• About
  • Contact Us
Sunday, October 19, 2025
Swastika
No Result
View All Result
  • হোম
  • সম্পাদকীয়
  • রাজ্যপাট
  • সুন্দর মৌলিকের চিঠি
  • অতিথি কলম
  • বিশ্বামিত্রের কলম
  • উত্তর সম্পাদকীয়
  • প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • পরম্পরা
  • সঙ্ঘবার্তা
  • বিশেষ নিবন্ধ
  • ই -পত্রিকা
  • হোম
  • সম্পাদকীয়
  • রাজ্যপাট
  • সুন্দর মৌলিকের চিঠি
  • অতিথি কলম
  • বিশ্বামিত্রের কলম
  • উত্তর সম্পাদকীয়
  • প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • পরম্পরা
  • সঙ্ঘবার্তা
  • বিশেষ নিবন্ধ
  • ই -পত্রিকা
No Result
View All Result
Morning News
No Result
View All Result
Home প্রচ্ছদ নিবন্ধ

28th April প্রচ্ছদ নিবন্ধ

in প্রচ্ছদ নিবন্ধ
28th April প্রচ্ছদ নিবন্ধ

Issue 77-34-28-04-2025

সমাজ পরিবর্তনে সঙ্ঘের বিবিধ সংগঠনের ভূমিকা
আনন্দ মোহন দাস
দীর্ঘদিন ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে একসময় ভারতে হিন্দুদের মনোবল একেবারে তলানিতে ঠেকে গিয়েছিল। বললে অত্যুক্তি হবে না, এই সময় হিন্দুরা নিজেদের গাধা বলতে প্রস্তুত থাকলেও নিজেদের হিন্দু বলতে লজ্জা পেত এবং কুণ্ঠাবোধ করতো। হিন্দু সমাজের আত্মবিশ্বাস একেবারে অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, কেবলমাত্র শবযাত্রা ছাড়া চারজন হিন্দু একমুখী হতে পারে না। সেক্ষেত্রে হিন্দু সংগঠনের চিন্তা বাতুলতা মাত্র। সেই কঠিন সময়ে ১৯২৫ সালে বিজয়া দশমীর দিন প্রাতঃস্মরণীয় ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার পরম বৈভবশালী রাষ্ট্র নির্মাণের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হিন্দু সমাজ গড়তে নাগপুরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি হিন্দু সংগঠনের যে বীজ রোপণ করেছিলেন, আজ তা মহীরুহে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের নাম সর্বজনবিদিত। সঙ্ঘ উপেক্ষা, উপহাস, বিরোধিতার পর্যায় পেরিয়ে এসে আজ বিশ্বের বৃহত্তম সামাজিক, সংস্কৃতভারতী সাংস্কৃতিক ও অরাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। যুবসমাজ ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষ ডাক্তার হেডগেওয়ারের আদর্শ ও দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে এগিয়ে আসছেন। সমস্ত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে সঙ্ঘ আজ শতবর্ষের পর্দার্পণ করেছে। যাঁদের পরিশ্রম ও ধ্যেয়নিষ্ঠায় সঙ্ঘ কাজের বৃদ্ধি, তাঁদের অবদানকে স্মরণ করার দিন। শতবর্ষে আত্ম চিন্তন ও সঙ্ঘ কাজে নিজেকে উৎসর্গ করে পরম বৈভবশালী রাষ্ট্র নির্মাণে ব্রতী হওয়ার সময়।
দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ডাক্তার হেডগেওয়ার জীবদ্দশাতেই সঙ্ঘকে সর্বভারতীয় রূপ দিতে পেরেছিলেন। তাঁর প্রয়াণের পর দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকার (শ্রীগুরুজী) সেই কাজকে সর্বব্যাপী ও সর্বস্পর্শী করার উদ্দেশ্যে বিবিধ ক্ষেত্রে অনেক সংগঠনের সূচনা করেছিলেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে হিন্দুত্বের আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে এক ঐক্যবদ্ধ হিন্দু সমাজ গঠনে ব্রত হয়েছিলেন। স্বয়ংসেবকদের মধ্যে শুধু হিন্দুত্ববোধ জাগ্রত হয়েছে। কিন্তু এই একাত্মতার ভাবটি এখন সম্পূর্ণ সমাজে ব্যাপ্ত করতে হবে। তাই সঙ্ঘ রূপী বটবৃক্ষের বহু শাখা প্রশাখা আজ প্রসারিত। বর্তমানে বিবিধ ক্ষেত্রে ৩৭টির বেশি সংগঠন সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। সঙ্ঘ একটি সামাজিক সংগঠনও বটে। পরম বৈভবশালী রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হলে সমাজের সর্বস্তরের মধ্যে সঙ্ঘের কাজকে পৌঁছাতে হবে। সেই উদ্দেশ্যে বিবিধ সংগঠন কাজ করে চলেছে। এই রকম কয়েকটি সংগঠনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।
এদিকে লক্ষ্য রেখে ১৯৫২ সালে একজন স্বয়ংসেবক সমাজের মধ্যে কাজ করার জন্য বনবাসী কল্যাণ আশ্রম নামে একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করেছেন। জনজাতি সমাজের পরম্পরা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বজায় রেখে তাদের কল্যাণে বনবাসী কল্যাণ আশ্রম কাজ করে চলেছে। জনজাতি সমাজকে ৩০ খ্রিস্টান মিশনারিদের কবল থেকে রক্ষা করতে এবং তাদের উন্নয়নে কল্যাণ আশ্রম বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করে চলেছে। বর্তমানে সারা দেশে ২২ হাজার ২০৩টি সেবাকেন্দ্র ও বহু ছাত্রাবাসের মাধ্যমে কল্যাণ আশ্রম জনজাতি এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেছে।
এছাড়াও সমাজে কেবলমাত্র সেবা কাজের উদ্দেশ্য নিয়ে রাষ্ট্রীয় সেবা ভারতী নামে স্বয়ংসেবকদের একটি সংগঠন সারা দেশে ১ লক্ষ ২৩ হাজারেরও বেশি সেবা প্রকল্প গড়ে তুলেছে। এর মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বনির্ভর প্রকল্প এবং সামাজিক সেবা প্রকল্প রয়েছে যা বেসরকারি ক্ষেত্রে সেবা কাজের জন্য যথেষ্ট প্রশংসার দাবি রাখে।
সামাজিক পরিবর্তনের জন্য শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো শিক্ষা। প্রচলিত মেকলে শিক্ষা পদ্ধতি দেশে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়নি। বরং আমাদের সনাতন শিক্ষা পদ্ধতির সর্বনাশ করেছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও সংস্কার যুক্ত ভারতীয় শিক্ষা পদ্ধতির বিকাশ ঘটেনি। ভারতীয় মূল্যবোধ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার কোনো প্রচলন নেই। বলাবাহুল্য বর্তমান প্রজন্ম লক্ষ্যহীন হয়েছে এবং নৈতিকতার অভাব দেখা দিয়েছে। সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা ভারতীয় সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে একটি উপযুক্ত শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষা ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটানোর কাজ করে চলেছে। এই উদ্দেশ্যে বিদ্যাভারতী নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সারা দেশে ২২০০০-এর বেশি বিদ্যালয়ের মাধ্যমে কাজ করে চলেছে। শিক্ষা, সংস্কার ও সেবার লক্ষ্য নিয়ে এই বিদ্যালয়গুলিকে আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য স্বয়ংসেবকরা সচেষ্ট হয়েছেন। এর মাধ্যমে সুসংস্কার যুক্ত নাগরিক গড়ে তোলাই কাজ। এমনকী জনজাতি অঞ্চলে যেসব শিক্ষা কেন্দ্র শুরু হয়েছে, সেখানকার বিদ্যার্থীরাও যাতে পরবর্তীকালে সুনাগরিক রূপে গণ্য হতে পারেন, সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে।
শ্রমিক ক্ষেত্রে বিদেশি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ কমিউনিস্ট শ্রমিক সংগঠনগুলি শ্রমিকদের ভুল পথে পরিচালিত করে রাষ্ট্রের পরিপন্থী কাজ করে চলেছে। সেজন্য সঙ্ঘ হিন্দু চিন্তাধারায় ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ নামে একটি রাষ্ট্রবাদী শ্রমিক সংগঠন গড়ে তুলেছে। বিএমএসের উদ্দেশ্য হলো শিল্পের শ্রমিকীকরণ, শ্রমিকের জাতীয়করণ এবং রাষ্ট্রের উদ্যোগীকরণ। আজকের দিনে বিএমএস সারা ভারতে সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিন্দুত্বের ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ কাজ করে চলেছে যা আজ সারা দেশের মধ্যে বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন। বিদ্যার্থী পরিষদ রাষ্ট্রবাদী চিন্তাধারায় ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সংগঠন গড়ে যুবসমাজকে সঠিক পথে দিশা দেখানোর কাজ করছে।
আর্থিক ক্ষেত্রে স্বদেশী জাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে দেশীয় পণ্য উৎপাদন, স্বদেশী বস্তু গ্রহণ, বিদেশি পণ্য বর্জন করে দেশীয় অর্থনীতিকে মজবুত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। বিদেশি কবল থেকে মুক্ত হয়ে আত্মনির্ভরশীল স্বদেশী অর্থনীতির জন্য সমাজের মধ্যে জাগরণের কাজ করছে এবং প্রয়োজনে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে সাধুসন্তদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ হিন্দু জাগরণের কাজ হাতে নিয়েছে। হিন্দু সমাজের বিভিন্ন বর্গকে একই ছত্রতলে ভেদভাবহীন সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ নির্মাণে ব্রতী হয়েছে। এছাড়াও ধর্মান্তকরণ রুখতে সমাজের বিভিন্ন বর্গের মধ্যে কাজ করে চলেছে। বিভিন্ন মত ও পথের সাধু সন্তরা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মাধ্যমে একত্রিত হয়ে ধর্মীয় ক্ষেত্রে হিন্দুদের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছেন। এই ভাবে বিবিধ সংগঠনগুলি ভারতীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সামাজিক পরিবর্তনের কাজে শামিল হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শতবর্ষের প্রেক্ষিতে সঙ্ঘ সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে নিম্নোক্ত পাঁচটি বিষয়ের উপর বিশেষ ভাবে জোর দিয়েছে যা আজকের দিনে সমাজে তার অত্যন্ত প্রয়োজন রয়েছে- (১) ভেদভাবহীন সমরসযুক্ত আচরণ, (২) পরিবেশবান্ধব জীবনশৈলী, মূল্যবোধ অধিষ্ঠিত পরিবার, (৩) ‘স্ব’ভাব যুক্ত আচরণ এবং (৪) নাগরিক কর্তব্যের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ সমাজ নির্মাণ।
১০০ বছরের যাত্রাপথ স্মরণ করে বিশ্বশান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য সমগ্র সমাজকে সঙ্গে নিয়ে স্বয়ংসেবকরা ভেদভাবহীন ঐক্যবদ্ধ হিন্দু সমাজ নির্মােেণর সংকল্প নিয়েছে। এই লক্ষ্যকে সফল করার জন্য বিবিধ সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের কাজে বিশেষ ভাবে মনোনিবেশ করেছে।


