হিন্দুত্বের মূল্যবোধে অক্ষয় তৃতীয়া উদ্যাপন
প্রদীপ মারিক
সংস্কৃত ভাষায় অক্ষয় শব্দের অর্থ হলো অবিনশ্বর, যার ক্ষয় নেই। অক্ষয় মানে সমৃদ্ধি, প্রত্যাশা, আনন্দ, সাফল্য। বৈদিক বিশ্বাসানুসারে, এই পবিত্র তিথিতে কোনো শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে। হিন্দুধর্মে অক্ষয় তৃতীয়ার গুরুত্ব অসীম। হিন্দু পঞ্চাঙ্গের সৌন্দর্য অর্থাৎ হিন্দু ক্যালেন্ডার গ্রহের অবস্থান দ্বারা চালিত হয় তার প্রতিটি হিন্দু পঞ্চাঙ্গ মাসকে পক্ষ বা ১৫ দিনে ভাগ করা হয় যা শুক্লপক্ষ নামে পরিচিত। তা অমাবস্যা বা অমাবস্যার দিন থেকে শুরু হয় এবং কৃষ্ণপক্ষ অর্থাৎ পূর্ণিমা বা পূর্ণিমার দিন পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। অক্ষয় তৃতীয়া বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয় চান্দ্র দিনে পড়ে যা সাধারণ ইংরেজি ক্যালেন্ডারের এপ্রিল-মে মাসে পড়ে।
সংস্কৃতে বৈশাখ মানে মন্থন করা লাঠি। এটি সারমর্ম, পদার্থ, সবচেয়ে শুভ বা শুদ্ধতম মন্থন করার মাস।
কেদার-বস্ত্রী-গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রীর যে মন্দির ছ’ মাস বন্ধ থাকে এই দিনেই তার দ্বার পুনরায় উদ্ঘাটন হয়। দ্বার খুললেই দেখা
যায় সেই অক্ষয়দীপ যা ছ’মাস আগে জ্বালিয়ে আসা হয়েছিল প্রজ্বলিত রয়েছে।
ভাগবত পুরাণ অনুসারে ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপর যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
সুদামা ছিল তার প্রাণের বন্ধু। গুরুগৃহে
থাকার সময় সুদামা একদিন লোভবশত
কৃষ্ণের সব খাবার খেয়ে ফেলেছিলেন, কৃষ্ণ খাবার খেতে চাইলে তিনি বলেন সব ছোলা পড়ে গেছে। সুদামা মিথ্যা কথা বলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে বলেন, সুদামা তুমি মিথ্যা কথা বললে। পরে সুদামা মস্ত বড়ো পণ্ডিত হন, তিনি টোল খোলেন। শ্রীকৃষ্ণ চলে আসেন দ্বারকায়। সুদামা সব সময় কৃষ্ণনাম করতেন। সুদামার সংসারে নেমে আসে দুর্যোগ। অভাব অনটনে দিন কাটাতে থাকে। খুব অনটনে দিন কাটালেও কখনো শ্রীকৃষ্ণকে দুঃখ মোচনের কোনো কথা বলেননি, অথচ তার মন জ্ঞান ছিল শ্রীকৃষ্ণে। সুদামার স্ত্রী সুশীলা একদিন সুদামাকে বলেন, তুমি এত কৃষ্ণ কৃষ্ণ করো তা একবার তাঁকে দেখে আসতে পারো না। সুদাম বলেন, কৃষ্ণ এখন দ্বারকার রাজা, আমাকে কি চিনতে পারবেন? – নিশ্চই
চিনতে পারবে। তোমাকে কত ভালোবাসে। স্ত্রী সন্তানদের কাতর অনুরোধে বাধ্য হয়ে যখন সুদামা দ্বারকায় পৌঁছান। নিয়ে যান চার মুঠো চিড়ে, যা সুশীলা ভিক্ষে করে এনে একটা কাপড়ে জড়িয়ে সুদামাকে দিয়ে দেন। দ্বারকাধীশ শ্রীকৃষ্ণকে সেই চিড়ে দিলে পাছে কিছু মনে করতে পারেন, তাই সুদামা ধুতির কোঁচড়ে লুকিয়ে রাখেন সেই চিড়ে।
