অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কি ডায়মন্ড হারবারের বাইরে জিততে পারবেন?
বালি থেকে তেল
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়
ঘুরে ঘুরে বাজার করতে দক্ষতা লাগে। চেষ্টা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা পারেননি। নন্দীগ্রাম আসনে শুভেন্দু অধিকারী তাঁকে হারিয়ে প্রমাণ করেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র মুখ নন। ১৯৭৭-এ ইন্দিরা গান্ধী আর ২০১১-তে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হারের সঙ্গে হেরে যায় কংগ্রেস ও বিদেশি সিপিএম। ২০২১-এ মমতা হেরে গেলেও তৃণমূল জিতে যায়। সেই হারের লজ্জা ইন্দিরা বা বুদ্ধদেবের চেয়ে কম ছিল না। ১৯৮৯-তে যাদবপুর কেন্দ্রে সিপিএমের মালিনী ভট্টাচার্যের কাছে হেরে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো ‘মুখ’ হয়ে ওঠেননি। তাঁর কোনো মুখ ছিল না তাই লজ্জাবোধ হয়তো কম ছিল। বাড়িতে টাঙানো ইন্দিরা আর রাজীব গান্ধীর ছবির তলায় তিনি ছিলেন একজন সাধারণ কংগ্রেস কর্মী। তাই সেই হারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু এসে যায়নি। যাদবপুরের লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে দক্ষিণ কলকাতার নিশ্চিন্ত আসনে আশ্রয় নিয়ে পরপর পাঁচবার জেতেন তিনি। ২০২১-এ নন্দীগ্রামের লড়াই তাঁর অর্ধশতাব্দীর রাজনৈতিক জীবনে সবচাইতে লজ্জার হার! তা ঢাকতে শুভেন্দুবাবুর বিরুদ্ধে তিনি ভোট জালিয়াতির মামলা করেন। তাতে তাঁর দুর্বলতা প্রকট হয়। শুভেন্দুবাবুর গর্ব তিনি তৃণমূলকে হারাতে না রলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারিয়েছেন।
জনসাধারণের চোখে তৃণমূলের শতগুণ বড়ো মুখ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় নির্বাচনের ইতিহাসে বিরোধীরা সবসময়ই শাসকের চেয়ে শক্তিশালী। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত জাতীয় ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দল ৫০ শতাংশের বেশি ভোেট পেয়ে জেতেনি। শেষ লোকসভা ভোটে তৃণমূল ৪৫ আর সব বিরোধী দলগুলি সর্বমোট ৫৫ শতাংশ ভোট পায়, যার ৩৯ শতাংশ বিজেপির। জাতীয় ক্ষেত্রে শাসক এনডিএ ৩৭ এবং বিরোধীরা ৬৩ শতাংশ ভোট পায়।
কথায় বলে বালি থেকে তেল বের করা যায় না, যেমন হরিণ দিয়ে চাষ হয় না। রাজ্যের সংবাদমাধ্যমে ‘ডগ স্কোয়াড’ বা ‘সারমেয় গোষ্ঠী’ কথাটি ইদানীং চালু হয়েছে। আসন্ন ভোটে তারা নাকি সক্রিয় হবে। সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে এরা রাজ্যের শাসক দলের তল্পিবাহক। এরা কেবল রাজ্যের শাসক
দলের নেতাদের কথা বলে। তল্পি বওয়ার পুরস্কার পেয়ে থাকে। সব যুগেই এরা ছিল আর থাকবে। শাসক অনুগামী না হলে ধিক্কার শুনতে হয়। সমস্যা একটাই- ধ্বংস হয়ে যাওয়ার আগে তারা এই রাজ্যের সংবাদমাধ্যমের যা ক্ষতি করে যায়, তা মেরামত করা যায় না। রাজ্য বিজেপির জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পঞ্চ পণ এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা’র পঞ্চবাণের অনুকরণে তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পঞ্চপ্রশ্ন নিয়ে ভালো রকম সরব হয়েছে স্কোয়াড। দলের সাংগঠনিক রশি তার হাতে। তবু অভিষেকবাবু খানিকটা অসহায়। তিনি ঝুলে রয়েছেন। এক প্রান্তে তার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আরেক প্রান্তে তিনি নিজে। এই টানাপোড়েনের লড়াই সামলানোর শিক্ষা অল্পবয়সি অভিষেকবাবু এখনও শেখেননি।
কিছু সংবাদমাধ্যমের ধারণা, বিজেপি নেতৃত্ব শুভেন্দুবাবুকে মুখ করেই ২০২৬-এ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে লড়বে। বহুদিন থেকেই ‘রাজ্যপাট’-এর পাতায় এই বিষয়টি উঠে আসছিল। রাজ্যে আসলে মুখের লড়াই। শুভেন্দুবাবু অবশ্যই যোগ্য ব্যক্তি। কারণ মমতাকে কাছ থেকে টক্কর নেওয়া আর হারানোর মুকুট বর্তমানে কেবল তাঁর রয়েছে। রাজনৈতিকভাবে হেরেই রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালে যেমন হেরেছিল বুদ্ধদেবের দল। শুভেন্দুবাবু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘কম্পার্টমেন্টাল চিফ মিনিস্টার’ বলেন। এই প্রতিবেদকের মতে ওটা ‘ফেল’ হবে। সবসময় নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে ভোটে জিতেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লড়াই করে নয়। নন্দীগ্রামেই ছিল তাঁর প্রথম লড়াই। আর তাতেই তিনি ফেল। রাজ্য বা জাতীয় ক্ষেত্রে অন্য কোনো কেন্দ্রে লড়াই করার সাহস মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখাননি। অথচ তৃণমূল একসময় জাতীয় দল ছিল। বিদেশি পত্র-পত্রিকায় ভারতীয় নারীর অন্যতম প্রভাবশালী মুখ ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এটা লক্ষ্য করার যে, পরিবারের সদস্য হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লাইন ধরেছেন অভিষেকবাবু। তিনিও ডায়মন্ড হারবারের বাইরে যাবেন না। ওয়াইনাড়, রায়বেরিলি, মেডাক, চিকমাগালুর, আমেঠি আর ফুলপুরের বাইরে যেমন নেহরু পরিবার কোনোদিন যায়নি। মমতার পরিবারও তাই- ভবানীপুর আর ডায়মন্ড হারবার। বালি থেকে তেল হয় না। চাণক্য বলতেন তার জন্য রাজনৈতিক সাহস ও সম্পদ লাগে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা অভিষেকের কোনোটাই নেই। জওহরলাল, ইন্দিরা বা রাজীবেরও ছিল না। নরেন্দ্র মোদী কিন্তু গুজরাট ছেড়ে বারাণসীতে লড়েছেন ও জিতেছেন। তাই তফাত বোঝা যায়।
(লেখকের মতামত ব্যক্তিগত)