সুস্থ ভারত গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে আরোগ্য ভারতী
অঙ্কিতা সুর
‘আরোগ্যম্ মম স্বভাবঃ অধিকারঃ কর্তব্যং চ।’ অর্থাৎ ‘সুস্থ থাকা আমার স্বভাবগত অধিকার এবং কর্তব্যও’। সুস্বাস্থ্য মানে কেবল রোগমুক্ত থাকা নয়, বরং শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক দিক থেকেও সুস্থ থাকা। পাশ্চাত্য প্রভাব, আধুনিকতা ও নগরায়ণের ফলে মানুষের জীবনধারা ও দিনচর্যাতে আমূল পরিবর্তন এসেছে এবং তার ফলে মানুষের শরীরে ও মনে বহু রোগ বাসা বেঁধেছে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা, হৃদরোগ। এছাড়াও আরও বিভিন্ন সমস্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটি দেশ তথা সমাজের উন্নয়নের জন্য সমগ্র দেশবাসীর সুস্থ থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন। শুধু রোগ নিরাময় নয় বরং কীভাবে নিজেকে সুস্থ রাখা যায় সেই বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে আরোগ্য ভারতীর মতো সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
ভারতীয় জীবনমূল্যের ভিত্তিতে স্বাস্থ্যচর্চা, প্রতিরোধক ও উপকারী স্বাস্থ্যসেবা সমাজের প্রত্যন্ত প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া এবং প্রতিটি ব্যক্তি যেন সুস্থ থাকে- এই লক্ষ্য নিয়ে ২০০২ সালের ২ নভেম্বর, (১৩ কার্তিক, যুগাব্দ ৫১০৪) ধন্বন্তরি জয়ন্তীর শুভদিনে কেরালার কোচিতে ‘আরোগ্য ভারতী’র প্রতিষ্ঠা হয় এবং ১৯ জুলাই, ২০০৪ সালে ভোপালে ‘আরোগ্য ভারতী’ পাবলিক ট্রাস্ট’-এর নামে যথাযথভাবে নিবন্ধিত করা হয়। বিগত ২২ বছরে দেশের মোট ৪১টি প্রান্তে আরোগ্য ভারতীর সক্রিয় কার্যকলাপ চলছে। সম্পূর্ণ দেশের মোট ৮৭১টি সাংগঠনিক জেলাতে আরোগ্য ভারতীর সক্রিয় কার্যকর্তা রয়েছেন।
২০০৭ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক ডাঃ গোপাল করের হাত ধরেই আরোগ্য ভারতীর সূচনা হয় পশ্চিমবঙ্গে। তিনি পশ্চিমবঙ্গে আরোগ্য ভারতীর প্রথম সংযোজক হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি পেশায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হওয়ার কারণে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলি অত্যন্ত সহজভাবে সাধারণ মানুষকে বোঝাতে সক্ষম। তিনি বর্তমানে আরোগ্য ভারতীর পূর্বক্ষেত্র সমিতির অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। সমাজের বিভিন্ন বিশিষ্ট মানুষ নিজেদের আরোগ্য ভারতীর সঙ্গে যুক্ত করে সমাজ কল্যাণে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে এসেছেন।
হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক, ন্যাচারোপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি ইত্যাদি বিভিন্ন মতের চিকিৎসকরা আরোগ্য ভারতীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রচারক বুদ্ধদেব মণ্ডল সংগঠন সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর সারা রাজ্যে ব্যাপকভাবে আরোগ্য ভারতী বিস্তার লাভকরে। বর্তমানে তিনি পূর্বক্ষেত্রের সংগঠন সম্পাদক এবং রাজেশ কর্মকার পূর্বক্ষেত্রের সংগঠন সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। পরবর্তীকালে দক্ষিণবঙ্গ, মধ্যবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ তিনটি প্রান্ত হওয়ায় তিনটি আলাদা করে সমিতি গঠন করা হয়। উত্তরবঙ্গের ১৫টি জেলা (শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, মালদা, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, ঈশ্বরপুর, কোচবিহার ইত্যাদি), মধ্যবঙ্গের ১৫টি জেলা (বর্ধমান, আসানসোল, দক্ষিণ মুর্শিদাবাদ, উত্তর নদীয়া, উত্তর বীরভূম, তারকেশ্বর ইত্যাদি) এবং দক্ষিণবঙ্গের মোট ১৬টি জেলায় (কলকাতা উত্তর, কলকাতা দক্ষিণ-পূর্ব, কলকাতা দক্ষিণ-পশ্চিম, বারাসাত, বসিরহাট, হাওড়া গ্রামীণ, সুন্দবর, ঝাড়গ্রাম, কাঁথি, তমলুক ইত্যাদি) আরোগ্য ভারতীর কার্যকলাপ সক্রিয়ভাবে চলছে।
আরোগ্য ভারতীর মোট ২৪টি আয়াম রয়েছে তার মধ্যে বর্তমানে দশটি আয়ামের ওপর পশ্চিমবঙ্গে কাজ চলছে। প্রতিবছর ২১ জুন বিশ্ব যোগ দিবস এবং ধন্বন্তরি জয়ন্তী পালন সংগঠনের অনিবার্য কার্যের মধ্যেই পড়ে। একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াম হলো ‘আরোগ্য মিত্র প্রশিক্ষণ’ যেখানে দুই দিনের বর্গে বিভিন্ন ডাক্তার, যোগ বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদরা আসেন এবং মানুষকে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জ্ঞান প্রদান করেন।
এই বর্গে মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই যোগদান করেন। ‘সুস্থ জীবনশৈলী’, বনৌষধি প্রচার প্রসার, কিশোর বিকাশ, যোগ, পর্যাবরণ, বিদ্যালয় স্বাস্থ্য কার্যক্রম, নেশামুক্তি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ আয়ামগুলি সফলভাবে আরোগ্য মিত্ররা পরিচালনা করছেন। সুস্থ ব্যক্তি, সুস্থ পরিবার, সুস্থ গ্রাম এবং সর্বোপরি সুস্থ ভারত গড়ার প্রচেষ্টা আরোগ্য ভারতী প্রতিনিয়ত করে চলেছে।


