সন্ত্রাসমুক্ত অরণ্য : অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট ও লাল সন্ত্রাসের শেষ অধ্যায়
সাধন কুমার পাল
নিঃশব্দে রাত ভেদ করে, গভীর অরণ্যের আঁধারে যখন দেশ ও বিপ্লবের মুখোমুখি লড়াই চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছিল- ঠিক তখনই ভারতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচিত হলো। ছত্তিশগড়ের অবুঝমাড় অরণ্যে ‘অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট’ নামে পরিচালিত এক রোমহর্ষক অভিযানে শেষ হলো ভারতের অন্যতম কুখ্যাত ও সর্বোচ্চ পর্যায়ের মাওবাদী নেতা নম্বালা কেশব রাও ওরফে বাসবরাজুর জীবন। এই এক অভিযানেই কেঁপে উঠেছে ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের ভিত্তি- শুধু একজন শীর্ষ নেতার মৃত্যু নয়, বরং একটি চরমপন্থী মতাদর্শের চরম বিপর্যয়।
এই ঘটনার অভিঘাত শুধু জঙ্গলে সীমাবদ্ধ নেই, এর প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক মহল, বুদ্ধিজীবী মহল এবং তথাকথিত ‘লেফট-লিবারেল’ ইকোসিস্টেমেও। একদিকে সরকার যখন লাল সন্ত্রাসের মূল কাণ্ডারিদের নির্মূল করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে, অন্যদিকে কিছু মুখোশধারী শহুরে মাওবাদী ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এই অভিযানের নৈতিকতা ও মানবাধিকারের পাঠ পড়াতে।
এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব
কেমনভাবে বাসবরাজুর পতন একটি উগ্রপন্থার পতনেরও ইঙ্গিত দেয়, কেমনভাবে সরকার পরিচালিত ‘অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট’ ভারতের নিরাপত্তা নীতিতে এক মাইলফলক হয়ে উঠেছে এবং কীভাবে এই সংঘাত উন্মোচন করছে ভারতের রাজনীতি, সমাজ ও তথাকথিত প্রগতিশীলতার অন্তর্গত দ্বন্দুকে। নম্বালা কেশব রাও, যিনি বাসবরাজু নামেও পরিচিত, গত ২১ মে ছত্তিশগড়ের নারায়ণপুর জেলার অবুঝমাড় জঙ্গলে একটি বড়ো মাওবাদী-বিরোধী অভিযানে নিহত হন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মাওবাদী)-এর সাধারণ সম্পাদক এবং ওই দলের সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের শীর্ষ কমান্ডার ছিলেন। গত তিন দশকের মধ্যে নিহত সর্বোচ্চ পর্যায়ের মাওবাদী নেতা হিসেবে চিহ্নিত বাসবরাজু।
এই অভিযানে ৩১ জন মাওবাদী এবং একজন ডিআরজি সদস্য নিহত হয়। রাওয়ের মাথার উপর সম্মিলিতভাবে ১ কোটি টাকার পুরস্কার ঘোষণা হয়েছিল এবং তিনি বহু প্রাণঘাতী হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১০ সালে ৭৬ জন সিআরপিএফ জওয়ানের হত্যা এবং ২০১৩ সালে ঝিরাম ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজন কংগ্রেস নেতাকে
হত্যা-সহ আরও মারাত্মক সমস্ত ঘটনার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন এই বাসব রাজু। তাঁর মৃত্যু মাওবাদী কর্মকাণ্ডের জন্য একটি বড়ো ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কারণ এই মৃত্যু মাওবাদী কর্মকাণ্ডকে নেতৃত্বহীন করে ফেলেছে এবং তাদের কার্যক্ষমতায় বড়ো রকমের আঘাত এনেছে। ভারত সরকার এই ঘটনাকে ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে নকশালবাদের সম্পূর্ণ অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে একটি বড়ো অগ্রগতি হিসেবে দেখছে।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আবার একবার অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছে ‘লেফট লিবারেল-ইসলামি-ইভানজেলিস্ট’ ইকোসিস্টেম। কারণ এই সিস্টেমের সেনাপতিরা ভারত সরকারের মাওবাদী নির্মূল অভিযানকারীদের জালে উঠেছে। জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরা পড়লে যাদের মাথার দাম উঠেছিল কোটি কোটি টাকা সেই সমস্ত নিরাপত্তা রক্ষীদের জালে রাঘববোয়াল ধরা পড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই যারা ভারতবর্ষকে চীনের মতো কয়েদ খানা কিংবা দারুল ইসলামের চারণভূমি অথবা ভ্যাটিকানের অনুগামী করে তুলতে চায়, তারা আর বসে থাকে কী করে! বিশ্বজুড়ে এরা পরস্পর লড়াই করলেও ভারতবর্ষে এরা এক হয়ে লড়ছে। যারা কিনা বলে
বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস, সেই রক্তপিপাসু মাওবাদী নেতাদের ‘গরিবের বন্ধু’, ‘বঞ্চিতের আওয়াজ’ ইত্যাদি তকমায় ভূষিত করে ভারত সরকারকে গণতন্ত্রের পাঠ পড়াতে, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পাঠ পড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে এই ইকোসিস্টেম। এদের বক্তব্য শুনলে যে কোনো মানুষ ভড়কে যেতে বাধ্য। এরা উচ্চশিক্ষিত মুখোশধারী সন্ত্রাসবাদী। এদের হাতে অস্ত্র থাকে না। কলম ও ক্যামেরা হচ্ছে এদের মূল অস্ত্র। সিপিআই(এমএল) লিবারেশন শীর্ষ মাওবাদী নেতা বাসবরাজুর হত্যার ঘটনাকে ঠাণ্ডা মাথায় ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিহিত করেছে।
সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা, বাসবরাজুর হত্যাকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে লিখেছেন, “ছত্তিশগড়ে একজন সিনিয়র মাওবাদী নেতা এবং বেশ কয়েকজন জনজাতি মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে সিপিআই। এটি বিদ্রোহ দমন অভিযানের আড়ালে বিচার বহির্ভূত পদক্ষেপের আরেকটি উদাহরণ। আইনসম্মত গ্রেপ্তারের পরিবর্তে বারবার প্রাণঘাতী শক্তির ব্যবহার গণতান্ত্রিক রীতিনীতি ও আইনের শাসনের প্রতি সরকারের অঙ্গীকার নিয়ে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি করে।” মাওবাদী নেতাদের সরকারের প্রতি খোলা চিঠি : ‘অপারেশন কাগার’ বন্ধ করে শান্তি আলোচনার আহ্বান ও অস্ত্রবিরতির আবেদনে ২০২৫ সালের ২ এপ্রিল, সিপিআই (মাওবাদী) মুখপাত্র অভয়ের মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জানায় যে তারা অবিলম্বে অস্ত্রবিরতি চায় এবং সরকার যদি মাওবাদী বিরোধী সামরিক অভিযান বন্ধ করে এবং ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ ও তেলেঙ্গানার মতো এলাকায় নিরাপত্তা শিবির তুলে নেয়, তাহলে তারা শান্তি আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। তারা দাবি করে, গত ১৫ মাসে ‘অপারেশন কাগার’-এর নামে ৪০০-রও বেশি মাওবাদী সদস্য ও জনজাতি সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। এছাড়াও, তারা নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বেআইনি আটক, মহিলা যোদ্ধাদের ওপর যৌন হিংসা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে।
গত ২১ এপ্রিল থেকে ১১ মে ২০২৫ পর্যন্ত পরিচালিত ২১ দিনব্যাপী ‘অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট’ মাওবাদীদের একটি পরিচিত শক্ত ঘাঁটি কারেগুত্তালু পাহাড় (কেজিএইচ)-কে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়েছিল। অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্টের সাফল্যের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকজন সিনিয়র মাওবাদী কমান্ডারকে নির্মূল বা আহত করা, যার
অভিযানে নিহত শীর্ষস্থানীয় মাওবাদী নেতা বাসবরাজু
মধ্যে মাওবাদীদের সশস্ত্র শাখা পিপলস লিবারেশনে গেরিলা আর্মি (পিএলজিএ)-র নেতারাও ছিলেন। এই অপারেশনে ১৬ জন মহিলা-সহ মোট ৩১ জন মাওবাদী নিহত হয়েছে এবং ২০ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে যাদের বিরুদ্ধে ১.৭২ কোটি টাকা সমষ্টিগত পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। মাওবাদী চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত এই অভিযানটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড়ো হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এর ফলে ৪৫০টি ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভডিভাইস (আইইডি), ৮০০টিরও বেশি ব্রিগেড গ্রেনেড লঞ্চার (বিজিএল) শেল এবং বিপুল পরিমাণে বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও, মেগা অভিযানের সময় প্রায় ১২ হাজার কিলোগ্রাম খাদ্যদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে।
বিজিএল শেল, ঘরে তৈরি অস্ত্র এবং আইইডি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত কমপক্ষে চারটি প্রযুক্তিগত ইউনিট সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা হয়েছে। অভিযানের সময় ২১০টিরও বেশি মাওবাদী আস্তানা (গুহার মতো বাঙ্কার) সফলভাবে শনাক্ত এবং ধ্বংস করা হয়েছে। মাওবাদীদের কারিগরি বিভাগ এই আস্তানাগুলিকে অস্ত্র তৈরির ইউনিট হিসেবে ব্যবহার করছিল। এই বাঙ্কারগুলির অস্তিত্ব প্রমাণ করে কারেগুত্তালু পাহাড়কে নিষিদ্ধ মাওবাদীরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের নিরাপদ স্বর্গ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। সিআরপিএফের ডিরেক্টর জেনারেল জ্ঞানেন্দ্র প্রতাপ সিংহ জানিয়েছেন, ২০২৬ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মাওবাদী নির্মূল করার সংকল্প পুরণে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা ৩১টি মৃতদেহ উদ্ধার করেছি এবং এটি ১২০০
বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং আমাদের কাছে তথ্য আছে যে এই অভিযানে আরও বেশি সংখ্যক মাওবাদীকে নিকেশ করা সম্ভব হয়েছে। উদ্ধার হওয়া ৩১ জন মৃত মাওবাদীর মধ্যে ২৮ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এই অভিযানের নামকরণ করা হয়েছিল অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট এবং কোবরা, সিআরপিএফ এবং ছত্তিশগড় পুলিশের দল এই অভিযানে সামিল ছিল। এত বড়ো মাপের জঙ্গি দমন ও অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা আগে ঘটেনি। এটি আমাদের জন্য একটি বড়ো সাফল্য।
এটি উল্লেখযোগ্য যে কেন্দ্রীয় সরকার আগামী বছরের মার্চ মাসের আগেই দেশ থেকে ‘লাল সন্ত্রাস’ নির্মূল করার সংকল্প নিয়েছে। এর আগে সরকার ঘোষণা করেছিল যে, দেশে মাওবাদী সন্ত্রাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলির সংখ্যা ২০১৪ সালে ৩৫টি জেলার তুলনায় কমে ৬টিতে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া, সাম্প্রতিক কয়েক বছরে নিরাপত্তা বাহিনী নিষিদ্ধ গোষ্ঠীর আধিপত্য বিস্তারকারী এলাকাগুলিতে ৩০০টিরও বেশি নিরাপত্তা শিবির স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। মাওবাদীদের অবাধ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, যার ফলে প্রশাসন দুর্গম এলাকাগুলিতে উন্নয়নের কাজ দ্রুত করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া, নিরাপত্তা বাহিনী মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটিগুলিতে অভিযান জোরদার করেছে, তাদের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে স্থানীয় মাওবাদী ক্যাডারদের আত্মসমর্পণের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধুমাত্র বছরের প্রথম চার মাসে ৭০০ জনেরও বেশি মাওবাদী ক্যাডার কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
