বালোচরা কোনো দিনই পাকিস্তানভুক্ত হতে চায়নি
দুর্গাপদ ঘোষ
পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পর ভারত যখন পাকিস্তানকে তুলোধোনা করছে, তখন অন্যদিকে ‘স্বাধীনতা’ ঘোষণা করে পাকিস্তানের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে স্বাধীনতাকামী বালোচরা। গত ৮ মে বালোচিস্তানের রাজধানী কোয়েটার একাংশেরও বেশি এলাকা থেকে পাক সেনাদের খেদিয়ে বার করে দিয়ে, পাক পতাকা টেনে নামিয়ে, ছিঁড়ে কুটি কুটি করে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। পতপত করে উড়িয়ে দিয়েছে ‘স্বাধীন বালোচিস্তান’-এর পতাকা। আন্তর্জাতিক মঞ্চকে বুক চিতিয়ে জানিয়ে দিয়েছে বালোচিস্তান এখন থেকে আর পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত নয়। স্বাধীন দেশ-‘ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব বালোচিস্তান’। বালোচিস্তান গণ-প্রজাতান্ত্রিক দেশ। সমাজকর্মী ও লেখক-নেতা মীর ইয়ার বালোচ গত ১৩ মে রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছে সরকারিভাবে বালোচিস্তানকে ‘স্বতন্ত্র দেশ’-এর স্বীকৃতি দেবার আবেদনও করেছেন।
এই মর্মে কালবিলম্ব না করে রাষ্ট্রসঙ্ঘের বৈঠক বসুক বলে দাবি করে তাঁদের এই অধিকারে কেউ যাতে হস্তক্ষেপ কিংবা বলপ্রয়োগ না করতে পারে সেজন্য বালোচিস্তানের সর্বত্র রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণাধীন নিরাপত্তা বাহিনী তথা সেনা মোতায়েনের আবেদনও জানিয়েছেন মীর ইয়ার বালোচ। দাবি করেছেন, বালোচ নাগরিকদের নিশানা করে পাক সেনাদের নিরন্তর হামলা ও নৃশংস নির্যাতন বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হোক। বালোচিস্তানে সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে পাক সরকার সে নির্দেশ জারি করে রেখেছে তা খারিজ করে সেখানে
পাকিস্তানের বাইরের সাংবাদিকদের প্রবেশের ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সেখানে পাক প্রশাসন, বিশেষ করে পাক সেনারা কী ধরনের বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে সারা বিশ্বকে তা জানানোর ব্যবস্থা করা হোক বলেও দাবি করেছেন তিনি। তাঁদের আরও দাবি, বালোচিস্তানে নিযুক্ত সমস্ত পাকিস্তানি সরকারি আধিকারিকরা অবিলম্বে চলে যাক।
কেবল দাবি উত্থাপনই নয়। গত ১১ মার্চ থেকে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই সশস্ত্র প্রত্যাঘাত চালিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতাকামী ‘বালোচ মুক্তি বাহিনী’ (বিএলএ)। তাদের হাতে মার খেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে পথ পাচ্ছে না পাক সেনারা। প্রায় রোজই কম-বেশি সংখ্যায়
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মাঝরাতে ‘পাকিস্তান’ নামে নতুন দেশ বিশ্বের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হলেও বালোচরা প্রথম থেকেই তার অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকার করে। সে সময় বালোচের ৩টি এলাকা মারকান, লামবেলা ও খারান পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু বৃহত্তম এলাকা কালাদের শাসক খান আহম্মদ ইয়ার খান পাকভুক্ত হতে রাজি হননি। বালোচিস্তানের এই এলাকা স্বাধীন ছিল।