প্রবুদ্ধ মননে সংস্কার সাধনে লোকপ্রজ্ঞার অগ্রগতি
প্রফেসার (ড.) সোমশুভ্র গুপ্ত
পশ্চিমবঙ্গে বিগত এক-দশকে ভারতীয় প্রবুদ্ধ মননে সংস্কার সাধনের কোনো প্রচেষ্টা যদি কোনো সংগঠন করে থাকে, তবে সেটি হলো লোকপ্রজ্ঞা। স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যশাসনের ভরকেন্দ্র বৈদেশিক প্রভাবমুক্ত না হওয়ায় সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতির ক্রমশ বিলীন হওয়ার একটা আশঙ্কা প্রকট হচ্ছিল। কিন্তু সঠিক সময়ে লোকপ্রজ্ঞার উদয়, উন্মেষ ও উত্তরণের মাধ্যমে এবং সহমর্মী সংগঠনগুলির সহায়তায় বঙ্গসমাজের মননকে ভারতীয় ভাবধারায় পুনর্জারিত করার প্রয়াস পরিলক্ষিত হচ্ছে। বঙ্গ মননে অবিচ্ছেদ্য ভারতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পরম্পরা, কৃষ্টি ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে, প্রকট হচ্ছে নিজেদের মূলভাবধারায় প্রত্যাবর্তনে। এটি আজগুবি কোনো দাবি নয়। বৈদ্যুতিন প্রভাবের সামাজিক মাধ্যমে জনসাধারণের মতামত পর্যবেক্ষণ করলেই বিষয়টির প্রমাণ মেলে।
লোকপ্রজ্ঞা সর্বভারতীয় প্রবুদ্ধমঞ্চ প্রজ্ঞা প্রবাহের বঙ্গীয় শাখা। লক্ষ্য একটিই, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে সনাতন ভারতীয় মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। লোকপ্রজ্ঞার তিনটি প্রান্ত- উত্তরবঙ্গ, মধ্যবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ। ঐতিহাসিক বেলুড় রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় হতে যাত্রা শুরু ২০১৮ সালে। যদিও উৎপত্তিগতভাবে প্রারম্ভ ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর প্রজ্ঞা প্রবাহের বারাণসীতে অখিল ভারতীয় বৈঠকে। সেই বৈঠকে তৎকালীন অখিল ভারতীয় সংযোজক ড. সদানন্দ সাপ্রেজীর আগ্রহে প্রবুদ্ধমঞ্চের তদানীন্তন পালক শ্রীদত্তাত্রেয় হোসবোলেজী সঙ্ঘ প্রচারক শ্রীঅরবিন্দ দাশের নাম প্রজ্ঞাপ্রবাহের পূর্ব ক্ষেত্র সংযোজক ঘোষণা করেন।
সাত বছরের মধ্যেই চারাগাছ থেকে মহীরুহের আকার ধারণ। স্থানগত, বিষয়গত, বয়সগত বৈচিত্রে এর এক-একটি একককে বলা হয় চর্চাকেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গে তিনপ্রান্ত তথা রাজ্যে এই মুহূর্তে সাংগঠনিক ও শৈক্ষণীক বিভাগ নিয়ে লোকপ্রজ্ঞার চর্চাকেন্দ্রের সংখ্যা ষাটের বেশি। প্রজ্ঞা প্রবাহের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী লোকপ্রজ্ঞার উদ্দেশ্য, শর্তাবলী ও কার্যাবলীর প্রতি প্রভূত গুরুত্ব আরোপিত। প্রতিটি পঞ্চ বিন্দুতে। প্রজ্ঞাপ্রবাহের প্রতীক চিহ্নে বোধবাক্য ‘জ্ঞানং বিজ্ঞান সহিতম্’। শ্রীমদ্ভগবদগীতা হতে প্রাপ্ত। লোকপ্রজ্ঞার প্রতীক চিহ্নে বোধবাক্য ‘অখণ্ড মণ্ডলাকারং ব্যক্তং যেন চরাচরং’। গুরুপ্রণাম মন্ত্রের অংশ।
এর শর্তাবলী হলো, লোকপ্রজ্ঞ নিঃশর্ত নয়; এর শর্ত বিন্দুগুলি নিম্নরূপ:
অরাজনৈতিক, ইতিবাচক, সময়ানুবর্তিতা, বিষয় প্রাসঙ্গিকতা এবং আলোচনাকালে নিজেকে মনোযোগী রাখা। কার্যাবলীর বিন্দুগুলি নিম্নরূপ:
প্রজ্ঞাবান হওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো ব্যক্তিগত জীবনে জ্ঞান চর্চা করা। গঠনতান্ত্রিকভাবে সমাজের শিক্ষিত অংশের জন্য হলেও লোকপ্রজ্ঞা সবার। কিন্তু প্রবুদ্ধ তিনিই, যিনি নিয়মিত অধ্যয়ন করেন, জ্ঞানচর্চার মধ্যে থাকেন।
প্রতি সপ্তাহে, পাক্ষিকভাবে অথবা মাসে অন্ততপক্ষে একবার নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট বিষয়ে চর্চাকেন্দ্র সদস্যদের সম্মিলিত চর্চা আবশ্যক। সময়ানুবর্তিতার উপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপিত।
আলোচনার বিষয়বস্তু প্রাসঙ্গিক ও পূর্বনির্ধারিত থাকে। এটি হয় অখিল ভারতীয় প্রজ্ঞাপ্রবাহ নির্ধারিত বিষয়সূচি (সম্প্রতি সর্বভারতীয় স্তর থেকে ১৫টি বিষয়সূচি নিয়ে গবেষণার আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে), অথবা ভারতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, পরম্পরা, কৃষ্টি ও মূল্যবোধ ভিত্তিক যে কোনো বিষয়। প্রাসঙ্গিকতার নিরিখে যদিও এটি সীমাবদ্ধ নয়। অর্থাৎ প্রান্ত বা রাজ্য স্তরে আঞ্চলিক গুরুত্বের বিষয়ও হতে পারে।
শুধুমাত্র নিজের চর্চাকেন্দ্র পরিসরে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রান্তস্তরের একক যেমন-মাতৃশক্তি। চারটি পর্যায়ের ছাত্রশক্তি যথা ঊষা, উদয়, উন্মেষ ও উত্তরণ। বিভিন্ন শৈক্ষণীক আয়াম যেমন- ইতিহাস, দর্শন, ভাষা বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, অর্থনীতি প্রভৃতির আন্তর্জালিক/বৈদ্যুতিন আলোচনায় অংশগ্রহণ করে নিজের জ্ঞান চর্চার পরিধি আরও প্রসারিত করা। বলা বাহুল্য দায়িত্বপ্রাপ্ত যারা, আমন্ত্রণ অনুসারে সাংগঠনিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করা কর্তব্য।
প্রান্তিক স্তরে অনুভব দর্শনে সপরিবারে অংশগ্রহণ করা। অনুভব দর্শন যেন আত্মোপলব্ধি ও আধ্যাত্মিকতার সন্ধানে লোকপ্রজ্ঞার পতাকাবাহী অনুষ্ঠান। এটি সাধারণত পরম্পরাগত ভাবে ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান যেমন মঠ-মন্দির, তীর্থক্ষেত্র, স্বাধীনতা সংগ্রামী বা দেশমাতৃকার সুসন্তানের স্মৃতি বিজড়িত গৃহ বা অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এবং অবশ্যই প্রজ্ঞাপ্রবাহের জাতীয় কার্যক্রম লোকমন্থনে অনুমতিক্রমে অংশগ্রহণ করা।
লোকপ্রজ্ঞার অনুষ্ঠিত অনুভব দর্শনগুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা:
২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রারম্ভ। পথ চলা শুরু। অখিল ভারতীয় সংযোজক জগন্নাথ নন্দকুমারজীর উজ্জ্বল উপস্থিতিতে। তদানীন্তন উপাচার্য স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দজী মহারাজের পৌরোহিত্য ও অভিভাবকত্বে। উপস্থিত ছিলেন অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দুটি।
পরের বছর ২০১৯-এর ১৮ মার্চ, দক্ষিণেশ্বর মা ভবতারিণী মন্দির পরিসর ভ্রমণ, দর্শন ও পূজন।
সেবছরেই ৬ আগস্ট, বেলুড় সাধারণ গ্রন্থাগারে (পাবলিক লাইব্রেরি) অনুভব দর্শন ও ড. ইন্দ্রজিৎ সরকার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অমর ভারত অজেয় ভারত’ পুস্তক উন্মোচন। অখিল ভারতীয় বৈঠক থাকায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রজ্ঞা প্রবাহের কার্যকর্তাদের উপস্থিতি।
পরের মাসে ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. জগদীশচন্দ্র বসুর স্মৃতি বিজড়িত বসু বিজ্ঞান মন্দির। এই অনুভব দর্শনের বিশেষ আকর্ষণ ছিল মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের স্বীকৃতি সম্মাননা প্রদান। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের প্রদর্শনী পর্বে তাদের অংশগ্রহণ ও উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো।
পরের অনুভব দর্শনটি ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের পৈতৃক আবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যেটি লোকপ্রজ্ঞার রাজ্যকার্যালয় মাধব স্মৃতির সন্নিকটে। বিশেষ আকর্ষণ ছিল স্বামী জ্ঞানলোকানন্দজী মহারাজের আশীর্বচন।
এর পর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র বালিগঞ্জ। অতিমারীর আবহে ১৫ মার্চ এটি অনুষ্ঠিত হয়। সমস্ত ভীতি তুচ্ছ করে ৫৫ জন উপনীত হন ভারতমাতার বীর সন্তান যুগাচার্য স্বামী প্রণবানন্দের আশ্রমে শ্রদ্ধা নিবেদনে।
অতিমারী আবহে প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ২০২১ সালের ২১ মার্চ বৃহদাকারে ত্রিমাত্রিক অনুভব দর্শন। একান্ন সতীপীঠের অন্যতম কালীঘাটে মাতৃ দর্শন। তৎসহ দেশমাতৃকার দুই বীর বঙ্গসন্তান নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর গৃহ ৫, এলগিন রোড ও ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির পিতৃভিটে দর্শন। স্যার আশুতোষ মুখার্জির স্মৃতি বিজড়িত।
অতিমারীর প্রভাব সম্পূর্ণ মুক্ত না হওয়ায় প্রায় এক বছরের ব্যবধানে অনুভব দর্শন। ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি। এবার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। কবিগুরুর স্মৃতি বিজড়িত গৃহে পূণ্য ভ্রমণ। রথীন্দ্র মঞ্চে সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শুভ সূচনা। অখিল ভারতীয় সংযোজক জগন্নাথ নন্দকুমারজীর উজ্জ্বল উপস্থিতিতে।
অতিমারীর আগ্রাসন নিয়ন্ত্রিত হওয়ার পরবর্তীতে দক্ষিণবঙ্গ ও মধ্যবঙ্গ বিকেন্দ্রীকরণের সূচনাকে স্মরণীয় করে রাখতে পরপর দুটি অনুভব দর্শন। ২০২২ সালের ১ মে দক্ষিণবঙ্গের আয়োজনে একান্ন সতীপীঠের একটি মেদিনীপুরের তমলুকে বর্গভীমা মন্দিরের অনুভব দর্শন। আত্মবলিদানকারী দেশপ্রেমিক সরোজিনী নাইডুর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান। আইআইটি খড়াপুরের প্রখ্যাত নির্দেশক প্র: বীরেন্দ্র কুমার তিওয়ারীর পৌরোহিত্যে। অপরটি সদ্যমান্যতা প্রাপ্ত মধ্যবঙ্গ আয়োজিত অনুভব দর্শন চুঁচুড়ার জোরাঘাটে প্রণবকন্যা আশ্রমে। সকালে গঙ্গাস্নান, তারপরে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মূর্তিতে মাল্যদান। তারপর আশ্রমে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এখানে উপস্থিতি আইআইটি খঙ্গপুরের খ্যাতনামা অধ্যাপক ড. পল্লব ব্যানার্জি এবং ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের স্বামী নির্গুণানন্দজী মহারাজের আশীর্বচন।
২০২২ সালের ৩১ জুলাই এগারোতম অনুভব দর্শন। আবার প্রারম্ভিক ক্ষেত্র বেলুড় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন। শ্রীরামকৃষ্ণ, সারদা মাতা ও স্বামী বিবেকানন্দের স্মৃতিক্ষেত্রে প্রতিটি স্থল এবং প্রাঙ্গণের অনুভব।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে পরবর্তী অনুভব দর্শন। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। লোকপ্রজ্ঞার প্রথম রাত্রিবাস-সহ দু-দিবসীয় অনুষ্ঠান। ছাত্র সংবর্ধনা। চোখে পড়ার মতো মাতৃমণ্ডলী ও ছাত্রদের উপস্থিতি। অধ্যক্ষ স্বামী ইষ্টেশানন্দজীর ভাষণ। উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি প্রধান অতিথি কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডাঃ সুভাষ সরকারের। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর পৈতৃক ভিটে সুভাষগ্রাম ভ্রমণ। এটি দ্বাদশ অনুভব দর্শন।
ত্রয়োদশতম অনুভব দর্শন বসু বিজ্ঞান মন্দিরের লবণহ্রদ পরিসরে। ২০২৩ সালের প্রথম অনুভব দর্শন। ৩০ এপ্রিল। প্রজ্ঞাপ্রবাহের পূর্বতন অখিল ভারতীয় সংযোজক ড. সদানন্দ সাপ্রেজীর উজ্জ্বল উপস্থিতি এবং অবশ্যই বসু বিজ্ঞান মন্দিরের নির্দেশক ড. উদয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্ঞানগর্ভবক্তৃতা। ২০২৩ সালের ১৮ জুন লোকপ্রজ্ঞার রাজ্য কার্যালয়ের নিকটে স্বামী বিবেকানন্দের পৈতৃক আবাস ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পুনরানুষ্ঠান। এটি চতুর্দশ।
তিন প্রান্ত সহযোগে বৃহদাকারে পঞ্চদশ অনুভব দর্শন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব তথা মা সারদাময়ীর স্মৃতি বিজড়িত কামারপুকুর ও জয়রামবাটিতে। দুটি পর্বে। প্রথমটি ২০২৩ সালে ২৯-৩০ জুলাই। পরের পর্বটি ২৬-২৭আগস্ট। বহু বিশিষ্টজনের সমাগম। দুটি পর্ব মিলিয়ে প্রায় পাঁচশোর বেশি প্রজ্ঞাপ্রবাহ সদস্যের অংশগ্রহণ।
বন্দেমাতরমের ধাত্রীভূমি নৈহাটির বঙ্কিম ভবন ও পাঠাগারে মূলত মধ্যবঙ্গের পরিচালনায়। ২০২৩ সালে ১ অক্টোবর। যদিও লোকপ্রজ্ঞার প্রতি অনুষ্ঠানেই বন্দেমাতরম্ স্তোত্র আবশ্যিক, কিন্তু তিন শতাধিক সদস্যের সমবেত কণ্ঠে সমোচ্চারিত পরিবেশনে এক অদ্ভুত অনুভূতি। বঙ্কিম গবেষণা কেন্দ্রের নির্দেশক ও গবেষকদের উপস্থিতি ও ভাষণ গৌরবময় প্রাপ্তি।
২০২৪ সালের দুটি অনুভব দর্শনই ব্যতিক্রমী। একটি এনআইটি দুর্গাপুর। অপরটি আইআইটি খঙ্গাপুর।
২০২৪ সালের ১৭ মার্চ এনআইটি দুর্গাপুরে ‘ভারতীয় জ্ঞান বিজ্ঞান পরম্পরা’ বিষয়ে লোকপ্রজ্ঞার অনুভব দর্শন একটি অসমান্তরাল প্রয়াস। কারণ কোনো এক জাতীয় কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লোকপ্রজ্ঞার কার্যক্রম এই প্রথম। অতীতে যদিও বসু বিজ্ঞান মন্দিরের মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানে লোকপ্রজ্ঞার অনুভব দর্শন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেটি প্রখ্যাত গবেষণা সংস্থা। এনআইটি দুর্গাপুরের নির্দেশক প্র: অরবিন্দ চৌবে এবং ডিন ডঃ পরিমল আচার্যের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে।
অষ্টাদশতম অনুভব দর্শন বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় কারিগরী সংস্থান বা আইআইটি খঙ্গপুরে। নির্দেশক ড. বীরেন্দ্র কুমার তিওয়ারীর পৌরোহিত্যে। অতীতেও বর্গভীমা মন্দিরে তিনি লোকপ্রজ্ঞার অনুভব দর্শন অলংকৃত করেছেন। বিশেষ আকর্ষণ ছিল মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এ রাজ্যের কৃতী ছাত্র-ছাত্রীদের সংবর্ধনা প্রদান। অমন্ত্রিত ছিলেন কারিগরি শিক্ষক প্রশিক্ষণ সংস্থা এনআইটিটিটিআর কলকাতার নির্দেশক ডঃ দেবী প্রসাদ মিশ্র। ছিলেন ডঃ সদানন্দ সাপ্রে, প্রজ্ঞাপ্রবাহের ভূতপূর্ব অখিল ভারতীয় সংযোজক। উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁদের জ্ঞানগর্ভ বক্তব্যে সমৃদ্ধ হন।
দুটিতেই লোকপ্রজ্ঞার পক্ষ হতে আসন অলংকৃত করেন ডাঃ আনন্দ পাণ্ডে।
উনবিংশতি অনুভব দর্শন ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত জাতীয় গ্রন্থাগার কলকাতায়। শুধুমাত্র রাজ্য বা দেশ নয়। আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ও মানের। মহামহিম রাজ্যপাল ডঃ সিভি আনন্দ বোস মহোদয়ের পথনির্দেশ। মূলত ছাত্রশক্তির কার্যক্রম। সর্ব ভারতীয় যুব কার্যকর্তা ঈশান যোশীর উপস্থিতি ও মনোমুগ্ধকর বক্তব্য। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ সোমনাথ ভট্টাচার্যের ভাষণ। রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ এডুকেশনাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের স্বামী কালেশানন্দজী মহারাজের আশীর্বচন। বিংশতিতমটি পুনরায় মা ভবতারিণী মন্দির ঐতিহ্যপূর্ণ দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি। প্রায় ছ’বছরের ব্যবধানে। ব্যতিক্রম এই যে এটি সম্পূর্ণ লোকপ্রজ্ঞার মাতৃশক্তি ও সংগীত বিভাগের ব্যবস্থাপনায়। এটি সাংগঠনিক পরিণত মনস্কতার পরিচায়ক। পবিত্র নাটমন্দিরে মন্দির প্রতিষ্ঠাত্রী রানি রাসমণির বংশজ বর্তমান পরিচালন সমিতির কর্ণধার কুশল চৌধুরী, যিনি কিনা লোকপ্রজ্ঞার জন্মলগ্ন থেকে একজন উৎসাহদাতা ও শুভানুধ্যায়ী, তাঁর ঐতিহাসিক তথ্যসমৃদ্ধ জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা। তদুপরি, প্রব্রাজিকা আত্মকাণপ্রাণা মাতাজীর আশীর্বচন এবং অবশ্যই মাতৃশক্তি ও সংগীত বিভাগের মনোমুগ্ধকর অনুষ্ঠান। একবিংশতি অনুভব দর্শন ঐতিহাসিক রাজভবনে। আগামী ইংরেজি ১৫ মে, ২০২৫।