বন্ধু সুদামার কাছ থেকে ভগবান জোর করে নিয়ে সেই চিড়ে খান এবং বলেন কলি যুগের সব বৈষ্ণবদের সব থেকে প্রিয় প্রসাদ হবে চিড়ে মাখা ভোগ। সুদামার বিশ্রামের সময় ভগবান দেখলেন তার পায়ের নীচে অজস্র কাঁটা ফুটে আছে, পরম প্রিয় সখা সুদামার পদযুগল স্বয়ং দ্বারকাধীশ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চোখের জলে ধুইয়ে দিলেন। ভক্তের পায়ের কাঁটা পরম যত্নে তুলে দিলেন। এ যে ভক্ত আর ভগবানের পরম মিলন। তাঁকে খাওয়ানোর জন্য বন্ধু সুদামার আনা চিড়ে মুগ্ধ করেছিল শ্রীকৃষ্ণকে। এরপর শ্রীকৃষ্ণের আশীর্বাদে সুদামার সমস্ত দারিদ্র্য ঘুচে যায়। মনে করা হয় যেদিন এই ঘটনা ঘটেছিল, সেদিন ছিল বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি- অক্ষয় তৃতীয়া।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীকে অক্ষয়পাত্র দিয়েছিলেন। যখন পাণ্ডবরা বনবাস পর্ব শুরু করেছিলেন, যাতে তাদের সর্বদা প্রচুর পরিমাণে খাবার থাকে। এই অক্ষয় পাত্রের খাবার কখনো ফুরোয় না। এই পাত্র থেকে গরিব মানুষদের খাবার বিতরণ করতেন যুধিষ্ঠির।
প্রথম যুগ হলো সিদ্ধ নৈতিকতার
সত্যযুগ এবং দ্বিতীয়টি ত্রেতাযুগ। ত্রেতা যুগের সময়কাল ১২,৯৬,০০০ বছর। এই যুগের পালনকর্তা ভগবান বিষ্ণুর তিন অবতার- বামন, পরশুরাম ও শ্রীরামচন্দ্র। অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেই রাজা ভগীরথ গঙ্গাদেবীকে মর্ত্যে নিয়ে এসেছিলেন। এদিনই কুবেরের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাকে অতুল ঐশ্বর্য প্রদান করেন। কুবেরের এই দিন লক্ষ্মী লাভ হয়েছিল বলে এই দিন বৈভব-লক্ষ্মীর পূজা হয়। কৌরবদের কাছে পাশা খেলায় হেরে পাণ্ডবরা বারো বছরের জন্য বনবাস এবং এক বছরের জন্য অজ্ঞাতবাসে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁদের বনবাসে থাকার সময়ে কৌরবদের চক্রান্তে দুর্বাসা মুনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে এক রাতে পাণ্ডবদের আশ্রয় গ্রহণ করতে যান। কিন্তু সেই সময় তাঁদের ঘরে কোনো অন্ন ছিল না। ক্ষুধার্ত দুর্বাসা অভিশাপ দেবেন ভেবে ভয় পান পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী। ঠিক সেই সময়ে শ্রীকৃষ্ণ এসে হাঁড়ির তলায় লেগে থাকা একটমাত্র চালের দানা খেয়ে নেন। আর তাতেই পেট ভরে যায় দুর্বাসা ও তাঁর শিষ্যদের। দুর্বাসার অভিশাপ থেকে পাণ্ডবদের রক্ষা করেছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে। তাই এই দিনকে অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়।
পুরাণ থেকে জানা যায় অক্ষয় তৃতীয়ার দিনেই পরশুরাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি অত্যাচারী ক্ষত্রিয়দের বিনাশের জন্য একটি পরশু অর্থাৎ কুঠার ব্যবহার করেছিলেন বলে তাঁর নাম পরশুরাম হয়েছিল। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এই দিন নদীতে স্নান করে সূর্যদান, জপ, হোম এবং ধর্মগ্রন্থ