সাম্প্রতিক মাসগুলিতে ভারতজুড়ে, বিশেষ করে ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা, ওড়িশা ও কেরালায় মাওবাদীদের আত্মসমর্পণের ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবণতা নিরাপত্তা অভিযানের তীব্রতা, মাওবাদী আদর্শের প্রতি মোহভঙ্গ এবং সরকারি পুনর্বাসন কর্মসূচির প্রতি আকর্ষণের সংযুক্ত প্রয়াসের সাফল্যকে প্রতিফলিত করে। নেতৃত্বের ধারাবাহিক পতন, অভ্যন্তরীণ হতাশা এবং সরকারিভাবে গৃহীত সক্রিয় নীতিমালার সম্মিলিত প্রভাবের ফলে মাওবাদীদের শক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে শুধু বস্তার অঞ্চলে কিছু সশস্ত্র ক্যাডার অবশিষ্ট রয়েছে এবং কেন্দ্রীয় কমিটিও দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা সংস্থাগুলি ২০২৬ সালের মার্চ মাসের মধ্যে মাওবাদ সম্পূর্ণ নির্মূল করার লক্ষ্যে আশাবাদী |
দেশের উন্নয়নের পথে বাধা মাওবাদ
অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট একটি সঠিক পদক্ষেপ
অরিন্দম ভট্টাচার্য্য
সরকার ছিল। সামরিক বাহিনীও ছিল। ছিল না উন্নয়ন। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়েও ছিল না প্রান্তিক, গরিব জনজাতির প্রতি দায়বদ্ধতা। ক্ষমতায় ছিল এক পরিবারবাদী সরকার। অন্য দেশের প্রতিপালনে আমদানি নির্ভর হয়ে ৫ শতাংশ মানুষের উন্নতি এবং ৯৫ শতাংশ মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের অবনতির সরকার। আর ৪০ শতাংশ প্রান্তিক জনজাতি সমাজের মানুষেরা বুঝতেই পারতো না স্বাধীনতার অর্থ। কারণ একটি পরিবারের হাতে ছিল দল ও দেশ। বিদেশিদের ইজারা নিয়ে তারা সরকার চালাচ্ছিল। ভারতবাসীর প্রতি বাড়ছিল বঞ্চনা। শয়তান বিদেশি শক্তির দরকার ভারতজুড়ে আরও ধ্বংস, আরও নৈরাজ্য। আরও লুঠ ভারত ও তার মানুষের। তার জন্য অনেক নতুন দেশবিরোধী শক্তির প্রয়োজন।
লখিন্দরের লোহার বাসর ঘরে যেমন সিঁধ কেটে তৈরি হয়েছিল মরণপথ, নকশালবাড়িতে তেমনই জন্ম নিল মাওবাদী আন্দোলন। শিক্ষিত, জাতীয়তাবাদী মানুষের প্রত্যাখ্যান এবং কঠিন সরকারি শাসনের দৌলতে পশ্চিমবঙ্গে তারা ব্যর্থ হলো ১০ বছরেই। এরপর আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে গিয়ে তারা নতুন পন্থা নিল। জঙ্গলকে ঘাঁটি করে দানা বাঁধতে থাকল মাওবাদী সন্ত্রাস। উন্নয়নের বৃত্তের বাইরে থাকা, দারিদ্র্যসীমার
নীচে বসবাসকারী মানুষদের ৪০ শতাংশ হলো জঙ্গলের গরিব, জনজাতি মানুষ। তাদের টার্গেট করল তারা। ১৯৮০ সাল থেকে শুরু হলো এই পর্ব। বিদেশ প্রেরিত অস্ত্রশস্ত্র ও কোটি কোটি ডলারের সাহায্যে আগুনে মসিহা হয়ে তারা সমান্তরাল প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করল চার রাজ্য জুড়ে। তারাই সেখানে স্থানীয় সরকার। প্রচার করল যে, ভারত একটি অত্যাচারী দেশ। মার্ক্স-লেনিন-স্তালিন-মাও নাকি তাদের আদর্শ। বন্দুকের নল হলো ক্ষমতার উৎস। বিদেশি মদত ও তোলাবাজির টাকায় ছেঁড়া রুটি দেওয়ার মতো করে অল্প অল্প খাবার দিতে লাগল দেশের সরকারি সাহায্য না পাওয়া জনজাতিদের।
মধ্যপ্রদেশ, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র জুড়ে ছড়াতে থাকল রেড করিডোর। মাওবাদী নৈরাজ্যবাদের প্রেক্ষিতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি থাকল নির্বিকার। চলতে লাগল অবাধে রুটি ছিঁড়ে দেওয়ার প্রতিদানে জনজাতিদের সম্পদ লুঠ, জঙ্গল ধ্বংস, জনজাতি মহিলা ধর্ষণ। যেমন লোভী, সরকারি প্রশাসক, তেমনি মাওবাদীরা। বিরসা মুণ্ডা থেকে সিধো কানুর ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মানুষদের তারা করে তুললো দেশবিরোধী, ভারত বিরোধী। ক্রমাগত হতে লাগল মাইন বিস্ফোরণ।
চলল গ্রেনেড, বন্দুক, গুলির যথেচ্ছ ব্যবহার; সরকারি সম্পত্তি লুঠ, ব্রিজ, রাস্তা ভেঙে দেওয়া। সাধারণ মানুষ, সেনা, পুলিশ, বনরক্ষী, সরকারি আধিকারিক, ব্যবসায়ী, কন্ট্রাক্টর হত্যা, অপহরণ। ১৯৮০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯০০০ ভারতীয় সেনা, পুলিশ ও সাধারণ মানুষকে ৪০০টি জেলায় হত্যা করা হয়। ধানবাদ, গয়া, লাতেহার, বিজাপুর, বস্তার, দান্তেওয়াড়া, গোন্ডিয়া, গড়চিরোলি, শ্রীকাকুলাম, চন্দ্রপুর জুড়ে ভাইয়ের সঙ্গে ভাইদের লড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাণ্ডব, হত্যালীলা, রক্তস্নান চলতে থাকলো।
“ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে গুলাগ, গ্রেট পার্জ, দ্য গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড বা কালচারাল রেভোলিউশন চলবে না। এগুলি ছিল রাশিয়া ও চীনের লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিরুদ্ধ মত পোষণের জন্য হত্যা।”
১৯৮০ সাল থেকে শুরু হয় পিপলস্ ওয়ার গ্রুপ বা পিডব্লুজি, আর তার পরে এমসিসি (মাওয়িস্ট কমিউনিস্ট সেন্টার)- এই দুই নৈরাজ্যের সশস্ত্র ধারা। এলাকা ভাগ করে নিয়ে হত্যা, লুঠ, চোরাপাচার আর সরকারি প্রশাসনিক ব্যবস্থা ধ্বংস। পিডব্লুজি কাজ করত মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশে, আর এমসিসি বিহারে। এমসিসি মূলত জেহানাবাদ ও গয়ায় ভূমিহার ও জমির মালিকদের হত্যা, অপহরণ থেকে জমি, খনি, কয়লার জগতে শাসন কায়েম করল আর পিডব্লুজি জঙ্গল থেকে শুরু করে ব্রিজ সমেত নানা সরকারি পরিকাঠামো একেবারে হাওয়া করে দিল। তারা রক্ষক-ভক্ষক দুই-ই হয়ে উঠল জনজাতিদের কাছে। ভারতের মধ্যে সৃষ্টি হলো ২৫০০ কিলোমিটারের এক রেড করিডোর। খাবার, ওষুধ,