খেলার মাধ্যমে ক্রীড়া ভারতী রাষ্ট্র নির্মাণে ব্রতী
পরিচয়: ক্রীড়া ভারতী একটি
সর্বভারতীয় অরাজনৈতিক খোলধুলার সংগঠন। ‘ক্রীড়া সে নির্মাণ চরিত্র কা, চরিত্র সে নির্মাণ রাষ্ট্র কা’- এই উদ্দেশ্যকে কার্যকর করতে নিয়ে ক্রীড়া ভারতী ১৯৯২ সাল থেকে সারা দেশে কাজ করে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে ক্রীড়া ভারতীর কাজের সূচনা হয় ২০১২ সালে কলকাতাতে। ‘ক্রীড়া বৃত্যা সদাচারো, রাষ্ট্র দেবো কৃতি যুবা’ এই উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের ২৭টি রাজ্য এবং ৫০৪টি জেলা-সহ বহু গ্রামে কাজ করে চলেছে। ভারতীয় বিভিন্ন খেলার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন পরম্পরাগত আঞ্চলিক খেলাকেও দেশবাসীর মধ্যে প্রচার করার চেষ্টা করছে ক্রীড়াভারতী। সমাজের সকল ব্যক্তি খেলার সঙ্গে যুক্ত হোক এবং তাদের স্বাস্থ্য ভালো রাখুক এই উদ্দেশ্যে- হর গাঁও মে ময়দান হো, হর ময়দান মে খেল হো’- এই ব্রতও নিয়েছে সংগঠনটি। শরীর, মন, বুদ্ধির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘স্বচ্ছ ভারত, সমর্থ ভারত’ এই উদ্দেশ্যও ক্রীড়া ভারতীর। খেলা ও যোগের মাধ্যমে ভারত পৃথিবীতে সুস্থ-সমর্থ দেশ হিসেবে পরিচিতি পাক এই উদ্দেশ্যও ক্রীড়া ভারতীর।
ক্রীড়া ভারতীর লক্ষ্য: খেলার মাধ্যমে দেশবাসীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো হোক। ভারতীয় খেলা, ব্যায়াম পদ্ধতির প্রচার-প্রসার এবং ভারতীর খেলোয়াড়দের মধ্যে সংস্কার ও দেশভক্তি জাগানো।
ক্রীড়া ভারতীর কাজ: ক্রীড়া কেন্দ্র, যোগ ও আত্মরক্ষা কেন্দ্র ক্রীড়া-ভারতী সূর্যনমস্কার প্রশিক্ষণ দেশি খেলার ক্রীড়াকেন্দ্র স্থাপন।
ক্রীড়া ভারতীর পঞ্চসূত্রী কার্যক্রম: ক্রীড়া ভারতী স্থাপনা দিবস (শ্রীহনুমান জয়ন্তী, সদস্য সংগ্রহ অভিযান)। রথ সপ্তমী তথা আন্তর্জাতিক যোগ দিবস ২১ জুন। রাষ্ট্রীয় ক্রীড়া দিবস ২৭আগস্ট (হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদ জয়ন্তী)। ক্রীড়া জ্ঞান পরীক্ষা। জীজামাতা সম্মান।
ক্রীড়া ভারতীর আয়াম: মাতৃশক্তি। দিব্যাঙ্গ। যুবা।
বার্ষিক পঞ্চসূত্রী কার্যক্রম ক্রীড়া ভারতী স্থাপনা দিবস (শ্রীহনুমান জয়ন্তী) সদস্য সংগ্রহ অভিযান শ্রীহনুমান জয়ন্তী চৈত্র পূর্ণিমা তিথিতে ক্রীড়া ভারতীর কাজ আরম্ভ করা হয়। হনুমানজীকে শক্তি, বুদ্ধি ও যুক্তির প্রতিমূর্তি হিসেবে গণ্য করা হয়। হনুমানজী ব্যক্তিগত জীবনে একজন পারদর্শী ক্রীড়াবিদ ছিলেন। যার জন্য লঙ্কা থেকে সীতা মাতার উদ্ধার হয়েছিল লঙ্কা থেকে। ভারতবর্ষ-সহ পশ্চিমবঙ্গের তিন প্রান্তে বিভিন্ন ক্রীড়া কেন্দ্রে এই দিনটি বিভিন্ন কার্যক্রম এবং প্রতিযোগিতার মধ্যে পালন করা হয়। এছাড়া হনুমান চল্লিশা পাঠ, হনুমান জয়ন্তীতে কেন ক্রীড়া ভারতীর প্রতিষ্ঠা দিবস তার বর্ণনা। কোথাও হনুমান মন্দিরে পূজাপাঠ-সহ প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থাও থাকে। এই সময় এক মাস ধরে সদস্য সংগ্রহ অভিযানও চলে।
রথসপ্তমী তথা আন্তর্জাতিক যোগ দিবস (২১ জুন)
সকলকে সংস্কারের মাধ্যমে ব্যায়াম শেখানো। এই কাজ ভারতবর্ষের ঋষিরা সারা বিশ্বে পৌঁছে দিয়েছেন। বর্তমান ক্রীড়া ভারতীও একই প্রয়াস নিয়ে কাজ করছে। ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় যুব দিবস (স্বামী বিবেকানন্দ জয়ন্তী) থেকে রথ সপ্তমী পর্যন্ত সূর্য নমস্কার চলতে থাকে। সূর্য নমস্কার মন্ত্র বলার পর ১৩টি সূর্য নমস্কার ৮ মিনিটের মধ্যে সমাপ্ত করা হয়। পরে সূর্য নমস্কার ফলমন্ত্র দিয়ে শেষ করা হয়।
রাষ্ট্রসঙ্ঘে ২১ জুন বিশ্ব যোগ দিবস ঘোষিত হয়। ক্রীড়া ভারতী এই দিন ভারতবর্ষের সকল নাগরিককে অনুরোধ করে সার্বজনিক যোগ উৎসবে অংশগ্রহণ করার জন্য। যোগ আমাদের জন্মগত ভাবে প্রাপ্ত-যার মন্ত্র নিজেকে সুস্থ রাখা। এই চিন্তাভাবনাকে সারা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। একে কার্যকরী করার চিন্তাভাবনা নিয়ে ক্রীড়া ভারতী নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছে। এজন্য প্রতি বছর ক্রীড়া ভারতী কলকাতার রানি রাসমণি রোডে ২১ জুন রাজ্যপালের উপস্থিতিতে যোগদিবস পালন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে কলকাতার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী-সহ শিক্ষক-শিক্ষিকা উপস্থিতি প্রশংসনীয়। প্রায় ৩ হাজারের উপর সংখ্যা থাকে। এছাড়া বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠন, ক্লাব, ৮টি যোগসংস্থার উপস্থিতিও প্রশংসনীয়। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রীড়া কেন্দ্র এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়া ভারতীর প্রচেষ্টায় যোগ দিবস পালন করা হয়ে থাকে। করোনার সময়েও রাজভবনে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়জীর উপস্থিতিতে যোগদিবস প্রতীকী রূপে পালিত হয়েছে। ২১ জুনকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি হচ্ছে এবং স্থায়ী ক্রীড়া কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ছে।
রাষ্ট্রীয় ক্রীড়া দিবস ২৯ আগস্ট (হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদ জয়ন্তী):
খেলার জগতে দেশভক্ত আদর্শ খেলোয়াড় ছিলেন ধ্যানচাঁদ। এজন্য খেলোয়াড়ের রাষ্ট্রভক্ত পরিচয় গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রত্যেক ক্রীড়াকেন্দ্রে বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক খেলা হয়ে থাকে। সঙ্গে খেলোয়াড়ের জীবনী বর্ণনাও করা হয়। ধ্যানচাঁদজীর দেশ মাতৃকার প্রতি অসম্ভব আকর্ষণ ছিল, এজন্য বিদেশি দেওয়া লোভনীয় চাকরিও তিনি করতে রাজি হননি। এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আত্মরক্ষামূলক বিষয়ও রাখা হয়ে থাকে।
জীজামাতা সম্মান ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের মাতা ছিলেন বীরমাতা জীজামাতা। তিনি বিপরীত পরিস্থিতিতে কীভাবে রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ করতে হয় সেই শিক্ষা পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে। শিবাজীর মধ্যে বীরভাবনা, সংকল্পশক্তি দিয়েছিলেন মাতা জীজাবাই। জীজামাতার যোগ্য লালন-পালনের ফলেই ছত্রপতি শিবাজী রাষ্ট্র নির্মাণ করার মতো গুণ অর্জন করেছিলেন। তেমনি প্রতিটি খেলোয়াড়ের জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের আড়ালে থাকে মায়ের সুকৌশল সহযোগিতা। এজন্য প্রতিবছর রাষ্ট্রীয় ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিযোগিতায় বিজেতা খেলোয়াড়ের মাকে ‘বীরমাতা জীজাবাঈ পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। সভাপতি বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার চেতন চৌহানের কলকাতায় প্রবাস এবং তাঁর প্রাণোজ্জ্বল ভাষণ সবাইকে ক্রীড়া ভারতীর কাজে উদ্দীপ্ত করেছিল। এরপর ক্রীড়া ভারতীর কাজ বিভিন্ন কার্যক্রম ও খেলাধুলার মধ্য দিয়ে প্রসার লাভ করতে থাকলো।
এই সংগঠন ক্রমাগত ১৪ বছর ধরে তাদের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংগঠনের মধ্যে ব্যক্তিবর্গের আন্তরিক মেলবন্ধন খুব মধুর। ক্রীড়া ভারতীর কাজ পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে ২০১২ সাল থেকে। আজ ক্রীড়া ভারতী এক বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। যার ছত্রছায়ায় কয়েক হাজার ক্রীড়াপ্রেমী-সহ বিভিন্ন খেলায় পারদর্শী ব্যক্তিত্ব নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সংগঠনকে আরও সুদুরপ্রসারী করার জন্য দীর্ঘ ১৪ বছর নতুন নতুন নেতৃত্বে সফলতার নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করে চলেছে, যেখানে আছে সংগঠনিক শৃঙ্খলা, সততা, দেশাত্মবোধের দক্ষতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণ। কয়েক বছরের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ সংগঠনটি বর্তমান নির্দিষ্ট দিশা নিয়ে সুচারুভাবে এগিয়ে চলেছে।
এর পেছনে অবশ্য সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাও আন্তরিকতা সর্বাগ্রে প্রশংসনীয়। বিশেষ করে সঙ্ঘ প্রচারক মধুময় নাথ (ক্রীড়া ভারতীর অখিল ভারতীয় সহ-সম্পাদক)। সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে নির্দিষ্ট সময়ে অনুশাসন মেনে কাজ করার পদ্ধতি, যা আমরা প্রতি পদে পদে অনুভব করি। অভিভাবক রূপে আছেন-তপনমোহন চক্রবর্তী। তাঁর অভিজ্ঞতা ও পরিচিতি আমাদের সাংগঠনিক কাজকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে সুদূরপ্রসারী করেছে। সর্বদা পাশে থেকে সাংগঠনিক কাজকে বিস্তারের কৌশল প্রণেতা হিসেবে আছেন বিভাস মজুমদার (প্রাক্তন সম্পাদক পশ্চিমবঙ্গ)। এছাড়া সঙ্ঘ প্রচারক অদ্বৈতচরণ দত্ত ভ্রমণ ও সময় দানের আহ্বান সবাইকে প্রেরণা দিয়েছে। পর্বতারোহী তেনজিং নোরগে পুরস্কার প্রাপ্ত দেবাশিস বিশ্বাসের সহজ সরল জীবনযাত্রা আমাদের কাজের প্রতি আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে দেয়। খুব সুন্দরভাবে তিনি বলেন- ‘কাজের ক্ষেত্রে পিছনের পাকে শুধু নিয়ম মেনে সামনে এগিয়ে নিতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট জায়গায় থামতে শিখতে হবে। তাহলেই আমরা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো।’ তিনি বর্তমানে দক্ষিণবঙ্গ প্রান্তের সভাপতির দায়িত্বে আছেন। এছাড়া যাদের কথা বলা হলো না, তাদের সকলের যোগদান ক্রীড়া ভারতীর কাজকে চলমান করে রেখেছেন আন্তরিক ভাবে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের মতো আমাদের দক্ষিণবঙ্গ প্রান্তে এই ব্যবস্থা করা হয় প্রতি বছর। পর্বতারোহী দেবাশিস বিশ্বাসের মাকেও একটি অনুষ্ঠানে ক্রীড়া ভারতী বিশেষ সম্মানে সম্মানিত করেছে। ক্রীড়াজ্ঞান পরীক্ষা: ছাত্র-ছাত্রী তথা অভিভাবক-অভিভাবিকাদের খেলার প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর জন্য ক্রীড়াজ্ঞান পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ফর্ম পূরণ ঘরে বসে অন লাইনে করা যায়। পরিবারের সকলে মিলে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন। এজন্য সকলের খেলার প্রতি রুচি বাড়ে সঙ্গে সঙ্গে খেলার জ্ঞানও বৃদ্ধি পায় এবং ক্রীড়া ভারতী সম্পর্কে সকলে ঘরে বসে জানতে পারে। এই পরীক্ষা সাধারণত বছরের শেষের দিকে করা হয়।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখ পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় প্রথম পুরস্কার এক লক্ষ টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার দু’জন পায় পঞ্চাশ হাজার টাকা, তৃতীয় পুরস্কার চার জন পঁচিশ হাজার টাকা। এছাড়া প্রতি ক্ষেত্র থেকে ১ জন করে ১১ জন ১১ এগারো হাজার টাকা করে পুরস্কার পেয়ে থাকে। এবছর আমাদের দক্ষিণবঙ্গ প্রান্ত থেকে পূর্বক্ষেত্রে প্রথম হয়েছে সায়ন মাইতি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর নীম পীঠ স্কুলের ছাত্র। সে এবছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। তাঁকে ক্রীড়া ভারতীর পক্ষ থেকে ১১ হাজার টাকার চেক দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে। আগামী দিনে আরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী খেলামুখী হোক এবং আরও পুরস্কার প্রাপ্ত হোক, ক্রীড়া ভারতী এই কামনা রাখে।
১১ সেপ্টেম্বর: প্রতি বছর ১১ সেপ্টেম্বর ভারত জাগো দৌড়ের আয়োজন করা হয়। কারণ ১১ সেপ্টেম্বর স্বামীজী বিশ্বের দরবারে সনাতন ধর্মকে বিশ্ব মাঝে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এজন্য যুব সমাজকে খেলার প্রতি আগ্রহ ও দেশকে আগে বাড়ানোর জন্য ক্রীড়া ভারতীর এই প্রয়াস। এবছর বিপ্লবী পুলিনবিহারী দাসের স্মরণে ভারত জাগো দৌড়, ম্যারাথন দৌড় করানোর পরিকল্পনা নিয়েছে ক্রীড়া ভারতী।
পশ্চিমবঙ্গে ক্রীড়া ভারতীর কার্য বিস্তারে কার্যকর্তাদের ভূমিকা:
ক্রীড়া ভারতীর এই কাজ পূর্ব ভারতে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে শুরুর প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া হয় সঙ্ঘের অখিল ভারতীয় শারীরিক শিক্ষণ প্রমুখ লক্ষ্মণরাও পার্ডিকর-সহ মধুময় নাথের সহযোগিতায় কলকাতার সল্টলেকে তপনমোহন চক্রবর্তীর বাড়িতে। তিনি বাণীপুরের ফিজিক্যাল এডুকেশন কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। এরপর কল্যাণ ভবনে কতিপয় প্রান্ত কার্যকর্তা প্রশিক্ষণ বর্গে বিশ্বশ্রী মনোহর আইচের অংশগ্রহণ ও বক্তব্য ক্রীড়া ভারতীর চলার পথকে আরও সুদৃঢ় করে।
উল্লেখ্য, এ বছর খেল মহাকুম্ভে দক্ষিণবঙ্গ প্রান্ত থেকে ৬২ জন খেলোয়াড় কবাডি এবং খো খো খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। ৫-১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খেল মহাকুম্ভ প্রয়াগরাজে অনুষ্ঠিত হয়। কার্যবিস্তার:
প্রথম কাজ শুরু হলো আন্তঃবিদ্যালয় কবাডি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। কলকাতায় অনেক বিদ্যালয়ের সঙ্গে পরিচয় বাড়ল, তাকে কেন্দ্র করে শ্যামবাজার আহিরি টোলায় কাবাডি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে। যেখানে অর্জুন পুরস্কার প্রাপ্ত বর্তমান প্রদেশ সভাপতি বিশ্বজিৎ পালিতের সহযোগিতা অনেকখানি ফলপ্রসূ হয়েছে। এই সঙ্গে অনেক কাবাডি সংস্থার সঙ্গে ও ক্রীড়া ভারতীর সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
পরে ফুটবল প্লেয়ার সুপ্রকাশ গড়গড়ি, সুমন দে-র সহযোগিতায় আন্তঃবিদ্যালয়- ‘বিবেকানন্দ ফুটবল কাপ আয়োজন হলো। সেন্ট লরেন্স বিদ্যালয়ে এই খেলায় ফাইনাল খেলা হলো-ইস্ট বেঙ্গল মাঠে, যার সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন ভারতীয় মহিলা ফুটবলার ইন্দ্রাণী সরকারের ব্যবস্থাপনায়। সার্বিক ভাবে কল্যাণ চৌবের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পরবর্তীতে ২১ জুন প্রথম আন্তর্জাতিক যোগদিবস পালন করা হলো যোগাচার্য ফণিভূষণ মঞ্চের হলে। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল। সেখানে বিভিন্ন সংস্থায় যোগের প্রদর্শন এবং তাদের সম্মানিত করা হয়। এর সঙ্গে সূর্য নমস্কারের প্রতিও ক্রীড়া ভারতী সমদৃষ্টি দিয়ে ক্রীড়াকেন্দ্র বাড়ানোর প্রসঙ্গ শুরু করে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সারাদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠান বিভিন্ন বিচার পরিবার মিলে সূর্য নমস্কার মহাযজ্ঞ আয়োজিত হয়। ক্রীড়া ভারতীর সক্রিয় অংশগ্রহণে ১১৪ কোটি মানুষ সূর্য নমস্কারে অংশগ্রহণ করেন।
এছাড়া ক্রীড়া ভারতীর উদ্যোগে বাইক র‍্যালির মাধ্যমে সারা দেশকে যুক্ত করার এক অভিনব অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় সারাদেশে। সেখানে শামিল হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত। এই অনুষ্ঠানে এ রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের সক্রিয় বিরোধিতা সত্ত্বেও আমাদের কার্যকর্তাদের দৃঢ়তা এই কার্যক্রমে সফলতা এনে দেয়। উৎসাহের সঙ্গে যুবক-যুবতীরা বাইক র‍্যালির মাধ্যমে সারা পশ্চিমবঙ্গে তথা ভারতে একই দিনে একই সময়ে হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে দেশ রক্ষায় সংকল্প নেয়। জেলা সম্মেলন, প্রান্ত সম্মেলন ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিযোগিতা প্রদর্শনমূলক কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয় বছরে একবার ভ্রমণ, পরিবার মিলন হয় যেমন-সুন্দরবন, গঙ্গাসাগর, মুকুটমণিপুর, মায়াপুর ইত্যাদি জায়গায় হয়েছে। সারা ভারতবর্ষ-সহ পশ্চিমবঙ্গেও কয়েক হাজার খেলোয়াড়ের সার্ভে ফর্ম ফিলাপ হয়েছে তাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়ে।
এই সমস্ত কাজ সাবলীল ভাবে করা সম্ভব হয়েছে ক্রীড়া ভারতীর সকল কার্যকর্তাদের নিরলস সহযোগিতার জন্য। এছাড়া সদস্য এবং ক্রীড়াপ্রেমী ব্যক্তিবর্গের আন্তরিক সহযোগিতা ও সম্পর্কের জন্য, ক্রীড়া ভারতী আগামী দিনে আরও সুন্দর ভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সকলের সহযোগিতা ও সহমর্মিতার আশা রাখে। এছাড়া বার্ষিক যোজনায় বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া হয়েছে ঘরে ঘরে কাবাডি খেলা এবং প্রতি পরিবারে আপাতত একজন করে আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য।


