স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ডঃ শ্যামাপ্রসাদ
অম্লান কুসুম ঘোষ
শ্যামাপ্রসাদ ক্ষণজন্মা পুরুষ। একদিকে তিনি ছিলেন তৎকালীন বিশ্বের বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়ের কনিষ্ঠতম উপাচার্য, পাশাপাশি ছিলেন সিংহহৃদয় রাজনীতিবিদ, তৎকালীন সময়ের দক্ষতম সাংসদ। তাঁর এতগুলি পরিচয়ের পাশাপাশি আরও একটি পরিচয় সম্ভবত অন্যান্য পরিচয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়, সেই পরিচয় হলো তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামীর পরিচয়। আর তাঁর জীবনের এই দিকটি নিয়ে বিশেষ আলোচনা হয়নি বলেই দেশদ্রোহী কমিউনিস্টরা মিথ্যা কুৎসা রটনা করে যে শ্যামাপ্রসাদ স্বাধীনতা সংগ্রাম করেননি। ইতিহাস কিন্তু বলছে অন্য কথা।
বিগত শতকের কুড়ির দশকে শ্যামাপ্রসাদ তদানীন্তন বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে বঙ্গের প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য হলেও প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আগমন আরও এক দশক পরে ১৯৩৭ সালে। স্বায়ত্তশাসন আইন অনুযায়ী তখন প্রাদেশিক সরকার গঠিত হয়েছে এবং ব্রিটিশ সরকারের বিভেদমূলক সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা নীতির ফলস্বরূপ মুসলমানদের জন্য তৎকালীন অখণ্ড বঙ্গের সিংহভাগ আসন বরাদ্দ হয়েছে এবং তার সুযোগে বঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মুসলিম লিগের জোট সরকার। ভারতের অন্যান্য প্রদেশগুলোতে সেই নির্বাচনে কংগ্রেস সরকার গঠিত হলেও বঙ্গপ্রদেশের নির্বাচনের ফল হয়েছিল ত্রিশঙ্কু। সাধারণ আসনগুলিতে কংগ্রেস জয়ী হলেও মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলিতে কংগ্রেস একটিও আসন পায়নি। সেই আসনগুলিতে জয়ী হয়েছিল মুসলিম লিগ এবং ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টি। ফজলুল হক কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে সরকার গঠন করতে আগ্রহী থাকলেও নেহরু ও কংগ্রেসের অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতাদের আপত্তিতে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে কংগ্রেসের জোট সম্ভব হয়নি। ফলে ফজলুল হক বাধ্য হয়ে জোট করেছিলেন মুসলিম লিগের সঙ্গে।
সেই মুসলিম লিগের জোট সরকার ব্রিটিশের সঙ্গে সহায়তায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে নাস্তানাবুদ করতে শুরু করলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
জানিয়ে শ্যামাপ্রসাদের মূলত সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। সেদিক দিয়ে দেখলে বলা যায় যে তাঁর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কর্মটি ছিল ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ যা একরকমভাবে পরোক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রাম। এরপরে শ্যামাপ্রসাদের ভূমিকা তো আরও মহান। ব্রিটিশের সহায়তাকারী মুসলিম লিগ জোট সরকারের থেকে ফজলুল হককে সরিয়ে এনে তাঁর সঙ্গে মিলিতভাবে জাতীয়তাবাদী মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেসের অনেক এমএলএ-ই চাইছিলেন ফজলুল হকের সঙ্গে জোট করে সরকার গড়তে কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের বাধায় পারছিলেন না। তাঁরাও ভরসা পেয়ে শ্যামাপ্রসাদের প্রচেষ্টায় সায় দেন এবং শ্যামা-হক মন্ত্রীসভাকে সমর্থন করেন।