পাঠ করেন। বেদব্যাস ও গণেশ এই দিনে মহাভারত রচনা আরম্ভ করেন। এই তিথি হতেই পুরীধামে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষ্যে রথ নির্মাণ শুরু হয়। অক্ষয় তৃতীয়ার দিন হিন্দুরা সর্বসুখের অধিকারী হতে এবং মৃত্যুর পর বৈকুণ্ঠবাসের সৌভাগ্যলাভ করতে এই ব্রত পালন করেন। অক্ষয় তৃতীয়ায় হিন্দু শাস্ত্রীয় ব্রত পালনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ অর্থাৎ নতুন কাপড়, কলসী, যব, ভুজ্জি, তালপাতার পাখা ও গামছা সংগ্রহ করতে হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রথমে যব দিয়ে লক্ষ্মী-নারায়ণ পূজা করতে হয়। তারপর ভুজ্জি, জলভরা কলসী, তালপাতার পাখা, গামছা বা নতুন কাপড় ব্রাহ্মণকে দান করতে হয়। এই দিনে যে কোনো অলংকার কেনা খুবই শুভ বলে মনে করা হয়।
দেবী লক্ষ্মীর আশীর্বাদ স্বরূপ স্বর্ণ ও রৌপ্যকে বোঝায় এবং বলা হয় যে কেউ যদি এই দিনে সোনা ও রুপা বিনিয়োগ করে তবে দেবী লক্ষ্মী সমৃদ্ধি ও সম্পদের আশীর্বাদ করবেন। এই দিনে শুরু হওয়া যে কোনো ব্যবসার উন্নতি হতে বাধ্য। অক্ষয় তৃতীয়ায় গৃহপ্রবেশ করতে কোনো মুহূর্তের প্রয়োজন নেই। এই দিনে অন্নদান দাতাদের জন্য অনেক শুভমুহূর্ত নিয়ে আসে। গোরুকে খাবার দিলে তার কোনো একটি পাপ ও দোষ দূর হয়। অক্ষয় তৃতীয়ায় উপবাস, সাধনা, দান, জপ পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। দেবী লক্ষ্মী এবং ভগবান বিষ্ণুর উপাসনা এদিন সকলকে পরম ভগবানের আশীর্বাদ প্রদান করে থাকে। অক্ষয় তৃতীয়াকে মূলত হিন্দু বা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে পালনীয় এক পবিত্র দিন হিসেবে দেখা হলেও জৈন মতেও এই দিনটির বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। জৈন মতে, ২৪ জন তীর্থঙ্কর মানুষকে সত্যের পথ দেখিয়েছেন। তাঁদের দেখানো পথেই মানুষ জন্ম ও মৃত্যুর অতীত ‘তীর্থে’ পৌঁছতে সক্ষম। এই ২৪ তীর্থঙ্করের প্রথম হলেন ঋষভদেব এবং শেষ ব্যক্তি মহাবীর।
জৈনশাস্ত্র গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ঋষভদেব ছিলেন ইক্ষাকু বংশের রাজা। তাঁর রাজত্বে মানুষের কোনো দুঃখ ছিল না।
পৃথিবী সেই সময়ে ছিল অগণিত কল্পবৃক্ষে পূর্ণ। এই বৃক্ষের কাছে যা চাওয়া যায়, তাই লাভ করা যায়। কিন্তু কালের সঙ্গে সঙ্গে ওই সব কল্পতরুর গুণাবলী হ্রাস পেতে থাকে। মানুষও শারীরিক ও আধ্যাত্মিক সংকটে পড়তে শুরু করে। সেই অবস্থায় তাঁর প্রজাদের ক্লেশ নিবারণের জন্য ঋষভদেব ছ’টি বৃত্তি অবলম্বনের নির্দেশ দেন। এগুলি অবলম্বন করলে মানুষ জাগতিক ক্লেশ থেকে দূরে থাকবে বলে তিনি বর্ণনা করেন।
