রামময় বঙ্গভূমি,
প্রায় সব জেলাতেই রামের নামে গ্রাম
নন্দলাল ভট্টাচার্য
অন্ধকে অন্ধ বলতে নেই। খঞ্জকে খঞ্জ। এ আপ্তবাক্য বহু দশকের। মান্যতা তাই দিতেই হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতি দেখা দেয় যখন বলতে হয় সত্য কথাটাই। অপ্রিয় হলেও আসলে আমাদের এই দেশে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে ছদ্ম-পণ্ডিতের আধিক্য দেখা দেওয়ার কারণেই এসব কথা বলার দরকার দেখা দিয়েছে।
এই ছদ্ম পণ্ডিতেরা হয় প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে অথবা শাসকের পদলেহনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত লাভের আশায় প্রায়শই এমনসব কথা বলেন যা বাস্তবের সম্পূর্ণ বিপরীত। অবশ্য কেবল শাসক নয়, অনেক সময় প্রগতির ধ্বজা উড়িয়ে নিজেদের জাহির করার লোভেও এসব কথা বলে থাকেন অনেকে। পাণ্ডিত্য অথবা বুদ্ধি বেচে আখের গোছানোর উদ্দেশ্যে মানুষকে বিভ্রান্ত করার এক ইচ্ছাকৃত খেলায় মাতেন এঁরা। অনেকটা রাংতার মুকুট পরে রাজা সাজার মতোই।
এমনই কিছু মানুষ ভারতের অতীত-ঐতিহ্য অস্বীকার করে অথবা তার বিপরীতে কথা বলে প্রচারের ভেলায় ভাসতে চান। ওইভাবে ভাসার তাগিদেই তাঁদের কেউ কেউ ‘বঙ্গদেশে রামের কোনো প্রভাব নেই’, জাতীয় কথা বলে সত্যের অপলাপে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেন না। ভাবের ঘরে চুরি করা এইসব ছদ্মজ্ঞানী কথাগুলি বলেন নিছক অজ্ঞতা অথবা ব্যক্তিগত কোনো উদ্দেশ্য সিদ্ধির কারণে।
‘রামনাম সত্য হ্যায়’ শুনলে এঁরা বলে ওঠেন, রাম! রাম! ওতো অবাঙ্গালি সংস্কৃতি। আর সেটা বলতে গিয়ে যে শব্দ তাঁরা উচ্চারণ করেন তার মধ্যে যে রয়েছে ‘রাম’ বেমালুম সেটা ভুলে যান।
বাংলাভাষা নিয়ে যাঁরা কিঞ্চিৎ চর্চা করেন, তাঁরা জানেন, বঙ্গের কেবল ধর্মীয় নয়, সামাজিক জীবনে ‘রাম’ শব্দটি জড়িয়ে রয়েছে অনেকটা জলে মিশে থাকা অক্সিজেনের মতোই। ইদানীং প্রযুক্তির উন্নতি, বিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে। কিন্তু বহু শতক ধরেই বঙ্গজীবনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন রাম। কেবল অতীতে নয়, আজও রাম একইভাবে বিদ্যমান- একটু ভিন্নভাবে। আপাতত বর্তমান উড়িয়ে বরং একটু অতীতচারী হওয়া যাক।
বছর চল্লিশ আগে প্রায় সর্বত্র কাঁটা পাল্লায় যখন জিনিসপত্র মাপা হতো, সে সময় হিসেব রাখার জন্য বলা হতো ‘রামে এক’, ‘রামে দুই’ ইত্যাদি। অর্থাৎ রাম দিয়েই শুরু হতো গণনা। আজও গ্রামাঞ্চলে এমনটাই হয়ে থাকে। এতো গেল সংখ্যা গণনার কথা। গ্রামবাঙ্গলায় একটু সম্পন্নদের বাড়িতে ধান মজুত রাখা হয় উঠোনে- এক আধারে- নাম যার গোলা বা মরাই। এই ধরনের জোড়া মরাইয়ের নাম ‘রাম-লক্ষ্মণ’।
একই ভাবে বর্তমানে মিনিকিটের দাপটে পশ্চিমবঙ্গে দেশি চালের তো প্রায় বিলোপ ঘটেছে। কিন্তু জানেন কী, বঙ্গের সুগন্ধী সরু চালের নাম ছিল রামশাল বা রামশালি। ধান ছেড়ে আসা যাক ফসলে। বড়ো ঝিঙে বা ধুধুলকে বলা হয় ‘রাম ঝিঙে’। ‘রাম পটোল’ হলো ঢেঁড়শ বা বড়ো পটোলের নাম। কলার নাম ‘রামকলা’ বা ‘রামরম্ভা’। লবণ, তারও নাম ‘রামলবণ’। মোটা বেশ বড়ো ধরনের রুটিকে বলা হয় ‘রামরোট।’
