চিন্ময় প্রভুর মুক্তিতে জেহাদিদের কাছে আত্মসমর্পণ বাংলাদেশ আদালতের
রঞ্জন কুমার দে
না, প্রত্যাশিতভাবে হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় প্রভুর জামিন হলো না। দেশদ্রোহের মামলায় জামিন মঞ্জুর হওয়ার পর দেশটির জেহাদি শক্তি রাজপথ, সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের আক্রোশ, ক্ষোভবহিঃপ্রকাশ করতে থাকে। এমনকী জামাত শিবির এবং সরকার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টারা প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের জামিনকে ভারতীয় শক্তির গোপন নির্দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে আদালত ও সরকারের উপর অলিখিত একটা চাপ সৃষ্টি করে। তাই তাঁকে ভুয়ো ৪টি মামলায় ফের জড়িয়ে জামিন অগ্রাহ্য করা হয়, এর ফলে খোলা আকাশে সন্ন্যাসীর অবাধ বিচরণে আবার অমাবস্যার কালো অন্ধকার নেমে এলো। প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাস কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনোদিন সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, তাঁর বিরুদ্ধে পূর্ব কোনো অভিযোগ কিংবা অপরাধেরও যোগসূত্রতা নেই। তাঁর একটাই অপরাধ, তিনি সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। একজন হিন্দু সন্ন্যাসী কীভাবে সভা-সমাবেশে হিন্দু জাগরণের প্রকাশ্য ডাক দিতে পারেন, ওটাই জেহাদিদের চক্ষুশূলতার প্রধান কারণ। আজ অবৈধ ইউনুস সরকার অপরাধ আসক্ত রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজার, টেকনাফে অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করে দিচ্ছে, দেশের ভেতরে করিডোর সৃষ্টি করেছে, কিন্তু দেশটির স্বাধীনতায় যে হিন্দুসমাজের ৯০ শতাংশ মানুষ সর্বস্ব দিল আজ তারা সেই দেশের ভেতরেই গৃহহারা, অসম্মানিত, বিতাড়িত।
নিঃসন্দেহে প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাস বাংলাদেশে হিন্দুদের পোষ্টারবয়। তাই ভারত যেকোনো রাজনৈতিক চালে তাঁকে মুক্তি করতে পারলে তিনিও বাংলাদেশে হিন্দু হৃদয় সম্রাট হয়ে থাকবেন।
যে আওয়ামি লিগ বর্তমান সরকার ও ঘনিষ্ঠদের চোখের বালি, সেই দলের অনেকে মুসলমান নেতা এখনো বুক ফুলিয়ে ঘুরছেন কিন্তু সেই দেশের বিন্দুদের ধুলায় মিশিয়ে দিতে হিন্দু যুবকদের আওয়ামি ট্যাগ লাগিয়ে যখন-তখন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে জেল বন্দি করে হিন্দু সমাজকে একটা পরোক্ষ বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে ভবিষ্যতে যাতে কেউ (অমুসলমানরা) এভাবে আর প্রকাশ্যে স্বজাতির জন্য শিরদাঁড়া সোজা না করতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে কিংবা পরে, অনেক হিন্দু নেতা শুধু হিন্দু ভোটের ঠিকাদারি করে গেছেন কিন্তু কেউই এভাবে প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের মতো জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি। ২০২৪-এর ৫ আগস্টের পর যখন হিন্দুদের খাঁড়ার উপর দাঁড়ালো তরবারির ঝুলছিল তখন প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাস নিপীড়িত নির্যাতিত এই সংখ্যালঘু হিন্দুদের ত্রাতা হয়ে উঠেছিলেন, হিন্দুদের মনোবল তৈরির এবং সংগঠিত করতে জেলায় জেলায় করেছেন বিশাল বিশাল সভা, ও মিছিল। তাঁর প্রত্যেকটি সমাবেশে ছিল হিন্দুদের উপছে পড়া ভিড় যেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনোদিন ঘটেনি এবং শর্ত একটাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ৮ দফা দাবি। তাই তাঁর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে মোল্লাবাদী সরকারের তাঁকে জেলে বন্দি করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা ছিল না।