এগুলি হলো অসি অর্থাৎ রণজীবী, যাঁরা দুর্বলকে রক্ষা করবেন; মসী অর্থাৎ কলমজীবী অর্থাৎ কবি-দার্শনিক-চিন্তাবিদ; কৃষি অর্থাৎ যাঁরা খাদ্য উৎপাদন করবেন; বিদ্যা অর্থাৎ অন্যকে যাঁরা শিক্ষিত করে তুলবেন; বাণিজ্য অর্থাৎ ব্যবসা; এবং শিল্প অর্থাৎ শিল্পকর্ম। ঋষভদেব একবার দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় এক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হলেন। সেখানে নৃত্যগীত চলাকালে এক অপ্সরা মারা যায়। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর নৃত্যরতা অপ্সরার আকস্মিক মৃত্যু তাঁকে বিহ্বল করে তোলে। তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেন এবং ১৩ মাস নির্জলা উপবাসে থেকে সত্যানুসন্ধান করে জন্ম-মৃত্যুর অনিত্যতা এবং আত্মার অবিনশ্বরতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভকরেন। ১৩ মাস অতিক্রান্ত হলে তিনি তাঁর প্রপৌত্র রাজা শ্রেয়াংশের হাত থেকে অঞ্জলি ভরে ইক্ষুরস পান করে উপবাস ভঙ্গ করেন। সেই দিনটি ছিল অক্ষয় তৃতীয়া। সেই কারণে এই দিনটি জৈন সম্প্রদায়ের মানুষ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে থাকেন। এই দিন তাঁরা সন্ন্যাসীদের আহার্য দান করেন। জ্যোতিষশাস্ত্রে, অক্ষয় তৃতীয়াকে মহাকাশীয় বস্তুর সারিবদ্ধতার কারণে অত্যন্ত শুভ বলে মনে করা হয়। এটি বিশ্বাস করা হয় যে এই সময়ে সূর্য ও চন্দ্র উচ্চ অবস্থানে থাকে, ইতিবাচক শক্তি বাড়ায় এবং পুণ্যময় কাজের প্রভাবকে বাড়িয়ে তোলে। অক্ষয় তৃতীয়া মানেই সমৃদ্ধি, প্রাচুর্য এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উদ্যাপন, তার সঙ্গে এই তৃতীয়া আমাদের ধার্মিকতা, দানশীলতা ও কৃতজ্ঞতার চিরন্তন মূল্যবোধের কথা মনে করিয়ে দেয়।
সংস্কৃত আমাদের নিজের ঘরের সম্পদ
অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায়
ভাষা আমাদের চিন্তা, আমাদের ভাবনা, আমাদের অন্তর অথবা বাইরের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। এমনকী আমাদের অর্জিত জ্ঞান এবং সেই অর্জিত জ্ঞানকে প্রকাশের মাধ্যমও হলো ভাষা। ভাষা আছে বলেই মানুষ অন্যের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্সটিটিউট অব লিঙ্গুইস্টিকস
ইন্টারন্যাশানাল’-এর ভাষা গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ‘এথনোলগ’-এর মতে বর্তমানে পৃথিবীতে মোটামুটি ভাবে ৭১৬৮টি ভাষা আছে। কিছু ভাষা ধীরে ধীরে কালের প্রভাবে বিলুপ্ত হতে চললেও এর মধ্যে প্রায় ১১টি ভাষা এখনো সর্বাধিক প্রচলিত। যদিও ‘এথনোলগ’-এর হিসাব মতো ৩০৪৫টি ভাষা ইতিমধ্যে মৃতভাষার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
পৃথিবীর প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের মধ্যে বর্তমানে সর্বাধিক প্রচলিত ভাষাগুলিকে ক্রমানুসারে সাজালে দেখা যাবে-
১. ইংরেজি- প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ কথা বলে।
২. ম্যান্ডারিন (চাইনিজ)- প্রায় ১২৯ কোটি মানুষ কথা বলে।
৩. স্প্যানিশ- প্রায় ১১০ কোটি মানুষ কথা বলে।
৪. হিন্দি- প্রায় ৬১ কোটি মানুষ কথা বলে।