পাক সেনা নিহত হচ্ছে। অনেক বছর ধরে সেখানে পাক-বিরোধী প্রতিবাদ যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। কিন্তু এ বছরের ১১ মার্চের মতো ঘটনা কখনো ঘটেনি। বালোচ মুক্তি সেনারা একটা বিরাট প্রত্যাঘাত করে সারা বিশ্বের নজর কেড়ে নিয়েছে। একেবারে দিন-দুপুরে, বেলা ১টা নাগাদ কোয়েটা-পেশোয়ার যাতায়াতকারী জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনের সামনে রকেট দেগে ট্রেনটিকে অপহরণ (হাইজাক) করে বিএলএ। পাকিস্তানের জেলে বন্দি বালোচদের মুক্তির দাবি করে প্রায় ৩ দিন ধরে জাফর এক্সপ্রেসকে আটকে রাখে। তাতে মোট ৩৫০ জনের মতো যাত্রী ছিলেন। তার মধ্যে ১৫০ জনের মতো পাকিস্তানি সেনা ছিল বলে জানা যায়। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বন্দি বালোচদের না ছাড়া হলে এক এক করে পাক সেনাদের খতম করার হুমকি দেয় বিএলএ। সেই সময় পার হয়ে যাবার পর ১০-১২ জন পাক সেনাকে হত্যা করা হয় বলে দাবি করে তারা। তবে সাধারণ যাত্রীদের কারও কোনো ক্ষতি করা হয়নি বলেও দাবি করেছে অপহরণকারীরা। ১৪ মার্চ বিশাল সেনাবাহিনী নামিয়ে ৮০ জন সেনাকে উদ্ধার করা হলেও বাকিদের সম্পর্কে পাক প্রশসান মুখ খুলতে চায়নি। বস্তুত পাক সরকারের বিরুদ্ধে এত বড়ো একটা হামলার কথা মানতেই চায়নি পাক প্রশাসন। কিন্তু যতদূর জানা যায়, তার আগে রাত-ভর পাক সেনা ও বালোচ মুক্তি সেনাদের মধ্যে তুমুল গুলির লড়াই চলে। প্রায় নাস্তানাবুদ অবস্থা হতে হয় পাক সেনাদের।
এরপর গত ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে পাকিস্তানি জঙ্গি হামলায় বেছে বেছে ২৬ জন হিন্দু পর্যটককে হত্যার এক সপ্তাহের মধ্যে ২৮ এপ্রিল পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তের ডুরান্ড লাইনের কাছাকাছি দক্ষিণ ওয়াজিরস্তানে শান্তি কমিটির বৈঠক চলাকালে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। ৭ জন নিহত এবং ১৭ জন আহত হয়। পাক প্রশাসন এজন্য ভারতের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করলেও তা ধোপে টেকেনি। তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মতে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) ওই বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারত ৬ মে মাঝরাত এবং ৭ মে-র প্রথম রাতে পাকিস্তানের মধ্যে ঢুকে যখন প্রচণ্ড প্রত্যাঘাত শুরু করে তার ৩ দিন আগে থেকে পাক সন্ত্রাস চুরমার করে দেবার জন্য হামলা চালাতে থাকে বালোচরা। ৩ মে তারা কালাদ শহর দখল করে ঘিরে রাখে। সেদিন বিএলএ-র সঙ্গে সংঘর্ষে ২২ জন পাকসেনা মারা যায়। সূত্রের খবর, গত ১৭ মার্চ থেকে ১৯ মে-র মধ্যে বালোচদের হাতে ২১৪ পাকসেনা নিহত হয়েছে।
বালোচদের ভয়ে যাকে বলে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যায় পাকসেনারা। মীরপুর ডিভিশনেও পাক সেনা রণে ভঙ্গ দিয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হয়। তার পরদিনও বালোচরা ৪ জন পাক সেনাকে হত্যা করে। দখল করে নেয় মানগোচর শহর। এদিকে ভারত যখন পাকিস্তানকে তুলোধোনা করছে সেই সময় বালোচ স্বাধীনতাকামীদের আইইডি বিস্ফোরণে বালোচিস্তানের সাচকান এলাকায় ১২ জন পাক সেনার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। দিনটা ছিল ৮ মে। ৯ মে কেচ লোকায় পাক সেনা কনভয়ে হামলা চালিয়ে এক এক করে ৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে বিএলএ সদস্যরা। গত ১০ মে যেদিন পাকিস্তানের কাকুতি মিনতিতে ভারত ‘অপারেশন সিঁদুর’ স্থগিত রাখতে রাজি হয় সেদিন পাক বাহিনীর ওপর বালোচদের হামলা ছিল বহুমুখী। বালোচ নেতারা পরিষ্কার জানিয়ে দেন, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছে, বালোচদের সঙ্গে হয়নি। তাঁরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবেন। যাচ্ছেনও।
