নেপালে সেই পুরনো শকুনের থাবা
বিভাজনের ডলার বাহিনীর তাণ্ডব
সেন্টু রঞ্জন চক্রবর্তী
একদম হুবহু বাংলাদেশ স্টাইল। মিলে যাচ্ছে আন্দোলনের কৌশলও। ঠুনকো অজুহাতে ছাত্রাদের ব্যবহার করে, তার সঙ্গে অছাত্রদের যুক্ত করে একতরফা হিংসাত্মক কাজ সংঘটিত করা। বাংলাদেশে কোটা বিরোধী আন্দোলন আর নেপাল সামাজিক মাধ্যমগুলি নিয়ন্ত্রণ করার ইস্যু যাই হোক না কেন লক্ষ্য একটাই সরকারের পতন। সেজন্য টাকা কোনো ব্যাপার নয়। গৌরী সেন ডলার নিয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যুদ্ধবাজ ও মিথ্যাবাদী প্রতারক ট্রাম্প আসলে চাইছে ভারতের চারপাশেই অশান্তি তৈরি হোক। বাংলাদেশে তার পোষা প্রাণী ক্ষমতায় বসেই ভারতের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে বহু গলাবাজি করার পর সমুদ্রসীমা নিয়েও মেতেছিল কিছুদিন। দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে যখন ব্যর্থ তখন গলাবাজিতে একটু টান পড়েছিল। এখন নেপালে অশান্তিকে ঘেউ ঘেউ করতে দেখা যাচ্ছে। পাকিস্তানের এখন পেট ফুলে ফেঁপে প্রাণ যায়-যায় অবস্থা। এর মধ্যে নেপালে অশান্তি তাঁদের জন্য সুখকর সংবাদ দিয়েছে। নাটের গুরু হয়ে সুদূর আমেরিকা থেকে গৌরী সেনের মতো টাকা ঢালছেন ট্রাম্প আর এই অঞ্চলে পোষা প্রাণীগুলি ঘেউ ঘেউ করে কামড়াতে শুরু করেছে। অথচ আমেরিকার নিজের ঘরেই অশান্তির আগুন জ্বলছে। সামলাতে পারছে না কিছুই। ভেবেছিল শুল্কের তুরুপে ভারত কুপোকাত হয়ে যাবে। অবশেষে যখন দেখলো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না, তখন বেহায়ার মতো আগ বাড়িয়ে গা ঝেড়ে নিয়ে কথা বলছেন। ভারত সম্পর্কে তার ধারণাহীনতাই এই জন্য দায়ী। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করে কী লাভ। খেলতে গিয়ে নীচে পড়ে গিয়ে চিমটি কেটে আত্মসুখ নেওয়ার মতো অনেকটা।
দক্ষিণ এশিয়ায় হিমালয় পর্বত অধ্যুষিত একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ নেপাল। এর ভৌগোলিক অবস্থান যেমন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রাজনৈতিকভাবে জটিল। ভারতের উত্তরে এবং চীনের দক্ষিণে অবস্থিত এই ক্ষুদ্র দেশটি বহুদিন ধরেই বড়ো শক্তিগুলোর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। পর্যটন নির্ভর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির এই দেশটি হিন্দু অধ্যুষিত হলেও বর্তমানে ধর্মান্তরের চক্র সেখানে ক্রিয়াশীল থাকায় হিন্দুদের সংখ্যা দিনদিন হ্রাস পাচ্ছে। দেশটিতে রয়েছে হিন্দু সভ্যতার অনেক পুরাকীর্তি। একই সঙ্গে রয়েছে বহু বৌদ্ধ
নিদর্শনও। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে খ্রিস্টানদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে ধর্মান্তরণের কারেণ। যে থাবা বারবার নেপালের উপরে এনজিও বা মানবাধিকার কার্যক্রমের আড়ালে, আবার কখনো জাতিগত বিভাজনকে উসকে দিয়ে। প্রতিটিক্ষেত্রে আগ্রাসী দেশগুলির সেই একই কৌশল। তাঁদের থাবা থেকে বাদ যায়নি
পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মায়ানমার, আফগানিস্তানও।
নেপাল একটি বহু জাতিগোষ্ঠী ও বহু ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠীর দেশ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা দেশীয় এজেন্সিগুলো স্থানীয় জনগণের মধ্যে
বিভাজন তৈরি করে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি উসকে দেয় এবং নানা ‘উন্নয়ন প্রকল্প’-এর আড়ালে জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য বিশাল অঙ্কের ডলার বিনিয়োগ করে দেশকে অচল ও পরনির্ভর করে তোলে। নেপালের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই।