চিকিৎসা পরিষেবা, টাকা সবই দিতে লাগল মাওবাদীরা। এর বদলে তারা করত শোষণ, অত্যাচার, যৌন নির্যাতন, ছেলে-মেয়েদের জোর করে তুলে নিয়ে আসা। অরণ্যাঞ্চলগুলিতে স্কুল-কলেজ উড়িয়ে দিয়ে শুরু হয় মাওবাদের উপাসনা। কেউ সামান্যতম সরকারি সুবিধা নিলে, প্রশাসনিক দপ্তরে গেলে জন-আদালতে চলে বিচারের প্রহসন ও হত্যা। সরকারি কর্মীরাও রেহাই পেতেন না। দেশের মধ্যে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে মাওবাদীরা এক আদিম, অসভ্য সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলল। ৯ জন এমএলএ এবং পঞ্চায়েত প্রধানকে তারা হত্যা করে। মাওবাদী হানায় প্রায় ১০,০০০ আধাসেনা, পুলিশ, সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, বনরক্ষী, সরকারি কর্মীর প্রাণ যায়। ভারতে ঘটে ৩৭টি বিস্ফোরণ, ১৪টি বিরাট মাপের গণহত্যা। ১৭টি জঙ্গলে সাধারণ মানুষের প্রবেশ হয় নিষিদ্ধ। রণবীর সেনা, সালোয়া জুড়ুম করে বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ প্রতিরোধের চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই লাভ হলো না। বিদেশি আর্থিক মদত, আইএসআই-এর তৈরি ছক, চীনা অস্ত্র, বিভিন্ন এনজিও-র মাধ্যমে প্রবাহিত অর্থের স্রোতের দরুন ভারতকে ঘিরে এলটিটিই, খালিস্তানি, মাওবাদী, জেহাদি, দাউদ ইব্রাহিম, পেট্রোডলারের এক বর্বর সাম্রাজ্য কায়েম হলো।
প্রথম পরিবর্তন আনলেন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। বিহার ভেঙে ঝাড়খণ্ড তৈরি করলেন। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু তাঁর প্রশাসনকে গতিশীল ও আধুনিক করলেন। মহারাষ্ট্র-নাগপুর অঞ্চলের উন্নয়নে জোর দিল শিবসেনা-বিজেপি সরকার। পুলিশ ও আধাসেনার আধুনিকীকরণ শুরু হলো। এলটিটিই, খালিস্তানি মুছে গেল। কার্গিলের যুদ্ধের পর আইএসআই-পাকিস্তান দুর্বল হলো। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শাখার সংখ্যা বৃদ্ধি পেল। দেশজুড়ে স্বয়ংসেবকরা আন্তরিকতার সঙ্গে বিভিন্ন প্রকারের সেবা প্রকল্প চালাতে লাগল। এই সাঁড়াশি চাপে এমসিসি প্রায় মুছে গেল। পিডবুজি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল গড়চিরোলি, দক্ষিণ অন্ধ্রপ্রদেশ, বস্তার-বিজাপুর, লাতেহার জেলায়। ৩০০০ কিলোমিটার সাম্রাজ্য নেমে এল ১০০০ কিলোমিটারে। ৪৩৭টি জেলা থেকে ২২০টি জেলায় সংকুচিত হলো মাওবাদ। বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নয়ন, সংরক্ষণ, স্কুল-কলেজ (শিক্ষা), রোজগার, সরকারি চাকরির স্বাদ পেল ৫০ বছর ধরে স্বাধীন দেশের পরাধীন মানুষরা। সোনালি চতুর্ভুজ প্রকল্পে নির্মিত জাতীয় সড়কগুলি বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করল বহুগুণ। পুলিশ ও আধাসেনার পক্ষে সহজতর হলো যাতায়াত। সরকারি সুবিধা, বিভিন্ন যোজনা ছুঁয়ে ফেলল প্রান্তিক মানুষদের। জনজাতিরা বিদ্রোহ ঘোষণা করল মাওবাদী
বর্বরদের বিরুদ্ধে। ধরিয়ে দিতে লাগল তাদের। ঠিক সে সময়ে ছন্দপতন ঘটল । ২০০৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পরিবর্তিত হলো।
আধাসেনা ও পুলিশের আধুনিকীকরণ বন্ধ হলো। সেই সুযোগে পিডব্লুজি আর এমসিসি মিলে তৈরি হলো সিপিআই (মাওবাদী)। তারা ফের নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করল। তৈরি করতে লাগল রাষ্ট্রবিরোধী, বামমনস্ক কিছু তথাকথিত খ্যাতনামা সাংবাদিক, লেখক, গায়ক, কবি, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, অধ্যাপক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, বিভিন্ন এনজিও, নাট্যকর্মী, তথাকথিত মানবাধিকার কর্মী নিয়ে এক সুচতুর গোষ্ঠী, যাদের পরিচয় হলো- ‘আরবান নকশাল’। যারা মাওবাদীদের কার্যকলাপকে মহান বলবে। পুলিশ, আধাসেনা ও দেশের সরকারকে অত্যাচারী বলবে। নকশালদের মহান হিসেবে দেখিয়ে নাটক, গল্প, উপন্যাস লেখা হবে, সিনেমা তৈরি হবে। তার ভিত্তিতে জনমত তৈরি করবে সাংবাদিকরা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মিছিল, সমাবেশ, বিক্ষোভ করবে মানবাধিকার কর্মীরা। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মগজ ধোলাই করবে সেই শিক্ষকরা। বিদেশ থেকে সমস্ত টাকা আসবে জেহাদি, বাম ও অতিবামমনস্ক বিভিন্ন এনজিও-র মাধ্যমে। এর ফলে শহুরে (আরবান) ও জঙ্গলে- দুই প্রকারের মাওবাদী ফুলেফেঁপে উঠল। বাম-জেহাদি জোট তৈরি হলো। সরকার থাকল নির্বিকার ও মৌন। ফের শুরু হলো গণহত্যা, সশস্ত্র বাহিনীকে আক্রমণ, সরকারি পরিকাঠামো ধ্বংস এবং একইসঙ্গে জনমত তৈরি যে এটা ভুল নয়। তথাকথিত আইনজীবীরা দেশের ভিতরের শত্রুদের সাহায্য করতে শুরু করল। পরপর আক্রমণে প্রাণ দিতে থাকল আধাসেনা, পুলিশ। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লাকেও হত্যা করল তারা। পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলের হাত দিয়ে ছড়িয়ে পড়ল নব্য মাওবাদ। জঙ্গলমহালে শুরু হলো খুন, হত্যা, বিস্ফোরণ। জঙ্গলমহলে সক্রিয় মাওবাদীদের সাহায্যে তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, টাকা-খাওয়া আরবান নকশালরা ছিল সদা-তৎপর। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও একবার হত্যার চেষ্টা করে তারা। এক ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয় গোটা রাজ্যে। মাও-মার্ক্স দ্বন্দ্বে সে যাত্রায় পরাজিত হয় বঙ্গীয় বামপন্থীরা। ২০১১ সালে রাজ্যে ঘটে পট পরিবর্তন।