১০ মে পাকসেনার কনভয়ে হামলা ছাড়াও বালোচিস্তানের আহমেদওয়ান এলাকা দখল, থানায় থানায় হামলা চালিয়ে দখল নেওয়া, রেল স্টেশন দখল করা, জাতীয় সড়ক অবরোধ ইত্যাদি ঘটনা ঘটে।
সরকারিভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার আগে ১২ মে বালোচরা মুক্তি সংগ্রামের জন্য ভারতের কাছে অস্ত্র সাহায্য চায়। বর্তমানে বালোচদের প্রধান নেতা হলেন বশির জেব। ২০১৮ সাল থেকে তিনি এই দায়িত্বে আছেন। তাঁর আগে ২০০৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত প্রধান নেতা ছিলেন আসলাম বালোচ ওরফে ‘আচু’। এঁদের নেতৃত্বে বালোচদের পাক বিরোধী আন্দোলন যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। বশিরের পাশাপাশি বর্তমানে মহিলা নেত্রী বানুক মাহিকান একজন দুঃসাহসী ও ওজস্বী বক্তা। স্বাধীনতার জন্য তিনি বালোচদের বিশেষ করে মহিলাদের শহর, গ্রাম সর্বত্র সংগঠিত করে যাচ্ছেন। আর এঁদের সবাইকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে লড়াইকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাচ্ছেন ওই সমাজকর্মী ও লেখক মীর ইয়ার বালোচ। ১২ মে তাঁর পরামর্শে বালোচরা ভারতের কাছে অস্ত্র দেবার অনুরোধ করে। যদিও আন্তর্জাতিক আইন এবং বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারতের পক্ষে তা সম্ভব হবে কিনা একটু ভিন্ন বিষয়। তবে একজন বালোচ নেতা ডাঃ আল্লাহ নিজার ভারতের উদ্দেশে বলেছেন যে তাঁদের অত্যাধুনিক অস্ত্র, প্রযুক্তি কিংবা পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সাধারণ এবং পুরনো মডেলের অস্ত্রই যথেষ্ট। তিনি এমনও বলেছেন যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে নতজানু করিয়ে যে ৯৩ হাজার খান সেনাকে (পাক সেনাদের তখন এটাই বলা হতো) বন্দি করেও ভারত পাকিস্তানের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছিল তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া সেইসব অস্ত্র বালোচদের দেওয়া হলেও তাঁরা পাকিস্তানকে ‘দেখে নিতে’ পারবেন। পাকিস্তানকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয়
তা বালোচদের জানা আছে বলেও দাবি করেছেন তিনি। প্রসঙ্গত জানতে পারা গেছে যে গত ৮ মে থেকে ৭ দিনের মধ্যে বালোচরা অন্তত ৫১ জায়গায় ৭৩টা হামলা চালিয়ে পাক সেনাদের পিছু হটতে বাধ্য করেছে। ১৫ মে আবারও একটা বড়ো হামলা হয় বালোচিস্তানের পঞ্জগুরে। সেনা কনভয়ের ওপরে ওই হামলায় ১৪ জন পাক সেনা নিহত হয়েছে। বালোচদের এরকম প্রত্যাঘাত এই প্রতিবেদন যন্ত্রস্থ হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।
এক্ষেত্রে একটা বড়ো প্রশ্ন হলো, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বালোচদের এহেন প্রত্যাঘাত চলছে কেন! অনেকেই হয়তো মনে করছেন, বালোচরা হঠাৎ করেই পাক সরকার বিশেষ করে সেনাদের বিরুদ্ধে মুখিয়ে উঠেছে। ভারত পাকিস্তানকে মেরে থেতো করে দিচ্ছে দেখে সুযোগ বুঝে বালোচরা স্বাধীনতার জন্য মাঠে নেমেছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো, বালোচরা