বিশেষ করে জনজাতি অধিকার, পাহাড়-ভিত্তিক ও তরাই-ভিত্তিক বিভেদগুলোকে পুঁজি করে বহু আন্তর্জাতিক এজেন্সি বড়ো অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ
করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে দেশটিকে নিজের কৌশলগত নিয়ন্ত্রণে আনা। নেপালের ভূ-অবস্থানের দিক থেকে একে দক্ষিণ
এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ায় মধ্যকার একটি সেতুবন্ধন হিসেবে দেখা হয়। চীন নেপালের সমর্থন নিয়ে পাকিস্তানকে স্থলপথে যুক্ত করে যে সব সুযোগ-সুবিধার
স্বপ্ন দেখেছিল তা এখন দিবাস্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সেই দহরম মহরম এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। পাকিস্তান যে সুবিধাবাদী এবং বিশ্বাসঘাতকের বংশধর চীন হয়তো সেটা বুঝতে পারছে।
আমেরিকা নেপালে সামাজিক বিনিয়োগের দিকে বিশেষ নজর দিয়ে সেখানকার সামাজিক সংস্কৃতিকে আগে কবজা করে নিয়ে তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে ঋণগ্রস্ত করেছে। এই অস্বাভাবিক ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় গ্রামের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী নেতাদের সকল শর্ত মেনে নিতে বাধ্য করা হয়। তাঁরই অংশ
হিসেবে নেপালে চলতি দশকে ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটেছে আগের যে কোনো সময়ের চাইতে বেশি। নেতারা, পরোক্ষভাবে খ্রিস্টান হতে ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। তাই
গরিব মানুষের বাধ্য হয়ে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে চলেছে। অপরদিকে ভারত নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক একতা ও জনসংখ্যাগত ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখে চলেছে। ভারত অশান্তির বাতাবরণকে ঘৃণা ও বরাবর বর্জন করে থাকে। ইদানীং আমেরিকার সাদা চামড়ার লোকদের নেপালে আগের চাইতে বেশি পরিমাণে যাতায়াত করতে দেখা যাচ্ছে। আর এরই ফসল হলো সাম্প্রতিক অশান্তি ও রক্তপাত। সিআইএ এজেন্টরা যে দেশে গেছে সে দেশেই প্রাণের বিনাশ ঘটিয়েছে। রক্ত ঝরিয়েছে বন্যার মতো। আমেরিকা না চীন এই দুই শক্তির টানাপোড়েনের ফলে নেপালের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, যা দেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের পথে প্রধান বাধা।
নেপালের বহু বিদেশি এনজিও ও ফান্ডিং সংস্থা কাজ করছে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, এদের মূল উদ্দেশ্য মানবাধিকার বা দারিদ্র বিমোচনের আড়ালে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ। এদের দেওয়া আর্থিক অনুদান স্থানীয় সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করছে, ধর্মান্তর কিংবা জনজাতি স্বাধিকারের নামে জাতীয় সংহতির ভিত দুর্বল করছে। এইভাবে বিশাল অঙ্কের ‘ডলার’ বিদেশ থেকে এসে দেশে বিভ্রান্তি ছড়ায়, রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রভাবিত করে এবং রাজনীতির প্রকৃত
প্রতিচ্ছবি বিকৃত করে তোলে।
