ভারতীয় নারীশক্তির প্রতীক সিঁদুর
জননী তোমার ওই সীমন্ত রেখায় বহিছে সদানীরা শুদ্ধ কল্লোলিনী সৌন্দর্যের সোল্লাস শহরে শহরে উচ্ছ্বসিত রঙ্গে তুমি দেবী কল্যাণী। তটিনীর তট-বাঁধা সিন্দুর-শোভা অরুণ-রাগে দীপ্ত রূপাতীত বিভা সে আলোকে শায়কে বিদ্ধ অরির তামস কৃষ্ণ-গাঢ় অন্ধকার।
জননী তোমার ওই আরক্ত সিঁদুর ত্রাতা হয়ে খুলে দিক শান্তির দ্বার।
আদি শঙ্করাচার্য ‘আনন্দলহরী’-তে এইভাবেই মুখর হয়েছেন পূর্ণ প্রজ্ঞায়-‘তনোতু ক্ষেমং ন-স্তব বদনসৌন্দর্য লহরী পরীবাহ স্রোত সরণিয়ির সীমস্ত সরণিঃ’- (৪৪)।
ভারতজীবনে সিঁদুর কেবলই নারীর অঙ্গশোভা প্রসাধন নয়, সিঁদুর হলো তেজ, ভালোবাসা-প্রেম, শক্তি ও শান্তিরও প্রতীক। সেই অর্থ না জানার কারণেই যুগে যুগে ঘটেছে ভ্রান্তি। ভুল ধারণায় বারবার এসেছে আঘাত। কিন্তু তার নিজস্ব ক্ষমতায় সবকিছু প্রতিহত করে তুলেছে বিজয়কেতন। এরই সাম্প্রাতিক উদাহরণ পহেলগাঁওয়ের বৈসরনে অকারণ অন্ধতায় হিন্দুনিধনের প্রতিক্রিয়া ভারত-শক্তির ‘অপারেশন সিঁন্দুর’ বা সিঁদুর অভিযানে। মাত্র পঁচিশ মিনিটে অধিকৃত কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের একশো কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে শতাধিক জঙ্গি নিকেশ করে ভারত-নারীর সিঁদুর মোছার পালটা মার দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিস্মিত করেছে বিশ্ববাসীকে- স্থাপন করেছে সেনা সাফল্যের অনন্য নজির।
বৈসরনের ঘটনার পরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, পাতালে লুকোলেও ঘাতক জঙ্গিদের টেনে বের হত্যা করা হবে। কথা রেখেছেন তিনি। ‘আপারেশন সিঁদুর’ তাঁর সেই কথা রাখারই এক সত্যনিষ্ঠ উদাহরণ। এই অভিযানের নামকরণও প্রধানমন্ত্রী
মোদীরই। কিন্তু প্রশ্ন, এতো বিষয় থাকতে কেন নাম দিলেন সিঁদুর অভিযান?
উত্তর, নারীর সিঁথির সিঁদুর মুছে যে বন্য উল্লাসে মেতেছিল জঙ্গিরা, তাদের
সমুচিত জবাব দিতে এবং পতিহারাদের সঙ্গে সহমর্মিতা দেখাতেই এই সেনা অভিযানের এবংবিধ নামকরণ।
এহ বাহ্য। এই সাধারণ সাযুজ্য ছাড়াও সিঁদুর ভারতীয় জীবনের এক চিরায়ত ঐতিহ্যের প্রতীক।
স্মরণাতীতকাল থেকেই সিঁদুর ভারতীয় জীবনকে দিয়ে আসছে শক্তি, শাস্তি এবং প্রেমের সন্ধান। ভারতীয় নারীর বিথির সিঁদুরকে তসলিমা নাসরিনের মতো যাঁরা মনে করেন পুরুষতান্ত্রিক স্বৈরাচার ও শাসনের প্রতীক, তাঁরা ভারতীয় জীবনের সঙ্গে সিঁদুরের অস্তিত্বের কথা জানেন বলে মনে হয় না।
ঐতিহাসিকরা জানাচ্ছেন, সিন্ধু-সভ্যতারও (৩৩০০-১৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) আগে বালুচিস্তানের মেহেরগড়ে (৫৫০০-৭০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নিওলিথিক সভ্যতার যে নিদর্শন পাওয়া গেছে, সেখানেও সিঁথি রাঙাতে রত নারীমূর্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। মহেঞ্জদাড়ো এবং হরপ্পার মতো সিঁদুর ব্যবহারের স্পষ্ট দৃষ্টান্ত রয়েছে বলে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অভিমত।