কোনোদিনই পাকিস্তানভুক্ত হতে চায়নি। ভারত ভাগ করে পাকিস্তান তৈরি হবার আগে থেকেই তারা এবং পাশতুন ও উত্তর-পশ্চিমে সীমান্ত এলাকার লোকেরা বুঝতে পেরেছিল পাকিস্তান একটা সন্ত্রাসবাদী দেশ ছাড়া কোনোদিনই কোনো সভ্য দেশ হবে না। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মাঝরাতে ‘পাকিস্তান’ নামে নতুন দেশ বিশ্বের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হলেও বালোচরা প্রথম থেকেই তার অন্তর্ভুক্ত হতে
অস্বীকার করে। সে সময় বালোচের ৩টি এলাকা মারকান, লামবেলা ও খারান পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু বৃহত্তম এলাকা কালাদের শাসক খান আহম্মদ ইয়ার খান পাকভুক্ত হতে রাজি হননি। বালোচিস্তানের এই এলাকা স্বাধীন ছিল। ভারতের উত্তর-পূর্বে যেমন ছিল স্বাধীন ত্রিপুরা। পরে ত্রিপুরা স্বেচ্ছায় ভারতভুক্ত হলেও বালোচিস্তান তা হয়নি।
১৯৪৮ সালে পাক সরকারের সঙ্গে এক চুক্তিমতে স্বাধীন বালোচ অঞ্চলকে পাকিস্তান স্বশাসন (অটোনোমাস) দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। জিন্না নিজে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সে বছরেরই ২৭ মার্চ পাক সরকার সেই প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে কালাদকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত ও অধীনস্থ বলে ঘোষণা করে। তার এক মাসের মধ্যেই পাকিস্তান সেনা অভিযান চালিয়ে বালোচদের পাকিস্তানভুক্ত ও অধীনস্থ হতে বাধ্য করে। বলাবাহুল্য, পাকিস্তান সৃষ্টির মূল নায়ক জিন্না এবং তৎকালীন পাক প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান সরকারের বিশ্বাসঘাতকতাই বালোচদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী করে তোলে। তাদের দমন করতে ১৯৭৩ সালে পাক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো বালোচিস্তানে সেনা অভিযানের নির্দেশ দেন। আর সেই নির্দেশ পাওয়া মাত্রই তার ২ বছর আগে বাংলাদেশে পর্যুদস্ত হওয়া পাক সেনারা হিংস্র নেকড়ের মতো বালোচদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পাকিস্তান সৃষ্টির সময় থেকে মুখ্যত পশ্চিম পঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের নেতা এবং সেনাধ্যক্ষদের কবজায় থাকা সরকার ও সেনাবাহিনী বালোচদের সঙ্গে বিমাতৃসুলভনৃশংস আচরণ করে আসছে। প্রতিবাদ করতে গেলেই পাক সেনাদের বুটের তলায় মাথা থেতলে দেওয়া হচ্ছে। কথায় কথায় গুলি করে হত্যা, অপহরণ, তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা, এমনকী নির্যাতন করে মেরে ফেলে অনেকের মৃতদেহ হেলিকপ্টার থেকে গ্রামে গ্রামে ছুঁড়ে ফেলার মতো বর্বরোচিত ঘটনাও বাদ যায়নি। কিন্তু পাক সরকার বালোচিস্তানে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের প্রবেশ নিষিদ্ধ করার কারণে বালোচদের ওপর পাকিস্তানি নির্যাতনের কথা বাইরে তেমন প্রকাশ পায় না। ২০০৬ সালে জেনারেল পারভেজ মুশারফ পাকিস্তানের সেনাশাসক থাকাকালে বালোচ নেতা আকবর বুগতিকে তুলে নিয়ে গিয়ে এক পাহাড়ের গুহায় গুপ্তহত্যা করে পাক সেনারা। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ডেরা বুগতি জেলার গৈন্ধরী গ্রামের সাধারণ মানুষদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে
এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। তরুণী, যুবতীদের সেনা ছাউনিতে তুলে নিয়ে গিয়ে দানবের মতো নির্যাতন করেই ক্ষান্ত থাকেনি। কয়েকদিন পরে ২২ অক্টোবর শাম্পি বুগতি নামের এক বিবাহিত মহিলার ছিন্নভিন্ন করা রক্তাক্ত দেহ হেলিকপ্টার থেকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয় পাক সেনারা। এরকম বহু ঘটনার কথা নানা সময়ে প্রকাশ পেয়েছে।