সেই আট দফার দাবিতে ছিল সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে হিন্দু ফাউন্ডেশনে উন্নতকরণ, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ট্রাস্টকেও ফাউন্ডেশনে উন্নীতকরণ, দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন এবং অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি প্রত্যার্পণ আইন বাস্তবায়ন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরস্বতীপূজার অধিকার এবং হোস্টেলে প্রার্থনা কক্ষ, সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের আধুনিকীকরণ এবং দুর্গাপূজায় পাঁচ দিন ছুটি দেওয়া। বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম হিন্দুদের জন্য সাহসিকতায় ভরা এরকম দাবি চাওয়াটাই কাল হলো প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের জন্য। ৭১-এর পরাজিত দোসররা তথাকথিত জাতীয় পতাকা অবমাননার বাহানায় প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে জেল হাজতে হিন্দুদের হৃদয়ে আঘাত করেছে। প্রথমে তাঁকে ইসকন, তারপর ভারত এবং আওয়ামি লিগের সঙ্গে জুড়ে দেশের মোল্লাবাদকে পুঁজি করে সরকার এখন পুরো বাংলাদেশ জুড়ে হিন্দু ও ভারত বিদ্বেষে মেতে উঠেছে। দেশদ্রোহ মামলা ছাড়াও তাঁর উপরে অভিযোগ আনা হয়েছিল জমি দখল, মন্দিরের অভ্যন্তরে অনাথ শিশুদের সঙ্গে অবাধ যৌনাচার এবং যৌন হয়রানির মতো কুরুচিপূর্ণ একাধিক অভিযোগ। দেশের প্রথম সারির মিডিয়াগুলোও একজন হিন্দু সন্ন্যাসীকে সর্বোচ্চ কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহারে সামান্যতম কার্পণ্য
করেনি।
বাংলাদেশে কার্যত পাকিস্তান, জামাতপন্থী এবং জেহাদি প্রশাসনিক ব্যবস্থা বলবৎ হয়েছে। এমনবস্তায় প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাস দুঃসাহসিকতা দেখিয়ে তাঁর ভাষণের প্রত্যকটি বাক্যবাণে মোল্লাবাদীদের রক্তক্ষরণ হওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। তিনি বলেছিলেন হিন্দুদের জন্য কথা বললে জেলে যেতে হয়, আর হিন্দুদের উপর আক্রমণ করলে জেল থেকে জামিন পাওয়া হয়। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন, বিগত সরকার পাঁচশোর বেশি মডেল মসজিদ বানিয়েছে আমরা স্বাগত জানিয়েছি কিন্তু আমরা কী পেলাম! কিন্তু এখন দেশের হিন্দু সমাজের জীবন জীবিকাতে হাত দেওয়া হয়েছে, শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের অপরাধে চাকুরিচ্যুত কিংবা পদাবনতি হচ্ছে। শুধু হিন্দু
পরিচয়ে ৯৩ জন পুলিশকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, ভেটেরিনারি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দুদের চিহ্নিত করে বহিষ্কার করা হয়েছে, প্রকাশ্যেই অন ক্যামেরায় দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কত যে হিন্দু শিক্ষাগুরুদের লাঞ্ছনা করে, পদত্যাগপত্র লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে সেটা বিশ্ব দেখেছে। প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাস দেশের সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, কারণ ইউনুস সরকার ছ’টি কমিশন গড়েছে কিন্তু সেখানে কোনো সংখ্যালঘু বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নেই।
তিনি বারবার দেশের ঘুমন্ত হিন্দুদের জাগাতে, বোঝাতে চেয়েছেন যে, দেশের সংবিধান সংশোধনে কোনো আপত্তি নেই কিন্তু হিন্দুরা সেখানে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকার প্রশ্নই আসে না। প্রবু চিন্ময়কৃষ্ণ দাস বলেছিলেন- ‘আমরা মোগল নই, ওলন্দাজ নই, আমরা ফরাসি নই, আমরা ব্রিটিশ নই, আমরা উড়ে আসিনি। আমরা এই বঙ্গ যিনি প্রহ্লাদ মহারাজের পৌত্র, বলি মহারাজের পুত্র, সেই বঙ্গ মহারাজ বঙ্গের নামানুসারে যে বঙ্গভূমি, আমরা তার উত্তরাধিকারী। আমাদের এখানে প্রথম অধিকার আছে। আমাদের অধিকারকে অস্বীকার করার কোনো প্রচেষ্টা হিন্দুরা আর মেনে নিবে না।
সাইফুল ইসলাম নামের জামাতপন্থী এক আইনজীবীকে প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী ভেবে কুপিয়ে হত্যা করে দেশের মোল্লাবাদীরা (দেশের প্রথম সারির মিডিয়া হাউজগুলো ফলাও করে তখন প্রচার করেছিল), পরে সেটার দায়ও মোল্লাবাদী সরকার ইসকন, প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাস এবং সনাতন ঐক্য জোটের ঘাড়ে চাপিয়ে পুরো দেশে মুসলমান সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগায়। শুধু তাই নয়, এই মামলায় প্রায় ১৫০ জনেরও বেশি হিন্দু আইনজীবীর নাম জুড়ে দেওয়া হয়। প্রাথমিক ভিডিয়ো ফুটেজ তদন্তে ৬ জন ইসলামি শিবির কর্মীর হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপরাধে আটক করলেও পরে বেছে বেছে হিন্দু