শিল্পীমনে রাষ্ট্রীয়তার বোধ জাগরণে সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গ
সুভাষ ভট্টাচার্য্য
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের উদ্দেশ্য, আদর্শ তথা ভাবধারাকে পাথেয় করে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল শিল্পীদের পরম্পরাগতভাবে সংস্কৃতিমনস্ক করার ব্রত নিয়ে ১৯৮১ সালে উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌতে সংস্কার ভারতীর প্রতিষ্ঠা হয়। সংস্কার ভারতীদ্দ প্রথম সভাপতি ছিলেন ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ গুপ্তা, সাধারণ সম্পাদক ড. বিষ্ণু শ্রীধর বকনকর এবং সংগঠন সম্পাদক যোগেন্দ্রজী। সংস্কার ভারতীর প্রতিষ্ঠা হবার পর পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষিপ্তভাবে সংস্কার ভারতীর নামে বিভিন্ন অনুষ্ঠান চলেছে ১৯৮৫ সাল থেকে। এই সময় অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন পণ্ডিত হিমাংশু বিশ্বাস এবং সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়।
সর্বভারতীয় এই সংগঠনের শাখা পশ্চিমবঙ্গে বিধিসম্মতভাবে শুরু হোক এই চিন্তা নিয়ে ১৯৮৭ সালের ১৬ জুন বর্ধমান শহরে এক বৈঠকে সঙ্ঘের প্রবীণতম প্রচারক কেশবজীর পৌরোহিত্যে এবং অরুণ চক্রবর্তী, ভোলানাথ চন্দ, শিবেশ সান্যাল, নিবারণ চট্টোপাধ্যায় এবং অশোক কর্মকার ও সুভাষ ভট্টাচার্য্যের উপস্থিতিতে সংস্কার ভারতীর কাজ যাতে এখানে সুশৃঙ্খলভাবে শুরু হয়, সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এরপর ১৯৮৭সালের আগস্ট মাসে কলকাতার নেতাজী সুভাষ ইনস্টিটিউট হলে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গ’র। উপস্থিত ছিলেন সংস্কার ভারতীর তৎকালীন সংগঠন সম্পাদক যোগেন্দ্রজী, বিশিষ্ট সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এবং স্টেটসম্যান পত্রিকার তৎকালীন প্রধান বার্তাসম্পাদক বিশ্বজিৎ মোতিলাল। ১৯৮৭ সালে এই প্রতিষ্ঠার পর ১৯৮৯ সালে হায়দরাবাদে আয়োজিত প্রথম সর্বভারতীয় ‘কলা সাধক সঙ্গমে’ পশ্চিমবঙ্গ থেকে সাতজন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন তৎকালীন প্রাদেশিক সভাপতি সত্যেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে।
১৯৯১ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম শিল্পী সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল উত্তর কলকাতার হটকেশ্বর ভবনে এবং প্রকাশ্য অনুষ্ঠান হয় বিদ্যামন্দির সভাগৃহে। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বনামধন্য শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী ড. সুনন্দা পট্টনায়ক, প্রাদেশিক সভাপতি ড. যামিনী গাঙ্গুলী, বিশিষ্ট অভিনেতা উজ্জ্বল সেনগুপ্ত, বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়। উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন সভাপতি ড. শৈলেন্দর নাথ শ্রীবাস্তব এবং সংগঠন সম্পাদক প্রয়াত যোগেন্দ্রজী ও অভিনেতা তপন গাঙ্গুলী যিনি আজও একই ভাবে আমাদের মধ্যে রয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গে এই ৩৮ বছরের যাত্রাপথে যাঁদের আশীর্বাদ ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতা আমরা পেয়েছি তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কেশবরাও দীক্ষিত ড. যামিনী গাঙ্গুলী, ড. গোবিন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায়, অহীন্দ্র দে, পণ্ডিত এ. কানন, উজ্জ্বল সেনগুপ্ত, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়, গোরা সর্বাধিকারী, ভবেন্দু ভট্টাচার্য্য এবং অমল শংকর। এছাড়া আরও যাঁদের শুভেচ্ছা এবং সহযোগিতা পেয়েছি এবং এখনও পাচ্ছি তাঁরা হলেন বিশিষ্ট অভিনেতা ও পরিচালক পদ্মভূষণ ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমতী মমতা শঙ্কর, তনুশ্রী শঙ্কর, অলকানন্দা রায়, অলকা কানুনগো, অমিতা দত্ত (নৃত্যসাধিকা), সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, রথীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. বিজয় আঢ্য (সাহিত্যিক ও সাংবাদিক), রঞ্জিত মল্লিক, সুদীপ মুখার্জী, কৌশিক চক্রবর্তী, অরিন্দম গাঙ্গুলী (অভিনেতা), ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, বিজয়লক্ষ্মী বর্মণ (বাচিক শিল্পী), শিক্ষাবিদ ড. সরূপপ্রসাদ ঘোষ প্রমুখ সাংস্কৃতিক জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।
সংস্কার ভারতীর বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে অভিনব কার্যক্রম বা প্রয়োগ হলো সাংস্কৃতিক দেওয়ালপঞ্জীর প্রকাশ, যা বিগত কুড়ি বছর ধরে সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গর পক্ষ থেকে আমরা করে আসছি।
১৯৮৭ সাল থেকে এভাবেই সংস্কার ভারতীর যাত্রা শুরু হয়, যা আজ এই ২০২৫ সালেও অব্যাহত হয়ে চলেছে এবং আগামীতেও যথার্থ হাতে এর আরও উত্তরণ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ সংগঠন আমাদের সবার, তাই হাতে হাত রেখে একে আলোর পথে আরও অগ্রসর করে দেওয়ার ব্রতও আমাদের সবার। বর্তমানে সংস্কার ভারতী পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ প্রান্তে, ড. সরূপপ্রসাদ ঘোষের সভাপতিত্বে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছেন সুভাষ ভট্টাচার্য্য, নীলাঞ্জনা রায়, গোপাল কুণ্ডু, নিখিল সমাদ্দার, অমিতাভ মুখোপাধ্যায়, ভরত কুণ্ডু, মহাশ্বেতা চক্রবর্তী, তিলক সেনগুপ্ত, অমিত দে, রীণা বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভঙ্কর ভট্টাচার্য প্রমুখ।


পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রারম্ভিক ইতিহাস ও ক্রমবিকাশ
পর্ব-১
প্রণয় রায়
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উল্লেখযোগ্য সাফল্য রাজ্য রাজনীতিতে এক মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়- যেন গেরুয়া জোয়ার এবং লাল পতনের যুগ। এই উত্থানের পিছনে থাকা কারণগুলো ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট-হিন্দু মহাসভা, ভারতীয় জনসঙ্ঘ এবং সঙ্ঘ বিচার পরিবারের মতাদর্শ ও সাংগঠনিক প্রভাব বুঝতে হবে।
উনিশ শতকে বঙ্গপ্রদেশে হিন্দু জাতীয়তার বীজ রোপিত হয়, যা পরে মহারাষ্ট্রে বিকশিত হয়ে ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার পথে নিয়ে যায়। সঙ্ঘের জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারায় ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র ও স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার কলকাতায় পড়াশোনা করার সময় বাঙ্গালি বিপ্লবীদের কাছ থেকে জাতীয়তাবোধের অনুপ্রেরণা পান।
হিন্দু মহাসভা সেই সময় বঙ্গপ্রদেশে সক্রিয় ছিল এবং মুসলিম লিগের বিরোধিতা করে হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯৪৭ সালের দেশভাগ- এই দুটি ঘটনাই হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতিকে ত্বরান্বিত করে। বিশেষ করে ১৯৪৬ সালের ‘কলকাতায় হিন্দু নরসংহার’ এবং পরবর্তীকালে নোয়াখালিতে হিন্দু গণহত্যা হিন্দু সমাজকে গভীরভাবে আঘাত করে।
১৯৪৬ সালে কলকাতায় ডাইরেক্ট অ্যাকশনের সময় বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দির তীব্র সমালোচনা করেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। স্বাধীনতার পরে ইংরেজদের শর্ত অনুযায়ী সকল দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় সরকার তৈরি হয়। জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে সেই জাতীয় সরকারে ড. মুখার্জি শিল্প ও সরবরাহ মন্ত্রী হন। তিনি ১৯৪৮ সালে হিন্দু মহাসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং নেহরু-লিয়াকত চুক্তির বিরোধিতা করে মন্ত্রীসভা থেকেও পদত্যাগ করেন।
১৯৪৯ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর সঙ্ঘকার্যকর্তা ও প্রচারকদের কয়েকজন দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক শ্রীগুরুজী (এম এস গোলওয়ালকর)-র সঙ্গে আলোচনায় বসে বলেন রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গিন, দেশ ভাগ করে মুসলমানরা পাকিস্তান পেয়ে ওপারে চলে গেছে। এখানে জাতীয় কংগ্রেসের তোষণনীতি দেশ বা জাতিকে সঠিক পথনির্দেশ করতে অসমর্থ এবং হিন্দু মহাসভা ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে। ড. মুখার্জি হিন্দু মহাসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন। সামনে রাজনৈতিক পথ নির্দেশের জন্য এমন কোনো সেরকম সামনে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এখন ভারতীয়ত্বের আদর্শে ও সাংস্কৃতিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ একটা রাজনৈতিক দলের আশু প্রয়োজন। আমরা অনুভব করছি, সঙ্ঘ যদি এই ঐতিহাসিক ক্ষণে এদিকে একটু বিশেষ চিন্তা করে একটা রাজনৈতিক দল শুরু করে, তাহলে দেশের মঙ্গল হবে বলে আমাদের মনে হচ্ছে। কার্যকর্তা ও কয়েকজন প্রচারকের ভাবনার কথা শুনে শ্রীগুরুজী কদিন ভাববার সময় নেন। পরে তিনি তাঁদের ডেকে জানান, আমরা কোনোদিন রাজনীতি করিনি, রাজনীতির কাজকর্ম জানা নেই, দল কে চালাবে? যদি এমন কোনো ব্যক্তিকে পাওয়া যায় যিনি রাজনৈতিক দল চালিয়েছেন বা রাজনীতি করেছেন, যাঁর কিছু অন্তত অভিজ্ঞতা আছে এরকম কোনো ব্যক্তি পাওয়া যায় কিনা দেখুন। সে সময় একনাথ রানাডে যিনি কন্যাকুমারী শিলাখণ্ডে স্বামী বিবেকানন্দের স্মারক মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা, কলকাতায় পূর্বাঞ্চল প্রচারক হিসেবে আসেন। তৎকালীন বর্ধমান জেলা প্রচারক সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির পূর্ব পরিচয় ছিল। সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে একনাথজী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে কথা বলেন। শ্রীগুরুজীর সঙ্গে দিন স্থির করে তাঁকে দিল্লিতে নিয়ে যান। শ্রীগুরুজী ও ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির কথাবার্তা হয়। তারপর ২১ অক্টোবর ১৯৫১ ‘ভারতীয় জনসঙ্ঘ’ নামে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয়।
সভাপতি হিসেবে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নাম স্থির হয়। আলোচনা অনুযায়ী শ্রীগুরুজী রাজনৈতিক কাজে প্রচার ও প্রসারের জন্য প্রতিটি প্রদেশ থেকে দুজন করে প্রচারককে জনসঙ্ঘের সহায়তার জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৫২ সালে ভারতের সর্বপ্রথম নির্বাচনে ‘ভারতীয় জনসঙ্ঘ’ দেশের স্বীকৃত রাজনৈতিক দল হিসাবে পরিগণিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে দু’জন প্রচারককে জনসঙ্ঘের জন্য দেওয়া হয়- রামপ্রসাদ দাস ও প্রভাকর ফৈজপুরকর।
নিজস্ব কর্মদক্ষতা ও প্রতিভার কারণেই দীনদয়াল উপাধ্যায় ১৯৫২ সালে কানপুরে ‘ভারতীয় জনসঙ্ঘ’-এর সর্বপ্রথম অধিবেশনে জনসঙ্ঘের সর্বপ্রথম সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত হন। সর্বভারতীয় সভাপতি ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এই অধিবেশনে প্রথম ভাষণেই বলেন, ‘আমাকে দু’জন দীনদয়াল দিন, আমি ভারতের স্বরূপই বদলে দেব। তাঁর মতো কার্যকর্তার জন্য আমি গর্বিত।’ দীনদয়ালজী এই দায়িত্বপূর্ণ কাজে বহুদিন থেকে কঠোর পরিশ্রম করে জনসঙ্ঘকে হরিপদ ভারতী দেশব্যাপী বিস্তার করেন। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৫২ সালে ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রথম রাজ্য সম্মেলন হয় মেদিনীপুর জেলার গড়বেতায়। ডঃ মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে ১৯৫২ সালে সংসদের প্রথম নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন জনসঙ্ঘের দুইজন। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ ও দুর্গাদাস চট্টোপাধ্যায় যথাক্রমে দক্ষিণ কলকাতা ও মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজয়ী হন। বিধানসভায় খঙ্গপুরের ডাঃ শতপতি ও জনার্দন সাধুসহ একজন বিধায়ক নির্বাচিত হন। সকলেই মেদিনীপুর জেলার।
এদিকে শেখ আবদুল্লা কাশ্মীর ভারতের অবিভক্ত অঙ্গ মেনে নিয়েও আলাদা প্রধান, আলাদা বিধান, আলাদা নিশান রাখার দাবি নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী কার্যকলাপ শুরু করে। শেখ আবদুল্লার এই চিন্তা ও কাজের বিরুদ্ধে ড. শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে সংসদ উত্তাল হয়ে ওঠে। তিনি এর প্রতিবাদে কাশ্মীরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
দেশের অনেক চিন্তাশীল, বিদ্বজ্জন বুদ্ধিজীবী এবং শ্রীগুরুজী-সহ বহু সহৃদয় ব্যক্তি ডঃ শ্যামাপ্রসাদের কাশ্মীর যাওয়াকে কোনো ভাবে মেনে নিতে পারছিলেন না। অনেকে এর মধ্যে একটি গভীর ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা করেছিলেন। অনেক মনে মনে খারাপ কিছু ঘটার অনুমান করেছিলেন। কারণ ভারতবর্ষের মঙ্গলের কথা তুলে ধরার জন্য লোকসভায় নেহরুর সামনে ড. মুখার্জি ছাড়া অন্য তেমন কানো প্রতিপক্ষ ছিল না। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ ১৯৫৩ সালে ১০ মে জম্মু-কাশ্মীরের উদ্দেশে রওনা দেন।
কাশ্মীরের পুলিশ ডঃ মুখার্জি ও সহযাত্রী মৌলীচাঁদ শর্মা, গুরুদত্ত বৈদ্য, টেকচাঁদ শর্মা, বলরাজ মধোক-সহ আরও কয়েকজন সঙ্গীকে ১১ মে গ্রেপ্তার করে। সর্বসময়ের সঙ্গী তরুণ অটলবিহারী বাজপেয়ীকে তিনি দিল্লিতে ফিরে যেতে বলে উচ্চৈঃস্বরে বলেন, অটল, তুমি সমস্ত দেশবাসীকে জানিয়ে দাও ‘শ্যামাপ্রসাদ’ ভারতের সমস্ত প্রদেশের মতো জম্মু-কাশ্মীরেও কোনো পারমিট ছাড়াই স্বাধীন ভাবে প্রবেশ করেছে। কিন্তু ওই জেলেই মাত্র ৫২ বছর বয়সে ২৩ জুন তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হলো। মা যোগমায়াদেবী মৃত্যুসংবাদ শুনে চিৎকার করে কেঁদে বলেন ‘আমি গর্ব করে বলছি যে আমার ছেলের অকালমৃত্যুতে ভারতমাতার অনেক ক্ষতি হলো।’
অশ্রুজলে শপথ নিয়ে জনসঙ্ঘের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত জাতীয়তাবাদী সংগঠন একত্রিত হয়ে ডঃ শ্যামাপ্রসাদের হত্যার তদন্তের দাবি তুলল, তা শীঘ্রই আসমুদ্রহিমাচলব্যাপী জনমানুষের অন্তরের দাবি হয়ে ফুটতে থাকে। তা সত্ত্বেও জনসঙ্ঘের চলার গতি ক্রমে ক্রমে বাড়তে থাকে। ডঃ মুখার্জির পর প্রেমনাথ ডোগরা, ডঃ রঘুবীর, বলরাজ মাধোক, দক্ষিণের ভি. রামা রাও, বৎসরাজ ব্যাস-সহ কয়েকজন জনসঙ্ঘের সভাপতির আসন অলংকৃত করেন। অধ্যক্ষ দেবপ্রসাদ ঘোষ পশ্চিমবঙ্গ-সহ সর্বভারতীয় অধ্যক্ষ হিসেবে সবচেয়ে বেশিদিন সভাপতিত্ব করেন। সমস্ত শীর্ষ নেতৃত্বের একান্ত অনুরোধে দীনদয়ালজী ভারতীয় জনসঙ্ঘের কালিকট অধিবেশনে সর্বভারতীয় সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করতে সম্মত হন।
কিন্তু ১৯৬৮ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি মুঘলসরাই রেল ইয়ার্ডে তাঁকে রহস্যজনকভাবে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর মৃত্যুর পর পার্টির নেতৃত্বে অটলজী সকলের মন আকর্ষণ করেন এবং মাত্র তেতাল্লিশ বছর বয়সে ভারতীয় জনসঙ্ঘের সর্বভারতীয় সভাপতির দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন।
৭০-এর দশকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসের দুর্নীতি ও দুষ্কর্মের জন্য এবং নেতাদের আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে দেশের বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন ভাবে আন্দোলন শুরু হতে থাকে। গুজরাটে ভ্রষ্ট কংগ্রেস সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে জাতীয়তাবাদী যুব ও ছাত্র নেতারা একত্রিত হয়ে আন্দোলনের জন্য অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের নেতৃত্বে মিলিতভাবে জয়প্রকাশ নারায়ণের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে তাঁকে গুজরাটে আসার অনুরোধ করে। জয়প্রকাশজী ছাত্র নেতাদের আমন্ত্রণ স্বীকার করে গুজরাটে এসে ছাত্রদের যথাযথ উপদেশ ও পথনির্দেশ দেন। ‘নবনির্মাণ সমিতি’র নামে অহিংস আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন।
১৯৭৪ সালে গুজরাট, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি প্রদেশে ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি’র নামে আন্দোলনটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন জয়প্রকাশজী।
১৯৭৪ সালে ৪ নভেম্বর দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় বিহার পুলিশ প্রচণ্ড লাঠি চালায় এবং একটা লাঠি জয়প্রকাশজীর মাথার উপর পড়ার মুহূর্তে জনসঙ্ঘের নেতা নানাজী দেশমুখ পাশে থেকে নিজের ওই আঘাত নিজের মাথায় নেন, ফলে জয়প্রকাশজী রক্ষা পান।
১২ জুন ১৯৭৫ সাল, এলাহাবাদ উচ্চ আদালত ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করে। ২৫ জুন ১৯৭৫ জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে দিল্লির রামলীলা ময়দানে বিশাল জনসভা হয়। যেখানে সমস্ত দলের প্রায় সব নেতা উপস্থিত ছিলেন। পরদিনই ২৫ জুন ১৯৭৫ শ্রীমতী গান্ধী দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। ইন্দিরা গান্ধী কেবল জয়প্রকাশজীকেই, নয় দেশের সমস্ত বিরোধী নেতাকেও গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে দেন। ‘নবনির্মাণ সমিতি’ কলকাতায় ‘জনসংঘর্ষ সমিতি’র নাম নিয়ে আন্দোলন শুরু করে দেয়। এদিকে জনগণ এখনও কংগ্রেসের সুকুমার ব্যানার্জি সঙ্গেই আছে, এই বিশ্বাসে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৭ সালে ১৮ জানুয়ারি লোকসভার নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেন। তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল যে বিক্ষিপ্ত ও বিভাজিত প্রতিপক্ষ তাঁর ক্ষমতার মোকাবিলা করতে পারবে না। লোকসভা নির্বাচনের ঘোষণার পর বিরোধী নেতাদের কারামুক্ত করা হতে থাকে। জয়প্রকাশজীর নেতৃত্বে ১৯৭৭সালের লোকসভা নির্বাচন লড়ার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়। ভারতীয় লোকদল, জনসঙ্ঘ, সমাজবাদী পার্টি, পরে বাবু জগজীবন রাম এবং হেমবতীনন্দন বহুগুণার দলও একত্রিত হয়ে লোকসভায় লড়ার জন্য প্রস্তুত হন। ভোটে ইন্দিরা সরকারের পতন হয়। ইন্দিরা সরকারের পতন ঘটিয়ে নতুন সরকার গঠিত হয় ১৯৭৭ সালের ২৭ মার্চ। তার আগেই সমস্ত দল মিলিত হয়ে ‘জনতা পার্টি’ গঠন করে। চন্দ্রশেখরজী সভাপতি হন। সব দল মিলে প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাইয়ের নেতৃত্বে জনতা পার্টির সরকারের হাতে ভারতের দায়িত্ব তুলে দেয়।
জনতা পার্টি ও সরকারের মধ্যে দ্বৈত সদস্য পদের অভিযোগে দলের মধ্যে ভাঙনের আভাস দেখা যায়। জনসঙ্ঘের নেতারা বলেন, আমরা সঙ্ঘের স্বয়ংসেবক আছি ও থাকবো। জনতা সরকার ভেঙে যায়। অবশেষে ১৯৮০ সালের ৬ এপ্রিল সকলের চিন্তার ফলস্বরূপ ভারতীয় জনতা পার্টি নামে সর্বসম্মতিক্রমে একটি নতুন দলের আবির্ভাব ঘটে। ওই সভায় ভারতীয় জনতা পার্টির সভাপতি হন অটলবিহারী বাজপেয়ী। লালকৃষ্ণ আদবাণী, সিকন্দর বখত ও সুরজ ভানকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই দিন সভায় উপস্থিত সমস্ত সদস্য ভারতীয় জনতা পার্টির সদস্যরূপে পরিগণিত হন। অটলজী প্রদেশ ভ্রমণে কলকাতায় আসেন। মহাজাতি সদনে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রথম সভাপতির প্রথম সভা অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। সভায় অটলজী অধ্যাপক হরিপদ ভারতীকে পশ্চিমবঙ্গের সভাপতি রূপে ঘোষণা করেন। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি মাত্র দুটি আসন পেলেও ১১ শতাংশ ভোট পায়। সেই ভারতীয় জনতা পার্টি আজ দেশের শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত।