নেপাল আজ এক নীরব সংগ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। একদিকেল অভ্যন্তরীণ অসঙ্গতি, অন্যদিকে বহিরাগত হস্তক্ষেপ- এই দুই মিলিয়ে দেশটি একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে হাঁটছে, আজ প্রয়োজন একটি স্বাধীন, আত্মনির্ভরশীল এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নেতৃত্ব যারা বিদেশি চক্রান্তেরল জাল ছিন্ন করে নেপালকে একটি স্থিতিশীল ও মর্যাদাপূর্ণ দেশে পরিণত করতে পারে। তবে বিগত এক-দুই দশকে নেপালে আমেরিকার সক্রিয়তা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, যা এখন অনেকেই ‘নতুন উপনিবেশবাদের সূক্ষ্ম রূপ’ বলে উল্লেখ করছেন। দলীয় রাজনীতিতে পরোক্ষ হস্তক্ষেপ- বিশেষ করে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সংখ্যালঘু অধিকার ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ইস্যুতে।
সংবিধান প্রণয়ন, সংখ্যালঘু অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্নে আমেরিকা নেপাল সরকারকে বারবার চাপ প্রয়োগ করছে। নেপালের ‘সেকুলার চরিত্র’ বজায় রাখার নামে হিন্দু রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে আসছে আমেরিকা।
(MCC)- এটি একটি আমেরিকা ভিত্তিক তহবিল, যার মাধ্যমে নেপালকে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অনুদান দেওয়া হয়। প্রকল্পটি বিদ্যুৎ ও সড়ক পরিকাঠামোকে হাতিয়ার করে তার আড়ালে নেপাল জুড়ে নানা কার্যকলাপে মদত দিচ্ছে। আজকাল নেপালে USAID, The Asia Foundation, National Endowment for De- mocracy (NED)-র মতো অনেক মার্কিন সংস্থা সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এই সংস্থাগুলোর বেশিরভাগ প্রকল্প নারীশিক্ষা, স্বাস্থ্য,
শিশু-সুরক্ষা, পরিবেশ বা দরিদ্র্য-দূরীকরণ নিয়ে কাজ করলেও, এসবের আড়ালে তারা তাদের নির্দিষ্ট মতাদর্শগত অ্যাজেন্ডাকে বাস্তবায়ন করে চলেছে। সেখানে খ্রিস্টান মিশনারিদের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে আমেরিকার তহবিলের কারণে। ফলে গ্রামীণ ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মান্তরের হার বেড়েছে- বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে, যেখানে দারিদ্র্য, চিকিৎসার অভাব ও সামাজিক বঞ্চনা রয়েছে। এ বিষয়ে নেপালিদের সমাজে অসন্তোষ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।
এছাড়াও নেপালে সরকারি স্তরে দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সমাজে বেকারত্বে সমস্যা তীব্র হওয়ায় বহু মানুষ ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যম থেকে অর্থ উপার্জন করে থাকেন। নেপালের কমিউনিস্ট প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির সরকার এই অ্যাপগুলিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে সাধারণ মানুষের সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে কাজে লাগায় আমেরিকা-স্থিত আন্তর্জাতিক গুপ্ত প্রশাসন বা গ্লোবাল ডিপ স্টেট।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও নেপাল সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও একাধিক চুক্তি ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছে। গোর্খা সৈন্যদের ইতিহাসকে কাজে লাগিয়ে, আমেরিকা প্রশিক্ষণ ও কৌশলগত সহযোগিতা বাড়াতে চায়, যদিও এখনো নেপালে কোনো মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নেই। নেপাল বহু কারণে অশান্ত হয়ে উঠেছে। তবে, যে কারণটি সবার কাছে স্পষ্ট সেটা হলো পশ্চিমি দুনিয়ার পক্ষ থেকে এই অঞ্চলের শান্তি বিনষ্ট করে দিয়ে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করা এবং ভারতকে ব্যতিব্যস্ত রাখা। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, আমেরিকা উচিত শিক্ষা পেয়েই এই অঞ্চল হতে লেজ গোটাতে বাধ্য হবে।