৫. ফ্রেঞ্চ- প্রায় ৩০ কোটির বেশি মানুষ কথা বলে।
৬. বাংলা- প্রায় ৩০ কোটি মানুষ কথা বলে।
৭. আরবি- প্রায় ২৮ কোটির বেশি মানুষ কথা বলে।
৮. পর্তুগিজ প্রায় ২৬ কোটি মানুষ কথা বলে।
৯. রুশ- প্রায় ১৫ থেকে ১৬ কোটি মানুষ কথা বলে।
১০. জাপানি প্রায় ১২ থেকে ১৩ কোটি মানুষ কথা বলে।
১১. উর্দু- প্রায় ৭ কোটি মানুষ কথা বলে।
এর মধ্যে ইংরেজি, চীনা, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, আরবি ও রুশ- এই ছটি ভাষাকে রাষ্ট্রসঙ্ঘ নিজেদের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে। হিন্দি বা বাংলা সংখ্যার হিসেবে এগুলির থেকে এগিয়ে থাকলেও
রাষ্ট্রসঙ্ঘের দাপ্তরিক ভাষা নয়। তদুপরি উপরিউক্ত ভাষাগুলির কোনোটিও বিশ্বের প্রাচীনতম ভাষা নয়।
বিশ্বের প্রাচীনতম ভাষা হলো সংস্কৃত। যার মূল্য আমরা দিতে পারিনি। সেই কারণে জাতিসঙ্ঘের কাছেও আপাতভাবে সংস্কৃত ব্রাত্য। কিন্তু ভেতর ভেতর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই ভাষা নিয়ে গোপন চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে রাশিয়া ও জার্মানি।
আমাদের জাতীয় অবক্ষয়ের শুরু সেদিন থেকেই যেদিন থেকে আমরা সংস্কৃতকে মৃতভাষা বলে অবহেলা করতে শিখেছি। এক বিশেষ উদ্দেশ্যে বহিরাগত লুঠেরা, বিদেশি উপনিবেশকারীরা এবং তাদের দালালরা আমাদের মনে তিলে তিলে যে এই ভাষা সম্বন্ধে বিরূপ ধারণা গড়ে দিয়েছে, তা আমরা ভুলে গেছি। সারা বিশ্ব ভয় করে সনাতনী হিন্দুর একতাকে। ভয় করে HINDU এই পাঁচটা বর্ণের একীকরণকে। তাই, যে ভাষা সারা ভারতবর্ষকে একসূত্রে বাঁধতে পারে, সেই সংস্কৃত ভাষাকে তারা কৌশলে ভারতবাসীর মন থেকে একরকম সরিয়ে দিয়েছে। বহিরাগত লুঠেরা ধ্বংস করেছে লাখে লাখে পুঁথি। পরে ঔপনিবেশিক আমলে এই ভাষার প্রাচীন পুঁথিগুলির অধিকাংশই বিদেশিরা নিয়ে গেছে নিজেদের দেশে এবং তাদের বিজ্ঞান, সাহিত্য, জীবনচর্যাকে উন্নত করে তুলেছে এই সব পুঁথিগুলির সাহায্যে।
সৈয়দ মুজতবা আলি বলেছিলেন- ‘সংস্কৃত ভাষা আত্মনির্ভরশীল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ।’ যে ভাষা বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ ভাষারই মাতৃস্বরূপা, যে ভাষা সনাতন ভারতবর্ষের আত্মা, যে ভাষার কাছে শুধু ভারতীয়রাই নয় প্রকারান্তরে সারা বিশ্বই ঋণী, সেই ভাষাকে জাতীয় ভাষা বা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা আমরা আজ পর্যন্ত দিতে পারিনি। আমরা মনে রাখিনি একমাত্র সংস্কৃতভাষাই রাষ্ট্রভাষা বা জাতীয় ভাষার স্বীকৃতি পেলে ভারতবর্ষের কোনো অঞ্চলের কোনো ভাষার মানুষই তার বিরোধিতা করবে না। ভারতবাসীর হৃদয়ে চিরকালই সংস্কৃতের ফল্গুধারা বয়ে চলেছে। কারণ, এই একটি ভাষাই ভারতের প্রতিটি ভাষার জননী স্বরূপ।
