্কার রেশিমবাগ সম্মন্বয়ে হয়েছে। সেখানে তাঁর স্মৃতি মন্দির রয়েছে। তাঁর বাহ্যিক রূপ মন্দিরের মতো কিছু সেখানে পৌঁছানো, ঘণ্টা, তোরণাগো, আরতি, প্রসাদ ইত্যাদি কিছুই নেই। স্মৃতি মন্দিরে ডাক্তারজীর সুন্দর প্রতিমূর্তি রয়েছে, তাঁর তিনটিকেই খোলা। অর্থাৎ, সঙ্ঘ ব্যক্তির গুরুত্ব রয়েছে কিন্তু ব্যক্তিপূজার নয়।
দ্বিতীয় সরসঞ্চালক শ্রীগুরুজী তাঁর প্রয়াণের আগেই তিনটি পত্র লিখে গিয়েছেন। প্রথমে পত্রে লিখেছেন তাঁর পরবর্তী সরসঞ্চালকের নাম, দ্বিতীয় পত্রে লিখেছেন, প্রাতঃস্মরণীয় ডাক্তারজীর মতো তাঁর যেনো কোনো স্মারক নির্মাণ করা না হয়। সেখানে স্মৃতি মন্দিরের সামনে যেখানে তাঁর দাহক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে, সেখানে যজ্ঞভোগীর মতো ছোট একটি ‘যুক্তিচিত্র’ বানানো হয়েছে। তাঁর ওপরে সব তুকাব্রামের একটি অভঙ্গের সেই পংক্তি উৎকীর্ণ রয়েছে যা শ্রীগুরুজী তাঁর পত্নীর সঙ্গে স্বয়ংসেবকের উদ্দেশ্যে ক্ষমাভিক্ষা করতেন।
তৃতীয় সরসঞ্চালক বালাসাহেব দেওরস আরও একধাপ এগিয়ে গিয়েছেন। তিনি আগেই বলে রেখেছিলেন, ‘রেশিমবাগ সঙ্ঘস্থানে আমরা যেনো সরসঞ্চালকের স্মরণে পরিচিত না করি। এজন্য আমার দরকার সর্বসাধারণের জন্য যেখানে, সেখানেই যেনো করা হয়।’ তাঁর দেহাবসান পুরতো হয় কিন্তু তিনি নাগপুরে বেশী দায়িত্ব পালন করেছেন, সেখানেই তাঁর বহু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন রয়েছেন, তাই তাঁর মরদেহ নাগপুরে এনে সর্বসাধারণের শ্মশান পঞ্চবাটি ঘাটে দাহকার্য করা হয়।
চতুর্থ সরসঞ্চালক রাজু ভাইয়ের দেহাবসান পুণেতে হয়। একবার তিনি বলেছিলেন, যেখানেই তাঁর দেহাবসান হবে সেখানেই যেন তাঁর মরদেহর অন্তিম সংস্কার করা হয়। তাই ই হয়েছে।
এক্ষণ পরিস্থিতি যে, সমস্ত সরসঞ্চালককে নিজেদের বিশিষ্ট থেকে সাধারণ পর্যন্ত নামিয়ে এনেছেন। এক সময় সঙ্ঘের ওপর মারাত্মক সংগঠন, ব্রাহ্মণবাদী, চিপব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণবাদী ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত করা হতো। কিন্তু যখন উত্তরপ্রদেশের রজ্জু ভাইয়া এবং কর্ণাটকের সূর্যনারায়ণ জীর ওপর সরসঞ্চালকের দায়িত্বভার আসে, তখন সব বিরোধীদের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। যারা সমাজে পুরাতনপন্থী, পরপম্পরাবাদী, কট্টরপন্থী ইত্যাদি অভিযোগ তুলিত করেন, তাঁদের সরসঞ্চালক পরম্পরা বিরোধী অবস্থান করা প্রয়োজন।
একশো বছরে সঙ্ঘের মধ্যে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। সঙ্ঘকে যুগানুকূল রাখা হয়েছে। এটি জীবন্ত সংগঠনের প্রতীক। তাই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ একটি জীবন্ত সংগঠন। স্বয়ংসেবকদের কাছে এটি গর্বের বিষয়।

















