সুগভীর চক্রান্ত
বৈদেশিক আক্রমণকারীরা ভারতবর্ষে শাসন কায়েম করিয়াছিল ছলে-বলে-কৌশলে। আরব মরুদস্যুরা সম্মুখ সমরে না পারিয়া লোভ প্রদর্শন ও ছলনার আশ্রয় লইয়াছিল। চতুর ইংরাজরা তো নীতিই গ্রহণ করিয়াছিল ডিভাইড অ্যান্ড রুল। ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড কমিউনাল অ্যাওয়ার্ড বা সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতি প্রণয়ন করেন। ইহার উদ্দেশ্য হইল ভারতীয় সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করিয়া এই দেশে ইংরাজ শাসনের ভিত্তি মজবুত করা। এই নীতির মাধ্যমে তাহারা ভারতবাসীকে সংখ্যালঘু, বর্ণহিন্দু এবং অনগ্রসর হিন্দু – এই তিনটি ভাগে বিভক্ত করিয়া আইন সভায় পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। ইহারই পরিণামে কালক্রমে ধর্ম-ভাষা, সম্প্রদায় ও জাতপাতে দীর্ণ হইয়া পড়ে ভারত এবং দেশ বিভাজনের পথ প্রশস্ত হয়। বস্তুত, বলা যাইতে পারে, ভারতে জাতিগত সংরক্ষণের বীজ ঔপনিবেশিক কালেই প্রোথিত হইয়াছে। স্বাধীন ভারতেও কেন্দ্র সরকার এমনকী রাজ্য সরকারগুলিও এই বিভেদনীতির ঊর্ধ্বে উঠিতে পারে নাই। সংবিধান প্রণেতাগণ ভারতীয় সমাজের বঞ্চিত ও পিছিয়েপড়া দরিদ্র মানুষদিগের জন্যই সংবিধানে সাময়িককালের নিমিত্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখিয়াছিলেন। তাঁহারা ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা না করিয়া বর্ণের ভিত্তিতে করিয়াছিলেন। ধর্মানুযায়ী সংরক্ষণের পক্ষপাতী ছিলেন না গণপরিষদের
সদস্যরাও। তাহা সত্ত্বেও কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশের ন্যায় কয়েকটি রাজ্য ধর্মভিত্তিক সংরক্ষণ প্রয়োগ করিয়াছে। স্বাধীনতার পূর্বে সৈয়দ আহমদ খানের ন্যায় নেতাও এই ধরনের সংরক্ষণের পক্ষ অবলম্বন করিয়াছিলেন। সংবিধান প্রণেতাগণ আশা করিয়াছিলেন, সামাজিক ও আর্থিকভাবে বঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া সমাজের মানুষদিগের উত্থান ঘটিলেই আপনা হইতেই সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সমাপ্ত হইয়া যাইবে। দুঃখের বিষয় হইল, ভোটভিখারি রাজনৈতিক দলগুলি ক্ষমতা ভোগ করিবার উদ্দেশ্যেই এই স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থাটিকে দীর্ঘমেয়াদি রূপ প্রদান করিয়াছে। তাহার কারণেই ভারতীয় সমাজে স্বাধীনতার এত বৎসর পরেও সংহতি প্রতিষ্ঠিত না হইয়া বরং জাতপাতে দীর্ণ হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটিতে ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষণের প্রবক্তা বামফ্রন্ট সরকার। তাহারাই এই রাজ্যে মুসলমানদের ওবিসি শ্রেণীভুক্ত করিয়া সংরক্ষণের আওতায় আনিয়াছে। ভারতীয় সংবিধানে তপশিলি জাতি হিসাবে শুধুমাত্র হিন্দু, বৌদ্ধ ও শিখদিগেরই কথা বলা হইয়াছে। মুসলমান ও খ্রিস্টানদের ইহার আওতায় ফেলা হয় নাই। কারণ ওই দুইটি আব্রাহামিক মজহব ও রিলিজিয়নে বর্ণব্যবস্থা অনুপস্থিত। তাহা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ভোটপ্রাপ্তির আশায় বামেরা তাহাদের ওবিসি তালিকাভুক্ত করিয়াছে। এই গর্হিত কর্মটি করিয়া বিভিন্ন সরকারি সুযোগসুবিধা হইতে তাহারা দরিদ্র হিন্দুদিগকে বঞ্চিত করিয়াছে। ইহার প্রতিবাদে আদালতে জনস্বার্থ মামলা পর্যন্ত হইয়াছিল। আশ্চর্যের বিষয় যে, ২০১১ সালে তৃণমূল দল সরকারে আসিয়া বামফ্রন্ট সরকারের অসাংবিধানিক সংরক্ষণকে আইনি বৈধতা প্রদান করে। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তো প্রকাশ্যেই বলিয়াছেন যে তিনি মুসলমান তোষণ করেন। তিনি মুসলমান সম্প্রদায়কে তাঁহার দুধেলগাই হিসাবেই সম্বোধন করিয়াছেন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, তৃণমূল সরকারের নূতন ওবিসি তালিকায় সংযোজিত ৮৬ শতাংশই মুসলমান সম্প্রদায়ের। আরও আশ্চর্যের বিষয় যে, ইহাতে যে ৭৬টি শ্রেণীকে অন্তর্ভুক্ত করা হইয়াছে তাহার মধ্যে ৬৭টিই মুসলমান সম্প্রদায়ের। এই নূতন ৭৬টি শ্রেণীকে আবার দুইভাগে ভাগ করা হইয়াছে। এ-ভাগে ৫১টি শ্রেণী। ইহার মধ্যে ৪৬টিই মুসলমান সম্প্রদায়। বি-ভাগে ২৫টি শ্রেণী। ইহার মধ্যে ২১টি মুসলমান সম্প্রদায়। অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হইয়াছেন। সুখের বিষয় যে, সমস্ত দিক পর্যালোচনা করিয়া কলকাতা উচ্চ আদালত গত বৎসর ২০১০ সালের পর বিতরণ করা প্রায় ১২ লক্ষ ওবিসি শংসাপত্র বাতিল বলিয়া ঘোষণা করিয়াছে। যাহার অধিকাংশই
মুসলমান সম্প্রদায়ের। পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সমাজ রাজ্য সরকারের এই সুগভীর চক্রান্তটি অনুধাবন করিতে না পারিলে, তাহাদিগের কপালে দুঃখ ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট রহিবে না।