ভারতীয় উপমহাদেশ এমনকী তার বাইরেও যে সব ভাষা প্রচলিত, যেমন- চীনা, জাপানি, ইংরেজি, রুশ, পারসিক বা ফার্সি, ল্যাটিন, গ্রিক, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, উর্দু, আরবি ইত্যাদি প্রায় সব ভাষাই বহুভাবে ঋণী সংস্কৃত ভাষার কাছে। যদিও, চীনা অভিধানে আদ্যক্ষর ও শেষ অক্ষরের তালিকা তৃতীয় শতাব্দীতে তৈরি হয় তবুও ষষ্ঠ শতাব্দীতে লিয়াং বংশের আমলে তা আরও সুষ্ঠুভাবে গঠিত হয় ভারতীয়দের সাহায্যে। ভারতীয়রাই চীনা বর্ণমালার আদর্শ তৈরি করে চৈনিক ৩৬টি ব্যঞ্জনের আদ্যক্ষরই শুধু নয়, মুখের কোন স্থান থেকে ওইসব ধ্বনি নির্গত হবে তাও ঠিক করে দিয়েছিল। এর অর্থ সংস্কৃতভাষা কেবল চীনের সংস্কৃতি ও ধর্মের উপরেই নয়, চীনা বর্ণমালাকেও প্রভাবিত করেছে।
পারস্যের জরাথুষ্ট্র প্রবর্তিত উপাসনা বৈদিক ধর্মের দ্বারাই প্রভাবিত। অথর্ববেদের একাংশই হলো জেন্দ অবেস্থা। ম্যাক্স মুলার তাঁর ‘Lectures on the Sanskrit Language’- গ্রন্থে লিখেছেন, আমাদের উত্তর ভারত থেকেই জরাথুষ্ট্রিয়ানরা পারস্য বা ইরানে কলোনি স্থাপন করে। জেন্দ-অবেস্থাতেই আছে, প্রাচীন ভারতীয় আর্যদের একাংশ আফগানিস্থান, বেলুচিস্থানের পথে হিমালয় অতিক্রম করে পারস্যে গেছিলেন। শুধু তাই নয়, বেদ ও জেন্দ-অবেস্থার অনেক শব্দের অর্থ ও তার ধ্বনিগত মিলও একইরকম- যেমন:
বেদ জেন্দ-অবেস্থা অর্থ
অস্মৈ অৈ
ইহাদেরকে
কস্মৈ কলৈ৷
কোন
শুন স্পন
কুকুর
পারসিকরা ‘স’-উচ্চারণের বদলে ‘হ’ উচ্চারণ করতো তাই তাদের উচ্চারণে ‘সিন্ধু’ হয়েছে হিন্দু। ওরা ‘অসুর’কে-অহুর, ‘সপ্ত’-কে ‘হপ্ত’, ‘মাস’-কে ‘মাহ’, ‘সেনা’-কে ‘হেনা’, ‘মিত্র’-কে ‘মিথ’, ‘ঘর্ম’কে ‘গর্ম’ বলতো। সংস্কৃত ও পারসিকের যে বিস্তর মিল আছে তা উপরের উদাহরণগুলিতেই পরিস্ফুট।
উর্দু ভাষার শব্দ ভাণ্ডারের প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং ক্রিয়াপদগুলির প্রায় ৯৯ শতাংশ
এসেছে সংস্কৃত বা প্রাকৃত থেকে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে আরব উপদ্বীপের যাযাবর গোষ্ঠীর ভাষা আরবি। যে যাযাবর গোষ্ঠীকে মনে করা হয় প্রাচীন আর্যাবর্তের থেকে বেরিয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠী। সংস্কৃত আরবির থেকে বহু প্রাচীন। প্রাচীন সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে এর মিলও প্রচুর। আরবি শব্দটি এসেছে অর-ভি থেকে অর্থাৎ যারা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন বা চলে গেছে। আল্লাহ শব্দটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ‘আ’ অর্থে আধার বা ভিত্তি ইলা অর্থে বিশ্ব। অর্থাৎ বিশ্বের ভিত্তি। ‘সমীর’ শব্দটির মানে সংস্কৃত ও আরবিতে একই; অর্থাৎ বায়ু। রামাল্লাহ রাম (রমণীয়) আল্লাহ। আরবিতে যা সুরা, সংস্কৃতে তাই সূত্র। সুভানাল্লাহ শুভ আল্লাহ। ‘মোল্লা’ মূল আল্লাহ (যিনি আল্লার ‘মূল’ বা ‘সার’ কিতা জানেন)। হারাম শব্দটি হর রাম হলেও ঋণাত্মক অর্থ বহন করছে। রমজান শব্দটি রাম জান (দান)। রাম অর্থে এখানে দানশীল। আল্লার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও দানের দিন হলো রমজান। ‘আয়াতুল্লাহ’ শব্দটির অর্থ আল্লার প্রতিনিধি। সংস্কৃতে আয়াত্ন শব্দের অর্থ প্রতিনিধি। সন্ধি বিশ্লেষণ করলে দাঁড়ায় আয়ত্ব আল্লাহ আয়াতুল্লাহ।
