• About
  • Contact Us
Sunday, October 19, 2025
Swastika
No Result
View All Result
  • হোম
  • সম্পাদকীয়
  • রাজ্যপাট
  • সুন্দর মৌলিকের চিঠি
  • অতিথি কলম
  • বিশ্বামিত্রের কলম
  • উত্তর সম্পাদকীয়
  • প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • পরম্পরা
  • সঙ্ঘবার্তা
  • বিশেষ নিবন্ধ
  • ই -পত্রিকা
  • হোম
  • সম্পাদকীয়
  • রাজ্যপাট
  • সুন্দর মৌলিকের চিঠি
  • অতিথি কলম
  • বিশ্বামিত্রের কলম
  • উত্তর সম্পাদকীয়
  • প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • পরম্পরা
  • সঙ্ঘবার্তা
  • বিশেষ নিবন্ধ
  • ই -পত্রিকা
No Result
View All Result
Morning News
No Result
View All Result
Home বিশেষ নিবন্ধ

5th May বিশেষ নিবন্ধ

in বিশেষ নিবন্ধ
5th May বিশেষ নিবন্ধ

Issue 77-35-05-05-2025

ওয়াকফ সংশোধনী আইন ছিল সময়ের দাবি
ধর্মানন্দ দেব
ওয়াকফ শব্দটি আরবি মূল শব্দ ‘ওয়াকফা’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘নিষেধ করা’ বা ‘বন্ধ করা’। কোনো মুসলমান ব্যক্তি যদি তাঁর নিজস্ব স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয়, দানমূলক বা জনহিতকর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন, তাহলে সেই সম্পত্তিকে ‘ওয়াকফ’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই সম্পত্তি ব্যবহারের উদ্দেশ্য সাধারণত মজহবি কর্মকাণ্ড, সমাজসেবামূলক উদ্যোগ কিংবা দান-খয়রাতের জন্য নির্ধারিত হয়। যদিও কে এই সম্পত্তি ভোগ করবেন, তা সব সময় স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে না, তবুও মজহবি অনুষঙ্গ থাকা আবশ্যক।
‘প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো’-র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের ইতিহাসে ওয়াকফের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় দিল্লির সুলতানি শাসনের প্রথম দিকে। জামা মসজিদ কর্তৃপক্ষকে দুটি গ্রাম উৎসর্গ করেছিলেন সুলতান মুইজুদ্দিন বিন সাম ঘোর মুলতান বা মহমুদ ঘোরি। ওয়াকফ হিসেবে ওই গ্রাম দুটি মসজিদের তৎকালীন প্রশাসন শাইখুল ইসলামের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। এটিই ভারতের প্রথম ওয়াকফ বলে মনে করা হয়।
ভারতে ওয়াকফ সম্পত্তিগুলি ওয়াকফ আইন, ১৯৯৫ দ্বারা পরিচালিত হয়। তবে, ১৯১৩ সাল থেকে ভারতে ওয়াকফ পরিচালনার জন্য একটি আইনি ব্যবস্থা রয়েছে, যখন মুসলিম ওয়াকফ বৈধকরণ আইন কার্যকর হয়। এরপর ১৯৫৪ সালে ওয়াকফ আইন প্রণয়ন করা হয়, যা শেষ পর্যন্ত ওয়াকফ আইন, ১৯৯৫ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। ২০১৩ সালে, আইনটি সংশোধন করে ওয়াকফ সম্পত্তি দখলের জন্য দু’ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল এবং ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রয়, উপহার, বিনিময়, বন্ধক বা হস্তান্তর স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
এছাড়াও বছরের পর বছর ধরে ওয়াকফ সংক্রান্ত বিরোধ দেশে বাড়তে থাকে। ওয়াকফ আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা এবং স্বচ্ছতার অভাবে জমি দখল, অব্যবস্থাপনা, মালিকানা বিরোধ, নিবন্ধন ও জরিপের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে জনমানসে। এই মুহূর্তে ওয়াকফ বোর্ডের দখলে সারা দেশে ৮.৭লক্ষেরও বেশি সম্পত্তি রয়েছে যা ৯.৪ লক্ষ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত। ভারতীয় রেল ও সেনার পর সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি রয়েছে ওয়াকফ বোর্ডের হাতে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বক্তব্য অনুযায়ী, ১৯১৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সমস্ত ওয়াকফ বোর্ডের মোট জমি ছিল ১৮ লক্ষ একর। তবে ১০১৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত অতিরিক্ত ২১ লক্ষ একর জমি যুক্ত হয়েছে।
২০২৫ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত, ভারতে প্রায় ৩৯ লক্ষ একরেরও বেশি জমি জুড়ে প্রায় ৮,৭২,০০০ নিবন্ধিত ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। এর মধ্য ৪,০২,০০০-এরও বেশি সম্পত্তি ‘ব্যবহারকারীর দ্বারা ওয়াকফ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত, যার অর্থ হলো আনুষ্ঠানিক নিবন্ধনের পরিবর্তে ঐতিহ্যবাহী ব্যবহারের ভিত্তিতে সম্পত্তিও চিহ্নিত করা হয়েছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে মাত্র ৯. ২৭৯টি মামলায় মালিকানার নথি আপলোড করা হয়েছে এবং মাত্র ১,০৮৩টি সম্পত্তির ওয়াকফ দলিল রয়েছে। উত্তরপ্রদেশে, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা সর্বাধিক, প্রায় ২,১৭,০০০। যদিও জমির সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না, তবে এটি সংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম ওয়াকফ সম্পত্তির খতিয়ান। পশ্চিমবঙ্গে ৮০,৪৮০টি সম্পত্তি, পঞ্জাবে ৭৫,৯৬৫টি, তামিলনাডুতে ৬৬,০৯২টি এবং কর্ণাটকে ৬২,৮৩০টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। WAMSI (ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম অব ইন্ডিয়া) পোর্টালের তথ্য অনুসারে, অসমে প্রায় ২,৬৫৪টি সম্পত্তি রয়েছে। এছাড়াও বর্তমানে ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালগুলিতে প্রায় ৪০,৯৫১টি মামলা বিচারাধীন, যা এই ব্যবস্থার জটিলতা ও অকার্যকারিতাকে প্রকাশ্যে তুলে ধরে। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের রায়গুলির উপর দেশজুড়ে কার্যকর আইনি ব্যবস্থায় তদারকি নেই, ফলে সঠিক বিচার প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হচ্ছে। ২০১৩ সালের পর থেকে ওয়াকফ আইন জনসাধারণ ও মুসলমান সমাজের বিভিন্ন স্তরের নজরে এসেছে। মুসলমান বুদ্ধিজীবী, মহিলা, বোহরা সম্প্রদায় এবং অন্যান্য অনগ্রসর মুসলমান গোষ্ঠী ওয়াকফ বোর্ড ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ সংবাদমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেছেন। আপিল প্রক্রিয়াতেও রয়েছে মারাত্মক ত্রুটি। বোর্ডের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার ব্যবস্থা থাকলেও, সেই আপিল নিষ্পত্তির জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমার অভাব মামলাগুলিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে রাখছে। এই বিলম্বিত বিচার পদ্ধতি ন্যায়বিচারের মৌলিক অধিকারকে ব্যাহত করে।