নেতাদের গ্রেপ্তা করা হয়েছে।
প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী রমেন রায় মোল্লবাদীদের আক্রমণে আইসিইউ-তে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েছেন। প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে বলা হয়েছিল কোনো আইনজীবী যাতে প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের হয়ে আদালতে আর না
দাঁড়ান। আদালতের অনুমতি সত্ত্বেও তাঁর জন্য ওষুধ ও খাবার নিতে যাওয়ায় পুলিশ তাঁর সেবকদের গ্রেফতার করে। ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এবং জাতীয় সংসদ বাংলাদেশের সংখ্যালঘু এবং প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারে নিন্দা ও চিন্তা ব্যক্ত করেছিল। দেশদ্রোহের ভুয়ো মামলায় জামিনের পর আবার তাঁর বিরুদ্ধে চারটি মামলা করে তাঁকে আদালতে আবার গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এই চারটি মামলায় তাঁকে আইনজীবী হত্যা, পুলিশের কাজে বাধা, আইনজীবী ও বিচারপতিদের উপর হামলা এবং বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের অভিযোগ আনা হয়েছে। অথচ তিনি এই ঘটনাস্থল থেকে ২ কিলোমিটার দূরে পুলিশের জিম্মায় ছিলেন। আজকাল প্রকাশ্যে জামাত-পাকিস্তানপন্থীরা দেশের পতাকা, জাতীয় সংগীত, সংবিধানকে প্রকাশ্যে অবমাননা করছে, অথচ তাদের ভয়ে পুলিশ-প্রশাসন ও আইন নীরব।
বাংলাদেশে ইসকনকে মোল্লাবাদীরা নিষিদ্ধ করতে চাইছে। রাজপথে স্লোগান দিচ্ছে-‘একটা একটা ইসকন ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’, ‘ইসকনের আস্তানা জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও’। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই পান্না স্পষ্ট বলছেন, সরকার চাইছে তাই তাঁকে কারাগারে রাখছে, এখানে আইন সংবিধানের
প্রশ্ন তুলে কী লাভ! সরকার কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে খুশি রাখতে কিংবা ভয়ে এরকম লজ্জাজনক কাজ করছে। আমরা দেশের সাধারণ হিন্দুদের কথা যদি বাদও দিই, প্রশাসনে থাকা হিন্দুরাও নিশ্চিন্তে নেই। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও হিন্দু পুলিশ কর্মকর্তা কিংবা সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত হিন্দুদের সরকারি ছাউনিতে ঝুলিয়ে আত্মহত্যার নাম দিয়ে চালিয়ে দিচ্ছে। এমন অবস্থায় প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের জেলের ভিতরে থাকা কতটুকু নিরাপদ কিংবা যদি কোনোদিন জামিন পেয়েও যান,
তাহলে তাঁর জীবনের নিরাপত্তা খুবই ক্ষীণ। ভারতের মৌনব্রতে প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের মুক্তি আরও জটিল অবস্থায় পৌঁছেছে। নিঃসন্দেহে প্রভু চিন্ময়কৃষ্ণ দাস বাংলাদেশে হিন্দুদের পোস্টারবয়। তাই ভারত যেকোনো রাজনৈতিক চালে তাঁকে মুক্তি করতে পারলে তিনিও বাংলাদেশে হিন্দু হৃদয় সম্রাট হয়ে থাকবেন।
অপারেশন সিঁদুরের সাফল্যে বালোচদের নৃত্যের মাধ্যমে উল্লাস প্রকাশ
মণীন্দ্রনাথ সাহা
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পাকিস্তানের পক্ষেনা থাকার কথা জানিয়ে বালুচিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও জিন্নার বিশ্বাসঘাতকতায় তা সম্ভব হয়নি। পাক সেনাবাহিনী গায়ের জোরেই দখল করে নেয় বালুচিস্তান। সেদিন থেকেই বালোচরা পরাধীন জীবনযাপন করছেন।
বালুচিস্তান ৩ লক্ষ ৪৭ হাজার ১৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত, যা পাকিস্তানের মোট আয়তনের প্রায় ৪৪ শতাংশ। কিন্তু দেশের ২৪ কোটি ১০ লক্ষ মানুষের মাধ্যে মাত্র ৬ শতাংশ এখানে বাস করেন। ভয়েস ফর বালুচ মিসিং পার্সনের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, বালুচিস্তান থেকে সাত হাজারেরও বেশি মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। ইরান ও আফগানিস্তান সীমান্তের কাছে অবস্থিত এই প্রদেশের অবস্থান অঞ্চলটিকে পাকিস্তানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
