হিন্দু সাম্রাজ্য দিনোৎসব-বর্তমান প্রেক্ষাপট
ডাঃ শিবাজী ভট্টাচার্য
ভারতবর্ষের গৌরবোজ্জ্বল সুপ্রাচীন ইতিহাসের ধারা হঠাৎ যেন থমকে গেল, সনাতন ধর্ম আধারিত ভারতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতা অকস্মাৎ যেন পথ হারাল ঘনকালো কুয়াশার আবর্তে। ৬৬৪ খ্রিস্টাব্দ। বর্বর, রক্ত পিপাসু, লুণ্ঠনকারী মুসলমান আরবেরা কাবুলে পৌঁছায়। আরব সেনাপতি সুহল্লার ভারতবর্ষে হামলা চালিয়ে মূলতান পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সেই শুরু। ভারতের ভাগ্যাকাশে ঘনিয়ে উঠল কালো মেঘের ঘনঘটা। যদিও প্রায় আশি বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর হিন্দু বীরেরা সিন্ধুদেশ পর্যন্ত ধাবমান আরব দস্যুদের প্রতিহত করে হটিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু দশম শতকের শেষ অবধি আগ্রাসী মুসলমান আক্রমণকারীদের সঙ্গে হিন্দু রাজাদের ঘোর সংঘর্ষ লেগে
যেত মাঝে মাঝেই। তারপর ১০০১ থেকে ১০২৪ সাল পর্যন্ত গজনির সুলতান মামুদ একাই ভারতবর্ষ আক্রমণ ও লুণ্ঠন করেছে মোট ১২ বার। কত মঠ, মন্দির, জনপদ যে ধ্বংস হয়েছে তা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। গুজরাটের বিশাল সোমনাথ মন্দিরও ধ্বংস হয় মামুদের বারবার আক্রমণে।
তারপর সময় যত এগিয়েছে ভারতবর্ষের তথা হিন্দুদের পরাধীনতার শৃঙ্খল তত ভারী হয়েছে। একে একে গজনভি বংশ (৯৯৯-১১৫২), ঘুরবংশ (১১৫২-১২০৬), দিল্লির দাস রাজারা (১২০৬-১২৮৮), খিলজি বংশ (১২৮৮-১৩২১), তুঘলক বংশ
(১৩২১-১৪১৪), সৈয়দ শাসন
(১৪১৪-১৪৫০), লোদি বংশ
(১৪৫০-১৫২৬) বিভিন্নভাবে হিন্দুদের
পদানত করে ভারতবর্ষের নানা অংশ শাসন করেছে, করেছে শোষণ। মুসলমান শাসকদের অত্যাচার আর লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে হিন্দু রাজারা স্থানে স্থানে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও সামগ্রিক ভাবে সুসংহত ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ না থাকায় মধ্যযুগীয় বর্বর শাসন ভারতবর্ষের উপর উত্তরোত্তর জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসল। হিন্দু চেতনা তথা রাষ্ট্রভাবনা ও দেশাত্মবোধ উত্তরোত্তর ক্ষয়িষ্ণু হয়েই চলল। এল মুঘল শাসন। তৈমুরলঙের বংশধর বাবর পাণিপথের প্রথম যুদ্ধ (১৫২৬) ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে দিল্লি ও আগ্রা দখল করে। শুরু হলো হিন্দুদের সর্বনাশের আর এক অধ্যায়।
পরপর মুঘল শাসকদের অত্যাচারে হিন্দু সংস্কৃতি, দেশীয় শ্রদ্ধাস্থলগুলি ক্রমশ কোণঠাসা ও ভুলুণ্ঠিত হতেই থাকল। ছলে-বলে-কৌশলে হিন্দু রাজত্ব লুণ্ঠন ও আত্মসাৎ, হিন্দু নারীর অসম্মান, হিন্দু ধর্মাচরণে বাধা এবং হিন্দুদের ইসালামে ধমান্তরিত করা- এই ছিল মুঘল শাসকদের প্রাথমিক লক্ষ্য। কোরান ও তরবারির মাঝখানে পড়ে স্বধর্ম রক্ষায় কত হিন্দু বীর যে প্রাণ দিয়েছেন, মুসলমান