২০২৫ সালের ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন কার্যকর হওয়ার আগে, বিদ্যমান ওয়াকফ আইনের ৪০ নম্বর ধারার অধীনে কোনো সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসেবে ঘোষণার একচেটিয়া অধিকার ওয়াকফ বোর্ডের হাতেই ন্যস্ত ছিল। এই ধারা অনেক সময় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, কারণ বহু ক্ষেত্রে অভিযোগ উঠেছে যে ওয়াকফ বোর্ড নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে- গরিব মুসলমানদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি কিংবা অন্য ধর্মাবলম্বীদের সম্পত্তিও কখনো কখনো জোরপূর্বক অধিগ্রহণ করে ‘ওয়াকফ’ ঘোষণা করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বোর্ডের ওপর নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা এবং সম্পত্তি সংক্রান্ত নিরপেক্ষ ও ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করতেই এই সংশোধনীটি আনা জরুরি হয়ে পড়েছিল দেশের আইন প্রণেতাদের কাছে।
২০২৫ সালের ওয়াকফ আইন সংশোধনের আগে ওয়াকফের দখল করা জমি বা সম্পত্তিতে কোনোভাবেই পর্যালোচনা করার সুযোগ ছিল না। এমনকী কারও আপত্তি সত্ত্বেও জমি বা সম্পত্তি দখল করতে পারে ওয়াকফ বোর্ড। ওয়াকফ সম্পত্তির সমস্ত সুবিধা ভোগ করছে বলা যায় দেশের একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী। বঞ্চিত হয়েছেন সাধারণ মুসলমানরা। নতুন আইন কার্যকর হওয়ার ফলে সাধারণ মুসলমানরা উপকৃত হবেন। তাছাড়া সাচার কমিটির রিপোর্টেও বলা হয়েছিল ওয়াকফ নিয়মের সংস্কারের প্রয়োজন। তাই ওয়াকফ আইন সংশোধন ছিল সময়ের দাবি।
তাই বর্তমান সংশোধনী আইন ২০২৫-এর মাধ্যমে একদিকে যেমন প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, ওয়াকফ ডিজিটাল নথিভুক্তি ও অডিট ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, অন্যদিকে মজহবের নাম করে অন্যের জমি দখলের প্রবণতারও অবসান ঘটানো হয়েছে। বিশেষ করে, আইনের নতুন ধারা ৩ (3E)-তে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, তফশিলি জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল- যা সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফশিলিভুক্ত-সেখানে ওয়াকফ সম্পত্তি ঘোষণা নিষিদ্ধ। অসম রাজ্য, যার ৮টি জেলা ষষ্ঠ তফশিলভুক্ত, এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের আবেদন দাখিল করে সংসদের পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছে। এর পাশাপাশি রাজস্থান, ছত্তিশগড়, উত্তরাখণ্ড, হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্র রাজ্যগুলিও একই রকম আবেদন দাখিল করেছে।
অপরদিকে, ভারতীয় সংসদ এই সংশোধনী আইনটি প্রণয়নের মাধ্যমে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে যে, মজহবি রীতি ও বিশ্বাসের নামে অন্যের মালিকানাধীন জমি জোরপূর্বক অধিগ্রহণ করা যাবে না। সংবিধানের সেকুলার চেতনা অনুযায়ী কোনো মজহবি প্রতিষ্ঠানকে এমন অবারিত ক্ষমতা দেওয়া যায় না, যাতে তারা ব্যক্তিগত বা সরকারি জমিকে নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করতে পারে। ওয়াকফ আইন, ১৯৫৪ এবং ১৯৯৫- মূলত সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী ছিল, যা ২০২৫-এর সংশোধনীর মাধ্যমে শোধন বা সংস্কার করা হয়েছে। এটি এখন একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সংবিধানসম্মত কাঠামো পেয়েছে।
এই সংশোধনী আইনটি মুসলমান সমাজের মহিলাদের ক্ষমতায়নের দিকেও একটি সুস্পষ্ট পদক্ষেপ। ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকে তালাকপ্রাপ্ত, বিধবা ও এতিম মহিলাদের জন্য আর্থিক সহায়তা বরাদ্দ করা হবে। ‘ওয়াকফ আল-আল-আউলাদ’ প্রথার অন্তর্ভুক্ত মহিলাদের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দাবিগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এর ফলে, দীর্ঘদিন ধরে মহিলারা যেসব অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন, তা ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড ও কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে দু’জন করে মহিলা সদস্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যাতে তারা নীতিনির্ধারণী স্তরে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন। পাশাপাশি বোর্ডে অমুসলমান সদস্য রাখারও প্রস্তাব রাখা হয়েছে- এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ। এর ফলে বোর্ডের কাজকর্মে বৈচিত্র্য, সহনশীলতা এবং আইনি ভারসাম্য তৈরি হবে। কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী কিরেন রিজিজু সংসদে বলেছেন, বিভিন্ন রাজ্যের ওয়াকফ বোর্ড যেহেতু অমুসলমানদের জমি ‘ওয়াকফ’ হিসেবে দাবি করছে, সেহেতু সেইসব জমিজমা সংক্রান্ত শুনানিও একতরফা হতে পারে না। ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলমান সদস্যের অন্তর্ভুক্তি আনতে পারে আইনি ভারসাম্য।
এই আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় একটি ওয়াকফ পোর্টাল তৈরি হবে, যেখানে সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তির নথি ও ব্যবস্থাপনার তথ্য থাকবে। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ বা প্রশাসন সহজেই দেখতে পারবে কোন সম্পত্তি কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার মালিকানা কী এবং সেই সম্পত্তি থেকে হওয়া আয় কোথায় ব্যয় হচ্ছে। এটি দুর্নীতি রোধে এক কার্যকর হাতিয়ার হয়ে উঠবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, এই আইন স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, মজহবি আচ্ছাদনে কোনো সম্প্রদায়ের পক্ষেও দেশের আইন ও সংবিধানের ঊর্ধ্বে যাওয়া সম্ভব নয়। ওয়াকফ বোর্ডের আগের স্বেচ্ছাচারী আচরণে যেমন জমির জবরদখল, বৈষম্যমূলক ব্যবহার, নারী ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বঞ্চনা দেখা গিয়েছিল, তেমনি এখন নতুন আইনের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।
উপসংহারে বলা যায়, ওয়াকফ সংশোধনী আইন ২০২৫ শুধুমাত্র মুসলমান সমাজ নয়, বরং সমগ্র দেশের জন্য একটি ন্যায়ভিত্তিক ও প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলবে। এই আইন সংবিধানের মৌলিক চেতনা- সর্বপন্থসমভাব সমতা, ব্যক্তি-অধিকার ও সুশাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা ভবিষ্যতের একটি দায়িত্বশীল, কল্যাণমুখী ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে সহায়ক হবে।