বালুচিস্তান হলো পাকিস্তানের সবচেয়ে বড়ো খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার। এর মাটির নীচে বিপুল পরিমাণ সোনা, তামা, ও অন্যান্য বহুমূল্য ধাতু মজুত রয়েছে। সমগ্র পাকিস্তান জুড়ে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করে থাকে বালুচিস্তান। কাজেই বালুচিস্তান যদি আলাদা হয়ে যায়, তাহলে পাকিস্তান প্রচণ্ড জ্বালানি সংকটের মধ্যে পড়বে। তাদের তখন বাইরে থেকে জ্বালানি আমদানি করতে হবে। তথ্য মতে বালুচিস্তানে প্রায় ১,৭০০টন সোনা মজুত রয়েছে। বালুচিস্তানকে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম স্বর্ণভাণ্ডার বলেও দাবি করা হয়। এখানে প্রচুর তামাও মজুত রয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ১৭৮ লক্ষ কোটি টাকা। এছাড়াও রয়েছে ইউরেনিয়ামের ভান্ডার।
শুধু তাই নয়, এখানে প্রচুর পরিমাণে ফল উৎপাদন হয়। পাকিস্তানে উৎপাদিত খেজুরের ৭০ শতাংশই আসে বালুচিস্তান থেকে। বালুচিস্তানে পর্যটনেরও বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতি বছর কয়েক লক্ষ কোটি টাকা আয় হয় এখান থেকে। বালুচিস্তানে ৭৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র উপকূল রয়েছে |
বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ১৯৭৭সালে বলেছিল- ‘ইসলামাবাদের হিসাব অনুসারে বালুচিস্তান লুণ্ঠনের জনা একটি বিশাল জমি, তেল ও খনিজ পদার্থে ভাসমান একটি শুষ্ক মরুভূমি। তাদের রাজনৈতিক কৌশলের একটি বড়ো অংশ পাকিস্তানি আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া এবং বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সুবিধার্থে এই সম্পদ আহরণের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা নির্ধারিত হয়। বালুচিস্তানে গ্যাস, তামা, সোনা, কয়লা ও তেলের মতো প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, যার মূল্য আনুমানিক ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু এই সম্পদের সুবিধা স্থানীয় বালোচদের কাছে পৌঁছয় না।’
ঠিক যেমন দেশভাগ হওয়ার পর পূর্ব-পাকিস্তানের কৃষিজ সম্পদের ওপর ভর করে পাক-শাসকরা আরাম আয়েসে দিন কাটাতেন। তার বিরুদ্ধেই ‘পিন্ডি নয় ঢাকা’ স্লোগান তুলে বাংলাদেশিরা ভারতীয় সেনার সাহায্যে নিজেদের স্বাধীন করেছিলেন ১৯৭১ সালে। আজ ঠিক সেরকম অবস্থা বালুচিস্তানেও। বালোচরা যখন পূর্ণ স্বাধীনতার পথে আন্দোলনরত, তখন নতুন আতঙ্কে ঘুম উড়েছে ইসলামাবাদের। বালুচিস্তান হাতছাড়া হলে আসলে দেউলিয়া পাকিস্তান একেবারে ভিখিরি দেশে পরিণত হবে বলে সকলে মনে করছেন।
আরও জানা গিয়েছে যে ১১ মার্চ ২০২৫-এ বালোচ লিবারেশন আর্মি
সকাল ৯টায় কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী ‘জাফর এক্সপ্রেস’ নামক ট্রেনটি হাইজ্যাক করে নেয়। ওই ট্রেনে প্রায় ৫০০ যাত্রী ছিল। ট্রেন হাইজ্যাক করে পাকিস্তানকে বুঝিয়ে দিয়েছে তারা স্বাধীনতা লাভের পথে এগোচ্ছে। এছাড়া জানা যাচ্ছে- তারা নাকি ভারতের কাছে আর্জি জানিয়েছে যে ১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধে ভারতের হাতে বন্দি ৯৩ হাজার পাক সেনার হাতে থাকা পুরনো রাইফেল এবং প্রতিটি রাইফেলের সঙ্গে মাত্র ১০টি করে গুলি আমাদের দিক। তাহলেই আমরা পাকিস্তানকে বুঝে নেব।
বালুচিস্তান যদি স্বাধীন হয়ে যায়, তবে পাকিস্তানের নিরাপত্তাও প্রশ্নের মুখে পড়বে। আফগানিস্তানে তালিবানের শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে চাপে রয়েছে পাকিস্তান। তালিবানদের সঙ্গে প্রায় সময়ই তাদের সংঘর্ষের খবর খবর পাওয়া যায়। বালুচিস্তান এতদিন ইরান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের মাঝে দুর্গের মতো কাজ করত। যদি বালুচিস্তান না থাকে, তবে আফগানিস্তান যেকোনো সময়ে আগ্রাসন দেখাতেই পারে। কেননা পাক-আফগান সীমান্তের ডুরান্ড লাইন তারা কোনোদিনই মানেনি বা এখনো তারা তা মানে না। ফলে পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও কূটনীতিতে প্রভাব পড়া অসম্ভব নয়।
