খানিক নীরবতা পালন করুন দিদি
সরবেষু দিদি,
আপনি চুপ করে থাকবেন না জানি। ইদানীং এত কথা বলছেন যে, হিতাহিত জ্ঞান থাকছে না। কিন্তু দিদি জয় করেও ভয় না যাওয়াটা একটা অসুখ। সেই অসুখে আক্রান্ত আপনার দল। কালীগঞ্জ উপনির্বাচনে দুর্দান্ত জয় পেয়েছে আপনার দল। আর তার পরে জয়োল্লাসেও আপনার ভাইয়েরা বোমা মারতে মারতে গেল। বিরোধীদের সবক শেখানোর সেই মিছিল থেকে আসা সকেট বোমা কেড়ে নিয়েছে কিশোরী তামান্নার প্রাণ। ধৃতেরা আদর শেখ, মানোয়ার শেখ, কালু শেখ ও আনওয়ার শেখ। না দিদি, দুষ্কৃতীর কোনো ধর্ম হয় না। কিন্তু দল হয়। বছর দশেকের তামান্না খাতুন রাজনীতি বোঝেই না। চতুর্থ শ্রেণীর পড়ুয়া। বড়ো চাঁদঘর পঞ্চায়েতের মোলান্দা গ্রামের বাসিন্দা তামান্নার মা সাবিনা ইয়াসমিন বলেছেন, ‘আমি দেখেছি কারা বোমা ছুঁড়েছে। ওদের নাম না-জানলেও সকলের মুখ চেনা, সবাই তৃণমূল করে।’ গোটা দেশে যখন রক্তপাতহীন ভোট হয় তখন তামান্নার মৃত্যু দেখিয়ে দিল ‘বাংলা এখনো বাংলা’তেই রয়েছে। সরকারি ঘোষণা করে গোটা রাজ্যের দু’মিনিট নীরবতা পালন করা উচিত। আমি শুধু ভাবছি, ধৃতদের নাম যদি তারক, কৃষ্ণ, হরিপদ
হলে কালীগঞ্জের আগুন কালীঘাটে চলে আসত।
দিদি, তৃণমূল রক্তপাত ছাড়া ভোটে জিততে পারে না! এটা সবার জানা ছিল। এবার এটা জানা গেল তৃণমূল রক্তপাত ছাড়া জয়ের আনন্দও করতে পারে না। অতীতেও দেখেছি, বিরোধীদের উপরে ভোেট পরবর্তী সন্ত্রাস ছড়িয়ে জয়ের আনন্দ উদ্যাপন করেছে তৃণমূল।
এবারের চিঠি লেখার কথা ছিল অন্য বিষয়ে। আরও তামান্নার মৃত্যুর সম্ভাবনা নিয়ে আসছে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে বর্ষা। দিদি, আপনি ডিভিসি-কে দোষ দেওয়া কবে শুরু করবেন? ও দিকে আপনি যে বলেছিলেন এই বছরের মধ্যে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান হয়ে যাবে, সেটার কী হলো?
অভিনেতা দেব কী অভিনয়টাই না জানেন! তাতে আবার আপনি ও আপনার ভাইপো যুক্ত। মনে আছে দিনটা। ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪। প্রথমে ক্যামাক স্ট্রিটে ভাইপোর অফিস এবং পরে কালীঘাটে আপনার
বাড়িতে বৈঠক সেরে দেব বললেন, আমি রাজনীতি ছাড়লেও, আমার মনে হয় রাজনীতি আমাকে ছাড়বে না। সেই বৈঠকেই নাকি দেব বলেছিলেন, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কার্যকর করা না হলে তিনি ভোটে লড়বেন না। তাঁকে কথাও দিয়েছিলেন আপনি দিদি। দেব দাঁড়ালেন এবং জিতেছেন। কিন্তু ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কী হলো?
বর্ষা এসে গেছে। প্রতিবারের মতো শিলাবতী নদী উপচে ভাসছে ঘাটাল। জল জমা এক ঐতিহাসিক সমস্যা ঘাটালের। ১৯৫৯ সালে মান সিংহ কমিটির রিপোর্টে প্রথম ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের কথা বলা হয়। এই প্রকল্পে সম্মতি দিতে যোজনা কমিশনের ২০ বছর লাগে। তারপর প্রকল্পের সলতে পাকিয়েছিল বামেরা। ১৯৮২ সালে এই প্রকল্পের শিলান্যাস হয়। কিন্তু কাজ হয়নি। দেবের চাপাচাপিতে এবার রাজ্য বাজেটে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ
হয় এই প্রকল্পের জন্য। যদিও খরচ কমপক্ষে দু’ হাজার কোটি টাকা। আর ঘোষিত ৫০০ কোটি টাকা কোথা থেকে আসবে তা কেউ জানে না। এরাজ্যে বাজেট এই রকম হয়। খরচ বলে দেওয়া হয়। টাকা কোথা থেকে আসবে কেউ জানে না। আরও একটা প্রশ্ন দিদি। বছর কয়েক আগে কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রকল্পের জন্য যে দেড় হাজার কোটি টাকা দিয়েছিল সেটা কোথায় গেল? কোন গর্তে ঢুকে গেল সেই টাকা?
আপনার প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যদি জমি প্রয়োজন হয়, তাহলে বাজারমূল্যের থেকে বেশি দামে জমি কেনা হবে। কিন্তু তাতে মন গলেনি দাসপুরবাসীর। তাঁদের অভিযোগ, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে দাসপুরের চন্দ্রেশ্বর খাল খনন করে দাসপুরকে বন্যাকবলিত করার পরিকল্পনা চলছে। শুধুমাত্র ঘাটালকে বাঁচানোর জন্য দাসপুরকে ডোবানোর চক্রান্ত হচ্ছে বলে
অভিযোগ উঠেছে। তাই যত টাকাই দিক, জমি দেওয়া হবে না।
কিন্তু দিদি জোর করে জমি নিয়ে আপনি ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান আদৌ বানাবেন কি? আপনি আপনাকে যতদূর জানি, তাতে যে কারণে বামেরা করেনি, সেই কারণেই আপনিও করবেন না। বামেরা জমিতে হাত দিতে ভয় পেত। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিল্প করতে চেয়ে সিঙ্গুরের জমিতে হাত দিয়েছিলেন। ব্যাস, সেই
সিঙ্গুর আন্দোলনকে হাতিয়ার করে ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে তৃণমূল। নন্দীগ্রামেও জমি নিয়েই আন্দোলন। আপনি ক্ষমতায় আসার পর নিজস্ব জমি নীতি তৈরি করে আপনার সরকার। সেই নীতি অনুযায়ী জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না।
তিন বার সাংসদ হয়েছেন দেব। কিন্তু রাজনীতিতে এখনো তিনি শিশু আপনাকে চেনেইনি। জমিতে আপনি হাত দেবেন না। মাঝে মাঝে পরিদর্শন হবে, সরকারি ফাইল চালাচালি হবে কিন্তু নো জমি অধিগ্রহণ। সেই কারণেই রাজ্যে শিল্প হয় না। চপ শিল্পে তো জমি লাগে না, তাই আপনি রাজি।