সালটা ২০১২-১৩। প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংহ নিজেই টাইগার টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান। এই টাস্ক ফোর্সের উদ্দেশ্য ব্যাঘ্র সংরক্ষণ, বাঘের সংখ্যাবৃদ্ধি ইত্যাদি। সেই সময় গড়চিরোলি ও গোন্ডিয়ায় নির্মিত হয় মাওবাদী নৃশংসতার এক বীভৎস ইতিহাস! মার্ক্সবাদ-মাওবাদের বস্তাপচা বুলি আউড়ে, জল-জমি-জঙ্গলের অধিকারের নামে নির্বিচারে ৩০০০ গরিব, জনজাতি সমাজের। মানুষকে তারা হত্যা করে; তার সঙ্গে ১৫০ জন পুলিশ এবং ফরেস্ট গার্ড, আধাসামরিক বাহিনী, শিক্ষক, ডাক্তার, ব্যবসায়ী নিয়ে প্রায় ১০০০ জনকে হত্যা করে মাওবাদীরা। টাডোবা-অন্ধেরি, নাগজিরা, মেলঘাট জুড়ে চলে অরণ্য ধ্বংস। বাঘ হত্যা, চিতাবাঘ হত্যা, বন্যপ্রাণী চোরাচালান, গাছকাটা, গাছ বেচে দিয়ে চলে কোটি কোটি টাকা কামাই। বাধা দেওয়া চলতে থাকে ব্যাঘ্রশুমারিতে। কারণ বাঘের সংখ্যা গুনতে গেলে বাঘের সঙ্গে ‘মাওবাদী’ নামক জানোয়ারগুলো ধরা পড়ে যাবে। আর গোল্ড, মাড়িয়া, পরধান সম্প্রদায় নির্বিশেষে স্থানীয় জনজাতির উপর অত্যাচার তো কহতব্য নয়। অরণ্য রক্ষা করতে, দেশ বাঁচাতে কোনো সরকারের হাতে অর্থের অভাব ছিল না। ছিল আধাসামরিক বাহিনী, পুলিশ। শুধু ছিল না সদিচ্ছা ও সাহস। মানসিকতা ছিল না ফান্ডিং বন্ধ করে আরবান নকশালদের সজোরে প্রত্যাঘাত। ছিল না তাদের জেলে ভরার প্রয়াস। ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেশবিরোধী হওয়া থেকে মুক্ত করার পরিকল্পনা। জানোয়ারগুলো বিরোধিতা করত জনজাতি সমাজের উন্নয়নে, বাধা দিত পরিকাঠামো উন্নয়নে। রাস্তা ভেঙে দেওয়া, কন্ট্রাক্টরদের হত্যা, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া, নির্বিচারে বন্যপ্রাণী পাচার, জন-আদালত বসিয়ে গরিব মানুষকে হত্যা ছিল তাদের কাজ। চক্রব্যূহ বানিয়ে এদের সাপোর্ট দিত মুম্বইয়ের বলিউড এবং বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এদের হয়ে লেখালেখি করা আরবান নকশালরা।
২০১৪ সালে কেন্দ্রে সরকার বদল হলো। ইতিমধ্যেই অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে হয়েছে তেলেঙ্গানা। স্থানীয় প্রশাসন, রাজ্য প্রশাসন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক- তিনটি স্তর একত্রে কাজ করা শুরু করল। প্রবল আধুনিকীকরণ হলো আধাসামরিক বাহিনী সিআরপিএফের। মাওবাদীদের ঠেকাতে আলাদা প্রশিক্ষিত বাহিনী তৈরি হলো। নামলো নাগা ব্যাটেলিয়ন, গ্রেহাউন্ড ও কোবরা বাহিনী। সঙ্গে বাস্তবায়িত হলো রিলোকেশন ফরেস্ট প্ল্যান। বনের মধ্যে থাকা প্রচুর গ্রাম ও জনজাতি গ্রামের পুনর্বাসন হলো। জঙ্গল থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে জনবসতি স্থাপন করে প্রত্যেককে বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হলো। পরিবার পিছু আর্থিক সাহায্য দেওয়া হলো। দেওয়া হলো পরিবারপিছু একটি সরকারি চাকরি। এরসঙ্গে পুরো অরণ্য জুড়ে চলল তীব্র অপারেশন। উন্নয়ন আর প্রত্যাঘাত এবার হলো একসঙ্গে। ২৬০০ মাওবাদী নিকেশ হলো। প্রায় ৫ হাজার পালিয়ে বাঁচলো। কিছু আত্মসমর্পণ করল। সবচেয়ে বেশি সাহায্য করল গোল্ড, মাড়িয়ারা- খবর সরবরাহ করে। ওরা বুঝতে পারে যে কারা ওদের ৫৫ বছর শোষণ করেছে। চারু থেকে গণপতি- চলছিল এক শোষণ ও
উদ্ধার হওয়া অস্ত্রশস্ত্র দেখছেন নিরাপত্তা আধিকারিকরা
১৯৪৭ পরবর্তী পর্যায়ে ভারতের প্রায় ২ লক্ষ সেনা ও সাধারণ নাগরিককে হত্যা করেছে পাকিস্তান। মাওবাদীরা হত্যা করেছে ১৫৩৩৫ জনকে। এরা ভারতের ভেতরের পাকিস্তানি। মাওবাদী ডেরা থেকে উদ্ধার হওয়া ড্রোন, মেশিনগান সম্প্রতি লোকসমক্ষে প্রদর্শন করেছে ছত্তিশগড় পুলিশ। সেখানে ৭০০ কোটি টাকার পাকিস্তানি আইএসআই ও চীনা সরঞ্জাম জনসমক্ষে আনে পুলিশ। এই অর্থে তো ১০০টি জনজাতি গ্রামকে ৫ বছর ধরে তারা খাদ্য সরবরাহ করতে পারত। কিন্তু করবে না, কারণ ওরা বিদেশি এজেন্ট। উন্নত ভারতের পক্ষে ওরা নয়।
লুঠতন্ত্র। জনজাতিরা এবার বিশ্বাস রাখলো সরকারের উপর। তারা বুঝতে পারলো যে উন্নয়ন ও সুরক্ষা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ এই সরকার। এল আইন। এনজিওগুলির টাকার হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক হলো। কোন টাকা কোন কারণে আসছে তা সরকারকে জানাতে হবে। বাম-জেহাদি যোগসাজশ নিয়ন্ত্রিত হলো। টুকরে টুকরে গ্যাং ও আজাদি ব্রিগেডকে জেলে ঢোকানো শুরু হলো। আরবান নকশালরা পুলিশি জেরার মুখে পড়ল।
পাঁচ বছরে সাফ হয়ে গেল গড়চিরোলি, গোন্ডিয়া, চন্দ্রপুর, ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ। টাডোবা অরণ্যে আজ বহু দেশি বিদেশি পর্যটক আসেন। পর্যটনক্ষেত্রে মানুষের রোজগার ও সরকারের রাজস্ব ২০১৪-র আগে যা ছিল, ২০২৪-এ তা বেড়েছে বহুগুণ। বাঘের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। বনজ সম্পদ মধু, মোম, মাটি, জলকে ব্যবহার করে সেই রিলোকেটেড জনজাতিরা খুলেছে বনজ হাট। তাঁদের অনেকেই আজ ফরেস্ট সাফারির গাড়িচালক, গাইড, ফরেস্ট গার্ড, রেঞ্জার্স অফিসের করণিক, পিওন।
মাওবাদী দমনের লক্ষ্যে শেষ আঘাত শুরু হলো কোভিডের পর। ৪০০ থেকে ২০৯ জেলা হয়ে মাওবাদীদের উপস্থিতি নেমে এলো ৭০টি জেলায়। বিজাপুর, বস্তার, দান্তেওয়াড়ায় শুরু হলো ‘অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট’। মাওবাদী খতমের ডেডলাইন ধার্য হলো ৩১ মার্চ, ২০২৬। স্যাটেলাইট ম্যাপিং ও ড্রোনের সাহায্যে সিআরপিএফ, কোবরা যৌথ বাহিনীর কুমবিং অপারেশন। আত্মসমর্পণকারী মাওবাদী আর স্থানীয়রা দিচ্ছে খবর। কোথায় রয়েছে মাওবাদীদের গোপন ঘাঁটি, কোথায় তারা লুকিয়ে থাকে- স্থানীয়রা দিতে থাকে তার সুলুকসন্ধান। বহু দিন পর তারা পেয়েছে স্বাধীনতার স্বাদ। তাদের জীবন হয়ে উঠেছে সুস্থ ও স্বাভাবিক। ‘সবকা বিকাশ’-এর শরিক তারাও হতে চায়।
জঙ্গলের প্রাণীরা সুন্দর। কিন্তু জঙ্গলের
মধ্যে কিছু কাগুজে দানব ঢুকে আছে। চীনের চেয়ারম্যান এদের চেয়ারম্যান। উপাচার্য, শিক্ষক, পুলিশ মেরে এরা কিন্তু চীনে আশ্রয় নেয় না। তারা কিউবাও যায় না। যায় আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। বাম-অতিবামেরা তাদের ছেলে-মেয়েদের পড়তে, চাকরি করতে চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা পাঠায় না। পাঠায় পুঁজিবাদী, সাম্রাজ্যবাদী দেশ- আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, ইংল্যান্ডে। এরাই হলো আরবান নকশাল। এদের মোকাবিলা খুবই জরুরি।
রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও আধাসেনাদের কনভয়ে তারা মাইন বিস্ফোরণ ঘটাবে। স্টিল ফ্যাক্টরি বন্ধ করবে। অরণ্যাঞ্চলে তোলাবাজি চালাবে। পশ্চিমবঙ্গের শালবনী, শিলদা, লালগড়, বেলপাহাড়ি অঞ্চলের উন্নয়ন আটকাতে সেখানে চলবে তাদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ। সেখানে যাবে কলকাতা থেকে আরবান নকশাল দাদা-দিদিরা স্করপিও-ইনোভা করে। ২০০৯ সালে সিপিএম ক্যাডার শালক সোরেনকে হত্যা করে মাওবাদীরা। তার মা এখনও বেঁচে। ইতিহাসের কী পরিহাস! তার হত্যাকারীদের মৃত্যুতে তার পার্টিই আজ শোকে মুহ্যমান। ছত্তিশগড়ের তিনটি অভয়ারণ্য জনসাধারণের জন্য বন্ধ ৯ বছর। ইন্দ্রাবতী, উদন্তি ও অচানকমার। বাঘ, অন্যান্য প্রাণী ও গাছপালা কমছে। সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংস হচ্ছে বন্যপ্রাণ। ২০২৪ সালে ছত্তিশগড়ে রাজ্য সরকার পরিবর্তিত হয়েছে। বিজাপুর, বস্তার, দান্তেওয়াড়া প্রভৃতি জেলাগুলিতে শুরু হয়েছে ‘অপারেশন সংকল্প’।
এরা চেনা সন্ত্রাসবাদী। এরাই ডেপুট করে অচেনা অথচ খ্যাতনামা আরবানদের। মুখোশের আড়ালে থাকে এই আরবান নকশালরা। আমির খান, মেধা পাটেকর চলে যান সর্দার সরোবর আটকাতে। এমনকী মাঝে মধ্যেই এরা পৌঁছে যায় তুরস্ক। এসব কাণ্ড করার সময় এই দেশে তাদের দমবন্ধ হয়ে যায় না। মেধা পাটেকর, অনুরাধা তলোয়ার পৌঁছে যান ভারতের বিভিন্ন জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় সরকারি উন্নয়নযজ্ঞ আটকাতে। জেহাদি-মাওবাদী জোট হচ্ছে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন। লাদেনকে তৈরি করার দাম আমেরিকাকে ৯/১১ দিয়ে মেটাতে হয়েছে। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় প্রণম্য। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ৫ বছরে রুণ গুহ নিয়োগীর ট্যাবলেট দিয়ে চারু মজুমদার গ্যাংকে বিনাশ করেছেন এবং পঞ্জাবের রাজ্যপাল থাকাকালীন কেপিএস গিলকে দিয়ে খালিস্তানি সমস্যার সমাধান করেছেন। প্রশাসন বা সিস্টেমের ভিতরে এই শহুরে নকশালরা অকল্পনীয় ক্ষমতাবান। তিস্তা সেতলওয়াড়ের জন্য কোর্ট খুলে যায় রাত সাড়ে দশটায়। এদিকে রাজ্যের ডিএ মামলা দশ বছর ধরে চলে। টাটা, মিৎসুবিসি, জিন্দাল, আম্বানি-আদানি সব এদের শত্রু। শিল্প স্থাপন, পরিকাঠামো উন্নয়ন হলেই এদের গাত্রদাহ। জনজাতির জল-জমি-জঙ্গলের অধিকারের স্লোগান তুলে তুমুল নৈরাজ্য কায়েম করা এদের লক্ষ্য।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তর থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের মগজ ধোলাইয়ে এই আরবান নকশাল ব্রিগেড সিদ্ধহস্ত। ছাত্রাবস্থায় ছেলে-মেয়েদের মাথায় ঢোকানো হয়- ‘কীসের ভারত?’, ‘জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেম হলো বুজরুকি’ ইত্যাদি। এদের কার্যকলাপ ও গতিবিধি বুঝতে হলে দুটি সিনেমা অবশ্যই দেখতে হবে- ‘বুদ্ধ ইন এ ট্রাফিক জ্যাম’ ও ‘বস্তার’। বুঝতে পারবে তিস্তা, জুবের, মেধা এবং গণপতি, বাসবরাজ, কিষেণজী, চীন, আইএসআই- সব এক শৃঙ্খলে যুক্ত। একই জায়গা থেকে অস্ত্র ও আর্থিক মদত পায় মুর্শিদাবাদ, পহেলগাঁওয়ের জেহাদি থেকে দান্তেওয়াড়ার মাওবাদী। একটাই দানব বন্ধন। ২০১৬ সালে বিবেক অগ্নিহোত্রী নির্মিত ‘বুদ্ধ ইন এ ট্রাফিক জ্যাম’-সিনেমাটি দেখতে গিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বহু দর্শক এই আরবান নকশালদের হাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বিবেক অগ্নিহোত্রীকেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করে দেওয়া হয়। এই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই ১৯৭০ সালে তদানীন্তন উপাচার্য গোপালচন্দ্র সেনকে হত্যা করে মাওবাদীরা। ২০২৩ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়াবহ র্যাগিং চালিয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্র স্বপ্নদীপ কুণ্ডুকে হত্যা করে এই আরবান নকশালরা। স্তালিন-মাও-পল পট কি কোনোদিন গণতন্ত্র বা মানবিকতার আদর্শ মানতেন? ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে গুলাগ, গ্রেট পার্জ, দ্য গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড বা কালচারাল রেভোলিউশন চলবে না। এগুলি ছিল রাশিয়া ও চীনের লক্ষ লক্ষ মানুষকে বিরুদ্ধ মত পোষণের জন্য হত্যা। স্তালিন ও মাওয়ের শিষ্যরা তাদের হিসেব অনুযায়ী ঠিক রাস্তায় চললেও ঠিক দেশে তারা নেই।
ভারত সরকার সকল নাগরিকের জন্য সেনা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করুক। প্রত্যেক যুবক-যুবতীকে ২৫ বছর বয়সের আগে ২টো বছর সেনাবাহিনীকে দিতে হবে। তাঁরা সমরকৌশল, প্রতিরোধের কায়দা কানুন শুধু নয়, পাবে দেশভক্তির পাঠ। দেশকে ‘মা’ হিসেবে চিনতে শিখবে।
ভারতের বুক থেকে জেহাদ, মাওবাদ শেষ করার বিরাট ধাপ হলো- ‘অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট’। ভারত যে পল পটের দেশ হবে না, এখানে যে গাজওয়াতুল হিন্দ হবে না, সেই দেওয়াল লিখন আজ স্পষ্ট। আগামীদিনে এক নতুন প্রভাতের নাম- ‘অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট’।
বাসব অতি সুবোধ বালক মাকু-পাকু-সেকু-নেকুদের চোখে জল
পিনাকপাণি ঘোষ
চোখের জলের নাকি কোনো রং হয় না। সবই এক। তবে সবই কি সমান স্বচ্ছ!