অনেকে বলেন, রাশিয়া শব্দটি ঋষি শব্দের অপভ্রংশ। পৃথিবীর বর্তমান যে ভৌগোলিক মানচিত্র যে রূপ, যে ব্যবধান তা এক সময় ঠিক এই রকমটি ছিল না। রামায়ণ, মহাভারত, বিভিন্ন পুরাণ ও প্রাচীন গ্রন্থগুলি থেকে আমরা আনতে পারি যে ভারতবর্ষ ছিল ব্রহ্মাবর্ত বর্ষ, ভদ্রাশ্ববর্ষ, কিম্পুরুষবর্ষ (তিব্বত), যা ছিল হিমবর্ষ (হিমালয়-সহ হিমবন্ত প্রদেশ ও নিষধবর্ষের যুগ্মরূপ); চীনের নাম ছিল ইলাবৃত বর্ষ, কোরিয়া ছিল কুরুবর্ষ এবং বর্তমান রাশিয়া ছিল কেতুমাল বর্ষের খানিকটা সহ হিরন্ময়বর্ষ ও রম্যকবর্ষের সমষ্টি। শৈলেন্দ্র নারায়ণ ঘোষাল শাস্ত্রী তাঁর ‘বৈদিক ভারত’ গ্রন্থে শুধু এগুলি সমর্থন করেই থেমে যাননি তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন রুশ ও সংস্কৃত ভাষার সম্পর্ক অতি নিকট।
সংস্কৃত
রুশ
কদা (কখন)
কগদা
তদা (তখন)
তগদা
বিনা (ছাড়া)
বিনে
দ্বার (দরজা)
দ্বের
চত্বার (চার)
চত্যেরি
ভ্রাত (ভ্রাতা)
ব্রাত
একম (এক)
আদিন
আদি (আদি)
আদিন
দ্বি (দুই)
দ্বি
তি
প্যাচ
ত্রি (তিন)
পঞ্চ (পাঁচ)
‘বৈদিক সংস্কৃত’ ও ‘ল্যাটিন’, ভাষা জগতের দুই প্রাচীন সদস্য হলেও সংস্কৃত প্রাচীনতম একথা আজ প্রমাণিত সত্য। ল্যাটিন থেকেই এসেছে স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, পর্তুগিজ, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষা। এই ভাষাগুলি যেহেতু ল্যাটিনের অপভ্রংশ তাই এগুলিও সংস্কৃতের কাছে ঋণী। সংস্কৃত পিতা, ল্যাটিনে হয়েছে ‘প্যাটার’, স্প্যানিশে ‘পাদ্রে’, গ্রিকে প্যাটার ও ইংরেজিতে ‘ফাদার’। মাতা শব্দটি সংস্কৃতে মাতরঃ, ল্যাটিনে ‘মাতের’, স্প্যানিশে ‘মাদ্রে’, গ্রিকে ‘মাতের’, ইংরেজিতে ‘মাদার’। আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া যায় কেমনভাবে সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে ল্যাটিন ও ইংরেজি শব্দের মিল পাওয়া যায়:
সংস্কৃত
ল্যাটিন
ইংলিশ
অগ্নি
দান
ধাম
নাসা
ইগনিশ
ইগনিশন
দোনাম
ডোনেশন
ডোমুস
ডোমিসাইল
নাসাম
নোজ
নামা
নোমেন
নেম
বর্বর
বার্বারিয়া
বার্বারিয়ান
জন
জেনিয়া
জিন
দ্বার
দোরু
ডোর
কাল
ক্যালেন্ডা
ক্যালেন্ডার
অষ্ট
অক্টো
এইট
দন্ত ডেনটিস
ডেনটাল
পরিশেষে জানাই, জ্যোতির্মঠ বা যোশী মঠের পূর্বতন শঙ্করাচার্য জগদ্গুরু শ্রীশ্রী ব্রহ্মানন্দ সরস্বতী মহারাজ বলেছেন-
‘সংস্কৃত হী ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ কা বীজক হ্যায়। বীজক কী রক্ষা আবশ্যক হ্যায়, আপনে ঘর কী নিধি মে লাভ উঠাও।’
মহাপুরুষের এই আহ্বান, এই উপদেশ, আর কবে আমরা রক্ষা করব! আর কবে শোধ করব আমাদের ঋষি ঋণ?