বেদে সরাসরি সিঁদুর পরার কথা না থাকলেও নানা অনুষ্ঠানে তার ব্যবহারের বেশ কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পুরাণ ও মহাকাব্যগুলিতে কিন্তু ভারতীয় নারীর সিঁদুর ব্যবহার সম্পর্কে নানা কাহিনি রয়েছে।
দেবমণ্ডলীতে সুন্দর-সুখী দাম্পত্য জীবনযাপনের এক মহত্তর আদর্শ শিব-পার্বতী। দেবী পার্বতী সিঁদুর পরতেন। পরতেন- মহাদেবের সঙ্গে তাঁর অনন্ত দাম্পত্য জীবনযাপনের কামনায়। সিঁদুর পরলে স্বামীর মঙ্গল হবে এই বোধই ছিল তাঁর সিঁদুর পরার কারণ। পুরাণ কাহিনিমতে, দেবী পার্বতী বলেন, যেসব মহিলা সিঁদুর পরবেন তাঁদের স্বামীরা হবেন দীর্ঘায়ু। তাঁদের কখনো ভোগ করতে হবে না বৈধব্যযন্ত্রণা।
বিভিন্ন পুরাণে আছে, বৃন্দাবনে শ্রীমতী রাধাও কৃষ্ণসঙ্গ বিচ্যুত না হওয়ার কামনায় কপালে দীপশিখার মতো করে সিঁদুর পরতেন।
কোনো কোনো রামায়ণে আছে, সীতার মাথায় সিঁদুর দেখে হনুমান তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কেন তিনি সিঁথিতে সিঁদুর দিয়েছেন? একটু ইতস্তত করে সীতা বলেছিলেন, এই সিঁদুর হলো তাঁর রামকে ভালোবাসার নিদর্শন, এটা তাঁর প্রেমের প্রকাশ।
একথা শুনে শ্রীহনুমানের মনে হয়েছিল, সিঁদুর পরা হয় ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে। আর তাই তিনি সারা দেহ সিঁদুরময় করে তোলেন। ওই কারণেই শ্রীহনুমানের মূর্তি সিঁদুর বর্ণ। সারা দেহ তাঁর সিঁদুর রঞ্জিত। ভক্তরা ওই কারণেই হনুমান মূর্তিকে সিঁদুর মাখিয়ে থাকেন।
মহাভারতে আছে, হস্তিনাপুরের রাজসভায় লাঞ্ছিত হবার পর দ্রৌপদী এই অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত চুল না-বাঁধার এবং সিঁদূর না পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দুর্যোধন- দুঃশাসনের নিধনের পর তাঁদেরই রক্তে তাঁর সিঁথি আবার রাঙিয়ে দেন ভীম। তারপর থেকেই দ্রৌপদী আবার সিঁদুর পরতে থাকেন।
পুরাণ, মহাকাব্যের এসব কাহিনি এবং নানা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে বোঝা যায়, ভারতে প্রায় দশ হাজার বছর আগে থেকেই সিঁদুর ব্যবহারের চল ছিল। এবং এই রীতির পেছনে ছিল বেশ কিছু ধ্যানধারণা।
পুরাকাল থেকেই মনে করা হয়, সিঁদুর হলো তেজ বা শক্তির প্রতীক। ওই কারণে কেবল মহিলারা নন, পুরুষরাও কপালে পরে থাকেন সিঁদুরের তিলক। শুধু নিজেদের ব্যবহারিক জীবনে নয়, হিন্দুর পূজাঅর্চনার ক্ষেত্রেও সিঁদুরের রয়েছে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রতিমার প্রাণপ্রতিষ্ঠা অথবা ঘটে দেবতার
অধিষ্ঠান কামনায় ব্যবহার করা হয় তেল সিঁদুর।
ঘটে তেল সিঁদুর দিয়ে যে স্বস্ত্রিকা চিহ্ন আঁকা হয়, অথবা পল্লব ইত্যাদিতে সিঁদুর দেওয়া হয় তার পেছনেও রয়েছে হিন্দুর এক বিশ্বাসের প্রকাশ। তেল সিঁদুর হলো তেজের প্রতীক। ঘটে সেই তেল সিঁদুরের চিহ্ন আঁকার মধ্য দিয়ে তাতে দেবতার তেজোময় রূপের প্রকাশ ঘটার উপলব্ধি থেকেই হিন্দুদের পালাপার্বণ বা আচার অনুষ্ঠানে সিঁদুর ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। মনে করা হয়, পূজাপার্বণে বা বিবাহে সিঁদুরের ব্যবহার
