সিঁদুর’-এর বর্ণে তথাকথিত নারীবাদীদের গাত্রদাহ
গত ৭ মে সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পর এমন একটি সংবাদ ভারতবাসী পেল যেটির জন্য তারা প্রায় ১৫ দিন ধরে ছিল প্রতীক্ষারত। সংবাদটি ছিল কয়েকজন ভারতীয় নারীর প্রতি ন্যায়বিচার সংক্রান্ত একটি বিষয়। সন্ত্রাসবাদীরা তাঁদের সিঁথির সিঁদুর মুছে দিয়েছিল। হিন্দু পর্যটকদের নাম ও ধর্ম জিজ্ঞাসা করে, তাঁদের পরিচয় জানার পর তাঁদেরকে হত্যা করে এই সন্ত্রাসবাদীরা তাঁদের স্ত্রীদের সিঁথির সিঁদুর মুছে দেয়। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভারত সরকার। সন্ত্রাসবাদ দমনের ক্ষেত্রে ভারতীয় সেনা অভিযানের নাম রাখা হয়- ‘অপারেশন সিঁদুর’।
ভারতীয় সংস্কৃতিতে সিঁদুরের স্থান অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আদ্যাশক্তি মহামায়া থেকে মা সীতা- সকলের মাধ্যমেই সিঁদুরের শক্তি ও মর্যাদা বার বার প্রকাশিত হয়েছে। সিঁদুর শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় চিহ্ন নয়। সিঁদুর হলো হিন্দু পরিচয়েরও প্রতীক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ যেসময় চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, সেই সময়ও কপালে টিপ পরা থেকে হিন্দু মহিলাদের বিরত রাখা হতো। গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে হিন্দু পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসবাদী আক্রমণে আক্রান্ত একজন মহিলা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, একজন সন্ত্রাসবাদী তাঁকে বলছিল তাঁর কপালের টিপটি খুলে ফেলতে এবং সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলতে। ওই সন্ত্রাসবাদী তাঁকে বলে যে, এটা করলে তাঁর স্বামী বেঁচে যেতে পারেন। এই ঘটনাগুলি থেকে এটা স্পষ্ট
যে, এই সন্ত্রাসবাদীরা যেকোনো প্রক্রিয়ায় ভারতীয় মহিলাদের সিঁথির সিঁদুর মুছে দিতে চায়। তার জন্য সবরকম রাস্তা তারা নিতে পারে।
বিবাহিত পুরুষদের হত্যার অর্থ তাঁদের বিবাহিতা নারীদের সিঁথির সিঁদুর মুছে দেওয়া। কিন্তু এর একটি অন্য দিকও রয়েছে। একজন বিবাহিত পুরুষকে হত্যা মানে একটি প্রজন্মকে পুরো শেষ করে দেওয়া। অসময়ে যাঁদের সিঁথি থেকে সিঁদুর মুছে দেওয়া হয়েছে, বা সন্ত্রাসবাদীরা যাঁদের সিঁথির সিঁদুর মুছে দিয়েছে, একমাত্র সেই মহিলারাই সিঁদুরের মাহাত্ম্য বা গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন। নবরাত্রিতে দেবী দুর্গার পূজায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সিঁদুর খেলা। সিদ্ধিবিনায়ক, বিঘ্নবিনাশক শ্রীগণেশকেও অর্ঘ্য হিসেবে সিঁদুর অর্পণ করা হয়ে থাকে। মহাবীর শ্রীহনুমান তো সিঁদুরে সদা রঞ্জিত হয়ে রয়েছেন। এই বিষয়গুলি থেকে এটি পরিস্ফুট হয় যে, হিন্দুধর্ম ও ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সিঁদুরের গভীর যোগ রয়েছে। এই যোগের বিভিন্ন
আঙ্গিক রয়েছে। এই কারণেই সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাতের ক্ষেত্রে শুরু হওয়া সামরিক অভিযানের নাম রাখা হয়েছে- ‘অপারেশন সিঁদুর’। ভারতীয় সেনা অভিযানের এই নাম রাখার কারণে ভারতবাসী গৌরবান্বিত বোধ করেছে। পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে ঘৃণা, ক্ষোভ ও ক্রোধের আগুনে ফুটছিল গোটা দেশ। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সূত্রপাতের দরুন দেশবাসীর হৃদয়ের দহনজ্বালা যেন একটু প্রশমিত হয়েছে।
কিন্তু এর মধ্যেও এক শ্রেণীর লোক রয়েছে, সিঁদুরে যাদের প্রবল অ্যালার্জি। সামরিক অভিযানের নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’ হওয়ায় তাদের তীব্র আপত্তি। এই নামে তাদের আপত্তির কারণটি উপলব্ধি করা অবশ্য খুব একটা কঠিন কাজ নয়। ভারতীয়দের কাছে সিঁদুর শ্রদ্ধা ও মর্যাদার প্রতীক হলেও ভারতে একটি বড়ো শ্রেণী রয়েছে যাদের কাছে সিঁদুর হলো শোষণের প্রতীক! নাকাব, হিজাব, বোরখা ইত্যাদি হলো তাদের চোখে নারী স্বাধীনতার প্রতীক।
ভারতীয় মহিলারা সিঁদুরের গুরুত্ব সম্বন্ধে জানেন ও বোঝেন। সিঁদুরের মাহাত্ম্যের বিষয়ে তাঁরা সম্যকরূপে অবহিত। সিঁদুর হলো নারীশক্তি, যার পরিচয় সম্প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বকে দিয়েছে ভারত।
এই শ্রেণীর লোকজন তাদের মনে ভারতীয় সত্তা ও হিন্দু পরিচিতির প্রতি ঘৃণাভাব পোষণ করেন। কপালে টিপ বা সিঁথিতে সিঁদুর পরিহিতা ভারতীয় নারীরা তাদের চোখে পিছিয়ে পড়া, অনগ্রসর শ্রেণীভুক্ত। এরা সেই শ্রেণীর লোকজন যাদের উদ্দেশ্য হলো অপপ্রচারের মাধ্যমে সিঁদুর, টিপ ইত্যাদি বিষয়ে হিন্দু নারীদের মনে বিদ্বেষ সৃষ্টি করা।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এর ছবি ও ভিডিয়ো দেশজুড়ে ভাইরাল হওয়া শুরু হতেই এই শ্রেণীর লোকজন সক্রিয় হতে শুরু করে। ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকাগোষ্ঠীর অন্তর্গত ‘ফ্রন্টলাইন’ পত্রিকার সম্পাদিকা বৈষ্ণা রায় এর নেতৃত্ব দেন। সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’-এ একটি পোস্ট লেখেন। এক্স হ্যান্ডলে এই পোস্ট করার পরেই তিনি তার প্রোফাইলটিকে ‘প্রোটেক্টেড’ করে দেন, যাতে তার পরিচিতজন ব্যতীত বাকি সবাই এই পোস্টটিকে দেখতে না পারেন। কিন্তু ততক্ষণে সেই পোস্টের স্ক্রিনশট সামাজিক মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এই পোস্টটিতে তিনি লেখেন, “বিচারধারার দিক থেকে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর নামকরণের আমি বিরোধিতা করছি। এই নামটি পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিচায়ক। নারীদের সম্মান ও অধিকারের উপর সরাসরি আঘাত। মেয়েদের পবিত্রতা রক্ষা, বিবাহবন্ধনকে পবিত্র করে তোলার মতো বিভ্রান্তিকর বিষয় এই নামটির মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে।” তার এই পোস্টটির প্রতিবাদে সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভে ফেটে পড়েন অনেকেই। সামাজিক মাধ্যমে একজন এই পোস্টের প্রত্যুত্তরে লেখেন, ‘সিঁদুর হলো শক্তির প্রতীক। নারীশক্তির প্রতীক হলো সিঁদুর।’
ইনি হলেন সেই বৈষ্ণা রায়, যার কাছে হিজাবের প্রতি আরোপিত নিষেধাজ্ঞা ছিল একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা। বর্তমানে বৈষ্ণা রায় একা নন যার ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামকরণে বা ‘সিঁদুর’ শব্দে আপত্তি রয়েছে। বহু তথাকথিত লেখক ও প্রাবন্ধিকও ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামটির বিরোধিতা করতে থাকেন। তাদের বক্তব্য হলো, “মহিলাদের শোষণের প্রতীক হলো সিঁদুর। এই চিহ্নটি প্রতিনিয়ত মহিলাদের মনে করিয়ে দেয় যে তারা কোনো একজনের অধীনস্থ, কোনো একটি শিকলে বাঁধা রয়েছে তারা। এই কারণে সামরিক অভিযানের নাম ‘সিঁদুর’ রাখা কখনোই উচিত হয়নি।”
‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের দল ‘ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা’র সাংসদ মহুয়া মাজীরও প্রবল সমস্যা। তিনি বললেন, “যাঁদের স্বামীদের হত্যা করা হয়েছিল, সেই মহিলাদের জন্য এই নামটি বেছে নেওয়া হয়েছে। এই অভিযানের নাম অন্য কিছুও রাখা যেত। তিন বাহিনীকে যখন তাদের লক্ষ্য ও সময় নির্ধারণের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, সেই সময়ে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামকরণ করলেন প্রধানমন্ত্রী। তাই এই নামের সঙ্গে রাজনীতি জড়িত রয়েছে।’ অন্য একজন মহিলা এক্স হ্যান্ডলে লেখেন, ‘এটা ঠিক যে এটি হলো সিঁদুর, এটা ঠিক যে ইনিই হলেন ভারতমাতা,
যাঁর রক্ষা মানুষকে করতে হবে অন্য লোকজনের থেকে; যতক্ষণ না যুদ্ধের কবল থেকে দেশের মানুষ, বিশেষত নারী ও শিশুদের রক্ষার ব্যাপার আসছে।’
সামরিক অভিযানের নাম ‘অপারেশন সিঁদুর’ রাখার ফলে ভারতের এই তথাকথিত নারীবাদীরা অস্থির ও বিরক্ত। এমতাবস্থায় পাকিস্তানের বহু মুসলমান মহিলাও ‘সিঁদুর’ নামকরণের দরুন মানসিক ব্যথায় জর্জরিত ও বিপর্যস্ত। সামাজিক মাধ্যমে দেখা গেল তাদের উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ। জোহা নামক একজন মহিলা লিখলেন, ‘যদি কেউ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে ভাবে তবে বুঝবে যে, অপারেশন সিঁদুর হলো ভয়ানক ও মানসিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। এই উপমহাদেশের মালিক হিসেবে তাকে মানতে হবে বলে দাবি করে থাকে হিন্দুত্ব বিচারধারা। এই বিষয়ে বিচারাধারাটি ভীষণ আবেগপ্রবণ এবং এই নামকরণটিও মোটেই কাকতালীয় নয়। এই চিন্তাধারাটি নারীবিদ্বেষী।’ সবহত জকারিয়া নামক আরেক জন পাকিস্তানি লেখেন, “এই ধরনের ধর্মীয় চিন্তাধারা আধারিত ও হঠকারী নাম কেন? অর্থাৎ, ‘সিঁদুর’ নামকরণের কারণ কী?”
সামাজিক মাধ্যমে এই ধরনের মন্তব্যগুলি থেকে স্পষ্ট যে, ভারত থেকে শুরু করে পাকিস্তানের তথাকথিত নারীবাদীরা হঠাৎই ‘সিঁদুর’ শব্দটির তুমুল বিরোধিতা শুরু করে দিয়েছেন।
‘অপারেশন সিঁদুর’ নামকরণের দরুন আরেকজন তথাকথিত নারীবাদী যখন প্রায় কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছেন, সেই সময় এর বিপ্রতীপে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর সম্পূর্ণ তথ্য ও বিবরণ সংবাদমাধ্যমের সামনে তুলে ধরলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল সোফিয়া কুরেশি ও বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিংহ। এই দু’জন মহিলা সেনা আধিকারিকের মাধ্যমে ভারত সরকার পাঠালো সিঁদুরের গুরুত্ব সম্পর্কিত বার্তা। ভারতীয় মহিলারা সিঁদুরের গুরুত্ব সম্বন্ধে জানেন ও বোঝেন। সিঁদুরের মাহাত্ম্যের বিষয়ে তাঁরা সম্যকরূপে অবহিত। সিঁদুর হলো নারীশক্তি, যার পরিচয় সম্প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বকে দিয়েছে ভারত |