১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে নতুন মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। সেই মন্ত্রীসভায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ফজলুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন নেতাজীর অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু আর অর্থমন্ত্রী ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ স্বয়ং। এই মন্ত্রীসভা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি পদে বিরোধিতা করে এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতিটি অন্যায়কাজের প্রতিবাদ করে। এই মন্ত্রীসভা যখন গঠিত হয় তার দু’বছর আগেই অর্থাৎ ১৯৩৯ সালেই কংগ্রেস দেশের অন্যান্য প্রদেশগুলিতে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করে এবং সেই সমস্ত প্রদেশে শুরু হয়ে যায় মুসলিম লিগের সরকার। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছিল সেই শাসনে। তৎকালীন বঙ্গপ্রদেশ তার মধ্যে ব্যতিক্রমী শাসন উপহার দিয়েছিল এই শ্যামা-হক মন্ত্রীসভার সৌজন্যে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই মন্ত্রীসভা গঠনের ৯ মাসের মধ্যে শুরু হয়েছিল ভারত ছাড়ো আন্দোলন। কমিউনিস্টরা
প্রচার করে যে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় শ্যামাপ্রসাদ মন্ত্রী ছিলেন এবং ব্রিটিশকে সহায়তা করেছিলেন, কিন্তু প্রকৃত তথ্য ভিন্ন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের উপর তীব্র দমন শুরু করে ব্রিটিশ পুলিশ। প্রাদেশিক মন্ত্রীসভার আওতায় পুলিশ থাকলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে চলার জন্য যুদ্ধের জন্য প্রযোজ্য বিশেষ আইন করে ব্রিটিশ সরকার সেই পুলিশকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল এবং সেই পুলিশকে দিয়ে চরম দমনপীড়ন চালিয়েছিল মেদিনীপুরের ভারত ছাড়ো আন্দোলনকারীদের ওপর। এই দমনপীড়নের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ এবং একটা তীব্র বিরোধিতা পূর্ণ চিঠি লিখেছিলেন তৎকালীন ছোটোলাট জন হার্বার্টকে।
শ্যামাপ্রসাদ বঙ্গের তৎকালীন গভর্নর জন হার্বার্টকে যে চিঠিটি লিখেছিলেন তার উল্লেখ- ‘আমি সুভাষ বলছি গ্রন্থে’ রয়েছে। চিঠিটির অংশবিশেষ উদ্ধৃত এখানে প্রাসঙ্গিক হবে, “জার্মানির অধিকৃত অঞ্চলে যেরূপ নৃশংস অত্যাচারের কথা আমরা শুনতে পাই, মেদিনীপুরেও তাই চলছে। সশস্ত্র সৈন্য ও পুলিশের সাহায্য শত শত বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। হিন্দুদের বাড়ি লুট করার জন্য মুসলমানদের উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ নিজেই এ কাজ করেছে। এমনকী ১৬ অক্টোবরের ঝড়ের পরেও গৃহলুণ্ঠন ও গৃহদাহের কাজ সমানভাবে চলেছে।… নিরস্ত্র ও অসহায় জাতির সঙ্গে লড়াই করা খুবই সোজা।
ভারতবাসী নিরস্ত্র, তা সত্ত্বেও ব্রিটিশ পক্ষ থেকে বলা হয় যে ভারতবাসী নাকি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাই যদি হয় তাহলে ভারতবাসীকে অস্ত্র সরবরাহ করা হোক। তারপর সমত্বের ভিত্তিতে যুদ্ধ চলুক। অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নিশ্চয় ভারতবাসী এই পরিবর্তনকে সাদরে সমর্থন জানাবে।” (আমি সুভাষ বলছি: শৈলেশ দে, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭২২-৭২৩)। এই তীব্র জ্বালাময়ী চিঠিটি লেখার পরেই তিনি তীব্র ঘৃণার সঙ্গে পদত্যাগ পত্র ছুঁড়ে দেন ব্রিটিশ সরকারের মুখে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যখন শ্যামাপ্রসাদ ব্রিটিশের বিরোধিতা করে পদত্যাগ করছেন তখন কমিউনিস্টরা ব্রিটিশকে সমর্থন করে বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশকে সাহায্য করছে এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সক্রিয় বিরোধিতা করছে। উপরোক্ত দুটি ঘটনা থেকেই প্রমাণিত হয় যে শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী আর কমিউনিস্টরা ছিল দেশদ্রোহী, ব্রিটিশের স্তাবক। সেজন্যই আজও এসব বিশ্বাসঘাতক কমিউনিস্টরা শ্যামাপ্রসাদের নিন্দা করে এবং তাঁর নামে মিথ্যা কুৎসা রটায় কিন্তু তাতে শ্যামাপ্রসাদের মহিমা খাটো হয় না বরং তাঁর নাম কালস্রোতে ধৌত হয়ে নিত্য সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠছে।