পত্রসাহিত্যে স্বামীজীর মহাসমাধি
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
পত্রসাহিত্যে স্বামীজীর মহাসমাধির সংবাদ পাওয়া যায় স্বামী অভেদানন্দজীর সৌজন্যে। তখন তিনি আমেরিকায় বেদান্ত প্রচারের জন্য অবস্থান করছেন। স্বামীজীর প্রয়াণের সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছলে বিস্তারিত খবর জানার জন্য বেলুড় মঠে তিনি চিঠি লেখেন। সেই চিঠি বেলুড়ে পৌঁছানোর আগেই শ্রীরামকৃষ্ণ পার্ষদ তথা অভেদানন্দের গুরুভাই স্বামী সারদানন্দ বা শরৎ মহারাজ তাঁকে চিঠিতে বিস্তারিত লিখেছিলেন (৭ আগস্ট, ১৯০২)। ১৯০২ সালের ২০ আগস্ট বেলুড় মঠ থেকে স্বামী প্রেমানন্দও (বাবুরাম মহারাজ) স্বামী অভেদানন্দকে বিস্তারিত জানিয়েছিলেন চিঠিতে।
শরৎ মহারাজের কথামতো, স্বামীজীর মৃত্যু খুবই অদ্ভুত। প্রায় মাস দুই আগে তিনি কাশীধামে গেছিলেন। সেখান থেকেই তিনি অসুস্থ হয়ে ফেরেন। মঠে ফিরে তিনি কবিরাজি চিকিৎসা করাচ্ছিলেন। একমাস ওষুধ ব্যবহার করার পর হাত-পা ফোলা আর রইল না, পেটে উদরীর জলও ছিল না। শরীরে লাবণ্য এসেছিল। এমনকী এক সপ্তাহের জন্য নদীয়ার জাগুলিয়াতে এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে গেছিলেন তিনি।
চিঠিপত্র থেকে জানা যায়, এসময় স্বামীজীর বৈরাগ্যভাব বেড়ে যায়। রাত্রি চারটের সময় সকলকে নিয়ে ঠাকুরঘরে জপধ্যান করতেন আর বলতেন, “আমার কার্য্য হইয়া গিয়াছে, এখন তোরা সব ক র্দ্যাখ, শোন, আমায় ছুটি দে।” বলতেন, “আমার মৃত্যু শিয়রে, কাজকর্ম ও খেলা ঢের করা গিয়াছে, যা কাজ করিয়া দিয়াছি তাই এখন জগৎ নিক, তাই বুঝতে এখন ঢের দিন লাগবে।” মৃত্যুর দিন কয়েক আগে রাখাল মহারাজকে বললেন, ‘এবার যা হয় একটা এস্পার ওস্পার করিব, হয় শরীরটা ধ্যান জপ করিয়া সারিয়া কাজে ভালো করিয়া লাগিব, না হয় তো এ ভগ্ন শরীর ছাড়িয়া দিব।”
কালী মহারাজকে (স্বামী অভেদানন্দ) লেখা শরৎ মহারাজের চিঠিতে জানা যায়, প্রয়াণের দিন স্বামীজী ঠাকুরের শয়নঘরে একলা বসে ধ্যান করেন। তারপর ঠাকুরের বিছানা নিজহাতে ঝেড়ে নীচে নেমে আসেন। সেদিন সকলের সঙ্গে বসে ইলিশ মাছের ঝোল, ভাজা ইত্যাদি দিয়ে ভাত খেলেন। খাবার পর এক ঘণ্টা বিশ্রাম করে সকলকে ডেকে ব্যাকরণ ও যোগ সম্বন্ধে দুই ঘণ্টা শিক্ষা দিলেন। যজুর্বেদের ‘সুষুম্নঃ সূর্য্য বর্চ্চসঃ’ পদের টীকা ঠিক নেই বলে সেই পদের ব্যাখ্যা নিজে করলেন। বিকেল চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে বাবুরাম মহারাজের সঙ্গে মঠের বাইরে দুই মাইল বেড়িয়ে এলেন। পৃথিবীর সমস্ত জাতির সভ্যতা কীভাবে হলো সে ইতিহাস গল্পচ্ছলে তাঁকে বললেন স্বামীজী। ফিরে এসে বাহ্যে গেলেন এবং বললেন, দাস্ত খুব সাফ হয়েছে।
সন্ধ্যায় নিজের ঘরে এক ঘণ্টা মালা জপ করতে বসলেন। এরপর শয়ন করে ধ্যান করতে লাগলেন। একজন ব্রহ্মচারী কাছে বসে বাতাস করছিলেন। এক ঘণ্টা চিৎ হয়ে শুয়ে থাকার পর স্বামীজীর ডান হাতটি খানিকটা কাঁপতে লাগলো, বিন্দু বিন্দু ঘাম হতে লাগলো কপালে। মিনিট দুই পর মুখ দিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মাথাটি নড়ে উঠলো, চোখ ভ্রূ’র মধ্যে স্থির হয়ে রইলো। মুখে একটা অপূর্ব জ্যোতি এবং হাসি দেখা গেল। মঠের সবাইকে ডাকা হলে তাঁরা দেখলেন হাত-পা ঠাণ্ডা, নাড়ি নেই। বরানগরবাসী ডাক্তার মহেন্দ্রনাথ মজুমদারকে ডাকা হলো। তিনি বললেন, স্বামীজী শরীর ত্যাগ করেছেন।
প্রয়াণের পর স্বামীজীকে কেমন দেখাচ্ছিল তা কালী মহারাজকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন বাবুরাম মহারাজ (স্বামী প্রেমানন্দ), ‘কী সে জ্যোতির্ময় মুখমণ্ডল! কী সে তেজঃপূর্ণ বিস্ফারিত নেত্র। কেবল কৌপিন পরিহিত সে সুন্দর শরীরে এক অপূর্বকান্তি পরিলক্ষিত হয়েছিল। তারপর দিবসেও সে মুখমণ্ডল দর্শন করে অনেকের দুঃখ শোক দূর হয়েছিল। ঠিক যেন শিব শুয়ে আছেন। কোনো অঙ্গের কোনোরূপ বিকৃতি হয় নাই। ইচ্ছা করে যেন শরীর ত্যাগ করিলেন।’ পরদিন বিকেলে স্বামীজীর শরীর অগ্নিসাৎ করা হয়। শরৎ মহারাজও চিঠিতে লিখছেন, ‘মুখের সে অপূর্ব ভাব শেষপর্যন্ত
যে দেখিয়াছিল সেই মোহিত হইয়াছিল।’ (স্বামীজীর মহা সমাধি দিবস উপলক্ষ্যে প্রকাশিত)