করার মধ্য দিয়ে প্রেম, নিষ্ঠা, আত্মনিবেদন, তেজ ও ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে। তাই-বা কেন, প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বাস করা হয় সিঁদুর হলো সৃজনের অন্যতম প্রতীক। বলা হয়, সিঁথিতে সিঁদুর পরার ফলে যৌন আকাঙ্ক্ষা বাড়ে। হয় সুপ্রজনন।
এসব তো তেল সিঁদুর পরার সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের কথা। বিজ্ঞান মতেও বলা হয় সিঁদুর পরার মধ্য দিয়ে শরীরের নানা উপকার হয়ে থাকে। সিঁদুর সাধারণত তৈরি হয় হলুদ, চুন ও পারদের মতো নানা যৌগের মিশ্রণে। এই পারদে রয়েছে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা। সিঁদুর পরলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে বলে মনে করেন বহু চিকিৎসক।
যোগবিদ ও আয়ুর্বেদিকরাও বিশ্বাস করেন সিঁদুরের মধ্যে রয়েছে নানা অলৌকিক ক্ষমতা। তাঁদের অভিমত, দুই ভ্রূ’র মাঝখানে যেখানে সিঁদুরের টিপ ব্যবহার করা হয়, সেটিই হলো বিভিন্ন স্নায়ুর একটি ভরকেন্দ্র। টিপ পরার সময় সেখানে নিয়মিত যে চাপ পড়ে তাতে মুখমণ্ডলে রক্তচলাচলের বৃদ্ধি ঘটায় এবং বিভিন্ন স্নায়ুকে সক্রিয় করে তোলে। এর ফলে মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে বিভিন্ন স্নায়ু ও মুখমণ্ডলের শিরা উপশিরাগুলি সক্রিয়
হওয়ার কারণে সুনিদ্রা হয়। ধ্যানেও
মনোনিবেশ করা যায়।
একশ্রেণীর যোগী মনে করেন, দুই ভ্রূ’র মাঝখানে যেখানে টিপ পরা হয়, সেটিই হলো দেহের সাতটি চক্রের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র- যোগনেত্র বা
আজ্ঞাচক্র। তৃতীয় নয়ন বলা হয় তাকে। তাই টিপ পরার সঙ্গে সঙ্গে ওই অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই যে চাপ সৃষ্টি হয় অথবা অজান্তেই এক ধরনের ম্যাসেজ ক্রিয়া কার্যকর হয়, তাতে মন শান্ত হয়। বিভিন্ন ব্যথার উপশম হয়। এছাড়া টিপ পরার সময় নাক-মাথা-মুখে রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি পাওয়ায় সাইনাসের মতো রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। হয় চোখেরও আরাম।
সিঁথিতে যেখান থেকে সিঁদুররেখা উঠে মাথার যেখানে শেষ হয়, সেখানেই রয়েছে পিটুইটারি গ্ল্যান্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্নায়ুগ্রন্থি। ওইভাবে সিঁদুর পরায় ওই অঞ্চলগুলিও সক্রিয় ও তেজোময় হয়ে সামগ্রিকভাবে মন ও শক্তিকে বলবান করে বলে তাঁদের বিশ্বাস।
সিঁদুর হলো নারীর শিরোভূষণ। বলা হয়, মাথায় অবস্থান করেন লক্ষ্মীদেবী। তাই মাথায় সিঁদুর পরলে প্রীত হন তিনি। তাতে সামগ্রিক ভাবে শ্রীবৃদ্ধি ঘটে সংসারেরই। আর সে কারণেই সিঁদুর পরার মন্ত্রে বলা হয়, ‘শিরোভূষণং সিন্দুরং ভর্তুরায়ু বিবর্ধনম্, সর্বরত্নাকরং দিব্যং সুন্দরম্ প্রতিগৃহ্যতাম্’।
কেবল সিঁদুর পরার মন্ত্র নয়, তিলক পরার মতোই সিঁদুর পরার সময়ও বলা হয়- সিঁথিতে কৃষ্ণ, কপালে কেশব, কণ্ঠে গোবিন্দ, শঙ্খে মধুসূদন এবং বস্ত্রে মাধবকে নমস্কার করছি।
সব মিলিয়ে সিঁদুর ভারতীয় জীবনের এক অপরিহার্য বিষয়। সিঁদুর হলো নারীশক্তির প্রতীক। আর তাতেই হাত দিয়েছিল জঙ্গিরা। আর তাই তাদের দমনে ‘সিঁদুর অভিযান’-এর চেয়ে ভালো আর কোনো নাম হতে পারে না।