শাসকদের লোলুপ দৃষ্টিতে ও স্পর্শ থেকে বাঁচতে যে কত হিন্দু রমণী জহরব্রত পালনে আত্মাহুতি দিয়েছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যখন আত্মবিস্মৃত বহু হিন্দু বীর নিজ দেশ ও ধর্মের প্রতি দায়িত্ব পালনে পরাম্মুখ হয়ে মুসলমান মুঘল শাসকদের বেতনভুক সেনাপতি বা আমির ওমরাহ হয়ে ‘দিল্লিশ্বরো বা জগদীশ্বরো বা’ মেনে নিয়েছেন, তখন ভারতবর্ষের পশ্চিমতট মহারাষ্ট্র প্রদেশে এক বীর মহাপুরুষের জন্ম হয়। (১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৬৩০)।
হাজার বছরের পরাধীনতা ও আত্মবিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে হিন্দুজাতি তথা ভারতবর্ষকে আবার স্বাধীনতার আলো দেখাতে ও আত্মশক্তির পুনঃস্থাপনে উজ্জীবিত করতে যে বীর আবির্ভূত হলেন- তিনি হিন্দুকুলগৌরব ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ। হাজার বছর ধরে ক্রমাগত মুসলমান শাসকদের নানাবিধ অত্যাচার ও যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে যে দেশ খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত, সেই রাজনৈতিক অবক্ষয়ী প্রেক্ষাপটে শিবাজীর ভাবনা- ‘এক ধর্মরাজ্য পাশে খণ্ড ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভারত বেঁধে দিব আমি’ সারা দেশে তথা হিন্দু মানসে এক নবচেতনা সঞ্চারিত করেছিল। শিবাজীর প্রখর বুদ্ধি, বিপুল পরাক্রম ও দুর্মর প্রতিজ্ঞা ‘এক ধর্মরাজ্য হবে এ ভারতে’ সমগ্র সুপ্ত হিন্দু জাতিকে উদ্বেলিত করেছিল, অণুপ্রাণিত করেছিল স্বাজাত্যভিমানে।
পুনার প্রত্যন্ত পার্বত্যপ্রদেশের মাওয়ালিদের সমর কৌশল শিক্ষা দিয়ে তাদের উন্নত যোদ্ধায় পরিণত করেন শিবাজী মহারাজ এবং ছোটো ছোটো সেনাদল তৈরি করে বিপক্ষের বড়ো সেনাদলকে অতর্কিতে আক্রমণ করার
কৌশলে বিজাপুরের সুলতান কিংবা মুঘল বাদশার সৈন্যদলকে বারবার পর্যুদস্ত করেন তিনি। অসংখ্য গেরিলা যুদ্ধে সফলতার ফসল হিসেবে বহু গুরুত্বপূর্ণ দুর্গম ও অজেয় গিরিদুর্গ শিবাজী দখল করেন এবং ক্রমে দক্ষিণভারতে একটি স্বাধীন হিন্দু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। রায়গড় দুর্গে তাঁর রাজ্যাভিষেকর দিনটি (জ্যৈষ্ঠ শুল্ক ত্রয়োদশী, ৬ জুন, ১৬৭৪) হিন্দু সমাজের কাছে একটি শুভদিন। কারণ তা পরাধীন মুঘল ভারতবর্ষে হিন্দু জনমানসে স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিয়েছিল, মুসলমান শাসনের নাগপাশ থেকে ভারতবর্ষের আপামর হিন্দুর মুক্তির দিন ঘোষিত হয়েছিল, ফিরে এসেছিল স্বাভিমান- তাই সেই দিনটি ভারতবর্ষের ইতিহাসে ‘হিন্দু সাম্রাজ্য দিনোৎসব’ নামে পরিচিত। বুদ্ধির ও শক্তির খেলায় হিন্দুপাদ-পাদশাহী ছত্রপতি শিবাজীর কাছে আওরঙ্গজেব এমনভাবে বারবার পর্যুদস্ত হয়েছেন যে কার্ল মার্কস রসিকতা করে ওই মুঘল বাদশাহের
ব্যবহারকে ‘গাধা’র সঙ্গে তুলনা করেছেন।