মাকু-পাকু-সেকু-নেকুদের চোখের জল দেখেছেন। একটা লালচে, না না সঙ্গে কালচে আভা থাকে। রাষ্ট্রদ্রোহের লালিমা বা কালিমা একটু নজর করলেই দেখা যায়।
আমার পেশাগত জীবন যেমন
তারকাখচিত হোটেলবাসের সুযোগ করে দিয়েছে, তেমনই রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে খাটিয়ায় মাওসঙ্গীদের পাশে শুয়ে তারা গুনেছি। এলোমেলো ভাবনায় ঘুম আসেনি একটুও। আবার শহুরে রাষ্ট্রদ্রোহীর পাশে বসে কাজ করেছি। দামি পারফিউম থাকলেও গায়ে তাঁদের আঁশটে জঙ্গিপ্রেমের বদবু। না, ‘বদবু’-র ঠিকঠাক বাংলা শব্দ হয় না। মুখে গরিব মানুষের মসিহা হওয়ার বাণী, কিন্তু আগের রাতের দামি স্কচের গন্ধ।
২০০১ সালের প্রবল গরমের দুপুর। পশ্চিম মেদিনীপুরের (তখন অখণ্ড) ভাদুতলা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়ানোর কথা ছিল। মাসখানেক আগেই সেখানে হত্যা করা হয়েছে সিপিএমের এক ডাকসাইটে নেতাকে। কিছুটা পরেই লাল টুপির চেনা মুখটি দেখা গেল। মোটর সাইকেলে উঠে বসলাম। ঘণ্টাখানেক যাওয়ার পরে উঠতে হলো অচেনা মুখের বাইকে। চেনা মুখ ফিরে গেলেন। এইবার চলতে চলতে আঁধার নামল। শাল মহুলের জঙ্গলে জোনাকির আলো আর বাইকের হেডলাইট। শুকনো পাতা মাড়িয়ে বাইক চলল। ক্লান্ত শরীর যখন বাইক থেকে নামল ক’টা বাজে কে জানে? মোবাইল অনেক দূর, হাতে ঘড়িও ছিল না। দু’চোখে বিস্ময়। মাওবাদী সংসার দেখা প্রথম বার। সেই সময়ে অবশ্য পিডব্লুজি (পিপলস্ ওয়ার গ্রুপ) নামেই পরিচিত। পরে জেনেছি সেই এলাকাটা ঝিটকার জঙ্গল ছিল। সঠিক কোথায় জানতে পারিনি। শহরে বসে
যাঁরা মাওবাদের প্রেমে পড়েন তাঁদের জন্যই এই অভিজ্ঞতা জানানো। নিজের চোখে দেখেছি জঙ্গলবাসীদের ভুল বোঝানোর রাজনীতি, কানে শুনেছি ‘স্বাধীনতার যোদ্ধা’-দের জুলুমবাজি আর ভোগের কাহিনি। সেই সফরেই জেনেছিলাম জঙ্গুলে মাওযোদ্ধাদেরও প্রেম, যথেচ্ছ যৌনতা, সংসার রয়েছে। জেনেছিলাম, কেন বেছে বেছে খেজুর গাছেই হুমকি পোস্টার সাঁটা হয়। মানুষ খুনের ছকের আড়ালে থাকে গরিবের উপকারী হওয়ার ছদ্মবেশ।
তেমনই একজন ছিলেন কি ছত্তিশগড়ের বস্তারে যৌথবাহিনীর এনকাউন্টারে হত সিপিআই (মাওবাদী) সাধারণ সম্পাদক নাম্বালা কেশবরাও ওরফে গগন্না? এতটাই কুখ্যাত যে, পুলিশের খাতায় তার মাথার দাম ছিল এক কোটি টাকা। যদিও তার মৃত্যুতে পশ্চিমবঙ্গের শহুরে নকশালরা যে চোখের জল ফেলেছে সংবাদমাধ্যমে তাতে বর্ণনা
কমরেডরা বড়োই অতীত ভুলে যান। তাঁদের মনেই থাকে না, কমরেড মাও জে দং, কমরেড চে গেভারা, কমরেড হোচিমিন, কমরেড ফিদেল কাস্ত্রো থেকে কমরেড স্তালিন সকলেই বন্দুক ধরেছিলেন। সাম্যের জন্য, সমাজতন্ত্রের জন্য। কিন্তু ইতিহাস বলছে, কিছুই পারেননি তাঁরা।
অন্যরকম। ইঞ্জিনিয়ারিঙের ডিগ্রিধারী তেলুগুভাষী নেতা নাম্বালা কেশবরাও ওরফে বাসবরাজ ওরফে গগন্নার ‘খ্যাতি’ ছিল ‘সমরকুশলী’ হিসেবে। ২০১৮ সালে সিপিআই (মাওবাদী)-র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার আগে সংগঠনের কেন্দ্রীয় মিলিটারি কমিশনের ‘প্রধান’ ছিলেন তিনি। তার আগে ছিলেন সংগঠনের অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তিগত শাখা ‘ট্রাম’ (টেকনিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড আর্মস ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট)-এর দায়িত্বে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সমাজমাধ্যমে
লিখেছিলেন, ‘এই অসাধারণ সাফল্যের কারণে আমাদের বাহিনীর জন্য গর্ব হচ্ছে। আমাদের সরকার মাওবাদী আতঙ্ক দূর করতে এবং দেশবাসীর শান্তি ও অগ্রগতির জীবন নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ যৌথবাহিনীর ‘অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট’-এর সাফল্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা মন্তব্য করেন, ‘নকশালপন্থার বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধের তিন দশকের মধ্যে এটিই সর্বোত্তম সাফল্য। এই প্রথম আমাদের বাহিনী সাধারণ সম্পাদক পদমর্যাদার এক মাওবাদী নেতাকে মেরেছে।’
শহুরে মাওবাদীরা এখনো রয়ে গিয়েছেন মূলত সাংবাদিকতা পেশায়। তারা বাসবকে হারিয়ে লিখেছেন, জনযুদ্ধ বা পিডবুজি-এর প্রতিষ্ঠাতা কোন্ডাপল্লি সীতারামাইয়ার মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন ‘সুবোধ বালক’ বাসব বা কেশব। সেই পথ ধরেই ‘গরিমা’-র সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন সশস্ত্র গেরিলা আন্দোলনে। অন্ধ্র এবং অবিভক্ত মধ্যপ্রদেশে নিরাপত্তাবাহিনীর উপর একাধিক হামলায় সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি, দলীয় প্রকাশনা আওয়াম-এ-জং-এর সম্পাদকীয় বোর্ডের সদস্যও হয়েছিলেন। জীবনীকারের মতো গুছিয়ে শহুরে নকশালরা লিখেছেন, ১৯৫৫ সালের ১০ জুলাই অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীকাকুলামের জিয়ানাপেটায় এক সাধারণ পরিবারে ‘মহান’ কেশবের জন্ম। পড়াশোনায় ‘কৃতী’ এবং খেলাধুলোয় ‘দক্ষ’ ছিলেন। ওয়ারঙ্গলের ‘রিজিয়োনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’ থেকে বি-টেক ডিগ্রিধারী কেশব এক সময় জাতীয় পর্যায়ের ভলিবল প্রতিযোগিতায় অন্ধ্রপ্রদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। তাঁর সেই ‘বহুমুখী প্রতিভা’ দেখা গিয়েছিল সাংগঠনিক নেতৃত্বেও। দু’দশক আগেই তাঁর মাথার দাম ১০ লক্ষ টাকা ঘোষণা করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়ায় এক কোটিতে!