ত্রিপুরার শ্রমিক কর্মচারীদের নতুন দিশা দেখাচ্ছে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ
সেন্টু রঞ্জন চক্রবর্তী
পার্বত্য রাজ্য ত্রিপুরায় সরকারি, বেসরকারি ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের কার্যকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে দেশাত্মবোধের চেতনার কারণে ফিরতে চলেছে সুসংহত কর্মসংস্কৃতি ও শৃঙ্খলা। অতীতের সকল সংকীর্ণতার বেড়াজাল হতে বেরিয়ে এসে প্রাণচঞ্চল হতে চলেছে শ্রেষ্ঠ ত্রিপুরা গঠনের কাজ। কংগ্রেস ও সিপিআইএম-এর ফেলে যাওয়া আদর্শহীন কর্মসংস্কৃতি চিরতরে বিসর্জন দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ‘ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ (বিএমএস)’। নতুন নেতৃত্বের দক্ষতা, উৎকর্ষতা, দেশাত্মবোধ এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা এই সফলতার মূল নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করছে এখানে। সর্বত্র ফিরে আসতে চলেছে সাবলীল কর্মসংস্কৃতি। সাম্প্রতিক সময়ে এই বিশাল পরিবর্তনের পেছনে যে কর্মযজ্ঞ কাজ করেছে তার জন্য ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের প্রেসিডেন্ট এবং তাঁর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি প্রশংসার দাবিদার। দীর্ঘদিনের অনেক চড়াই উৎরাই ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সংগঠন এগিয়ে চলেছে সুচারুরূপে। এক্ষেত্রে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা স্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। তৃণমূল পর্যায় হতে নতুন নেতৃত্ব তুলে এনে গঠিত হয়েছে একটি আদর্শ সংগঠন।
আসলে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার সংগ্রামে দত্তোপন্ত ঠেংড়ীজী যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা বাস্তবায়নে ত্রিপুরা বিএমএস বড়ো অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এখন সক্ষম। ১৯৫৫ সালের ২৩ জুলাইয়ে রোপিত বীজ বিশাল মহীরুহের আকার ধারণ করেছে। আজ শুধু সারা ভারতেই নয় সেটা এখন বিশ্ব শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ভারতের শিক্ষা, সংস্কৃতি, গবেষণা ধর্ম-দর্শন, সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের আবিশ্ব স্বীকৃতি আজকে ভারতবাসীকে সম্মানিত করেছে। শ্রমিকদের মধ্যে মতবাদের ভিন্নতা এতদিন আমাদের শুধু পিছিয়েই রাখেনি এগিয়ে যাওয়ার অনেক সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ এরূপ একটি সমস্যা হতে বের হয়ে এখন অনেক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। যে সকল কর্মকর্তা, কর্মচারী সংগঠিত ও অসংগঠিত পর্যায়ে থেকে ভারত নির্মাণে এতদিন কাজ করে যাচ্ছিলেন তাঁদের রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। সম্প্রতি কার্যকর্তা কর্মচারীদের রাজনীতি করার অধিকার প্রদানের মাধ্যমে বিএমএস-এর সফলতা একটি নতুন মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত হলো। ভারতীয় অর্থনীতিতে বিএমএস-এর অবদান এখন সূর্য উঠার মতো সত্য। শক্তিশালী হচ্ছে দেশ, বার্তা যাচ্ছে বিদেশেও।
১৯৫৫ সালে দত্তোপন্ত ঠেংড়ীজীর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব, আদর্শিক স্বপ্ন ও নির্দেশনায় গঠিত ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ আজকে ভারত নির্মাণের এক কারিগর। একজন চিন্তাবিদ ও বুদ্ধিজীবী, যিনি আত্মত্যাগের মহৎ নীতি গ্রহণ করে তাঁর সমগ্র জীবনকে সামাজিক কাজের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। সংগঠনের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার জন্য তিনি যে কয়জন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কর্মী সংগ্রহ করে দিয়ে গেছিলেন তাদের শিক্ষা ও দীক্ষায় ব্রতী হয়ে আজকের দিনে ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের প্রতিটি কার্যকর্তা এবং সদস্য ভারত নির্মাণে নিরলস, অগ্রণী সৈনিকের মতো ভূমিকা রেখে চলেছেন। ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ ত্রিপুরা প্রদেশ কমিটিও আজকে তার ব্যতিক্রম নয়। ত্রিপুরার প্রত্যন্ত এলাকা হতে নতুন নতুন আত্মত্যাগী কর্মী তুলে এনে ত্রিপুরার মজদুর সঙ্ঘকে রূপান্তরিত করা হয়েছে এক শক্তিশালী ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের ত্রিপুরা প্রদেশ কমিটি হিসেবে। এই দুরূহ কাজটি সম্পাদনে প্রদেশ কমিটির সভাপতির নিরলস চেষ্টা ও সততা একটি অনুকরণীয় উদাহরণ। বর্তমানে ত্রিপুরার সকল সেক্টরে গড়ে উঠেছে সেক্টর ভিত্তিক ইউনিয়ন। গত ৩০ নভেম্বর ও ০১ ডিসেম্বর দু’দিন ব্যাপী ১৫তম রাজ্য কার্যকরী প্রদেশ সমিতির একটি সভা ধলাই জেলার পিআরটিআই হলে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় উপস্থিত ছিলেন সর্বভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের সহ-সংগঠন মন্ত্রী এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রভারগণেশ মিশ্র। তিনি প্রত্যক্ষ করে গেছেন ত্রিপুরা প্রদেশ কমিটির অভূতপূর্ব সফলতা। মিশ্রজীর দক্ষ নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় চলে আসা মজদুর সঙ্ঘ ত্রিপুরা প্রদেশ কমিটি আজকে একটি শক্তিশালী রূপ ধারণ করেছে


দুর্গত মানুষের সেবায় বাস্তুহারা সহায়তা সমিতি
জীবনময় বসু
বাস্তুহারা সহায়তা সমিতির কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ১৯৫১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি শ্রীগুরুজীর নির্দেশে। সেই সময়ে কলকাতার বিখ্যাত ব্যারিস্টার রণদেব চৌধুরী সভাপতি এবং অমল কুমার বসু- সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মোট ১৫ জনের এক কর্মসমিতি গঠিত হয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের তৎকালীন ক্ষেত্র প্রচারক একনাথজী রাণাডে বাস্তুহারার কাজকে কেন্দ্রীভূত ভাবে পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে কলকাতায় আসেন ও কাজ শুরু করেন। যদিও দেশ ভাগের দুঃখ, ক্লেশ ও যন্ত্রণা লাঘব করার লক্ষ্য নিয়ে উদ্বাস্তুদের মধ্যে সেবাকাজ শুরু হয়। Ra ১৯৫০-এর শুরু থেকেই ধারাবাহিক ভাবে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত প্রায় ৪৫ লক্ষ উদ্বাস্তুর মধ্যে ত্রাণ বিলি, তাঁদের থাকার ব্যবস্থা, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা, চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার কাজ স্বয়ংসেবকরা সুচারু রূপে সম্পন্ন করেন। ১৮ মাসের সেবাকাজের বিবরণ ও আয়-ব্যয়ের হিসেব অডিটরের স্বাক্ষর-সহ কেন্দ্রীয় কার্যকারিণীর বৈঠকে পেশ করা হয়।
১৯৪৯ সালের শেষার্ধে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু বিতাড়ন কাণ্ডে লক্ষাধিক হিন্দু সর্বস্বান্ত হন। কোনোরকমে যারা ভারতে পৌঁছন তাঁদেরই উদ্বাস্তু আখ্যা দেওয়া হয়। অসহায় উদ্বাস্তু হিন্দুদের সেবার নিমিত্ত অনেক সহায়তা সমিতি গঠিত হয়। স্বদেশ থেকে হিন্দু বিতাড়নের কারণে ভারতবাসীর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ক্রোধ বাড়তে থাকে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সমস্ত জনগণ ভারত সরকারের পাশে দাঁড়ায়। পরিণামস্বরূপ নেহরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাকিস্তানের হিন্দুদের ফোলে আসা জমি-সম্পত্তি ব্যবহারের সুযোগ এবং ভারতে পরিত্যক্ত জমিতে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর পুনর্বাসনে উভয় সরকার সহমত হয়। যদিও বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তান ‘নেহরু-লিয়াকত’ চুক্তির শর্তকে মান্যতা দেয়নি। তার কুফল আজও আমরা বহন করে চলেছি। এর শেষ কোথায় এবং তার ফলাফল কী হবে তা বলা কঠিন।
উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজ বাস্তবে সরকার দ্বারাই সম্ভব, কোনো বেসরকারি উদ্যোগে সম্ভব নয়, কারণ তাদের ক্ষমতা সীমিত। বাস্তুহারা সহায়তা সমিতি উদ্বাস্তুদের কাজ, চাকুরি, ব্যবসার জন্য টাইপ রাইটিং, শর্টহ্যান্ড, অ্যাকাউন্টেন্সি ইত্যাদি শেখার ব্যবস্থা ও সাহায্য করে, বিভিন্ন কারখানায় কাজের ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনে, প্রশিক্ষণের সময়ে কিছু আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করে। প্রায় ৬ হাজারের বেশি পরিবার এতে উপকৃত হয়। কালের অমোঘ নিয়মে উদ্বাস্তুরা ভারতে সামাজিক ব্যবস্থায় শামিল হয়ে যান এবং বাস্তুহারা সহায়তা সমিতিও তার সেবা কাজের ধারা বদল করে সামাজিক, অর্থনৈতিক শিক্ষা, সামাজিক উৎপীড়নে স্থানচ্যুতদের পুর্নবাসন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সাহায্য ইত্যাদিতে মনোনিবেশ করে। এছাড়াও সমিতি সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে দুঃস্থ ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ার জন্য আর্থিক সাহায্য, বই কেনার জন্য এককালীন সাহায্য, চক্ষু/স্বাস্থ্য শিবির করা এবং বিনামূল্যে চশমা বিতরণ করার কাজে ব্যাপৃত আছে। এসব কাজে সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থার আর্থিক সহায়তা সমিতির কাজকে আরও সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করছে