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজের জীবন ও কর্মপদ্ধতি, তাঁর ব্যক্তি নির্মাণের আদর্শ তাঁকে কুশলী রাষ্ট্রনেতার মর্যাদা দিয়েছে। তাই তাঁর রাজ্যাভিষেকের দিনটিকে জাতীয়তাবোধের উদ্বোধনের দিন হিসেবে, বিদেশি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবর্ষের জনগণের মধ্যে দেশপ্রেম ও আত্মশক্তির পুনরুত্থানের দিন হিসাবে পালন করার জন্য লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক সমগ্র দেশবাসীকে আহ্বান জানালেন-পালিত হলো ‘শিবাজী উৎসব’। পূর্ব ভারতে এই উৎসবের প্রবর্তন করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তিনি আহ্বান জানালেন-‘মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙ্গালি, এক কণ্ঠে বলো ‘জয়তু শিবাজী’। মারাঠির সাথে আজি, হে বাঙ্গালি, এক সঙ্গে চলো মহোৎসবে সাজি।’
ব্রিটিশ শাসন অবসানকল্পে বহু স্বাধীনতা সংগ্রামী শিবাজী মহারাজের জীবন ও কর্ম থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বলেছেন, ‘ভারতীয়দের সামনে স্বাধীনতাযুদ্ধে সফলতা লাভের জন্য
শিবাজীর উদাহরণ রাখা উচিত। ‘অভিনব ভারত’ দলের সদস্যরা শিবাজী মহারাজের চিত্রের সামনে শপথ নিতেন। আচার্য যদুনাথ সরকারের মতে, ‘তিনিই (শিবাজী) আধুনিক আত্মসচেতন হিন্দু জাতির পূর্ণ অভিব্যক্তি লাভের দীক্ষাদাতা’। তিনি আরও পরিষ্কার করে বলেছেন, ‘শিবাজীর চরিত-কথা আলোচনা করিয়া আমরা এই শিক্ষা পাই যে, প্রয়াগের অক্ষয়বটের মতো হিন্দুজাতির প্রাণ মৃত্যুহীন। কত শত বৎসরের বাধা-বিপত্তির ভার ঠেলিয়া আবার মাথা তুলিবার, আবার নূতন শাখাপল্লব বিস্তার করিবার শক্তি তাহাদের মধ্যে নিহিত আছে। ধর্মরাজ্য স্থাপন করিলে, চরিত্রবলে বলীয়ান হইলে, নীতি ও নিয়মানুবর্তিতাকে অন্তরের সহিত মানিয়া লইলে, স্বার্থ অপেক্ষা জন্মভূমিকে বড়ো ভাবিলে, বাগাড়ম্বর অপেক্ষা নীরব কার্যকে সাধনার লক্ষ্য করিলে- জাতি অমর অজেয় হয়।’
ছত্রপতি শিবাজী চলে গেছেন সেই কবে (৬ এপ্রিল, ১৬৮০), কিন্তু তাঁর মাত্র পঞ্চাশ বছরের জীবনে সমগ্র ভারতবর্ষের হিন্দুজাতিকে হাজার বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে উদ্ধারের পথ দেখিয়েছেন, জাগিয়ে তুলেছেন জাতির বিজিগীষুভাব ও সৌভ্রাতৃত্ববোধ। তাই এত বছর পরেও ক্রমাগত নানাবিধ আক্রমণে যখন আমাদের দেশ, জাতি, সংস্কৃতি নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে বিধ্বস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত আমাদের স্বধর্মলালিত মূল্যবোধ, তখন শিবাজী মহারাজের আদর্শ সমান প্রাসঙ্গিক, সমান। অর্থবহ। তাই হিন্দু সাম্রাজ্য দিনোৎসব পালনে আমরা ছত্রপতি শিবাজী মহারাজকে স্মরণ করে প্রার্থনার ভাষাতেই জানাই-‘হে বীর, আমরা, হিন্দুরাষ্ট্রের সন্তানরা তোমাকে প্রণাম করি। তোমারই কাজে কোমর বেঁধেছি। আশীর্বাদ কর। আমাদের সেই শক্তি দাও, যাতে পৃথিবীর কেউ আমাদের আর পরাজিত করতে না পারে। আমাদের শুদ্ধ চরিত্রবলে বলীয়ান কর। সেই চরিত্র দাও যা সারা বিশ্বে মান্য হবে। সেই জ্ঞান দাও যাতে স্বেচ্ছায় যে কণ্টকময় পথে চলেছি তা সুগম হয়ে উঠবে |