রবীন্দ্র মূল্যায়নে অসফল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ড. বাপ্পাদিত্য মাইতি
এক সময়ের ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’, বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু ১৯২১ সালে ফিলিপ জোসেফ হারটগকে উপাচার্য করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ আসেন ১৯২৬-এর ১০ ফেব্রুয়ারি, তখন তিনি ভুবনজয়ী কবি। সাহিত্যে এশিয়ার প্রথম নোবেল প্রাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ ১০ ফেব্রুয়ারি ও ১৩ ফেব্রুয়ারি মাত্র দুদিন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন। অসুস্থতার জন্য তাঁর কয়েকটি কর্মসূচি স্থগিত হয়ে যায়। ১০ আগস্ট তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছাত্র ইউনিয়নে দুটো লিখিত বক্তৃতা দিলেন- ‘The Rule of the Giant’ ও ‘The Meaning of Art’। জগন্নাথ হলের ছাত্রদের অনুরোধে তিনি লিখলেন বিখ্যাত এই গান- ‘এই কথাটি মনে রেখো,/তোমাদের এই হাসি খেলায়/আমি যে গান গেয়েছিলেম/ জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।’ এই গান অবশ্য কোনো অজানা কারণে পরে ১৯৮১-এ জগন্নাথ হলের হীরক জয়ন্তীর সময় প্রকাশিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে অনুষ্ঠান হয়েছিল তা মূলত ছাত্র সংসদের উদ্যোগে। ছাত্র সংসদের অনুষ্ঠানে কবি যখন বক্তৃতা করেছিলেন তখন সম্ভবত নিয়ম রক্ষার্থে সভাপতিত্ব করেছিলেন উপাচার্য জিএইচ ল্যাঙলি। এমনকী রবীন্দ্রনাথের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান কোথায় হবে তা নিয়েও দ্বন্দু ছিল। হয়তো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে চোখা আক্রমণ করেছিলেন বলেই ব্রিটিশ পরিচালিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনায় প্রতিবাদী কবির প্রতি এমন ঠাণ্ডা অভ্যর্থনা!
১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার এএফ রহমান এবং রেজিস্ট্রার নাজিরুদ্দিন আহমেদ রবীন্দ্রনাথ-সহ আটজনকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধি গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানান। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাকি সাতজন হলেন- ১. বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য স্যার জন অ্যান্ডারসন, ২. স্যার আবদুর রহিম, ৩. স্যার জগদীশচন্দ্র বসু, ৪. স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ৫. স্যার যদুনাথ সরকার, ৬. স্যার মুহম্মদ ইকবাল, ৭. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
রবীন্দ্রনাথ এলেন না ডিলিট নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার আগের বছর অর্থাৎ ১৯৩৫-এ তিনি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট নিয়েছেন। কিন্তু ঢাকা এলেন না অসুস্থতার কথা বলে। যদিও ১৯৩৬ নয়, ১৯৩৭-এ তিনি অসুস্থ হন। ১৯১৩-র নোবেল প্রাপককে এতো দেরী করে সাম্মানিক ডি.লিট দেওয়ার জন্য কি এই ক্ষোভ? নাকি উপরোক্ত অন্য সাতজনের সঙ্গে সাম্মানিক ডি.লিট প্রাপ্তি তাঁর মতো মহাজাগতিক প্রতিভার কাছে অমর্যাদার মনে হয়েছিল? যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর আগে আরও কয়েকজনকে সাম্মানিক ডি.লিট প্রদান করেছে। পূর্ববর্তী বিভিন্ন সময়ের ডিগ্রি প্রাপকদের মধ্যে আছেন আর্ল অব রোলান্ডস, জোসেফ হারটগ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রমুখ। ১৯২৬ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ প্রথমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন তখন তো পৃথিবীর এই মহত্তম কবিকে সাম্মানিক ডি.লিট দেওয়া যেত। কিন্তু তা হয়নি।
রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের কিছু পর দেশভাগ। ইসলামিক পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথকেই বর্জনের আহ্বান জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আলি আহসান। ১৯৫১-তে ‘মাহে নও’ পত্রিকায় তাঁর অভিমত ‘আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার এবং হয়তো বা জাতীয় সংহতির যদি প্রয়োজন হয়, আমরা রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করতে রাজি আছি। সাহিত্যের চাইতে রাষ্ট্রীয় সংহতি এই মুহূর্তে প্রয়োজন।’
পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী শাসকেরা রবীন্দ্রনাথকেই বর্জন করতে চাইলে ১৯ জন বুদ্ধিজীবী বিরোধিতা করেন। আবার এঁদের মুক্ত চিন্তার বিরোধিতা করে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, কেএমএএ মুনিব, মহম্মদ শাহাবুদ্দিন প্রভৃতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচজন অধ্যাপক বিবৃতি দিলেন। তাঁদের মূল অভিযোগ রবীন্দ্রনাথ হিন্দু কবি ও সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অপূর্ব সংসদ’, ‘ক্রান্তি’ ইত্যাদি সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তি আন্দোলনের প্রেরণা রবীন্দ্রনাথেই খুঁজে পেলেন। পাকিস্তানের অধীনে চব্বিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবই সক্রিয় ছিল।
পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হলে রবি-গান হলো জাতীয় সংগীত। কিন্তু স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে শীতল কখনো-বা ঋণাত্মক মনোভাবে ভাটা পড়েনি। স্বাধীনতা প্রাপ্তির সামান্য পরে ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী আহমেদ শরিফ পূর্বজদের মনোভাবকেই আরও বলিষ্ঠ করতে চাইলেন- ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের সম্পদ নন। তাঁর সাহিত্য বাঙ্গালির অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে না।’
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের এই অধ্যাপকের বিরূপ মনোভাব বড়ো কর্কশ। ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করলেন নির্লজ্জ সংকীর্ণতায়। ১৯৮৬ সালে ‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মের রবীন্দ্র মূল্যায়ন’ প্রবন্ধে তিনি লিখলেন-‘ভূতে ভগবানে ছিল তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) সমান বিশ্বাস। আমৃত্যু ভৌতিক প্ল্যানচেটে ছিল তাঁর গভীর আস্থা। আর কে না জানে এ ধরনের আস্তিকতা মানস মুক্তির একটা বড়ো অন্তরায়। রক্ত মাংসের মানুষ রবীন্দ্রনাথ কামে প্রেমেও উদাসীন ছিলেন না কখনো।’
প্রবন্ধটির শেষাংশে বলা হয়-‘রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ব্যক্ত-অব্যক্ত, সত্য-মিথ্যা, লঘু-গুরু অনেক অনুযোগ অভিযোগ রয়েছে। খোঁজও মিলেছে তাঁর অনেক অপূর্ণতার ও ত্রুটির।’ কিন্তু প্রশ্ন হলো পৃথিবীর কেউই অপূর্ণতা ও ত্রুটি মুক্ত নয়। প্রাবন্ধিক খুঁজে খুঁজে শুধু রবীন্দ্রনাথই এমন অপূর্ণতা ও ত্রুটি পেলেন? আসলে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু বলেই এমন বিরোধিতা। বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের সাহিত্য ত্রুটিহীন নয়। রবীন্দ্রনাথ যদি মহাজাগতিক বিস্ময় হন, নজরুল নিতান্তই সীমায়িত আলো। কিন্তু আক্রমণ তো রবীন্দ্রনাথকেই করতে হবে। তাঁর নাম তাই আক্রমণের লক্ষ্য হয় নানা ভাবে। বারেবারে। তা সে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ হোক।
এহো বাহ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আফতার আহমাদ ‘হিন্দু’ রবীন্দ্রনাথের গান জাতীয় সংগীত হিসেবে যে বিবেচিত হতে পারে না, তা জানাতে মুক্তকচ্ছ হয়েছিলেন। জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’-র সৃষ্টির শতবর্ষ এক প্রকারে নীরবেই বাংলাদেশে অতিক্রান্ত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এক্ষেত্রে একেবারেই নিশ্চুপ।
রবীন্দ্রনাথ তো মানবতার চেতনার রং। পূর্ববঙ্গকে নিয়ে তাঁর বিপুল সাহিত্যকীর্তি। তাঁকে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার দায় তো ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। বাংলা বিভাগ ও সংগীত বিভাগ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি বিপন্ন। আরও এক ভয়াবহ তথ্য আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবিভাগে ১৯২১ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ১৭৭ জন পিএইচডি হয়েছেন। এঁদের মধ্যে মাত্র চারজন রবীন্দ্র গবেষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ থেকে নানা ‘গবেষণা পত্রিকা’ থাকলেও কোথাও রবীন্দ্র সংখ্যা নেই। জাতীয় সংগীতের রচয়িতার নামে কোনো চেয়ারও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই। কেন এতো উপেক্ষা? কেন ভুলিয়ে দেওয়ার এত ব্যর্থ অপপ্রয়াস? রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় হিন্দু বলেই সমস্যা। স্পষ্ট কথায় তিনি বিধর্মী- বিশেষত হিন্দু। এবার তো লুঠতরাজের সময় জেহাদিদের দ্বারা তাঁর মূর্তি ভাঙা বাংলাদেশে একটি ভয়াবহ সংস্কৃতি হয়ে ওঠে। তবে এও সত্যি, কিছু মুক্তমনের মানুষ রবীন্দ্রনাথকে এই প্রতিকূলতায়ও বাঁচিয়ে রেখেছেন। হুমায়ুন আজাদ মোল্লাবাদীদের হাতে নিহত হওয়ার আগে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতায় অস্বীকার করতে গিয়ে অন্তর্গত সত্তাই রবীন্দ্রময় হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাদ্রাসায় রূপান্তরিত হতে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে হারিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাই ব্রাত্য। অন্যদিকে মুক্ত পৃথিবীতে কবি ও দার্শনিক হলেন চিন্তার স্বরূপ, প্রতিবাদের ভাষা, ব্যানারের ক্যাচলাইন- বিশ্বাসের ধ্রুবতারা। রবীন্দ্রনাথ গোটা বিশ্বের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমশ সংকীর্ণ হতে থাকা পরিমণ্ডলে তাঁকে মুছে ফেলার অপপ্রয়াসে যতই তীব্র হোক আবিশ্ব, তাঁর অপরিসীম সৃষ্টিশীলতাকে ঢেকে রাখা যাবে না।


রাজ্য সরকার অযোগ্যদের বাঁচাতে যোগ্য শিক্ষকদের বলি চড়াল
আনন্দ মোহন দাস
‘এগিয়ে বাংলা’। ইতিমধ্যে সকলে জেনে গেছেন ভারতবর্ষে শিক্ষাক্ষেত্রে বৃহত্তম নিয়োগ দুর্নীতি ধরা পড়েছে এই রাজ্যে। রাজ্যের শাসকদল তথ্য প্রমাণ লোপাট করে শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। শিক্ষকদের মান মর্যাদা, সামাজিক সম্মান ও শ্রদ্ধাকে ধূলায় মিশিয়ে দিয়ে বর্তমান রাজ্য সরকার প্রায় ২৬,০০০ শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীকে পথে বসিয়েছে। সম্পূর্ণ শিক্ষককুলকে কলঙ্কিত করে যোগ্য অযোগ্যের বেড়াজালে শিক্ষক সমাজকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে সকলে জানতে পারলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অভূতপূর্ব দুর্নীতির ফলে রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে ২৫,৭৫৩ জন শিক্ষকের চাকরি বাতিল হলো। হাইকোর্ট শিক্ষা পর্ষদ, স্কুল সার্ভিস কমিশন ও রাজ্য সরকারকে শিক্ষক নিয়োগে কারচুপি ও ঘোটালার জন্য তীব্র ভর্ৎসনা করছে। রাজ্য সরকার যোগ্য ও অযোগ্য শিক্ষকদের পৃথক না করে দেওয়ায়, পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। অসাধু উপায় অবলম্বন করে শিক্ষক নিয়োগের ফলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হলো।
রাজ্যের দুর্নীতির মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত হলো। একদা শিক্ষা, শিল্পে সমৃদ্ধ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটির সঙ্গে আজ দুর্নীতি শব্দটি যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। এর আগে শাসকদলের বদান্যতায় বালি, কয়লা, গোরু, পাথর, রেশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে চুরি করে শাসকদলের নেতা-নেত্রীদের পকেট ফুলেফেঁপে উঠেছে। এই অভিযোগের নিষ্পত্তি আজও আদালতের কাঠগড়ায় আটকে রয়েছে। কয়েকজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা জেলের ভাত খেয়ে বর্তমানে জামিনে বাইরে রয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাসকদল কোনো রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কারণ দলের উঁচু থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত সকলেই কোনো না কোনো ভাবে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। এরাজ্যে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।
জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাকে ভেঙে দেওয়ার পাকাপাকি ব্যবস্থা করেছে শাসকদল। কারচুপির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের জন্য একসঙ্গে প্রায় ২৬,০০০ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের চাকরি চলে যাওয়ার ফলে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার করুণ অবস্থা। এত সংখ্যক ব্যক্তির চাকরি চলে যাওয়ার অর্থ প্রায় লক্ষাধিক লোক নিশ্চিতভাবে এর দ্বারা প্রভাবিত হবেন। এই ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষক যোগ্য অযোগ্যের বিভাজনে নিজেদের আত্মসম্মান নিয়ে চাকরি করতে দ্বিধাবোধ করছেন। তাই আন্দোলনকারীরা বলছেন, মাইনের চেয়ে আমরা আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই। উচ্চ শিক্ষিত যোগ্য শিক্ষকরা যাঁরা যোগ্যতা অর্জন করে শিক্ষকতা করছিলেন, তাঁদের সঙ্গে অযোগ্যদের মিশিয়ে দিয়ে রাজ্য সরকার প্রকৃত শিক্ষকদেরও সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।
একটু পিছনের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০১৬ সালে প্রায় ২২ লক্ষ চাকরি প্রার্থী নবম, দশম, একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষক এবং গ্রুপ সি পদের জন্য স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে পরীক্ষায় বসেছিলেন। সেই সময় শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীদের শূন্য পদের সংখ্যা ছিল ২৪, ৬৪০টি, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে শূন্য পদের সংখ্যা বেড়ে ২৫,৭৫৩ হয়ে যায় এবং সেই মতো ২৫,৭৫৩ জনকে নিয়োগপত্র দেওয়া হয়। ২২ লক্ষ পরীক্ষার্থীর মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতার অভিযোগ তুলে তথ্য প্রমাণ-সহ কলকাতা হাইকোর্টে বঞ্চিতরা মামলা করেন।
আদালতের নির্দেশে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিত কুমার বাগের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি তৈরি হলো এবং তাঁরা প্রাথমিকভাবে তদন্ত করে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে আদালতে রিপোর্ট পেশ করলেন। কলকাতা হাইকোর্ট নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতির তদন্তে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইকে নিযুক্ত করল। সিবিআই তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর খাটের তলা থেকে নগদ ৫০ কোটি টাকা উদ্ধার করল। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় নামে বেনামে অনেক সম্পত্তির হদিশ পাওয়া গেল। শিক্ষামন্ত্রী-সহ গোটা শিক্ষা দপ্তর জেলে চলে গেল। যে রাজ্যে পুরো শিক্ষা দপ্তর জেলে, সেখানে শিক্ষার কী অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়। এছাড়াও শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী নিয়োগে টাকা সংগ্রহ করার অপরাধে জেলায় জেলায় তৃণমূলের নেতারা সিবিআইয়ের হাতে ধরা পড়তে লাগলো। ইডি ও সিবিআই তদন্তের জালে অনেকে জড়িয়ে গেলেন। যদিও এখন পর্যন্ত এই মামলা আদালতে বিচারাধীন। বর্তমান প্রজন্মের কাছে শিক্ষকদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হলো। রাজ্য সরকার অযোগ্যদের বাঁচাতে গিয়ে যোগ্য শিক্ষকদের বলি চড়াল প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রথমে কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গেল বেঞ্চের রায়ে ৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর দুর্নীতির দায়ে অযোগ্য ঘোষিত হয়ে চাকরি বাতিল হয়েছিল। কিন্তু রাজ্য সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে এবং সুপ্রিম কোর্ট সাময়িক স্থগিতাদেশ দিয়ে মামলাটির শুনানির জন্য কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে স্থানান্তরিত করে। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাবে এবং যোগ্য অযোগ্য সঠিকভাবে নির্ধারিত না হওয়ায় ডিভিশন বেঞ্চ সম্পূর্ণ প্যানেলটি বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। যার ফলে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারী মিলে একজন বাদে ২৫,৭৫২ জনের চাকরি চলে যায়।