ব্রজধামের শ্রীশ্রী যোগমায়া কাত্যায়নী দেবী
অর্ণব দাস
“যোগমায়া যোগেশ্বরী জগৎ পালিকা, এই জগবাসী জীব তব বালক-বালিকা… বৃন্দাবনে অপ্রাকৃতিক লীলা করিবারে, যোগমায়া রূপে অবর্তীর্ণ অবনীতে…”
বঙ্গের প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব সাধক শ্রীমদ্ রাধারমণ চরণ দাস দেব তাঁর অন্তরের ভক্তিরস মিশ্রিত করে দু’নয়নের বারিধারার সিক্ত হয়ে শ্রীজগজ্জননী জগন্মাতার সম্মুখে এই সুদুর্লভ পদটি কীর্তন করেছিলেন। পরবর্তীতে তাঁর প্রিয় শিষ্য শ্রীপাদ রামদাস বাবাজী
মহারাজ তাঁর এই ‘শ্রীগুরু কৃপার দান’কে বুকে আঁকড়ে ধরে জগদ্বাসীকে প্রেমসুধা পান করিয়েছিলেন। অনুভূতির সঙ্গে আচরণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন ব্রজের সেই অপ্রাকৃতিক লীলাকথা-শ্রীযোগমায়া কাত্যায়নী দেবী এবং শ্রীগোপেশ্বর মহাদেব হলেন জগতের আদি পিতা-মাতা। তাঁদের কৃপা হলে তবে ব্রজরস আস্বাদন করা যায়, প্রবেশ করা যায় বৈষ্ণবীয় সাধনায়।
শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণ মতে শ্রীরাধারানির সঙ্গে ব্রজগোপীগণ
শ্রীশ্রীযোগমায়া কাত্যায়নী দেবীর উপাসনা করে তাঁদের প্রাণাধিক প্রিয় শ্রীগোবিন্দকে প্রিয়তম রূপে লাভকরেছিলেন, যে ব্রতের ফলে ব্রজবধূগণের শ্রীকৃষ্ণ প্রাপ্তি হয়েছিল। সেই ব্রত জগতে শ্রীকাত্যায়নী ব্রত নামে প্রসিদ্ধ। শ্রীমদ্ভাগবতের সেই ভাব অনুসরণ করে আজও গোড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত ভক্তগণ একমাস ব্যাপী শ্রীকাত্যায়নী ব্রত পালন করে থাকেন, তাঁদের ভজনের অঙ্গ হিসেবে কপালে ধারণ করেন শ্রীশ্রীযোগমায়া কাত্যায়নী দেবীর প্রসাদি সিঁদুর।
একান্ন সতীপীঠের মধ্যে অন্য একটি পীঠ হলো বৃন্দাবনের শ্রীকাত্যায়নী সতীপীঠ অথবা শ্রীউমা শক্তিপীঠ। শ্রীশ্রী আদ্যাস্তোত্রে বর্ণিত ‘ব্রজে কাত্যায়নী পরা’ যে দেবীর কথা বলা হয়েছে তিনি হলেন দেবী কাত্যায়নী। শ্রীধাম বৃন্দাবনের এই স্থানে দেবী সতীর কেশগুচ্ছ মতান্তরে দেবীর আংটি পতিত হয়েছিল। ১৯২৩ সালে যোগীরাজ স্বামী কেশবানন্দ মহারাজ এই স্থানে সুবিশাল মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরে শ্রীকাত্যায়নী দেবীর পাশাপাশি দেবীর ভৈরব শ্রীবটেশ্বর শিব, শ্রীগণেশ, শ্রীসূর্য ও শ্রীলক্ষ্মী-নারায়ণ পূজিত হয়ে চলেছেন। ভারতবর্ষের এই মন্দির যেন পঞ্চ উপাসক সম্প্রদায়ের প্রধান তীর্থক্ষেত্র। আজও প্রাচীন প্রথা মেনে নবরাত্রি উপলক্ষ্যে চলে দেবীর বিশেষ পূজা। দূরদূরান্ত থেকে ভক্তগণ আসেন দেবীর দর্শন করে তাদের মনস্কামনা পূরণ করতে। মাতা কাত্যায়নী সকলের দুঃখ-কষ্ট দূর করে চতুর্বর্গ ফল দান করেন, ভক্তের হৃদয়ে প্রকাশিত হন ভক্তি রূপে, মনুষ্য জীবকে অগ্রসর করেন তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্যের দিকে। ভক্তিলাভে সার্থক করান আমাদের এই মনুষ্য জীবন|
স্বাধীনতাযুদ্ধের এক অগ্নিকন্যা
বীণা দাস
প্রবীর আচার্য্য