সোনার খনি-সহ প্রাকৃতিক সম্পদে
সমৃদ্ধ বালোচিস্তান কেবল পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশই নয়, আয়তনের দিক থেকে গোটা পাকিস্তানের প্রায় অর্ধেক, ৪৬ শতাংশ। কিন্তু এই অর্ধেক পাকিস্তানের কাছে ২৭ মার্চ দিনটা হলো ‘পরাধীনতা দিবস’। তীব্র মানসিক যন্ত্রণার দিন। এখন থেকে ৭৭ বছর আগে, ১৯৪৮ সালের এই তারিখে বালোচিস্তানকে জবরদখল করে নিয়েছিল পাক সেনারা। তখন থেকে স্বাধীনচেতা বালোচরা তাদের এই ভূখণ্ডকে ‘পাক অধিকৃত বালোচিন্তান’ হিসেবেই দেখে আসছে। ২০১৬ সালে জেনেভায় রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের বৈঠকের সময় ‘দ্য বালোচ হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল অ্যান্ড পাশতুন’ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সামাদ বালোচ পাক শাসকদের মুখোশ খুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান হলো সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর।’ পাকিস্তানকে ‘দুর্বৃত্ত দেশ’ বলতেও বাকি রাখেননি। সেদিন জেনেভা সম্মেলনস্থলের বাইরে প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে সারা বিশ্বকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান শুধুমাত্র বালোচ নয়, সমগ্র
বিশ্ববাসীর সামনেই এক মূর্তিমান ত্রাস।’ ভারতও নিরন্তর পাক সন্ত্রাসের শিকার হয়ে অনবরত প্রতিবাদ করে এসেছে। কিন্তু দুর্বোধ্য কারণে আন্তর্জাতিক মঞ্চ এতদিন যেমন বালোচদের কথা কানে তোলেনি, তেমনি ভারতের কথাও। ফলে বালোচরা নিজেদের সশস্ত্র বাহিনী (বিএলএ) তৈরি করে মাঝে মাঝে প্রত্যাঘাত করে যাচ্ছে।
এদিকে ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় ভারতীয় সেনা ঘাঁটিতে এবং এ বছরের ২২ এপ্রিল পহেলগাঁওয়ে সন্ত্রাসী হামলার পর নরেন্দ্র মোদীর ভারত যখন বালাকোটে এবং পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় যথাক্রমে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ এবং ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিল, বালোচরাও তখন একের পর এক মোক্ষম আঘাত করে গেছে ‘জঙ্গিদেশ’ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। তাদের লক্ষ্য পাকিস্তানের খপ্পর থেকে বেরিয়ে স্বাধীন হওয়া। এটাই হলো উপযুক্ত সময়। বালোচ নেতারা ভারতকে পুরোপুরি সমর্থন করে বলেছেন, ভারত পাক অধিকৃত কাশ্মীর ফিরিয়ে নেবার জন্য পূর্ব দিক থেকে পাকিস্তানকে আক্রমণ করুক, বালোচরা দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ করে পাকিস্তানকে চিঁড়ে চ্যাপ্টা করে দেবে।
সেটা ঠিক কতদিনে ও কীভাবে বাস্তবায়িত হবে সে ইতিহাস বলবে। কিন্তু এই মুহূর্তে পাক সেনাদের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ শানানোর পাশাপাশি সমগ্র বালোচ জুড়ে ধ্বনি উঠছে, ‘ভারত তুমি এগিয়ে যাও, আমরা তোমার সঙ্গে আছি।’ পাকিস্তানের এবার খান খান হবার সময় এসেছে। পাক সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা বলয়ের দেওয়ালে বিরাট ফাটল ধরে প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম এটা দেখে আশান্বিত ও উৎসাহিত বালোচদের স্লোগান- ‘এক ধাক্কা আউর দো, গিরতে দিবার তোড় দো।’ আরও একটা ধাক্কা দাও, পড়ন্ত দেওয়াল গুঁড়িয়ে দাও |

















