মমতার ছকের প্রতিনিধি অভিষেক কি ভারতের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে যোগ্য?
‘ম’-তে লক্ষ্মণরেখা টানতেই হবে
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়
চতুর রাজনীতিক হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্য অনৈতিক কাজকে নৈতিক হিসেবে তুলে ধরা। সন্ত্রাসবিরোধী ভারতীয় প্রতিনিধি দলে তৃণমূল দলের সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্তর্ভুক্তি তার বড়ো উদাহরণ। তাতে সাপও মরল আর লাঠিও ভাঙল না। মমতা প্রমাণ করলেন অভিষেককে ঘিরে জনমানসে যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে তা ভুয়ো। ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে তৃণমূল দল থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে নির্বাচনের বিষয়ে তিনি গোঁ ধরে থাকেন। অন্য বা একাধিক নাম দেওয়ার পরিবর্তে নানা টালবাহানার পর এই একটি নামের প্রসঙ্গেই তিনি স্থির থাকেন। তাঁর পছন্দের এই একমাত্র সাংসদটি প্রতিনিধি দলের সদস্য না হলে প্রতিনিধি দলের জন্য তৃণমূল আর কাউকে মনোনীত করবে না, এই প্রতিনিধি দল থেকে সরে দাঁড়াবে বলেও জানিয়ে দেন। তৃণমূলে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুখেন্দুশেখর রায়, ডেরেক ও’ ব্রায়েন, সাগরিকা ঘোষ, এমনকী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বলিয়ে কইয়ে নেতা থাকা সত্ত্বেও অভিষেককেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিনিধি হিসেবে বাছলেন এবং সেই সঙ্গে প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে চার্জশিট-সহ অভিষেকের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ রয়েছে তার সবই অর্থহীন।
বিজেপি ও তৃণমূলের ‘সেটিং তত্ত্ব’ বেচে খাওয়া বামপন্থী ও কংগ্রেসও তাতে বোকা বনে গিয়েছে। দিল্লিতে তৃণমূলের ইন্ডি জোটসঙ্গী এবং পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধী এই দলগুলির কেউ বিরোধিতার টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্য বিদেশি বামেদের ভোট মমতা এইভাবেই জোগাড় করে দিয়েছিলেন। পাক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিশ্বকে বার্তা দিতে বিভিন্ন দেশে ভারতের পাঠানো ‘অল-পার্টি এমপি ডেলিগেশন’ বা সব দলের সাংসদদের নিয়ে গঠিত প্রতিনিধি দলের ৫৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে কেবল অভিষেকের বিরুদ্ধেই টাটকা অভিযোগ রয়েছে। দেশের প্রতিনিধি হিসেবে অভিষেককে তুলে ধরে মমতা যেমন তার উত্তরসূরী সুনিশ্চিত করলেন, তেমনই বোঝালেন অভিষেক ধোয়া তুলসীপাতা। তার বিরুদ্ধে সব
অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মমতার এই ছলচাতুরী আগামী বছর রাজ্য বিধানসভা ভোটে তাকে কী সুফল দেবে সেটাই দেখার।
তবে এটা ঠিক যে, এরপর অভিষেককে কোনো বেআইনি কাজের অভিযোগে আটক করা তদন্তকারী সংস্থাদের পক্ষে হয়তো একটু কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সেক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ সত্য হলেও তা সাজানো বলেই অপপ্রচার চালাবে তৃণমূল। বিজেপি নেতৃত্বের বক্তব্য হতে পারে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রস্তাবিত নামটি গ্রহণ করে গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিকভাবে সঠিক কাজই করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। অভিষেকের প্রতিনিধিত্বে কোনো আপত্তি না করে, গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বহাল রেখে রাজনৈতিক সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার। কারণ এরপর সরাসরি প্রধানমন্ত্রী-বিরোধী কিছু বলতে গেলে অভিষেককে অস্বস্তিতে পড়তে হবে। তার খোঁতা মুখ ভোঁতা হবে।
দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। রাজ্যের চারিদিকে জঙ্গি ভরে দেওয়ার পর মমতা এখন বলছেন যে, লক্ষ্মণরেখা টানতে হবে। অথচ ‘ম’-তে মুসলমান, মমতা, মুর্শিদাবাদ ও মৃত্যু সমার্থক হয়ে গিয়েছে। এই চার ‘ম’ বা গ্যাং অফ ফোর (চারচক্র)-এর বিরোধী প্রমাণটিই হলো ‘অপারেশন সিঁদুর’। বৈসরন থেকে বেতবোনা পর্যন্ত যে হিন্দুবিরোধী সন্ত্রাস ভারতের মানুষ দেখেছেন, মুর্শিদাবাদ সংক্রান্ত কলকাতা
২০২৬-এর ভোটে এই রাজ্যের চার ‘ম’-এর উপর লক্ষ্মণরেখা টানতে না পারলে এখানকার হিন্দুদের অনস্তিত্বের অস্তিত্ব হিসেবেই থেকে যেতে হবে।
হাইকোর্টের এসআইটি (সিট) রিপোর্ট তা আরও বেশি করে প্রমাণ করেছে। এই রিপোর্ট দেখিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসন কতটা নির্লজ্জভাবে হিন্দুবিরোধী। সিপিএম আর কংগ্রেস সেই হিন্দুবিরোধী গাছে জল ঢালে। মুর্শিদাবাদের ঘটনা দেখিয়েছে কারা এই রাজ্যে ইসলামি সন্ত্রাসের দোসর। রাজ্যের মানুষ জানে যে, শওকত ও জাহাঙ্গিরের মতো জেহাদিরা কার ছায়াসঙ্গী। তারপরেও তৃণমূলের সাংসদ অভিষেকবাবুকে ইসলামি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বলতে দেশের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে পাঠানোর ব্যাপারে অবস্থান নেয় তৃণমূল। এর চাইতে হাস্যকর ও মশকরার আর কী থাকতে পারে? মুর্শিদাবাদে হিন্দু নিধন যজ্ঞে রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক সন্ত্রাসের প্রধান কারিগর তৃণমূল নেতা আর তাদের প্রশাসন। অভিষেকবাবুর মতো নানা অপরাধে অভিযুক্ত এবং একজন বিতর্কিত চরিত্র যেভাবে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেলেন তা কতটা সঙ্গত তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই জনমানসে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের কাছে তা হতাশা ও বেদনারও বটে। তৃণমূলের অন্দরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে যে, পুরো নাটকটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ক্রিপ্টেড বা লিখিত। অভিষেককে সামনে নিয়ে আসার জন্য সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ইউসুফ পাঠানকে ঘিরে মমতা নাটুকেপনা করেছিলেন। সবশেষে অভিষেকের নামটাই দেন। কারণ অভিষেকের
নামটাই তিনি প্রথম থেকে ঠিক করে রেখেছিলেন।
যে চার ‘ম’-এর সমাহার পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে, তার ইতি টানার সময় আগত। ‘ম’-এর মরণফাঁদে যেমন পড়েছে রাজ্য, তেমনই পড়েছে এখানকার হিন্দুরা। এই রাজ্যের হিন্দুরা এই মুহূর্তে যে অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে, সেই সংকটের মেঘ সরাতে গেলে ওই চার ‘ম’-এর উপর লক্ষ্মণরেখা টানতেই হবে। কালিঝুলি মাখা তিন বারের সাংসদ পাকিস্তান বা বিশ্বকে কী বার্তা দেবে তা বলা কঠিন! ২০২৬-এর ভোটে এই রাজ্যের চার ‘ম’-এর উপর লক্ষ্মণরেখা টানতে না পারলে এখানকার হিন্দুদের অনস্তিত্বের অস্তিত্ব হিসেবেই থেকে যেতে হবে। অনেক জেলায় তারা হতে পারে অস্তিত্বহীন। আর তা মোটেও সুখের হবে না।