এই রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকার পুনরায় সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে। সুপ্রিম কোর্ট নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পর্ষদ ও রাজ্য সরকারের কাছে যোগ্য ও অযোগ্যদের তালিকা জমা করার আদেশ দেয়। কিন্তু দীর্ঘ টালবাহানার পরেও পর্ষদ ও স্কুল সার্ভিস কমিশন সঠিক তালিকা জমা দিতে অক্ষম বলে জানায়। কারণ হিসেবে পর্ষদ ও স্কুল সার্ভিস কমিশন সঠিক তালিকা জমা দিতে অক্ষম বলে জানায়। কারণ হিসেবে পর্ষদ আদালতে জানায়, পরীক্ষার ওএমআর শিট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তার স্ক্যান কপিও সংরক্ষণ করা হয়নি। তার ফলে গত ৩ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ বাধ্য হয়ে স্বচ্ছতার অভাবে পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটি বাতিল করে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের রায় বহাল রাখেন। যার ফলে প্রায় ২৬,০০০ শিক্ষক ও গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি কর্মচারী চাকরি হারালেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি বাতিলের পরিসংখ্যানটি হলো নিম্নরূপ:
১. ২০১৬ সালের এসএসসি-র মোট নিয়োগপত্র ২৫,৮৪৪|
২. তার মধ্যে যে মোট নিয়োগ ২৫,৭৫৩।
৩. ইনসার্ভিস পারবেন)। ৪২৫ (এঁরা আগের কর্মস্থলে যোগদান করতে
৪. ইনসার্ভিস বাদে মোট নিয়োগ ২৫,৭৫৩-৪২৫ = ২৫,৩২৭।
৫. ক্যানসার রোগী সোমা দাসকে বাদ দিলে সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫, ৩২৭।
৬. সর্বমোট চাকরি বাতিল = ২৫,৩২৭।
এই ২৫,৩২৭ জন বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে অযোগ্য বিবেচিত হয়েছেন (ক) ওএমআর কারচুপি এবং র‍্যাঙ্ক জাম্প করে চাকরি পেয়েছেন = ৪,৩২৭। (খ) এসএসসি-র সুপারিশ ছাড়াই চাকরি পেয়েছেন – ২,৮২৩। (গ) প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও চাকরি পেয়েছিলেন ১,১৭৪। মোট (ক) + (খ)+ (গ) ৮,৩২৪।
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, এই অযোগ্য চাকরি প্রাপকদের অবিলম্বে বার্ষিক ১২ শতাংশ সুদ-সহ বেতন ফেরত দিতে হবে। এছাড়াও সিবিআই তদন্তের মাধ্যমে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীদের নিয়োগে নিম্নলিখিত কারচুপিগুলি সামনে উঠে এসেছে।
১. ওএমআর শিটে কারচুপি করা এবং তা পুড়িয়ে দেওয়া।
২. নম্বর বাড়িয়ে র‍্যাঙ্ক পরিবর্তন করা।
৩. ইন্টারভিউয়ের নম্বরে কারচুপি করা।
৪. এসএসসি-র রেকমেন্ডেশন ছাড়াই নিয়োগ করা।
৫. প্যানেলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও নিয়োগ করা।
৬. শূন্য খাতা জমা দিয়েও চাকরি পাওয়া।
এই সমস্ত অন্যায় কাজগুলি বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে করা হয়েছে যা সিবিআই ও ইডির তদন্তে উঠে এসেছে। ওএমআর শিটগুলির স্ক্যান কপি না রেখে পুড়িয়ে দেওয়ার একমাত্র কারণ হলো, যাতে ভবিষ্যতে কেউ দুর্নীতির হদিশ করতে না পারে। সবচেয়ে পরিতাপের বিষয় হলো এই বিশাল পরিমাণ দুর্নীতির জন্য রাজ্য সরকার নিজেদের দায় স্বীকার না করে, কখনো বিজেপির ঘাড়ে, কখনো বঞ্চিতদের উকিলের ঘাড়ে, বিচারপতির বিরুদ্ধে এবং সুপ্রিম কোর্টকে দোষারোপ করে নিজে সাধু সাজছে। মুখ্যমন্ত্রী বলতে লাগলেন, ‘ভাত দিতে পারে না, কিল মারার গোঁসাই।’ একেবারে নির্লজ্জতার শেষ সীমায় পৌঁছালে তবেই কোর্টের রায় নিয়ে এই ধরনের মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করা সম্ভব। মুখ্যমন্ত্রী নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়ামে নিজেদের কিছু ধামাধরা ব্যক্তির উপস্থিতিতে কয়েকজন যোগ্য নামাঙ্কিত চাকরিহারাদের সামনে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেন এবং প্ল্যান এবিসিডি তৈরি আছে বলে মিথ্যা আশ্বস্ত করলেন। কিন্তু কি সেই প্ল্যান তিনি প্রকাশ করলেন না। তিনি আইনি পথে সমস্যা সমাধানের কোনো আশার আলো দেখাতে পারলেন না। কেবলমাত্র বিরোধীদের উপর দোষ চাপানো এবং নিজেদের সাফাই গাওয়ার জন্য সমাবেশটিকে বেছে নিলেন।
কখনো শিক্ষামন্ত্রী আলোচনায় যোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করবেন বলে আশ্বাস দিচ্ছেন, আবার পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টের দোহাই দিয়ে তালিকা প্রকাশ না করার কথা বলছেন। সুতরাং সরকার যে তালিকা বের করার মাধ্যমে স্বচ্ছতা চায় না, তা তাদের আচরণে প্রকাশ পেয়েছে। প্রাক্তন বিচারপতি তথা বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গাঙ্গুলি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যোগ্য অযোগ্যের তালিকা প্রকাশের বিষয়ে কোনো রকম বাধা নেই। প্রকৃতপক্ষে সরকার ও পর্যদের সদিচ্ছা নেই বলেই এই ধরনের অজুহাত খাড়া করা হচ্ছে। অথচ সাংবাদিক সম্মেলনের শিক্ষামন্ত্রী জানালেন শিক্ষকদের মাহিনার জন্য ১৭,২০৬ জন যোগ্যের তালিকা ডিআই অফিসে পাঠানো হয়েছে। তাহলে যোগ্যদের তালিকা প্রকাশ করতে অসুবিধা কোথায়? তাহলে এর পিছনে কি অন্য কাহিনি রয়েছে? সুতরাং সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী অশিক্ষক কর্মচারী বা শিক্ষাকর্মীরা স্কুলে যোগ দিতে পারবেন না।
এই তালিকা প্রকাশের দাবিতে চাকরিহারা যোগ্য শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছেন। সারা রাত জেগে গরমে কষ্টের মধ্যেও যোগ্য শিক্ষকদের তালিকা প্রকাশ করতে এবং নিজেদের সম্মান পুনরুদ্ধারে যোগ্য শিক্ষকরা কখনো শিক্ষা দপ্তরের সামনে, কখনো পর্ষদের সামনে ধরনা ও অনশন করে চলেছেন কিন্তু নির্লজ্জ সরকারের দিক থেকে কোনোরকম ইতিবাচক সাড়া নেই। এমনকী যোগ্যদের তালিকা প্রকাশের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে শিক্ষকদের পুলিশের লাঠিপেটা ও লাথিও খেতে হয়েছে। কারণ শাসকদলের ভয় রয়েছে, যোগ্যদের তালিকা প্রকাশ হলেই অযোগ্যরা ঘুষের টাকা ফেরত নেওয়ার জন্য তৃণমূল নেতাদের বাড়ি ঘেরাও করবে এবং কোর্টের নির্দেশে এতদিনের মাহিনার টাকা ফেরত দেওয়ার বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করবে। তাই তালিকা প্রকাশ না করেই যোগ্য শিক্ষকদের স্কুলে যোগ দেবার কথা বলে চলেছে। ইতিমধ্যে গত ১৭ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারের আবেদনে সাড়া দিয়ে স্কুলে পড়াশোনা চালু রাখতে যোগ্য শিক্ষকদের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বা নতুন পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হওয়া পর্যন্ত স্কুলে চাকরি করতে পারবেন বলে সংশোধিত আদেশ জারি করেছে। এক্ষেত্রে অবশ্য গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি অশিক্ষক কর্মচারীরা চাকরিতে যোগ দিতে পারবেন না। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে রাজ্য সরকার সামরিক স্বস্তি পেলেও যোগ্য শিক্ষকরা একেবারেই খুশি নয়। এই ২৬ হাজার শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মচারীর ভবিষ্যৎ যেমন ঝুলে থাকল, সেরকম রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলো। পশ্চিমবঙ্গের বুকে শিক্ষাক্ষেত্রে এই অচলাবস্থা কবে কাটবে তাতে প্রশ্ন চিহ্ন রয়ে গেল। বর্তমান প্রজন্মের কাছে শিক্ষকদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হলো। রাজ্য সরকার অযোগ্যদের বাঁচাতে গিয়ে যোগ্য শিক্ষকদের বলি চড়াল যা কখনোই কাম্য নয়।