বীণা দাস ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন নারী স্বাধীনতা সংগ্রামী। তাঁর জন্ম নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। কিন্তু তাঁদের আদি বাড়ি ছিল চট্টগ্রাম। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ আগস্ট তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতা বেণীমাধব দাস ছিলেন কটকের র্যাভনশ কলেজিয়েট স্কুলের সেই প্রখ্যাত প্রধান শিক্ষক যাঁকে সুভাষচন্দ্র বসু নিজের বিপ্লবী জীবনের গুরু বলে মানতেন। বীণা দাসের মা ছিলেন সরলা দাস এবং দিদি ছিলেন বিপ্লবী কল্যাণী দাস।
বীণা দাস কলকাতায় এসে ভর্তি হন বেথুন স্কুলে। সেখানেই তাঁর বিপ্লবী জীবনের হাতেখড়ি। পিতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং সহপাঠিণী সুহাসিনী দেবীর হাত ধরে তিনি ও তাঁর দিদি কল্যাণী দেবী গুপ্ত সমিতিতে নাম লেখান। অসহযোগ ও জাতীয় আন্দোলনের যোগ দেওয়ার কারণে তাঁর দাদা কারাবরণ করেন। আসলে বেণীমাধব দাসের রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গোটা পরিবারই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। সে সময় যুগান্তর দলের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে বীণা দাসের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বয়কট করার জন্য বেথুন কলেজের ছাত্রীদের নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। ১৯৩০ সালে ডালহৌসির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য ছোটো ছোটো দলের নেতৃত্ব দেন এবং গ্রেপ্তার বরণ করেন।
গুপ্তসমিতি থেকে বীণা দেবী পেয়েছিলেন একটি আগ্নেয়াস্ত্র। ১৯৩২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব। এই সমাবর্তনে গভর্নরের হাত থেকে তাঁর বিএ পাশের সার্টিফিকেট নেওয়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য তখন বঙ্গের ব্রিটিশ গভর্নর স্ট্যালিন জ্যাকসন। আচার্যের হাত থেকে বিএ পাশের শংসাপত্র নিতে মঞ্চে উঠে এলেন বীণা দাস। কিন্তু শংসাপত্র নেবেন কী! গভর্নর কুখ্যাত স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে পরপর পাঁচটি গুলি চালালেন। দুর্ভাগ্য, অনভ্যস্ত হাতের গুলি ব্যর্থ হলো। এই সময় জ্যাকসনকে রক্ষা এবং বীণা দাসকে ধরে ফেলার কৃতিত্ব অর্জন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের
উপাচার্য হাসান সোহরাওয়ার্দি।
জেল হাজতে তাঁর উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু হলো। কিন্তু শত অত্যাচারেও কোনো বিপ্লবীর নাম ফাঁস করলেন না। আদালতে বীণাদেবী স্ট্যানলিকে গুলি করার দায়িত্ব স্বীকার করে নিলেন। কুড়ি বছরের সাজা হয়ে গেল। তাঁকে পাঠানো হলো প্রেসিডেন্সি জেলে। সেখান থেকে মেদিনীপুর জেল। সেখানে স্বদেশী মহিলা কয়েদিদের উপর চলতো অকথ্য নির্যাতন। তার প্রতিবাদে বীণা দাসের নেতৃত্বে শুরু হলো অনশন। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেলেন তিনি। কর্তৃপক্ষ কয়েদিদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হলো।