দু’হাজার বছরের প্রাচীন হাওড়া শিবপুরের বেতাই চণ্ডী মন্দির
অদিতি চক্রবর্তী
পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম দেবালয় ও প্রসিদ্ধ উপপীঠগুলির মধ্যে শ্রীশ্রী বেতাই চণ্ডীর মন্দির অন্যতম। সুদীর্ঘ অতীতের নানাবিধ বিবরণ ও ইতিবৃত্তে এই দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
দেবী বেতাই চণ্ডী মূলত লৌকিক দেবী, কিন্তু কালক্রমে শাস্ত্রীয় দেবী ‘বেত্রচণ্ডিকা’ নামে পরিচিতা ও পূজিতা। এই দেবী মূর্তির বৈশিষ্ট্য হলো- প্রকৃতির খেয়ালে মানুষের মুখের আদলে সৃষ্ট একটি প্রস্তর খণ্ড। প্রায় হাজার বা তারও বেশি বছর ধরে এই মুখাবয়ব বিশিষ্ট প্রস্তর খণ্ডে সিঁদুর লেপনের ফলে দেবী বেতাই চণ্ডীর বর্তমান রূপটা প্রকাশ পেয়েছে ভক্তজনের কাছে।
দেবীর আসল রূপটি আজ অজানা। তবে দেবীর সেবাইতরা বংশানুক্রমে শুনে এসেছেন, দেবীর মূর্তিটি একটি মুখের আদলে সৃষ্ট এক প্রস্তর খণ্ড। দেবী দুর্গা ও চণ্ডী রূপে পূজা ও আরাধনা করা হয়। প্রতিদিন সকালে দেবীকে স্নান করিয়ে নতুন বস্ত্র পরিধান করানো হয় এবং ভক্তি সহকারে আড়ম্বরে নিত্য পূজা সমাপন হয়। দুপুরে দেবীর ভোগ হয় এবং ভোগে প্রতিদিন মাকে মাছ রান্না করে দিতে হয়। শীতকালে মাকে অবশ্যই শীতবস্ত্র পরিধান করানো হয়।
দেবী বেতাইচণ্ডী (বেত্রচণ্ডিকা)-র অধিষ্ঠান গঙ্গার পবিত্র পশ্চিম তীরে হাওড়া শহরের দক্ষিণ প্রান্তে শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে বেতাইতলায় জিটি রোডের ওপর।
বহুকাল আগে, প্রায় ১২০০ থেকে ১৫০০ বছর আগে হাওড়ার দক্ষিণ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূমি নীচু জলাভূমি ছিল। নীচু জলাভূমি অর্থাৎ হাওড় থেকে হাওড়া নামকরণ। এই নীচু জলাভূমি গভীর বেতবনে আবৃত ছিল। এই বেতবনেই বঙ্গের পাল রাজবংশের আমলে প্রচলিত দেবী বেতাইচণ্ডীর আরাধনা হতো, বেতবনে দেবী আরাধিতা বলেই দেবীর নাম বেতাইচণ্ডী বা বেত্রচণ্ডিকা। এই তথ্য জানা যায় শিবপুর কাহিনি তথা লেখক অন্নদা প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বিবরণ থেকে।
প্রাচীন যুগের দ্বিতীয় ভাগ হলো সেন বংশের আমল। ২৪ পরগনা জেলার গোবিন্দপুরে প্রাপ্ত রাজা লক্ষ্মণ সেনের তাম্রশাসনে উল্লেখ আছে, ‘বেতড্ড-চতুরক নামক স্থানের অন্তর্গত একখানি গ্রাম জনৈক ব্যাসদেব শর্মা নামক ব্রাহ্মণকে তিনি দেবসেবার নিমিত্ত দান করেন। এই বেতড্ড-চতুরক বর্তমান হাওড়া জেলার ‘বেতড়’ নামক স্থানটি। বহু পণ্ডিত এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মুঘল আমলের আগেই এই অঞ্চলে প্রসিদ্ধ জনপদ ছিল এবং বেতড়ের মধ্যে দিয়ে সরস্বতী নদী প্রবাহিত ছিল। সেই সরস্বতী নদী আজ বিলুপ্ত প্রায়। মুঘল আমলেও এই নদীপথে ব্যবসা বাণিজ্য চলত। বেতাইতলা, শিবপুর ও বোটানিক্যাল গার্ডেন সংলগ্ন বহু জনপদ আগে বেতোড়ের অধীন ছিল। ডি. ব্যারোজ (১৫৫২-১৬১৩), ব্লায়েভ (১৬৪৫-৫০) এবং রেনেলের (১৭৭৯-৮১) মানচিত্রে বেতোড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই বেতড় বা বেতোড়ের একমাত্র অধিষ্ঠাত্রী ছিলেন শ্রীশ্রী বেতাইচণ্ডী মাতা।
একটা বিষয় প্রমাণিত যে, সেন বংশের আগেই পাল রাজবংশের আমলে বেতাইচণ্ডীর উল্লেখ পাওয়া যায়। এই বেতোড়ের বেতবনেই তিনি পূজিতা, সুতরাং রাজা লক্ষ্মণ সেন দেবসেবার জন্য দান করেছেন, এমন অনুমান করে নেওয়াটা বোধহয় অবিশ্বাস্য মনে হয় না। শিবপুরের এক প্রাচীন দুর্গাপূজার স্মরণিকা ক্রোড়পত্রে জনৈক লেখক উল্লেখ করেছেন, বেতাইচণ্ডীর মন্দির ২০০০ বছরের প্রাচীন। প্রসঙ্গত বলা যায়, সেন রাজবংশের আমলে বেতোড়ে বেতাইচণ্ডী ভিন্ন অন্য কোনো দেবস্থানের নাম পাওয়া যায় না।
১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে বিপ্রদাস পিপলাই রচিত মনসামঙ্গলে এবং ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম রচিত চণ্ডীমঙ্গলে বেত্রচণ্ডিকা বা বেতাইচণ্ডীর উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে বেতোড় ও সন্নিহিত অঞ্চলের বিবরণও পাওয়া যায়। শ্রীমন্ত সদাগরের গঙ্গাসাগর যাওয়ার কালে।
‘চিৎপুর শালিখা সে এড়াইয়া যায়। কলিকাতা এড়াইল বেনিয়ার বালা। বেতোড়েতে উপজিল অবসান বেলা। সমস্ত গ্রাম খানা সাধু এড়াইল গ্রামে।’
কবি কঙ্কণের সম সাময়িক কবি মাধবাচার্যের চণ্ডী মঙ্গলেও:
‘ছৈঘরে বসিয়া সাধু বলে বাহবা বেতোড়েতে উপজিল সাধুর সপ্তলা।’ মনসা মঙ্গলে সর্বদেব দেবী বন্দনা দেখা যায়-
‘বন্দনা করিতে ভাই না করিব হেলা বালি ডাঙায় বন্দিলাম সর্বমঙ্গলা। কালীঘাটে কালীবন্দ, বেতোড়ে বেতাই।
পুরটে ঠাকুর বন্দো, আমতার মেলাই।’ কালক্রমে সরস্বতী নদী মজে যাওয়ায়
বেতোড়ে ব্যবসা বাণিজ্যের ঘাটতি এবং ইংরেজ বণিকদের কলিকাতায় রাজধানী স্থাপন ও বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠায় বেতোড়ের ব্যবসা বাণিজ্য ও সমৃদ্ধি কমে আসে এবং তার মর্যাদা ও হ্রাস পায়। তবে বেতোড়ের মর্যাদা কমে এলেও, উপপীঠ বেতাইচণ্ডীর মাহাত্ম্য বিলীন হয়নি বা একটু ও হ্রাস পায়নি।
বেতোড় বাণিজ্য কেন্দ্র হওয়ায় মাঝে মাঝে মগ আরাকান দস্যু (জলদস্যু)-রা বেতোড়ে উৎপাত শুরু করে। ইতিমধ্যে বীরভূইয়ার অন্যতম প্রতাপাদিত্য রায় তাঁর সৈন্য বাহিনীর নায়ক নির্বাচিত করেন, পর্তুগিজ রডাকে। তাঁদের যৌথ উদ্যোগে সুন্দরবন থেকে বেতোড় পর্যন্ত নদী পথের পাশে পাঁচটি দুর্গ নির্মিত হয়। এই দুর্গগুলির মধ্যে অন্যতম হলো বেতাই মন্দিরের অদূরে থানা মাকুয়ায়। এর পরবর্তীকালে থানা মাকুয়া মুঘলদের অধিকারে আসে।
সেবাইত বংশ ও তাঁদের পারিবারিক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।।
বেতাইচণ্ডীর সেবাইত শুদ্ধ শ্রোত্রীয় বাৎস্য গোত্রীয় ব্রাহ্মণ (কুলপদবি ঘোষাল)। এই বংশ সুদীর্ঘকাল ধরে দেবী চণ্ডিকার সেবা পূজা করে আসছেন। কমপক্ষে ঊর্ধ্বর্তন ৯/১০ পুরুষের নাম পাওয়া যায়। এই সেবাইত বংশ বরাবরই শিবপুরে বসবাস করছেন। শেওড়াফুলি রাজার প্রদত্ত নিষ্কর ব্রহ্মোত্তর জমিতে তাঁরা বসবাস করছেন। এক সময় তাঁরা বিপুল জমিজমার স্বত্বাধিকারী থাকলেও কালক্রমে বিভিন্ন কারণে বেশিরভাগ ভূসম্পত্তি হস্তান্তরিত হয়।
এই সেবাইত বংশ ‘হাবিলদার’ উপাধিতে ভূষিত হয় নবাবি আমলে। হাবিলদার থেকে ক্রমে হালদার বংশ নামে তাঁরা পরিচিত। প্রসঙ্গত বলা যায়, আলিবর্দি বা তাঁর আগে কোনো এক নবাব এই হাবিলদার উপাধি দেন। নবাব মফস্সল সফরে দক্ষিণবঙ্গে এলে তাঁর নিজস্ব প্রাসাদে থাকতেন। নবাবের প্রাসাদ যখন ফাঁকা থাকতো, তখন সেই প্রাসাদে দেওয়ানি ও ফৌজদারি দুই বিচার ব্যবস্থা
সম্পন্ন হতো। আজ সেই স্থানের কাছেই বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুবিশাল বটবৃক্ষ। এই কথা আগেই বলা হয়েছে, দেওয়ানি বিচারক ছিলেন হাবিলদার বা হালদাররা (বেতাই চণ্ডীর সেবাইত বংশ) এবং ফৌজদারি মামলার বিচারক ছিলেন কাজীরা (কাজীপাড়া)।
বিভিন্ন নথি, তথ্যসূত্র বা বিবৃতি থেকে জানা যায়, দেবী বেত্রচণ্ডিকা বা বেতাইচণ্ডীর সুদীর্ঘকাল সেবাইতদের গৃহে অধিষ্ঠিতা এবং সেখানেই নিত্য পূজিতা। অনেকেরই মনে প্রশ্ন ওঠে, দেবীর আবির্ভাব ও আদি পূজাস্থান বেতোড়ের বেতভবনে, তাহলে দেবী সেবাইত হালদার বংশের গৃহে অধিষ্ঠিতা ছিলেন কেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে ৩টি সম্ভাব্য কারণ মনে আসে: ১. বেতোড় বন্দরের মর্যাদাহানি, লোক সমাগম কম, তাই দেবী মন্দিরে ভক্ত সমাগমও কম, ২. ‘থানা’ মাকুয়াকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেবী বিগ্রহের ক্ষতি সাধন ও পূজায় বিঘ্ন হওয়ার আশঙ্কা। ৩. বেতোড়ের অন্তর্গত শিবপুরের শ্রীবৃদ্ধি এবং ক্রমশ ভক্ত সংখ্যা বৃদ্ধি। মনে হয়, ওই ৩টি কারণের কোনো একটির কারণে নয়তো সম্মিলিতভাবে ৩টি কারণেই দেবী বেত্রচণ্ডিকাকে নিরাপদস্থানে সেবাইতগৃহে সেবাইতরা স্থানান্তরিত করেন। তাঁরা এই স্থানান্তরণ যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন।
মূল মন্দিরের উত্তর দিকের ফাঁকা জমিতে একটি ফুল বাগান ছিল। সেখানে এখন একটি হনুমানজীর মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই সঙ্গে মন্দির সংলগ্ন বাকি অংশে বিবাহ, উপনয়ন-সহ অন্যান্য অনুষ্ঠান এবং হোম, যাগযজ্ঞাদি করার জন্য সুন্দরভাবে, সুপরিকল্পিত ব্যবস্থায় নির্মাণ কার্য সম্পন্ন হয়েছে। প্রয়োজনে দূরদূরান্তের পূজার্থীরা এইখানে বিশ্রাম ও নিতে পারেন।
তথ্যসূত্র:
শ্রীঅরবিন্দ হালদারের লেখা বই ‘পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন উপপীঠের দেবী শ্রীশ্রী বেতাইচণ্ডী মাতা।’ (দেবীর অন্যতম সেবাইত)। পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৫-১৫।