গত ৯ মে পাকিস্তানের হহৃদকম্প বাড়িয়ে বালুচিস্তান প্রদেশের বালোচ স্বাধীনতাকামীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ‘অপারেশন সিঁদুরের’ মধ্যেই বালোচ লিবারেশন আর্মি বালুচিস্তান প্রদেশের বোলান ও কেচ অঞ্চলের দুটি পৃথক হামলা চালিয়ে ১৪ জন পাক সেনাকে খতম করেছে। তাছাড়া বালোচরা কোয়েটা-সহ কয়েকটি শহর দখল করে সেখান থেকে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বালোচ পতাকা উত্তোলন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। সঙ্গে সঙ্গে তারা রাষ্ট্রসঙ্ঘে বালুচিস্তানকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য আবেদন করেছে। উপরন্তু ভারতের কাছেও তারা বালুচিস্তানকে স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি দেওয়ার আর্জি জানিয়েছে এবং ভারতে তাদের দেশের দূতাবাস খুলতে চেয়েছে।
বালোচরা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে ভারতের অপারেশন সিঁদুরের সাফল্যে। ভারত যখন অপারেশন সিঁদুর নামে পাকিস্তানের মধ্যে এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরে একের পর এক জঙ্গি শিবির এবং বিমান ঘাঁটিতে প্রত্যাঘাত করে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে, সেই দৃশ্য দেখে এক বালুচ নাগরিক আনন্দে নৃত্য শুরু করেছেন। তাঁর সেই নৃত্যের দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েও পড়েছে। অনেকেই বলছেন, বালোচরা যে ভারতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে সেটাই নৃত্যের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন তিনি।
সারা বিশ্ব জানে পাকিস্তান একটি সন্ত্রাসবাদী দেশ। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে সেদেশে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের লালনপালন করা হয়। আর ভারত-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাস চালানো হয়। অথচ নিজের দেশের জনগণের প্রতি শাসকের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। সরকার ও সেনার দমন-পীড়নে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বালুচিস্তান, সিন্ধ, খাইবার পাখতুনখোয়া প্রভৃতি প্রদেশের জনগণ আজ বঞ্চিত, শোষিত ও বিপন্ন। তাই বালোচদের স্বাধীনতা ঘোষণাকে শান্তিপ্রিয় দেশের সমর্থন জানানো উচিত বলেই অনেকে মত প্রকাশ করছেন।
ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা
অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য
১৯২৫ সালে ভারতবর্ষের ইতিহাসে জন্ম নিল দুই বিপরীতধর্মী ভাবধারার দুটি সংগঠন। একটা রাজনৈতিক, অন্যটা সমাজিক- সাংস্কৃতিক। একটা বিদেশি ভাবনার ভাবধারায় পুষ্ট ও সমর্থক; অন্যটা ভারতীয় ঐতিহ্য, পরম্পরা ও সংস্কৃতির পূজারি। প্রথমটা জন্ম নিল রাশিয়ার তাসখন্দে মার্কসীয় জড়বাদের আতুড়ঘরে, যার দেশ থেকে বেশি দেশের বাইরে প্রতি নিষ্ঠা আর বিজয়াদশমীর পুণ্যলগ্নে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের দৃঢ় বন্ধনের শপথ নিয়ে জন্ম নিল এক সামাজিক-সাংস্কৃতি পরিমগুলে- হিন্দুত্ব যার প্রাণ। প্রথমটা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিল, রাশিয়া-চীনের স্বার্থই বড়ো, দেশের স্বাধীনতা নয়। তাদের ভাষায় ‘We must fight harder for our freedom in order to defend the Soviet Union. (Arun Sourie, Illustrated weekly, 08.04.1984)
আর দ্বিতীয়টি হলো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। ‘হিন্দু রাষ্ট্রের পুনরুত্থান’ এবং ব্যক্তিগত জীবন হতে সমষ্টি জীবনের দিকে, দাসত্ব হতে স্বাধীনতার দিকে, নিদ্রা হতে জাগৃতির দিকে, দৈন্য হতে স্বর্গতুল্য সুখের দিকে এবং দুর্বলতা হতে বিজিগীষু মানসিকতার দিকে সমগ্র ভারতবর্ষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প নিয়ে ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার প্রতিষ্ঠা করলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। ভারতীয় জাতীয়তাবোধের নবধ্রুবতারা সঙ্ঘের জন্ম কি আকস্মিক, না কোনো ঐতিহাসিক পথ পরিক্রমার ফসল। কারণ দেখা যাচ্ছে সঙ্ঘশক্তির কথা বার বার, যুগে যুগে গুরুত্ব পেয়েছে ভারতীয় চিন্তাচেতনায়। শুধু ভারতেই নয় সমগ্র বিশ্বের প্রথম সাহিত্য ঋগ্বেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে- ‘সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম্। ‘মানব সমাজের অগ্রগতির প্রথম ও প্রধান সোপান হলো এই মন্ত্র।
