পরিবেশ সংরক্ষণ এবং ভারতীয় সংস্কৃতি
বিশ্ব জুড়িয়া প্রশ্ন উঠিয়াছে, এই পৃথিবী মানুষের বাসযোগ্য থাকিবে কিনা? সত্য কথা হইল, মানুষেরই কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডে এই প্রশ্নের উদ্ভব হইয়াছে। মানুষ ভোগসর্বস্ব জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া প্রকৃতিকে শোষণ করিবার খেলায় মাতিয়াছে, তাহাতে এই পৃথিবী পরিবেশের ভারসাম্য হারাইয়া প্রবল দূষণের কবলে পড়িয়াছে। তাহার ফলে ওজোনস্তরের ক্ষয়, বায়ুবাহিত রোগ-ব্যাধি, অ্যাসিড বৃষ্টি, সমুদ্র-নদী-জলাশয়ে প্রবল দূষণ প্রভৃতি বিশ্ব জুড়িয়া ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করিয়াছে। এককথায় পরিবেশ দূষণ এই একবিংশ শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ বিপদে পরিণত হইয়াছে। তাহারই ফলশ্রুতিতে ১৯৭২ সালে ৫ হইতে ১৬ জুন সমগ্র বিশ্বের পরিবেশ বিজ্ঞানীগণ ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন দ্য হিউম্যান এনভায়রনমেন্ট-এ সম্মিলিত হইয়াছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, প্রতি বৎসর ৫ জুন তারিখটিকে পরিবেশ রক্ষার্থে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা ও কর্মোদ্যোগ গ্রহণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা। পর বৎসর হইতেই দিনটি বিশ্ব পরিবেশ দিবস রূপে পালিত হইয়া আসিতেছে। প্রতি বৎসরই বিশ্বের পৃথক পৃথক শহরে পৃথক পৃথক প্রতিপাদ্য বিষয় লইয়া দিনটি উদ্যাপিত হইয়া থাকে। তাহা সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা তেমনভাবে আগ্রহ সৃষ্টি করিতে পারে নাই। পরিবেশ রক্ষার নামে তাহা একটি উৎসব দিবসে পর্যবসিত হইয়াছে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে শুধুমাত্র একটি দিবস নহে, নিত্যদিনের আচরণে পরিবেশ সচেতনতার কথা বলা হইয়াছে। কেননা ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই পৃথিবীকে ঈশ্বরের প্রতিরূপ এবং প্রকৃতিকে সমাজজীবনের অভিন্ন অঙ্গ মনে করা হইয়াছে। তাই ভারতীয়গণ এই পৃথিবীকে পৃথ্বীমাতা, ধরিত্রীমাতা বলিয়া পূজা করিয়া থাকেন। শুধু তাহাই নহে, এই পৃথিবীর নিকট হইতে জীবন ধারণের নিমিত্ত যাহা গ্রহণ করিয়া থাকেন তাহাতেই দেবত্ব আরোপ করিয়াছেন। হিন্দুগণ এই পৃথিবীর প্রতিটি কণায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করিয়াছেন। বেদগ্রন্থ হিন্দুজাতিকে শিক্ষা দিয়াছে, সর্বং খন্দ্বিদং ব্রহ্মা। অথর্ববেদ শিক্ষা দিয়াছে, মাতা ভূমি পুত্রোহহম্ পৃথিব্যা। অর্থাৎ এই পৃথিবী হইলেন মাতা, আর আমি তাঁহার পুত্র। এই মাতা-পুত্রের সম্পর্কের কারণে হিন্দুরা প্রকৃতিকে শোষণ করেন না, দোহন করিয়া থাকেন। বেদ-উপনিষদ-পুরাণ, রামায়ণ-মহাভারত সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে পরিবেশকে রক্ষা করিবার কথা বলা হইয়াছে। বেদ-উপনিষদে জলকে যেমন ‘জীবন’ বলা হইয়াছে, তেমনই বৃক্ষকেও ‘প্রাণ’ বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। ঋকবেদের একটি সূক্তে বলা হইয়াছে, বৃক্ষের পূজা করিলে সমগ্র সৃষ্টির পূজা সাধিত হইয়া থাকে। যজুর্বেদে জল সংরক্ষণ এবং জলকে দূষিত না করিবার উল্লেখ রহিয়াছে। হিন্দু সংস্কৃতির ছত্রে ছত্রে পবিবেশ সংরক্ষণ ও সংবর্ধন করিবার নির্দেশ রহিয়াছে।
ভারতীয় সভ্যতার মূলে রহিয়াছে আরণ্যক জীবন। ইহার মূল ভিত্তি হইল মনুষ্য ও পরিবেশের সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা। হিন্দুরা মনে করিয়া থাকেন, এই বিশ্বপ্রকৃতি ঈশ্বরেরই প্রতিরূপ। সেই কারণেই আমাদিগের পূর্বপুরুষগণ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সর্বদা রক্ষকের ভূমিকা পালন করিয়াছেন। পাঁচহাজার বৎসর পূর্বের হরপ্পা সভ্যতায়ও তাহার নিদর্শন মিলিয়াছে। কৌটিল্যনীতিতে জলকে সমষ্টিগত পণ্য বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। তাহা ব্যক্তিগত পণ্যে পরিণত করিলে মানবজাতির উপর ভয়াবহ অভিশাপ বর্ষিত হইবে বলিয়া সাবধানবাণী উচ্চারিত হইয়াছে। তাহা সত্ত্বেও সমষ্টিগত এই পণ্যকে ব্যক্তিগত পণ্যে পরিণত করিয়া একশ্রেণীর মানুষ কোটি কোটি টাকার ব্যবসায় করিয়া চলিয়াছেন। সুখের বিষয় হইল, পরিবেশ রক্ষার সংকল্প ও সচেতনতা এখন শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তকেই সীমাবদ্ধ না রাখিয়া ভারতীয় সংস্কৃতি অনুসারে প্রতিটি দিবসই সক্রিয় থাকিবার কথা বলা হইতেছে। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন ও সচেতনতা গড়িয়া তুলিয়া প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইবার কথা বলা হইতেছে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তাহাদের শতবর্ষের যাত্রাপথে সমাজ পরিবর্তনে পঞ্চ পরিবর্তনের কর্মসূচি গ্রহণ করিয়াছে। তাহারই একটি হইল পর্যাবরণ অর্থাৎ পরিবেশ সচেতনতা। তাহারা পরিবেশ রক্ষার নিমিত্ত বৃক্ষরোপণ, জল সংরক্ষণ, প্লাস্টিক বর্জন প্রভৃতি যাবতীয় কর্মসূচি নিজেদের আচরণে আনয়ন করিয়া পরবর্তী বৎসর সমগ্র সমাজকে উদ্বুদ্ধ করিবেন। পরিবেশ রক্ষার কথা ভারতবর্ষ বিশ্ববাসীকে বলিয়াছে, আজ এতদিন পর তাহারা তাহাতে সহমত পোষণ করিয়াছে, ইহা একটি শুভ লক্ষণ।