সঙ্ঘ শতবর্ষে পঞ্চপরিবর্তনের একটি পরিবার প্রবোধন
সারদা প্রসাদ পাল
একজন স্বয়ংসেবক পূজনীয় সরসঙ্ঘচালকজীকে প্রশ্ন করেছিলেন সঙ্ঘের ও স্বয়ংসেবকদের লক্ষ্য পরমবৈভশালী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন কবে পূর্ণ হবে?
উত্তরে তিনি বলেন অতি শীঘ্রই আমাদের দেশ ভারতবর্ষ পরম বৈভবসম্পন্ন হবে। সেই অবস্থায় পৌঁছতে গেলে হিন্দু সমাজকে তার ধারক হতে হবে। তাই সমাজকে প্রস্তুত করতে হবে। সেই সমাজ তখনই প্রস্তুত হবে যখন সমাজের প্রতিটি পরিবার বর্ধিষ্ণু ও যোগ্যতাসম্পন্ন হবে। এই বিষয়কে মাথায় রেখে শতবর্ষে সঙ্ঘের কার্যকর্তারা পঞ্চ পরিবর্তনের মধ্যে পরিবার প্রবোধনকে রেখেছেন।
বিশ্বের অন্যান্য দর্শন এই বিশ্বকে বাজার হিসেবে দেখলেও হিন্দু দর্শন বিশ্বকে পরিবার হিসেবে মনে করে। আমাদের সমাজের যা কিছু গুণসম্পন্ন বৈশিষ্ট্য আছে তার মধ্যে অন্যতম উত্তম ব্যবস্থা পরিবার পরম্পরা। এই পরিবার ব্যবস্থা কবে থেকে শুরু তার হিসেব করা যাবে না। তবে মহাউপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায় ৭১ থেকে ৭৩ শ্লোকে বলা হয়েছে: অয়ং নিজঃ পরো বেতি গণনা লঘুচেতসাম্।
উদারচরিতানাং তু বসুধৈব কুটুম্বকম্।। পরিবারের আর একটি উদাহরণ শোনা যায়, যম-যমুনার শ্লোকে। সেখানে যম তাঁর বোন যমুনাকে বলছে, এই চরাচরে কোনো নারী পুরুষকে পুরুষ হিসেবে দেখার পরিবর্তে পিতা, পুত্র বা ভ্রাতার দৃষ্টিতে দেখলে অথবা পুরুষ কোনো নারীকে নারী হিসেবে না দেখে নিজের মা বা ভগ্নী হিসেবে দেখলে তাদের সেই দৃষ্টিভঙ্গি পূর্ণতা লাভ করবে। এই উপলব্ধি থেকেই পরিবারের সঙ্গে এবং পরস্পরের মধ্যে একটা সম্বন্ধের সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান যুগে এখনও এই পরিবার ব্যবস্থা এত ভালো আছে যে ব্রিটেনের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার মীরাটের একট পরিবার কয়েকদিন কাটিয়ে গেলেন। তিনি এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে দেশে ফিরে বলেছিলেন, ব্রিটেনের সামাজিক ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ভারতীয় পরিবার ব্যবস্থাকে এখানে চালু করতে হবে।
ভারতে হিন্দুত্বই রাষ্ট্রীয়ত্ব। হিন্দু পরিবার বলশালী হলে সমাজ তথা রাষ্ট্র বলশালী হবে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একটা বন্ধন গড়ে উঠে। বড়োদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং ছোটোদের প্রতি ভালোবাসার যে টান অনুভূত হয় তাতেই বন্ধন আরও দৃঢ় হয়ে উঠে। কবির কথায় বললে এরকম: আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।।
শ্রদ্ধা কেমন হয় তার একটি উদাহরণ তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা। বড়লাট কার্জন বাঙ্গলার বাঘ আশুতোষ মুখার্জিকে ইংল্যান্ডে গিয়ে সরকারের কিছু কাজ করে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে নিজের জন্য একটা ডিগ্রিও নিয়ে আসার অনুরোধ করেছিলেন। স্যার আশুতোষের যাতায়াতের ভার বহন করবে সরকার। আশুতোষবাবু বললেন ঠিক আছে আগে মায়ের অনুমতি পাই তারপর বলব। শুনে কার্জন সাহেব রেগে গিয়ে বলেছিলেন, আপনি কী মনে করেন? আমি ব্রিটিশ-ভারত সরকারের প্রধান, আপনার মা কি আমার থেকেও বড়ো?
উত্তরে আশুতোষবাবু বললেন যে আমার মা আমার কাছে সবার থেকে বড়ো। এমনকী ঈশ্বরের থেকেও। আর ভালোবাসার উদাহরণ- একবার গান্ধীজী টেগোর হিলে গেছিলেন। তিনি টিলার উপর থেকে দেখলেন একটি বাচ্চা মেয়ে একটি শিশুকে নিয়ে টিলার উপরে চড়ছে। শিশুটির চেহারা মেয়েটির থেকে অনেক ভারী। উপরে উঠতে মেয়েটির বেশ কষ্ট হচ্ছে। উপরে ওঠার পর মেয়েটিকে গান্ধীজী জিজ্ঞাসা করলেন, কি কষ্ট হলো তো? মেয়েটি একগাল হেসে বলল, কষ্ট হবে কেন? এতো আমার নিজের ভাই। যেহেতু নিজের ভাই তাই কষ্ট হয় না। নিজের ভাই হলো আদরের।
সমাজ পরিবর্তনের আগে নিজের পরিবারে এই ভাব আনতে হবে। বর্তমানে পরিবারের সদস্যরা বিশ্বের নানা প্রান্তে থাকে। তাদের সঙ্গে সবসময় কথা হয় না, দেখাসাক্ষাৎ হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সকল সদস্য প্রত্যেকে ভালোবাসার টানে বাধা থাকে। সেই ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেদের মধ্যে কথাবার্তার সময় মাতৃভাষায় কথা বলা, বছরে একবার একজায়গায় জড়ো হওয়া, কুলদেবী দর্শন করতে যাওয়া। এই কারণে অষ্টাঙ্গ মার্গের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে-যেমন, ভূত, ভবিষ্যৎ, ভাষা ভূষা, ভজন-ভোজন, ভবন-ভ্রমণ।
নিজের পরিবারকে সামাজিক ভেদাভেদের উর্ধ্বে তোলার জন্য সমাজের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করতে হবে। মুক্তসমাজ তৈরি করতে হলে নিজের পরিবারকে সর্বপ্রথম সেই মন্ত্রে দীক্ষিত করতে হবে। যাদের সাহায্যে প্রতিদিন আমাদের দিনানিপাত হয় অর্থাৎ সেই সাফাই কর্মী, যারা চুল কাটে, যারা কাপড় কেচে দেয়, জুতা সেলাই করে দেয়, আমাদের পোশাক ইস্ত্রি করে দেয়, তাদের নিজের বাড়িতে ডেকে পরিবারের সবার সঙ্গে সহভোজ করা প্রয়োজন।
সঙ্ঘের তৃতীয় সরসঙ্ঘচালক পূজনীয় বালাসাহেবজী বলতেন অস্পৃশ্যতা যদি পাপ না হয় তবে পৃথিবীতে আর কোনো পাপ নেই। তিনি এটা শুধু কথার কথা বলেননি। নিজের পরিবারে এটি প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে অস্পৃশ্যতা মুক্ত পরিবারের সদস্য হিসেবে গর্ব অনুভব করতেন।
পাশ্চাত্য দর্শন বলে সমাজ Maximum Good of Maximum People-এর কথা। কিন্তু আমরা Maximum-এ বিশ্বাসী নয়। বিশ্বাসী সর্বে। তাই বলি সর্বে সন্তু নিরাময়ের কথা। এই ব্যবস্থা আমাদের সমাজে চালু ছিল। তাই যারা ভিক্ষা করতে বাড়িতে আসে তাদের বলি ভিক্ষা নয়, আদায়ে এসেছে। পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যের হাত দিয়ে তার কাছে সাহায্য পাঠাই যাতে সমাজের জন্য কিছু করার ভাব ছোট্ট সদস্যের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। শতবর্ষে সঙ্ঘ চায় স্বয়ংসেবক এবং তার পরিবারের মাধ্যমে এই সংস্কারের বিস্তৃতি হোক। তবেই পরিবার যোগ্যতায় উত্তীর্ণ হবে। আমাদের দেশ পরমবৈভবশালী হবে।
‘মা’কে কেন্দ্র করে আমাদের পরিবার ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। যতই হিন্দু বিরোধীরা বলুক যে হিন্দু সমাজব্যবস্থায় মেয়েদের কোনো সম্মান ছিল না তাঁদের কোনো বিশেষ ভূমিকা ছিল না, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে তাঁরাই সংসার প্রতিপালনে মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করতেন। মা কেমন ছিলেন? একটা উদাহরণ দিই। সবাই এখন একটা শব্দের সঙ্গে খুব পরিচিত, সেটা AI অর্থাৎ Artificial Intelligence। পরিবারে মা হলেন N.I. Natural Intelli-gence অর্থাৎ শুধু সন্তানেরা নয় পরিবারের কার কী অসুবিধা সেটা খাবার হোক বা অন্য কিছু, সমস্ত বিষয়ে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে। তারা কিছু বলার আগেই সমস্যার সমাধান করে দেন তাঁরা। সেই জন্য আমাদের পরিবারের মধ্যে একটা বন্ধন তৈরি হয় ‘মা’কে কেন্দ্র করে।
পারিবারিক স্তরে চেতনা জাগরণের আবশ্যক সিঁড়ি হলো পরিবার প্রবোধন। ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সর্বাধিক গুরত্বপূর্ণ ব্যবস্থা হলো পরিবার ব্যবস্থা। সমাজের ক্ষুদ্রতম স্বরূপ পরিবারে অনুভব করা যায়। বলা হয় সংস্কার প্রদানের প্রথম পাঠশালা হলো পরিবার।
১. সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন একসঙ্গে ভোজন করা।
২. মাসে অন্তত ১/২ বার পরিবার-সহ নিকটবর্তী মন্দিরে যাওয়া।
৩. মাসে একবার পারিবারিক বৈঠকের আয়োজন করা।
৪. পরিবারের পরম্পরা জানা।
৫. অন্তত পাঁচ পূর্বপুরুষের পরিচয় জানা।
৬. ভোজনের সময়ে ইলেক্ট্রনিক্স উপকরণ ব্যবহার না করা।
৭. সপ্তাহে অন্তত একদিন বাড়িতে পূজাঘরে একসঙ্গে উপস্থিত হওয়া।
৮. সপ্তাহে অন্তত একদিন শিশুদের সঙ্গে মহাপুরুষ জীবনী আলোচনা করা।
৯. পরিবারের সকলে একসঙ্গে গীতাপাঠ করা বা ভজন করা বা সুভাষিত (শ্লোক) বলা।
১০. ইলেক্ট্রনিক্স উপকরণ, দূরদর্শন, দূরভাষ, কম্পিউটারের ব্যবহার না করে সপ্তাহে ১/২ ঘণ্টা একসঙ্গে বসে গল্প করা।
১১. নিজের বংশের ব্যক্তির দ্বারা কৃত ভালো কাজের আলোচনা করা।

READ ALSO

29th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

29th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

October 8, 2025
15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

September 23, 2025
ShareTweetShare

Related Posts

29th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

29th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

October 8, 2025
15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

September 23, 2025
15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

September 23, 2025
15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

September 23, 2025
15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

September 23, 2025
15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
প্রচ্ছদ নিবন্ধ

15th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ

September 23, 2025

POPULAR NEWS

4th September 2023 Rajjopat

4th September 2023 Rajjopat

September 21, 2023
৩৫০ বছর পর দেশে ফিরছে শিবাজীর বাঘনখ

৩৫০ বছর পর দেশে ফিরছে শিবাজীর বাঘনখ

October 2, 2023
কেশব ভবনে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী হানা

কেশব ভবনে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী হানা

October 4, 2023
4th September Angana

4th September Angana

September 21, 2023
2nd October 2023 Parampara

2nd October 2023 Parampara

October 1, 2023

EDITOR'S PICK

18th September Angana

18th September Angana

September 21, 2023
18th September Biswamitraer Kalam

18th September Biswamitraer Kalam

September 21, 2023
21th July বিশেষ নিবন্ধ

21th July বিশেষ নিবন্ধ

July 23, 2025
12th May উত্তর সম্পাদকীয়

12th May উত্তর সম্পাদকীয়

May 12, 2025

About

Follow us

Categories

  • Uncategorized
  • অতিথি কলম
  • উত্তর সম্পাদকীয়
  • পরম্পরা
  • প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • বিশেষ নিবন্ধ
  • বিশ্বামিত্রের কলম
  • রাজ্যপাট
  • সঙ্ঘবার্তা
  • সম্পাদকীয়
  • সুন্দর মৌলিকের চিঠি

Recent Posts

  • 29th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • 29th September পরম্পরা
  • 29th September পরম্পরা
  • 29th September পরম্পরা

© 2023 Swastika. All rights reserved.

No Result
View All Result
  • হোম
  • সম্পাদকীয়
  • রাজ্যপাট
  • সুন্দর মৌলিকের চিঠি
  • অতিথি কলম
  • বিশ্বামিত্রের কলম
  • উত্তর সম্পাদকীয়
  • প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • পরম্পরা
  • ই -পত্রিকা

© 2023 Swastika. All rights reserved.

Welcome Back!

Login to your account below

Forgotten Password?

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In

Add New Playlist

Are you sure want to unlock this post?
Unlock left : 0
Are you sure want to cancel subscription?