এরপর কেটে গেছে বহু শতাব্দী। সমাজজীবনে ঘনিয়ে এসেছিল স্থূলতা, স্থবিরতা। তাই প্রয়োজন পড়েছিল একজন যোগ্য সাধকের। ভারতের পবিত্র মাটিতে বার বার ভগবানের আবির্ভাব ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা ও ভারতীয় জীবনধারাকে সজীব ও সচল করে রেখেছে। যুগের প্রয়োজনেই সনাতন ধর্মকে গতিশীল, করতে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর এক বৈশাখী পূর্ণিমার পুণ্যলগ্নে আবির্ভাব হলো গৌতম বুদ্ধের। এক শ্রেণীর বিভেদকারী পণ্ডিত হিন্দুধর্ম থেকে বৌদ্ধমতকে আলাদা করে মূল্যায়ন করার পক্ষপাতী। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। এ প্রসঙ্গে রিস ডেভিস দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেন- ‘Gautama was born and broughtup and lived and died as a Hindu’। তিনি হিন্দুদের মধ্যে মহত্তম, জ্ঞানী শ্রেষ্ঠ ও উত্তম এবং আজীবন তিনি ছিলেন একজন ভারতীয়। স্বয়ং বুদ্ধদেব স্বীকার করেছেন তাঁর প্রচারিত মত বৈদিক অনুসারী।
আবার মধ্যযুগীয় ভারতে ইসলামি আগ্রাসনের ক্রমস্পর্ধিত উদ্ধত তরবারির মোকাবিলা করার জন্য মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ‘সঙ্গে শক্তির কলৌযুগে’ অর্থাৎ কলিযুগে সঙ্ঘ শক্তির গুরুত্বের কথা তুলে ধরেছেন। নিত্যানন্দ মহাপ্রভু তো বলেই দিয়েছিলেন, অটুট সঙ্ঘশক্তি ছাড়া একটা জাতি সমুন্নত হতে পারে না। তাই দেখা যায় যুগে যুগে সঙ্ঘশক্তি ভারতীয় সভ্যতার নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে।
১৯২৫ সালে হিন্দুজীবনের নবীন প্রভাতের কলকাকলি শোনাতে, নবভারত জাগৃতি কল্পে, একটি ঐতিহ্যশালী সঙ্ঘশক্তি প্রতিষ্ঠা হবে তার সব ব্যবস্থা ঈশ্বর যেন সাজিয়ে
গুছিয়ে রেখেছিলেন। ঋগ্বেদ থেকে শুরু করে বৌদ্ধমত, বৈষ্ণবমত ও কলকাতার ঠাকুর পরিবারের ‘হিন্দুমেলা’-র ভাবনা সবেতেই সঙ্ঘশক্তির কথা বলা হয়েছে।
সুদূর অতীতের স্বর্ণযুগে না গিয়েও যদি আমরা পঞ্চদশ শতাব্দীর কথাই ধরি দেখতে পাবো নিত্যানন্দ মহাপ্রভু, যাঁর মধ্যে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের জনকল্যাণ চেতনা ও বিশ্বমৈত্রী ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠেছে সেই দিব্য জ্যোতিষ্কের আলোকজোতি প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষভাবে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের মধ্যে। ক্রান্তদর্শী নিত্যানন্দ প্রভু অনুভব করেছিলেন, ‘আজকের শিশু-কিশোররাই আগামীকালের দেশের, দশের কর্ণধার। তাই তিনি আপন অনুগত আউল মনোহরকে মুখ্য নেতত্ব দিয়ে এ দেশের দিকে দিকে ছোটো ছোটো গোষ্ঠী (দল)-তে পাঠাতে লাগলেন, যারা বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রদের চরিত্র গঠন তথা নৈতিক উন্নতির বিষয়ে বিশেষ যত্ন নেবে এবং উপযোগী শিক্ষা দেবে।’ তেমনই প্রাতস্মরণীয় ডাঃ হেডগেওয়ারও চিন্তন করেছিলেন আজকের শিশুরাই ভাবী ভারতের কর্ণধার। তিনিও শিশু-বালকদের শাখাস্থান অভিমুখীকরণের পথ নির্দেশ দিয়েছেন। স্বামী বিবেকানন্দ যেমন তরুণদের শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যচর্চার উপর জোর দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনই ডাক্তারজীও শিশু-বালক-তরুণদের শাখার মাঠে খেলাধুলা, ব্যায়াম, যোগাসনের মাধ্যমে দৃঢ় দৈহিক গঠন, সবল চিন্তাধারা এবং শাখায় ‘ভারতমাতা কী জয়’ প্রার্থনা বাণী উচ্চারণের মাধ্যমে দেশ ও হিন্দুত্বের প্রতি ধ্যেয়নিষ্ঠ হওয়ার প্রেরণার ব্যবস্থা করে গেছেন।