একটি মেয়ের কুড়িটি চিঠি মৃত্যুপুরীর সঞ্জীবনী
একটি মেয়ে ৩৭ বছর বয়স। এখন সে পরিণত। এটা বুঝতে পারার জন্য যে মাত্র ৬ মাস বয়সে যখন সে মাতৃহারা হয়, যখন তার মায়ের ৩১ বছর বয়স। কী মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কষ্ট পাচ্ছিল তাঁর মা। তিনি মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন আর শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন তাঁর স্বামী সেই দেশের সবথেকে শক্তিশালী মানুষটিকে। সেই মানুষটি এই ৩৭ বছরের মেয়েটির বাবা সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বাধিনায়ক জোসেফ স্ট্যালিন।
প্রথম পর্ব
পিন্টু সান্যাল
দেশের সবথেকে শক্তিশালী মানুষ হতে গিয়ে, ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে সে কাকে মারেনি? সন্দেহ যাকে হয়েছে, তাকেই নির্বাসনে পাঠিয়েছে। সন্দেহ হলেই ‘শাস্তি’ হয় নির্বাসন নয়তো মৃত্যুদণ্ড। আর দেশের মানুষকে ঠকানোর জন্য লোকদেখানো বিচার আর অপরাধীর স্বীকারোক্তি। দেশের বা বলা ভালো সারা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তির মেয়ে হয়েও তার শৈশব কষ্টে ভরা। বাবা বলেই সে বাবাকে ভালো না বেসে পারে না, আবার বাবার অপরাধগুলোকেও না বলে পারে না। সবথেকে বড়ো অপরাধ তাকে মাতৃহারা করা।
শুধু কি তার মা? তার মাসি, মেসো, ভাই, আত্মীয়-পরিজন সবাই এই হত্যালীলার বলি হয়েছে। এমনকী বাড়ির চাকর পর্যন্ত হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।
কিন্তু হাজার হলেও বাবা তো! মন চায় না তার বাবাকে অপরাধী, গণহত্যাকারী বলতে। তাই বাবা বলে তার অপরাধকে বিশ্বের চোখে একটু কম দেখাতে, সেই গণহত্যাকারীকে প্যারানয়েড-এর রুগি বলেছে। দায় কখনো দিয়েছে তার বিশ্বস্ত কোনো আধিকারিকের ঘাড়ে, কখনো বলেছে তার বাবাকে ভুল বুঝিয়ে করানো হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো হত্যাকাণ্ডগুলিকে। কিন্তু, ইতিহাস ও তথ্যপ্রমাণ বলে অন্য কথা।
প্রতি পদে নিজের দলের কর্মী, দেশের স্বনামধন্য কবি, লেখক, বিজ্ঞানী, অধ্যাপক মেয়েটির বাবাকে ভুল ধরানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ভুল ধরানোর সাজাই হচ্ছে মৃত্যু। তার মায়ের মৃত্যুর কারণ প্রায় ৩০ বছর লুকিয়ে রাখা হয়েছিল মেয়েটির থেকে। তার মা আত্মহত্যা করেছিল, তার মামার উপহার হিসেবে দেওয়া পিস্তল দিয়ে।
স্ত্রীর আত্মহত্যার পর একটিবারের জন্যও তার বাবা মায়ের সমাধি দেখতে যায়নি আক্ষেপ মেয়েটির। সারা পৃথিবীকে সুখী করতে যে সমাজতন্ত্র রচনা করতে চায় তার বাবা, সেই মানুষটির আশেপাশে কেউ শান্তিতে থাকেনি। সবসময়ই এক ভয়ার্ত পরিবেশ। কার কখন ডাক আসে মৃত্যুর, কে কখন বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হয়। কে কখন সমাজতন্ত্রের একনিষ্ঠ ভক্ত থেকে গণশত্রুতে অভিযুক্ত হয়। সে এক ভয়ের যুগ। সেই মৃত্যুপুরীর দরজা বন্ধ। বাইরে বেরোয় না কথা। কিন্তু দেওয়ালেরও কান আছে। তাতে কী, শুনতে পাওয়া সব কান, বলতে চাওয়া সব মুখ বলা-শোনার আগেই বন্ধ করে দিতে পারে তার পিতা, একটু সন্দেহ হলেই। অবাক করার বিষয় হলো, যে মানুষটি তার নিজের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলেছিল, লক্ষ লক্ষ কৃষককে অনাহারে থাকতে বাধ্য করেছিল, তার নিজের স্ত্রী-ছেলে-মেয়ের জীবনকে দুর্বিষহ করেছিল, আত্মীয়-পরিজনকে শুধুমাত্র মৃত্যু দিয়েছিল, সেই মানুষটি আর তার মতাদর্শকে সামনে রেখে নতুন সমাজ রচনা করতে চায় একটি দল।
সেই মানুষটি; যার মেয়ে তার বাবার হত্যার কাহিনি বর্ণনা করেছে আর তার বাবার মতাদর্শ থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে নিজেকে, সেই মানুষটি নাকি একটি দলের নায়ক। শুধু মায়ের মৃত্যুই নয়, মেয়ের প্রেমিককেও নিরুদ্দেশ করে দেওয়ার কারিগর তার পিতা। এতসবের প্রয়োজন নাকি সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের জন্য। গোটা পৃথিবীর কোনো শিশু-কিশোর-তরুণকে তার মতো যন্ত্রণা যাতে না পেতে হয়, এই মতাদর্শের নামে হত্যালীলার কষ্টভোগ যাতে কোনো দেশের মানুষকে না করতে হয়, তার জন্য বিশ্বের সামনে নিজের কাহিনি তুলে ধরেছিল মেয়েটি।
বাবাকে সে ভালোবাসে- এ কথা বলেও তার বাবার অপরাধ সে নিজেই বলে গেছে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে সুখী করার জন্য।
ইংরেজি শেখার চেষ্টায় ইংলিশ ও আমেরিকান খবরের কাগজ পড়তো মেয়েটি। হঠাৎ করে আবিষ্কার করলো, ১৯৩২ সালের ৮ নভেম্বর তার মা আত্মহত্যা করেছে। ছুটে গেল তার দিদিমার কাছে, জিজ্ঞাসা করলো কেন এতদিন লুকিয়ে রাখা হয়েছিল এই মর্মান্তিক ঘটনা? মনে করার চেষ্টা করলো ছোটোবেলার ঝাপসা হয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো। বড়োদের কাছে এই খবর পুরাতন কিন্তু মাত্র ৬ বছর বয়সে তার মা যেন তার সামনেই আত্মহত্যা করলো। মাতৃহারা মেয়ে, বিধ্বস্ত হলো ভিতর থেকে।
তার ৩৬ বছরের ব্যথা শোনার মতো আত্মীয় আশেপাশে কেউ নেই। ইচ্ছা ছিল সাহিত্য নিয়ে পড়বে। পিতার অনিচ্ছায় হয়নি। ১৯৬৩ সাল। পিতা মৃত। সেই একনায়ক আর নেই, সেই গণহত্যার দিনগুলো আর নেই। কিন্তু তার মতাদর্শ আছে। কত কবি, লেখক, বিজ্ঞানী, অধ্যাপক নিজের আত্মকথা বলতে চেয়েও পারেনি, অনেকেই পালিয়েছেন। তাঁর বাবাই এরকম কত লেখক, অধ্যাপক, বিজ্ঞানীকে গুলাগের ক্যাম্পে নির্বাসিত করেছে।
মেয়েটির স্মৃতিকথা ১৯৬৩-র সোভিয়েত রাশিয়াতেও নিষিদ্ধ। ভারতীয় রাজদূত টিএন কৌলের মাধ্যমে তার আত্মকথার পাণ্ডুলিপি ভারতে পৌঁছায়। সারা বিশ্বের মানুষের উদ্দেশে লেখা চিঠিগুলো ‘Twenty Letters to a Friend’ নামে প্রকাশিত হয়। বিশ্বের সবথেকে বড়ো গণহত্যাকারীর মেয়ে হিসেবে নিজের বাবার কুকীর্তি বলার ব্যথা কম নয়। অনেক সমালোচক এই স্মৃতিকথাকে স্তালিনের অপরাধকে আড়াল করে NKVD চিফ বেরিয়ার ঘাড়ে দেওয়ার কৌশল বলে মনে করেন। কিন্তু স্তালিনের মেয়ে শ্বেতলানা আলিলুয়েভা’র এই বেদনাতুর জীবনের স্মৃতিচারণা বিশ্বশান্তির জন্য তার অনবদ্য প্রয়াসের জন্যই প্রশংসনীয়। কারণ একদিকে এই স্মৃতিকথা যেমন তার ব্যথাকেই খুঁচিয়ে দিয়েছিল, আবার অন্যদিকে তার গণহত্যাকারী পিতার সমর্থক দুনিয়া জুড়ে যারা বিশ্বাস করে যে সুখী সমাজ গড়ার পথ স্তালিনের দেখানো বিপ্লবের পথ, স্তালিন তাদের কাছে নায়ক, স্তালিন তাদের আরাধ্য।
গুলাগ থেকে ফিরে এসে আত্মকাহিনি লিখেছেন এরকম লেখক যেমন আছেন, সোভিয়েত রাশিয়া থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যাওয়া নেতা, কবি, আধিকারিক প্রচুর, যারা সোভিয়েত রাশিয়ায় মানব সভ্যতার চরমতম দুর্দিনের সাক্ষী। কিন্তু তাদের মধ্যে শ্বেতলানা অনন্যা, কারণ তিনি গণহত্যাকারীকে মেয়ে হিসেবে ভালোবেসেও অকপটেই সত্য তুলে ধরেছেন। স্তালিনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তার পরিবার কীভাবে তার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বলি হয়েছিল, তার একমাত্র সাক্ষী তিনি। শ্বেতলানাই সেই মৃত্যুপুরী থেকে সারা বিশ্ববাসীকে কমিউনিজমের বিষ থেকে রক্ষা করতে সঞ্জীবনী এনেছেন।

