ইতিহাসের পট পরিবর্তন
ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাঙ্গালিদের নিকট একটি আবেগজড়িত নাম। তিনি না থাকিলে বাঙ্গালিদের অস্তিত্বরক্ষার ভূমি পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটিও
থাকিত না। তাঁহার রাজনৈতিক জীবন হিন্দুদের জন্যই উৎসর্গীকৃত ছিল। তাঁহার ন্যায় হিন্দুপ্রেমী রাজনৈতিক নেতা সেই সময়কালে কেহই ছিলেন না।
প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন শিক্ষাব্রতী ছিলেন। বাঙ্গালার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সুপুত্র তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ভাইস চ্যান্সেলর পিতাকে শিক্ষাসংক্রান্ত নানান বিষয়ে সহায়তা করিতেন। পিতার ন্যায় তিনিও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হইয়াছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা-পূর্ব বঙ্গপ্রদেশের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করিয়া তাঁহার রাজনীতিতে আগমন। মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা এবং তাহাদের গুন্ডামি যে অদূর ভবিষ্যতে এই দেশের, বিশেষ করিয়া হিন্দুদিগের দুর্গতির কারণ হইবে তাহা তিনি উপলব্ধি করিতে পারিয়াছিলেন। তাহা রোধ করিতেই তিনি ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির বঙ্গীয় সরকারে যোগ দিয়াছিলেন। সেই মন্ত্রীসভায় তিনি আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব সফলভাবে পালন করিয়াছিলেন। পরর্তীকালে বীর সাভারকরের আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া হিন্দু মহাসভার সদস্যপদ গ্রহণ করেন এবং ক্রমে সর্বভারতীয় সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। বঙ্গীয় মন্ত্রীসভায় থাকার সময়ে তিনি বঙ্গের হিন্দুদের বিভিন্ন অধিকারের বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন। কংগ্রেস দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সমর্থন পাইলেও হিন্দুদের ভালো-মন্দ লইয়া ভাবিত ছিল না। ১৯৪০ সালে মুসলিম লিগ তাহাদের লাহোর অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া পঞ্জাব ও বঙ্গপ্রদেশকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করিবার কথা বলে। কংগ্রেস ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবর্গ ইহাকে পাগলের প্রলাপ বলিয়া উপেক্ষা করে। কিন্তু দূরদর্শী শ্যামাপ্রসাদ ইহার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করিয়া আন্দোলনে অবতীর্ণ হন। তিনি ভারত ভাগের তীব্র বিরোধী হইলেও বিভাজন যখন অনিবার্য হইয়া উঠিল তখন তিনি বঙ্গ বিভাজনের দাবিতে
সোচ্চার হইয়াছিলেন। সেই সময় বেশ কয়েকজন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাঁহাকে সমর্থন জানাইয়াছিলেন। তাহারই পরিণতিতে ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গপ্রদেশের হিন্দুবহুল পশ্চিমাংশ লইয়া পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির সৃষ্টি হয়। বাঙ্গালি হিন্দুদের ভুলিলে চলিবে না যে পশ্চিমবঙ্গের জনক হইলেন ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং পশ্চিমবঙ্গের জন্মদিবস হইল ২০ জুন। স্বাধীন ভারতে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারে শিল্প ও সরবরাহ মন্ত্রী রূপে যোগ দিয়াছিলেন। সেই সময় তাঁহার শিল্পনীতি প্রণয়ন, শিল্পোন্নয়ন নিগম, চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা, সিন্ধ্রি সার কারখানা স্থাপনের সহিত খঙ্গপুরে দেশের প্রথম ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট স্থাপনের কথা দেশবাসী শ্রদ্ধার সহিত উল্লেখ করিয়া থাকেন।
ডঃ শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু দরদি রাজনীতিবিদ। হিন্দুদিগের স্বার্থরক্ষাই তাঁহার ব্রত ছিল। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গে হিন্দুদের উপর মুসলমানদের প্রবল অত্যাচারের প্রতিবাদে লোকসভায় তিনি মুখর হন। নেহরু-লিয়াকত চুক্তির তীব্র প্রতিবাদ করিয়া তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা হইতে পদত্যাগ করেন। নীতিনিষ্ঠ রাজনীতির সহিত এই দেশের মূল সমাজ হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষা করিবার মানসে তিনি ১৯৫১ সালে একটি পৃথক রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেন। জন্মলগ্ন হইতেই এই নূতন দলটিকে কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের বিরোধিতার সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। নূতন দলের সদস্য হিসাবে লোকসভায় তিনি দেশের স্বার্থরক্ষায় সোচ্চার হইয়াছেন। ভারতের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এবং সংবিধানে কাশ্মীরের জন্য ৩৭০ ধারা ও ইনার পারমিট ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে তিনি কাশ্মীর অভিযান করেন। ভারতবাসীর দুর্ভাগ্য, সেখানেই তাঁহার মৃত্যু হয়। এই মৃত্যু যে স্বাভাবিক নহে তাহা দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার। শ্যামাপ্রসাদ-জননী যোগমায়াদেবী তাঁহার পুত্রের এই রহস্যমৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের জন্য জওহরলাল নেহরু এবং শেখ আবদুল্লার নিকট তদন্তের দাবি জানাইয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহারা তাহাতে কর্ণপাত করেন নাই। শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন রাজনৈতিক হিন্দু। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট-সহ স্বার্থান্বেষী দলগুলি চিরকাল শ্যামাপ্রসাদ ও তাঁহার মতাদর্শের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করিয়াছে। তাহা সত্ত্বেও তাঁহার মতাদর্শ এবং তাঁহার সৃষ্ট হিন্দু স্বার্থরক্ষাকারী দলটির অগ্রগতি কেহ রুদ্ধ করিতে পারে নাই। আজ ভারতীয় জনতা পার্টি ভারতবাসীর মানসলোকে স্থান করিয়া লইয়াছে। কংগ্রেস-সহ সেকু-মাকুর দল দীর্ঘদিন শ্যামাপ্রসাদকে বাঙ্গালি মানস হইতে লুক্কায়িত রাখিয়াছিল। স্বামী প্রণবানন্দজী মহারাজের আশীর্বাদধন্য এই হিন্দু রাজনেতা এবং তাঁহার মতাদর্শ আজ বাঙ্গালি তথা ভারতবাসী হৃদয়ঙ্গম করিয়াছে। ভারতবাসী আজ ভারতের শাসনভার পরিচালনার দায়িত্ব তাঁহারই সৃষ্ট দল এবং তাঁহার উত্তরসূরীদিগের হস্তে প্রদান করিয়াছে। ‘এক নিশান, এক বিধান, এক প্রধান’-ভিত্তিক ভারতের স্বপ্ন বুকে লইয়া যিনি আত্মবলিদান দিয়াছিলেন, তাঁহার সেই স্বপ্ন আজ পূরণ হইয়াছে। যাহারা একসময় ভারত কেশরী ড. শ্যামাপ্রসাদকে অন্ধকারে আচ্ছাদিত রাখিয়াছিল, বিধির কী বিধান যে, আজ তাহারাই অন্ধকারে নিমজ্জিত হইয়া পড়িয়াছে। ইহাকেই বোধ হয় ইতিহাসের পট পরিবর্তন বলা হইয়া থাকে।