হিন্দুজাতির হিত কামনায় ১৮৬৭ সালে কলকাতার ঠাকুর পরিবারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘হিন্দুমেলা’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন, ‘আমাদের বাড়ির সাহায্যে হিন্দুমেলা বলিয়া একটি মেলা সৃষ্ট হয়েছিল।’ সম্পাদক হন গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সরকারী সম্পাদক হন নবগোপাল মিত্র। এই মেলার উদ্দেশ্য ও কার্যপদ্ধতির মধ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের আদর্শ ও লক্ষ্যে পৌঁছানোর কার্যপদ্ধতির বেশ মিল দেখতে পাওয়া যায়। এই হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল- ১. বছরের শেষে হিন্দুজাতিকে একত্রিত করা এবং ২. ‘মানব জন্ম গ্রহণ করিয়া চিরকাল পরের সাহায্যের উপর নির্ভর করা অপেক্ষা লজ্জার বিষয় আর কী আছে; অতএব যাহাতে এই আত্মনির্ভরতা ভারতবর্ষে স্থাপিত হয়, ভারতবর্ষে বদ্ধমূল হয় তাহা এই মেলার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য।’
শুধু উদ্দেশ্য থাকলেই হবে না, প্রয়োজন উদ্দেশ্য সাধনের পন্থা। হিন্দুমেলার কার্যকর্তারা তাঁদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ছয় প্রকার পন্থা নির্ণয় করেন। যেমন- ১. এই মেলা পরিচালনার জন্য একটি সাধারণ মণ্ডলী গঠিত হবে, তাঁরা হিন্দুজাতিকে এই মেলার লক্ষ্য বিশেষভাবে বোঝাবেন এবং এই জাতীয় মেলার গৌরব বৃদ্ধিতে সচেষ্ট থাকবেন। ২. প্রত্যেক বছরে আমাদের এই হিন্দু সমাজের কতখানি উন্নতি হলো সেই বিষয়ে চৈত্র সংক্রান্তিতে সাধারণের উপস্থিতিতে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন পাঠ করা হবে। ৩. অস্ম্যদ্দেশীয় যেসব ব্যক্তি স্বজাতীয় বিদ্যানুশীলনে উন্নতি সাধনে নিয়োজিত হয়েছেন তাঁদের উৎসাহ দান করা হবে। ৪. প্রতি মেলায় বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শ্রেণীর লোকের উৎপাদিত পরিশ্রম ও শিল্পজাত দ্রব্য সংগ্রহ করে প্রদর্শন করা হবে। ৫. এই মেলায় স্বদেশীয় সংগীতে নিপুণ ব্যক্তিদের উৎসাহ প্রদান করা হবে এবং ৬. যাঁরা মল্ল বিদ্যায় সুশিক্ষিত হয়ে খ্যাতি লাভকরেছেন তাঁদের প্রতি মেলায় একত্রিত করে সম্মাননা প্রদান করা হবে এবং স্বদেশীয় লোকেদের ব্যায়াম শিক্ষা প্রচলন করা হবে। এইসব পন্থা সাধনে যে সকল ব্যক্তিদের যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা হলেন-
রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, তারিণী চরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরীশচন্দ্র ঘোষ, নীলকমল বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্ণ কমল ভট্টাচার্য্য, অম্বিকা চরণ গুহ প্রমুখ। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার প্রায় ছয় দশক আগেই তার বীজ রোপিত হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির তত্ত্বাবধানে হিন্দুমেলার উর্বর ভূমিতে।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনস্মৃতির পাণ্ডুলিপিতে লেখেন- ‘আমাদের পরিবারে
শিশুকাল হইতে স্বদেশের জন্য বেদনার মধ্যে আমরা বাড়িয়া উঠিয়াছি। আমাদের পরিবারে বিদেশি প্রথার কতকগুলি বাহ্য অনুসরণ অনেকদিন হইতে প্রবেশ করিয়াছিল সন্দেহ নাই, কিন্তু আমাদের পরিবারে হৃদয়ের মধ্যে অকৃত্রিম স্বদেশনানুরাগ সাগ্নিকের পবিত্র অগ্নির মতো বহুকাল হইতে রক্ষিত হইয়া আসিতেছে।’ হিন্দুমেলার বিভিন্ন আলোচনার জন্য ঠনঠনিয়ার একটি পোড়ো বাড়িতে সভা বসত যা ছিল গোপন সভা। এই সভায় আদি ব্রাহ্ম সমাজ গ্রন্থগার থেকে আনা হয়েছিল লাল রেশমের কাপড়ে জড়ানো বেদমন্ত্রের একটা পুঁথি। এই সভাগৃহে ছিল একটা টেবিল। টেবিলে ছিল দুটি মড়ার মাথা। মাথার চক্ষু দুটির কোঠরে দুটি মোমবাতি থাকত। এটা ছিল এক সাংকেতিক রূপক ভাবনায় ভাবিত। মড়ার মাথা ছিল মৃত ভারতের সংকেত আর চোখের বাতিলগুলি ছিল মৃত ভারতে প্রাণ সঞ্চার এবং তার জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত করার চেষ্টা। ডাক্তারজী বহুদিন কলকাতায় ছিলেন, তিনি ছিলেন সমাজ সচেতন মানুষ। ধর্ম ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিচ্ছুরিত আলোকজ্যোতির সন্তান। হিন্দুমেলার এই সব ঘটনা ও আদর্শের কথা তিনি নিশ্চয়ই