READ ALSO

15th September বিশেষ নিবন্ধ

15th September বিশেষ নিবন্ধ

September 22, 2025
15th September বিশেষ নিবন্ধ

15th September বিশেষ নিবন্ধ

September 19, 2025
ShareTweetShare

Related Posts

15th September বিশেষ নিবন্ধ
বিশেষ নিবন্ধ

15th September বিশেষ নিবন্ধ

September 22, 2025
15th September বিশেষ নিবন্ধ
বিশেষ নিবন্ধ

15th September বিশেষ নিবন্ধ

September 19, 2025
08th September বিশেষ নিবন্ধ
বিশেষ নিবন্ধ

08th September বিশেষ নিবন্ধ

September 12, 2025
01st September বিশেষ নিবন্ধ
বিশেষ নিবন্ধ

01st September বিশেষ নিবন্ধ

September 2, 2025
01st September বিশেষ নিবন্ধ
বিশেষ নিবন্ধ

01st September বিশেষ নিবন্ধ

September 2, 2025
25th August বিশেষ নিবন্ধ
বিশেষ নিবন্ধ

25th August বিশেষ নিবন্ধ

August 28, 2025

POPULAR NEWS

4th September 2023 Rajjopat

4th September 2023 Rajjopat

September 21, 2023
৩৫০ বছর পর দেশে ফিরছে শিবাজীর বাঘনখ

৩৫০ বছর পর দেশে ফিরছে শিবাজীর বাঘনখ

October 2, 2023
কেশব ভবনে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী হানা

কেশব ভবনে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী হানা

October 4, 2023
4th September Angana

4th September Angana

September 21, 2023
2nd October 2023 Parampara

2nd October 2023 Parampara

October 1, 2023

EDITOR'S PICK

18th August বিশেষ নিবন্ধ

18th August বিশেষ নিবন্ধ

August 21, 2025
2nd October 2023 Sundar Mouliker Chithi

2nd October 2023 Sundar Mouliker Chithi

October 1, 2023
01st September বিশেষ নিবন্ধ

01st September বিশেষ নিবন্ধ

September 2, 2025
04th August বিশেষ নিবন্ধ

04th August বিশেষ নিবন্ধ

August 8, 2025

About

Follow us

Categories

  • Uncategorized
  • অতিথি কলম
  • উত্তর সম্পাদকীয়
  • পরম্পরা
  • প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • বিশেষ নিবন্ধ
  • বিশ্বামিত্রের কলম
  • রাজ্যপাট
  • সঙ্ঘবার্তা
  • সম্পাদকীয়
  • সুন্দর মৌলিকের চিঠি

Recent Posts

  • 29th September প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • 29th September পরম্পরা
  • 29th September পরম্পরা
  • 29th September পরম্পরা

© 2023 Swastika. All rights reserved.

No Result
View All Result
  • হোম
  • সম্পাদকীয়
  • রাজ্যপাট
  • সুন্দর মৌলিকের চিঠি
  • অতিথি কলম
  • বিশ্বামিত্রের কলম
  • উত্তর সম্পাদকীয়
  • প্রচ্ছদ নিবন্ধ
  • পরম্পরা
  • ই -পত্রিকা

© 2023 Swastika. All rights reserved.

Welcome Back!

Login to your account below

Forgotten Password?

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In

Add New Playlist

Are you sure want to unlock this post?
Unlock left : 0
Are you sure want to cancel subscription?