একইভাবে বেশ লম্বা ঝুলওয়ালা ঢিলে জামা- নাম তার রামজামা। শিশুর হাতে খড়ি হবে। তার জন্য অপরিহার্য যে ফুলখড়ি বা চক তার নামও রামের নামেই ‘রামখড়ি’। রামনাম জপ আর হরে রাম কীর্তন তো জীবনেরই একটি অঙ্গ তথা করণীয়। তিলক কাটার মাটি তারও নাম ‘রামমাটি’। সবমিলিয়ে রামনাম জড়িত বাঙ্গালির নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে। অবাক হলে ‘হায় রাম’, ভয় পেলেও ‘রাম রাম’, ঘৃণা বা ধিক্কার জানতেও ওই ‘রাম রাম’। এককথায় রাম যেন বাঙ্গালির রোজকার জীবনের একটা অঙ্গ।
দিনের প্রথম প্রহরে গান শোনা- তার জন্য রয়েছে ‘রামকরী’ বা রামকেলি’ রাগ। সঙ্গে বাজবে যে বীণা তার নাম ‘রামবেণী’। সঙ্গতে বড়ো করতাল ‘রামচাকি’ ‘রামগণ্ডী’, ‘রামচন্দ্র’, ‘রামশিঙা’ ইত্যাদি আরও কত কী? ‘রামরাজ্য’-তো এখন প্রায় সোনার পাথরবাটি। কিন্তু অভাব নেই কুচক্রী-দুর্জন ‘রামঘুঘু’দের। রামযাত্রা, রামদা, রামধনু বা রামধুন- ওসব তো স্রেফ কথায় লব্ধ। তাই বাদ থাক ওসব কথা। বঙ্গজীবনে রামের প্রভাব প্রমাণের দরকার নেই ওসব কথার উল্লেখ। ‘রাম কহো! এসব আবার প্রভাব নাকি- এও তো স্রেফ কথার কথা। আর রামনবমীর জায়গা বাঁধা কেবল পঞ্জিকাতে।’ শ্রীরামনবমীও তো বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়েই রয়েছে।
তাই আসা যাক ভিন্ন কথায়। ‘বঙ্গ’-এর প্রাচীনতম উল্লেখ ঐতরেয় আরণ্যকে। প্রাচীনতার দলিল এটা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই বঙ্গেরই অন্তর্গত এই পশ্চিমবঙ্গের ২৩টি জেলার ওপর এবার বরং নজর বোলানো যাক।
২০১১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনার হিসেব- রামের নামে রয়েছে কম-বেশি ৪০ হাজার ২১৮টি গ্রাম। এইসব গ্রামের নামের তালিকা দেবে এক বিচিত্র তথ্য। ওইসব নামের মধ্যে রয়েছে কিছু ইতিহাস, কিছু লৌকিক বিশ্বাস, ব্যক্তিবিশেষের নাম বা কীর্তির কথা। কিন্তু বেশ বড়ো একটা অংশের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক ধরনের ধর্মীয় আবেগ। সেটা হিন্দু ও মুসলমান- দুইয়েরই। আর সেভাবে চিহ্নিত নাম শুনেই বোঝা যায় সেখানকার জমিদার অথবা সংখ্যাগুরুরা ছিলেন কোন ধর্মের। একইভাবে জমিদারির নানা হিসেব নিকেশেরও খোঁজ মিলবে এই নামাবলিতে, যেমন মিলবে বেশ কিছু ভৌগোলিক তথ্যও। নদীবহুল এই রাজ্যে, নদীর স্রোত ও গতিপথ বদলের ফলে সৃষ্টি হয় এবং বিলোপ ঘটে বহু জায়গার। তাই ‘চর’ যুক্ত গ্রামের নাম শুনেই বোঝা যায়। নদীর পলিতে তৈরি নবভূমি এইসব চরে গড়ে উঠেছে ওইসব গ্রাম।
গ্রামের নামের তালিকা নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে দেখা করে, এই রাজ্যে শিব, দুর্গা, কালী, কৃষ্ণ, বিষ্ণু ও রামের নামেই রয়েছে বেশির ভাগ গ্রামের নাম। পরিসংখ্যান বলছে, সর্বাধিক না হলেও ওইসব গ্রামের একটা বড়ো অংশের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে রামের নাম- বিভিন্ন ভাবে। রাম, রঘু, রাঘব ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে সীতার নাম যুক্ত গ্রাম যেমন রয়েছে, তেমন আছে রামজন্মভূমি অযোধ্যার নামও।
এক পর্যালোচনায়, রাজ্যের ২৩টি জেলার মধ্যে আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি আর কালিম্পং জেলায় রামের নামে কোনো গ্রামের সন্ধান পাওয়া যায়নি। কলকাতা-সহ বাকি ২০টি জেলাতেই রয়েছে রামের নামে বেশকিছু গ্রাম। এরমধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় আছে সবচেয়ে বেশি রামের নামযুক্ত গ্রাম। সংখ্যাটা ১১৮-র বেশি। অন্যদিকে রাজ্যের রাজধানী তথা কলকাতা জোলাতেও রয়েছে রাম নামের অন্তত তিনটি অঞ্চল। যেমন বন্দর এলাকায় রামনগর, গড়িয়ার কাছে রামগড় এবং ডিহি শ্রীরামপুর। সব মিলিয়ে এই রাজ্যের কম করে ৯১০টি গ্রাম রামের নামে চিহ্নিত। প্রসঙ্গত, গোর্খা ও নেপালি গরিষ্ঠ দার্জিলিং জেলাতেও রয়েছে রামের নামে আট থেকে দশটি গ্রাম।
জনগণনার হিসেব অনুযায়ী, এই রাজ্যে রয়েছে ১২৬টি শহর। এর মধ্যে ছ’টি শহরের নাম রামের নামে। যেমন, গঙ্গারামপুর (দক্ষিণ দিনাজপুর), রঘুনাথগঞ্জ (মুর্শিদাবাদ), রামপুরাহাট (বীরভূম), রঘুনাথপুর (পুরুলিয়া), শ্রীরামপুর (হুগলি) এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের রামজীবনপুর। অর্থাৎ রাজ্যের শহরগুলির মধ্যে ৩.২৭ শতাংশের বেশি শহর রামের নামেই চিহ্নিত।
মোট গ্রামের তুলনায় রামনামের গ্রামের এই শতাংশ সামান্য মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, মোট গ্রামের অর্ধেকেরও বেশির সঙ্গে কোনো দেব-দেবীর নাম যুক্ত নেই। আর যেগুলির সঙ্গে যুক্ত আছে, তার বড়ো অংশই ভাগাভাগি হয়েছে মূলত শিব-কৃষ্ণ- দুর্গার নামের গ্রামগুলির মধ্যে। সেক্ষেত্রে রাম নামের গ্রামের শতাংশকে তুচ্ছ করা যায় না কোনো মতেই।
যাইহোক, বিভিন্ন জেলায় রামের নামে চিহ্নিত বেশিরভাগ গ্রামের নাম রামচন্দ্রপুর, রঘুনাথপুর, রামনগর, শ্রীরামপুর, রাঘবপুর, রামেশ্বর পুর, রামপুর, রঘুদেবপুর, রামজীবনপুর, রামকৃষ্ণপুর, রামপ্রসাদপুর, রামগড়, গঙ্গারামপুর ইত্যাদি। রামকেলিও পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার এক উল্লেখযোগ্য নাম।
লক্ষ্য করার বিষয়, রেলস্টেশন হিসেবে হুগলির শেওড়াফুলির নিকটবর্তী শ্রীরামপুরের নাম বহুজানিত হলেও এক হুগলি জেলাতেই রয়েছে শ্রীরামপুর নামে কম করেও পাঁচটি গ্রাম। একই ভাবে রাজ্যের বহু জেলাতেই শ্রীরামপুর নামের একাধিক গ্রাম রয়েছে। আবার রামচন্দ্রপুর নামেও প্রায় সব জেলাতেই আছে একাধিক গ্রাম। যেমন আছে রামনগর বা রামকৃষ্ণপুর বা রামেশ্বরপুর। পুরুলিয়া-সহ রাজ্যের একাধিক জেলায় রয়েছে অযোধ্যা, অযোধ্যা নগর ইত্যাদি নামের গ্রাম। আছে সীতারামপুর নামেও গ্রাম।
সব মিলিয়ে বলা যায়, পূর্ববঙ্গ বাদ দিলে এই পশ্চিমবঙ্গও প্রায় রামময়। এবং সেটা বহু প্রচীনকাল থেকেই। তারপরও যদি কেউ বলেন বঙ্গজীবনে রামের কোনো প্রভাব নেই তাহলে স্মরণ করতে হবে শ্রীরামেরই নাম। বলতে হয়, হে রাম, তুমি এঁদের ক্ষমা করো। এরা নিজেরাই জানেন না এঁরা কত বড়ো
পণ্ডিত!