শুনে থাকবেন।
সুগভীর ও সুদীর্ঘ অতীতের পাতা যতই
উলটানো হবে দেখা যাবে যুগে যুগে সঙ্ঘশক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। আজ নবনির্মিত ভারত নির্মাণের মূল কারিগর সঙ্ঘ। ভারতের স্বাধীনতা লাভ এবং স্বাভিমানী ভারত রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে ডাক্তারজী আর পাঁচটা তরুণের মতো তিনিও জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু নেতাজী-সহ চরমপন্থী নেতাদের মতো কংগ্রেস সম্পর্কে তাঁরও মোহভঙ্গ হয়। বিশেষ করে তুরস্ককে কেন্দ্র করে খিলাফতের নামে যে জেহাদ শুরু হয় তার সঙ্গে ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনকে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত করার কী কারণ ছিল তা অনেক চিন্তাশীল ব্যক্তির মতো ডাক্তারজীকেও ভাবিয়ে তুলেছিল।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ২৪ নভেম্বর অখিল ভারতীয় খিলাফত পরিষদ গঠিত হয়। গান্ধীজীর সক্রিয়তায় হিন্দু-মুসলমান সকলকেই শামিল হতে বলা হলো। শুধু তাই নয় ওই পরিষদের সভাপতি হিসেবে গান্ধীজী যে বক্তব্য রাখেন তাতে তিনি স্পষ্ট হলেন- ‘আমরা হিন্দু-মুসলমান একতার কথা বলি। কিন্তু মুসলমানদের উপর বিপত্তি এলে আমরা হিন্দুরা যদি পিছিয়ে পড়ি তাহলে একতার ঘোষণার অর্থ কী? কিছু লোকে বলে যে, আমাদের
মুসলমানদের শর্ত সাপেক্ষে করা উচিত, কিন্তু প্রকৃত সাহায্য তো নিস্বার্থ হওয়া উচিত।’
গান্ধীজীর এই বক্তব্যকে অনেকেই মুসলমানদের হাতে ‘ব্ল্যাঙ্ক চেক’ তুলে দেওয়ার নীতি বলে মন্তব্য করেন। ডাক্তারজীকে চরমভাবে ভাবিয়ে তুলল গান্ধীজীর এই বক্তব্য। তাহলে তিনি যে শক্তিশালী, স্বাভিমানী, আত্মনির্ভর স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখতেন তার কী হবে? কংগ্রেস তো স্বাভিমানী ভারত রাষ্ট্র নির্মাণ করবে না, কংগ্রেস তো ‘সাম্রাজ্যের মধ্যে স্বরাজ’ অথবা ‘উপনিবেশিক স্বরাজ’ লাভেই সন্তুষ্ট, কিন্তু ডাক্তারজী তো ‘শুদ্ধ স্বরাজ’ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেন-ই না। শুরু হলো মানসিক দ্বন্দ্ব সেই দ্বন্দুে ক্ষত-বিক্ষত হতে লাগলেন। ভাবলেন কংগ্রেসে থেকে কিছু করা যাবে না। তাঁর স্বপ্নের বৈভবশালী হিন্দুরাষ্ট্র গঠন করা যাহে না।
তিনি ছিলেন ইতিহাস সচেতন মানুষ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের কাহিনি পড়েছেন, জেনেছেন। ইতালির জাতীয় আন্দোলনে ম্যাৎসিনীর অবদান এবং তাঁর আন্দোলন পন্থা তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। ইতালির আন্দোলন ইতালীয়দের নিয়ে করতে হবে। এই জন্য ম্যাতসিনি ইয়ং ইতালি প্রতিষ্ঠা করেন। লক্ষ্য ইতালির যুব সমাজকে জাতীয় ঐক্য আন্দোলনে শামিল করা। এই জন্য তিনি ‘কার্বোনারি’ নামে এক গুপ্ত সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন। এই গুপ্ত সমিতিও তাদের দেশের ধর্মীয় বিশ্বাসে গভীরভাবে আস্থাশীল ছিল। এই কার্বোনারির গুপ্ত সমিতির সদস্যদের নির্দিষ্ট পোশাক বিধি ছিল। হয়তো ডাক্তারজী ইতালির এই গুপ্ত সমিতির উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও কার্য পদ্ধতির দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন বা বিশ্বাসী ছিলেন। সেজন্য তিনিও স্বয়ংসেবকদের দিলেন রাষ্ট্র সেবার, নতুন ভারত নির্মাণের দর্শন-হিন্দুত্ব।
এভাবে দেখা যায় হিন্দুরাষ্ট্র নির্মাতা ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার ইতিহাসের ধারা অব্যাহত প্রতিষ্ঠা করলেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। হয়তো রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়েছে বা বলা ভালো নির্মাণের প্রয়োজন ছিল, তা নাহলে বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে বর্ণিত ‘মা কী ছিলেন, কী হইয়াছেন আর মা কী হ’বেন’ ভবানন্দের অঙ্কিত স্বপ্নের ভারতমাতাকে পেতাম না। সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা দীর্ঘ একশো বছর ধরে হৃদয়তন্ত্রের এক গভীর অন্তঃস্থলে পরম আরাধ্যা জননী রূপে ভারতমাতাকে লালন পালন করে আসছে। ।