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালে এমসিসি এবং জনযুদ্ধ মিশে জন্ম হয়েছিল নতুন সংগঠন সিপিআই (মাওবাদী)-র। গত দু’দশকে সেই সংগঠনের অধিকাংশ নেতাই নিহত হয়েছেন নিরাপত্তাবাহিনীর অভিযানে। কেন্দ্রের বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার দেশ থেকে মাওবাদ নিশ্চিহ্ন করার ঘোষণা করে তার ব্লু প্রিন্টও তৈরি করে। আর তাতেই ২০১৬ সালে অন্ধ্র-ওড়িশা-ছত্তিশগড় সীমানায় সংঘর্ষে দয়া ওরফে গারলা রবি, গণেশ ও মল্লেশের মতো কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের মৃত্যু হয়। এই বছরের শুরুতেই ছত্তিশগড়ের গরিয়াবন্দ জেলায় যৌথবাহিনীর গুলিতে মৃত্যু হয় মাওবাদী কেন্দ্রীয় কমিটির আর এক পরিচিত সদস্য রামচন্দ্র রেড্ডি ওরফে চলপতির। এক সময়ে পশ্চিমবঙ্গে রাজত্ব করা যৌথবাহিনীর সঙ্গে গুলির লড়াইয়ে মৃতু কিষেণজীর ভাই মাল্লোজুলা বেণুগোপাল রাও ওরফে ভূপতি ওরফে বিবেক ওরফে সোনুর স্ত্রী তথা সিপিআই (মাওবাদী) দণ্ডকারণ্য জোনাল কমিটির নেত্রী বিমলা চন্দ সিদাম ওরফে তারাক্কা গত ১ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলিতে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। ২০২১ সালে মহারাষ্ট্রে গড়চিরৌলিতেই সে রাজ্যের পুলিশের মাওবাদী দমন বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারান কেন্দ্রীয় কমিটির আর এক সদস্য মিলিন্দ তেলতুম্বড়ে।
প্রতিবারই চোখের জলে ভেসেছে কলকাতা। বর্ষাকালের মতো জমে থাকেনি কিন্তু সেই জলে নরম হয়েছে নিউজপ্রিন্ট। আর আমার বারবারই মনে হয়েছে, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস। মনে হয়েছে, বন্দুকই একমাত্র
এই মাওবাদীদের অত্যাচার সয়ে-চলা মানুষের চোখের জল মোছাতে পারে। বন্দুকই দেশ থেকে মাওবাদের ক্ষত মেটাতে পারে।
কমরেডরা বড়োই অতীত ভুলে যান।
তাঁদের মনেই থাকে না, কমরেড মাও জে দং, কমরেড চে গেভারা, কমরেড হোচিমিন, কমরেড ফিদেল কাস্ত্রো থেকে কমরেড স্তালিন সকলেই বন্দুক ধরেছিলেন। সাম্যের জন্য, সমাজতন্ত্রের জন্য। কিন্তু ইতিহাস বলছে, কিছুই পারেননি তাঁরা। কালের নিয়মে তারা শূন্য থেকে মহাশূন্যের পথে। কমরেড কাকুরা যে ‘ইসলাম খতরে মে হ্যায়’ বলে গলার শিরা মোটা করেন তাঁরা দিনের শেষে কোলবালিশে মুখ লুকোন। সন্ত্রাসবাদ দমন অভিযান ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ তাঁদের পাকুমনে আঘাত লাগলেও, কলিজা ফেটে গেলেও বুঝতে পারেন দিন ফুরিয়েছে। সময় গিয়ে, অসময় গিয়ে, এখন শুধুই দুঃসময়। সুবোধ বালক বাসবেরা আর ফিরবে না। মৃত মতবাদের মতো বাসবদের মৃত্যু নিশ্চিত। কারণ, সাধারণ মানুষের জন্য বন্দুক ধরার অভিনয় ধরা পড়ে গিয়েছে।
সেকু-মাকু-কাকুরা কী বলবেন, জঙ্গলে গোরু চরাতে আসা রাখাল, চাষের মাঠে লাঙ্গল ধরা কৃষকের বিরুদ্ধে বন্দুক ধরাটা ‘জায়েজ’! বন্দুক দেখিয়ে দিন বদলের গল্প বলে, পার্লামেন্টকে শুয়োরের খোঁয়াড় বলে টুক করে ভোটের রাজনীতিতে ঢুকে যাওয়ার পরে আপনাদের নেতারা কী করেছেন? কিছু কি বুঝতে পারছেন? মনে করতে পারছেন, কীভাবে অহিংস পদ্ধতিতে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা ঘটানো হয়েছিল? সেই ট্রেনের সব যাত্রীই কি শ্রেণীশত্রু ছিলেন? কেন তাঁদের খতম হতে হয়েছিল?
শালকু সরেনকে মনে পড়ছে? ২০০৯ সাল। আপনারা চিনতে পারবেন না। রিপোর্টার হিসেবেই গিয়েছিলাম লালগড়ের ধরমপুরে। সিপিএম পার্টি অফিসের সামনে দেহটা পচে গিয়েছিল। টানা পাঁচ দিন পড়ে ছিল যে। কাছে যেতে দেওয়া হয়নি সিপিএম কর্মী শালকুর বৃদ্ধা মা ছিতামণি সরেনকেও। দেহ দাহ করতে দেওয়া হয়নি। কতবড়ো শ্রেণীশত্রু ছিলেন কৃষক পরিবারের তরতাজা শালকু? গরিবের রক্তে এর পরেও লাল হয়েছে লালগড়ের মাটি। শালকু জানতেও পারলেন না তাঁর প্রিয়
দল সিপিএমের পলিটব্যুরো নিন্দা করেছে তাঁকে হত্যা করা মাওবাদীদের নেতা বাসবের মৃত্যুতে। প্রশ্ন করা হয়েছে, একটা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদককে এভাবে কেন হত্যা করল মোদী-অমিত শা-র যৌথবাহিনী? জবাব চাই, জবাব দাও।
আচ্ছা। বস্তার, দান্তেওয়াড়া, গড়চিরৌলিতে যৌথ বাহিনীর জওয়ানদের হত্যাকাণ্ড মনে রাখতে হবে না। ‘হত্যা’ নয় তো, এগুলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অ্যামবুশ করা। বরং, কমরেড বুদ্ধদেবের কথা ভাবুন। চিনতে পারছেন না! আরে বাবা সদ্য প্রয়াত কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন যিনি। তিনি তো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানকে নিয়ে জঙ্গলমহলে শিল্প করতে গিয়েছিলেন। সেই যে জিন্দালদের ইস্পাত কারখানা। আজও হয়নি। কাদের ভয়ে জিন্দালরা পিছিয়ে গিয়েছে? বুদ্ধদেবও তো আপনাদের দলের মানে একটা কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য ছিলেন। তাঁর গাড়ি উড়িয়ে খুনের চেষ্টা করেছিল কারা কমরেড? বাসবের জন্য হা-হুতাশ করার সময়ে স্মৃতির গোড়ায় এক পেগ হুইস্কি ঢালবেন নাকি! দামি স্কচ ঢাললে হয় তো মনে পড়বে যে, একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন বুদ্ধদেব।
তখনো শালবনী, ঝিটকার জঙ্গলে গিয়েছিলাম রিপোর্টার হিসেবে। দেখে এসেছিলাম লালগড়ের লাল চোখ। ফিরতে পারব কিনা ভয় ছিল। চারিদিকের রাস্তা কেটে দিয়েছিল বাসবের অনুগামীরা। বুদ্ধদেবকে খতম করতে না পারার আফশোস থেকেই সাংবাদিকদের আটকে রাখার চেষ্টা। পুলিশকে থানায় বন্দি করেও রাখা হয়েছিল।
সাবধান কমরেডরা। দেখবেন, সোডার বদলে স্কচের গ্লাসে চোখের জল না পড়ে যায়। নোনতা লাগবে। কমরেড মনে রাখবেন, গরিব গুর্বো মানুষের ঘামের মতো রক্তের স্বাদও নোনতা। গরিবের বন্ধু সাজার অভিনয় বন্ধ করুন কমরেড। গরিবকে শ্রেণীশত্রু বানানোর নাটকের মঞ্চটা ছাড়ুন। কার্টন পড়ে গিয়েছে।
শো শেষ কমরেড। দেখতে পাচ্ছেন, অন্ধকারে কটা চোখ জ্বলজ্বল করছে। ওরা গরিব মানুষ। সব দর্শক চলে গিয়েছে। হাততালি দেওয়ার লোকেরা নেই। মঞ্চের সামনে পড়ে থাকা চট গুটোতে এসেছেন ওঁরা।