হঠাৎ তাঁকে পাঠানো হলো কলকাতার সেন্ট্রাল জেলে। গান্ধীজী এলেন জেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। জেলেই তাঁর সঙ্গে তর্ক শুরু করলেন অহিংস আর সংহিস পথ নিয়ে। আসলে বিপ্লবের পন্থা নিয়ে তিনি সুভাষচন্দ্র বসু এমনকী গান্ধীজীর সঙ্গে তর্ক করতেও পিছপা হতেন না। অবশেষে গান্ধীজীর চেষ্টাতেই ১৯৩৯ সালে জেল থেকে মুক্তি পেলেন। কিন্তু তখন স্বাস্থ্য ভেঙে পড়েছে ভয়ানক ভাবে, চেনাই যায় না তাঁকে।
১৯৪১ সালে অন্তর্ধান করার আগে সুভাষ চন্দ্র বীণাদেবীকে ডেকে পাঠালেন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য। ১৯৪১ থেকে
১৯৪৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেসের সম্পাদিকা নিযুক্ত হলেন তিনি। সারাভারত কংগ্রেস সম্মেলনে যোগ দিতে বোম্বাই গেলেন। কিন্তু ১৯৪২ সালে দক্ষিণ কলকাতার কংগ্রেস সম্পাদক থাকাকালীন আন্দোলন করতে গিয়ে আবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করলেন। মুক্তি পেলেন ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৫ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রভিন্সিয়াল বিধানসভার সদস্যা ছিলেন তিনি। ১৯৪৬ সালের নোয়াখালিতে হিন্দু নরসংহারের পরেও সেখানে তিনি ত্রাণের কাজ করতেন।
১৯৪৭ সালেই তাঁর বিয়ে হয় যতীশ ভৌমিকের সঙ্গে। যতীশ ভৌমিক ছিলেন ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসার। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে যোগ দিয়ে শরণার্থী পুনর্বাসন নিয়ে মেতে গেলেন। ১৯৫৩ সালে তার স্বামী যতীশ ভৌমিক বদলি হয়ে এলেন ছোট্ট মহকুমা শহর কাটোয়ায়। সেখানে তিনি পূর্ণ উদ্যমে সমাজসেবার কাজে যোগ দিলেন। গড়ে তুললেন নারী কল্যাণ সমিতি এবং কাটোয়ার ডিডিসি বালিকা বিদ্যালয়ে অবৈতনিক ইংরেজি শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিলেন। সমাজে মহিলাদের স্বনির্ভর করে তোলার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। কাটোয়া থেকে চলে যাওয়ার পর অন্য একটি স্কুলেও তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন।
পরবর্তীতে মরিচঝাঁপিতে উদ্বাস্তুদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি ও তাঁর স্বামী পেনশন ত্যাগ করলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিফৌজের পাশে দাঁড়ান। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার প্রতিবাদ
করেছিলেন তিনি। বীণা দাসের শেষ জীবন বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। শিক্ষিকা হিসেবে তিনি পেনশন দাবি করেও পাননি। কারণ তাঁর বিএ পাশের সার্টিফিকেট ছিল না। এই সার্টিফিকেট না থাকার কারণটা যে মর্মান্তিক সেটাও বাম সরকার বোঝেনি। স্বামীর মৃত্যুর পরে তিনি হরিদ্বার চলে যান। শেষ জীবনে
বড়ো নিঃসঙ্গতায় ভুগতেন বীণা দাস। ১৯৮৬ সালের ২৬ জানুয়ারি হৃষিকেশের রাস্তায় পুলিশ এই মহান বিপ্লবীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখে। সহায় সম্বলহীন হয়ে পথপ্রান্তে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান বিপ্লবী।