মুখ্যমন্ত্রী কেন মানছেন না যে চাইলেই ভোটার বা নাগরিক হওয়া যায় না
শিশুসুলভ
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়
বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা। মমতা ব্যানার্জির অস্বস্তি বাড়িয়ে অক্টোবর থেকেই দেশজুড়ে নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ শুরু হতে চলেছে। মমতা
ব্যনার্জি সাতবারের সাংসদ। তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী। চারবারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। অথচ শিশুর মতো মানতে চাইছেন না যে চাইলেই ভারতের নাগরিক বা ভোটার হওয়া যায় না। তার জন্য সাংবিধানিক পদ্ধতি রয়েছে। একটানা ক্ষমতায় থাকলে এক ধরনের রাজনৈতিক বদভ্যাস তৈরি হয় যে সবকিছু মনমতো হতে হবে। নেহরু থেকে মমতার এক ধারা। ক্ষমতায় থাকার শিশুসুলভ লোভ।
সুপ্রিম আদালতের মতে রাজনৈতিক জটিলতা কাটাতে নাগরিকত্ব আর ভোটাধিকার নিয়ে বড়ো ধরনের ঝাড়াই-বাছাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে। বিহারে আধার কার্ডের জাল ব্যবসা এখন তুঙ্গে। আদালতের নথি অনুযায়ী অন্তত ১৪০ শতাংশ কার্ড কোনো প্রমাণ ছাড়াই বিলানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তবর্তী রাজ্য হওয়ায় ভোটার তালিকার সংশোধন অবশ্য প্রয়োজন, বিশেষত পঙ্গপালের মতো রোহিঙ্গা আর অনুপ্রবেশকারী মুসলমানরা যখন এরাজ্যে আশ্রয় নিচ্ছে। এরাই
পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের ভুয়ো আর ভূতুড়ে ভোটব্যাংক। বেআইনি অনুপ্রবেশ ঘিরে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলেও এটা অনস্বীকার্য যে শাসক দলের আশকারা আর মদতেই তারা এই রাজ্যে আশ্রয় পাচ্ছে।
২০০৫ সালে বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জি অনুপ্রবেশকারী আটকাতে যতটা উদ্যোগী ছিলেন ২০ বছর বাদে ভোটের লোভে তাদের বেআইনি জায়গা করে দিতে পশ্চিমবঙ্গে। ঠিক ততটাই আন্তরিক। উদ্ভট ভাবনাকে রাজনৈতিক ডিঙ্গি বানাতে সিদ্ধহস্ত তিনি। তা ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হোক বা অনুপ্রবেশ সমস্যা। ভুয়ো ও ভুতুড়ে ভোটারদের শায়েস্তা করতেই বিশেষ নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন।
মমতা ব্যানার্জির মতো জ্যোতি বসুও কল্পনা করতেন আমৃত্যু তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। অবসর না নেওয়ার আস্ফালন করতেন। ২৩ বছরের মধ্যেই তাঁর
মুখ্যমন্ত্রিত্বের অবসান হয়। জাতীয় নিরাপত্তা বনাম রাজ্যের অধিকারের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়েই মমতা ব্যানার্জি ভোেট জিততে চান। তাই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী মুসলমানদের সাহায্য নেন। বাংলাদেশ থেকে যত পরিমাণে রোহিঙ্গা আর মুসলমান অনুপ্রবেশকারী এরাজ্যে আসছে, তা নিয়ে কিছু বুদ্ধিজীবী অবান্তর বুদ্ধি ব্যয় করেন। এক্ষেত্রে এক আর একশোর মধ্যে যে ফারাক নেই তা তাঁরা বোঝেন না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনুমান, এরাজ্যে আনুমানিক ১ কোটি ৩৮ লক্ষ ভুয়ো ভোটার রয়েছে। এদের না ছেঁটে ২০২৬ সালে ভোট হওয়া বাতুলতা। ভূতুড়ে ভোটার বাঁচিয়ে রেখে ভোট করার অর্থ নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই অবৈধ করে দেওয়া। প্রধানমন্ত্রী নেহরু থেকে মনমোহন সিংহের সময় অবধি নাগরিক বা ভোটার তালিকা নিয়ে সেরকম বড়ো মাপের নাড়াচাড়া হয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পর সেখানে সামরিক সাহায্যে মোল্লাবাদী সরকার চালু হয়
আশির দশক থেকে। তারপর থেকেই চালু হয় বেআইনি আর অবৈধ বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশ। যেমন আফগানিস্তান থেকে কাশ্মীরে, ঠিক তেমন বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে।
অনুপ্রবেশের বেশিরভাগটাই জুড়ে ছিল কেন্দ্রের কংগ্রেস শাসন, ফলে তা আটকানোর চেষ্টা হয়নি। রাজ্যের বাম আমলে অনুপ্রবেশকারীরা ব্যবহৃত হয়েছিল
ভোটস্বার্থে। যেমন এখন করছেন মমতা ব্যানার্জি। বিভিন্ন সময় মোট ১৩বার নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন হয়েছে, তখন কিন্তু মমতা ব্যনার্জি তার বিরোধিতা করেননি। ২০১১-তে প্রথমবার জয়ের পর রাজ্যের ভোটে তৃণমূল দু’বার বেমক্কা জিতে যাওয়ায় অনুপ্রবেশ আর ভুয়ো ভোটারের খেসারত গুনতে হচ্ছে রাজ্যের প্রকৃত ভোটারদের।
তৃণমূল সঠিক অর্থে কোনো রাজনৈতিক দল নয়। একটা পারিবারিক গোষ্ঠী। ফলে বিজেপির মতো একটি প্রকৃত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের মোকাবিলা একটু কঠিন হবে। গত ছয় দশক ধরে কংগ্রেস আর বিদেশি বামেরা রাজ্যটিকে যতটা পিছিয়ে দিয়েছিল, তৃণমূল কেবল সেটাকে ত্বরান্বিত করেছে। নীচের দিকে গড়িয়ে চলা রাজ্যটিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে নিবিড় ভোটার তালিকা সংশোধন করতেই হবে। এটি একটি সাংবিধানিক পদ্ধতি। বিগত তিন দশকে অনুপ্রবেশ আর অভিবাসনের ঠেলায় ইংল্যান্ডের ব্রিটিশরা এখন লন্ডনের বড়ো শহরগুলি থেকে পালিয়ে গ্রামেগঞ্জে বাস করছেন। ভুয়ো ভোটার আর অনুপ্রবেশ রুখতে না পারলে পশ্চিমবঙ্গের সেই দশা হবে। কংগ্রেসের নেতারা সব ত্যাগ করলেও পদত্যাগটা করেন না। ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে হয়। মমতা ব্যানার্জি সেই আঁতুড়ের উপজাত।
(লেখকের মতামত ব্যক্তিগত)