উন্নয়নের স্বার্থেই মাওবাদীমুক্ত ভারত
হাজার বৎসরের পরাধীনতা সমাপ্ত হইয়াছিল ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হইয়া। খণ্ডিত ভারতেরই অংশ পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদী দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। জন্মাবধি তাহারা ভারতের বুকে আঘাত করিয়া দেশের মাটিকে রক্তরঞ্জিত করিয়াছে। স্বাধীন ভারতের পুনর্গঠনের কার্য তাহাতে ব্যাহত হইয়াছে। নবগঠিত দুর্বল ভারত সরকার সেই সন্ত্রাস দমনে কার্যকরী পদক্ষেপও গ্রহণ করিতে পারে নাই। সেই কারণে দেশের অগ্রগতিও আশানুরূপ হইতে পারে নাই। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্ব হইতেই বিদেশি মতাদর্শপুষ্ট কমিউনিস্টরা দেশের মুক্তি সংগ্রামে নানাপ্রকারে ব্যাঘাত ঘটাইয়াছে। স্বাধীনতার পরেও তাহাদের সেই ধারা অব্যাহত রহিয়াছে। দেশের উন্নয়ন কার্যে সর্বপ্রকার বিরোধিতাই তাহাদের একমাত্র লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই তাহাদের কয়েকজন নেতা উত্তরবঙ্গের নকশালবাড়িতে কৃষকদের স্বার্থরক্ষার নাম করিয়া এক ধ্বংসাত্মক আন্দোলনের সূচনা করিয়াছিল। চীনের মাও-সে-তুং এবং রাশিয়ার লেনিন ইহাদের আদর্শপুরুষ। ‘জনযুদ্ধ’-এর মাধ্যমে ভারতীয় গণতন্ত্রের উৎখাত সাধনই ইহাদের লক্ষ্য। ইহারা নিজেদের মাওবাদী বলিলেও নকশালবাড়ি হইতে তথাকথিত ‘যুদ্ধ’ শুরু করিয়াছিল বলিয়া জনমানসে তাহারা ‘নকশাল’ নামেই অধিক পরিচিত। ১৯৬০-এর দশকে ইহারা পশ্চিমবঙ্গের জনজীবন বিপর্যস্ত করিয়া ফেলিয়াছিল। শ্রেণীশত্রু খতমের নামে ইহারা শিক্ষক-অধ্যাপক, চিকিৎসক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, বড়ো কৃষক, পুলিশ, দারোগা সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করিয়াছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদরদি উপাচার্য গোপাল চন্দ্র সেনকে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই ইহারা ছুরিকাঘাতে হত্যা করিয়াছে। দেশবরেণ্য মনীষী বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের মূর্তি ইহারা চূর্ণ করিয়াছে। সমাজ পরিবর্তনের নাম করিয়া শত শত বিপুল সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীকে বিপথে চালিত করিয়া তাহাদিগকে ধ্বংসের পথে ঠেলিয়া দিয়াছে। পশ্চিমবঙ্গবাসীর সৌভাগ্য যে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের তৎপরতায় এক দশকের মধ্যেই এই ধ্বংসাত্মক আন্দোলন স্তিমিত হইয়া পড়িয়াছিল।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই আন্দোলন স্তব্ধ করা হইলেও ততদিনে ইহারা ওড়িশা, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের ন্যায় জনজাতি অধ্যুষিত রাজ্যগুলিতে জাল বিস্তার করিয়া ফেলিয়াছিল। ইহাদের উৎসাহিত করিয়াছে শহরের ভারতবিরোধী তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা। ইহাদের মধ্যে রহিয়াছেন শিক্ষক-অধ্যাপক, চিকিৎসক ও সাংবাদিকরাও। ইহারাই আরবান নকশাল নামে পরিচিত। ইহা ব্যতীত দেশ বিদেশের কমিউনিস্টরা তো রহিয়াছেই। ভারতের তৎকালীন দুর্বল কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ লইয়া দেশের ৪০ শতাংশ এলাকায় প্রভুত্ব স্থাপন করিয়া ৯২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা ব্যাপী রেড করিডোর নির্মাণ করিয়া তাহাতে ইহারা সমান্তরাল এক শাসনব্যবস্থা স্থাপন করিয়াছিল। জনজাতিদের অধিকার রক্ষার নাম করিয়া তাহাদের দেশের উন্নয়ন যজ্ঞের বাহিরে থাকিতে বাধ্য করিয়াছিল। যাহারা তাহাদের বিরুদ্ধে মাথা তুলিয়াছে মাওবাদীরা তাহাদের হত্যা করিয়াছে। স্থানীয় মানুষের নিকট হইতে অবৈধ কর আদায় করিয়াছে। মহিলাদের যৌন শোষণ করিয়াছে। নির্বিচারে দেশের নিরাপত্তা কর্মীদের হত্যা করিয়াছে। গভীর অরণ্যে দরিদ্র জনজাতিদের দ্বারা আফিং, গাঁজা চাষ করাইয়া কোটি কোটি টাকার মালিক হইয়াছে। তাহাদের স্বরূপ অনুধাবন করিয়া তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ ইহাদের দেশের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে বৃহত্তম হুমকি বলিয়া বর্ণনা করিয়াছিলেন। ভারতবাসীর সৌভাগ্য যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশ হইতে মাওবাদী উৎখাতের জন্য সংকল্পবদ্ধ হইয়া একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়াছেন। কেন্দ্রীয় সরকার আগামী ২০২৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত দেশ মাওবাদী মুক্ত করিবার সময়সীমা নির্ধারণ করিয়াছে। তাহারই লক্ষ্যে বিভিন্ন অভিযানে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী সফলও হইয়াছে। সম্প্রতি তাহাদের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা-সহ বেশ কয়েকজনকে নিহত করিয়া নিরাপত্তা বাহিনী বহু অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করিয়া তাহাদের মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া দিয়াছে। সরকারি সূত্রে জানা গিয়াছে, ছত্তিশগড়ের বস্তার জেলা মাওবাদী মুক্ত করা সম্ভব হইয়াছে। ভারতের উন্নয়ন যজ্ঞে দেশের দরিদ্রতম মানুষটিকেও উন্নয়নের অংশীদার করিবার লক্ষ্যেই ভারত সরকারের এই সকল পদক্ষেপ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হইল, এহেন যুগান্তকারী সফলতায় শহুরে মাওবাদীরা অত্যন্ত বিমর্ষ হইয়া পড়িয়াছে। তাহারা নানাভাবে সরকারের সমালোচনায় মুখর হইয়াছে। তাই দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তুলিয়াছেন, এই শহুরে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করিলে দেশের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন কি সম্ভব হইবে?