কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দৃষ্টিতে ‘বর্তমান হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা’
ড. চন্দ্রশেখর মণ্ডল
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অমর কথাসাহিত্যিক। সাহিত্যের মাধ্যমে সমাজ নির্মাণে, সমাজের মধ্যে ভেদাভেদ দূরীকরণে, মূল্যবোধ তৈরিতে তিনি ব্যতিক্রমী লেখক। তিনি শৃঙ্খল ভাঙার কারিগর, আধুনিক ভাবনা প্রসারের অন্যতম মুক্তচিন্তক। তাঁর সাহিত্য আপামর বাঙ্গালিকে যেভাবে স্পর্শ করেছিল, অন্য কোনো লেখকের ক্ষেত্রে তা সম্ভবত হয়ে ওঠেনি। হিন্দু ধর্মে জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, উঁচু-নীচু ভেদের তিনি তীব্র সমালোচক। শুধু সাহিত্যে নয়, ব্যক্তি জীবনেও তিনি এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। যুক্ত হয়েছিলেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। অসবর্ণ বিবাহে হিরন্ময়ী দেবীকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেছিলেন। ধর্ম ভাবনায় তিনি প্রকৃত অর্থে ‘পন্থনিরপেক্ষ’ মানুষ। সেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি প্রদানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল সমস্ত ইসলামি ছাত্র সংগঠন। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শরৎচন্দ্র কিংবা রবীন্দ্রনাথ যখনই তুরস্ক ও মধ্য এশিয়া থেকে ভারতে আসা হানাদার মুসলমান শাসনকালের সমালোচনা করেছেন, তখনই মুসলমানরা তাদের ‘পূর্বপুরুষ’কে সমালোচনা হিসেবে দেখেছে। সে ধারা প্রবহমান, বরং আজকের দিনে তা আরও তীব্র হয়েছে।
পরাধীন দেশে ১৯২৬ সালে প্রকাশিত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’ প্রবন্ধে সমস্যার গভীরে গিয়ে তাঁর অনুভব আজকের ভারতেও সমান প্রাসঙ্গিক। মজহব বিস্তারের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের মিশেলে যে ইসলামের আগ্রাসন সারা বিশ্বে ঘটেছে, সেই মজহবে মুক্তচিন্তা সম্ভব নয়। সম্ভব নয় ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববোধ ছাড়া অন্য কোনো অ-ইসলামিক দেশের প্রতি সমর্পণ। মুসলমানদের মন ও মানসিকতা ভারতকেন্দ্রিক হওয়ার ভাবনা অলীক
কল্পনা। স্বাধীনতার আগেই তিনি লিখেছিলেন- ‘মুসলমান যদি কখনো বলে- হিন্দুর সহিত মিলন করিতে চাই, সে যে ছলনা ছাড়া আর কী হইতে পারে, ভাবিয়া পাওয়া কঠিন।’
পাকিস্তান-তুরস্ক-আরবের মতো ইসলামি দেশগুলোর প্রতি আনুগত্য ও সমর্থন মুসলমানদের মজহবি শিক্ষা। ভারত প্রেম ও ইসলাম চেতনা কখনোই সমার্থক হতে পারে না। বহুলাংশে সাযুজ্য নেই ভারতের জাতীয়তা ভাবনার সঙ্গে মুসলমানের মজহবি আবেগের। এই বাস্তবতাকে শরৎচন্দ্রের লেখা পূর্ণ সমর্থন করে-‘হিন্দুস্থান হিন্দুর দেশ।… মুসলমান মুখ ফিরাইয়া আছে তুরস্ক ও আরবের দিকে, এদেশে চিত্ত তাহার নাই। যাহা নাই তাহার জন্য আক্ষেপ করিয়াই-বা লাভ কী…’।
সনাতন ধর্মের উৎসভূমি, প্রাচীন সংস্কৃতির বাহক ভারতের পরাধীনতার ইতিহাস শুধু ইংরেজ শাসনের একশো নব্বই বছরের নয়, বরং তার সঙ্গে যুক্ত হবে বিদেশাগত ইসলাম শাসনের প্রায় আটশো বছরের যন্ত্রণার ইতিহাস। যে দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যাখ্যা হোক না কেন-শক, হুন, পাঠান, মুঘলরা লুঠ করার জন্যই এদেশে এসেছিল। দু’একজন শাসকের ক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু ব্যতিক্রমকে উদাহরণ হিসেবে চালাতে গিয়ে অর্ধসত্য, মিথ্যা ও বিকৃত ইতিহাসই দীর্ঘদিন লালন করে চলেছে জাতি। তাই সময় এসেছে পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইতিহাসকে পুনরায় ফিরে দেখার। তাহলেই ভবিষ্যৎ নির্মাণের পথ সুদৃঢ় হবে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখছেন-‘একদিন মুসলমান লুণ্ঠনের জন্যই ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল, রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য আসে নাই। সেদিন কেবল লুঠ করিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, মন্দির ধ্বংস করিয়াছে, প্রতিমা চূর্ণ করিয়াছে, নারীর সতীত্ব হানি করিয়াছে, বস্তুত অপরের ধর্ম ও মনুষ্যত্বের উপরে যতখানি আঘাত ও অপমান করা যায়, কোথাও কোনো সংকোচ মানে নাই।’
মুর্শিদাবাদে হরগোবিন্দ দাস, চন্দন দাসেরা কেবল হিন্দু হওয়ার অপরাধে মরেছেন। হাজার হিন্দু ধর্ম বাঁচাতে, প্রাণ বাঁচাতে বাপ-ঠাকুরদা-চোদ্দপুরুষের ভিটে ছেড়ে পালিয়েছেন অন্যত্র। এই ধর্মীয় সন্ত্রাসের পেছনে বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক ইসলামিক গোষ্ঠীগুলোর হাত আছে, এটা নিশ্চিত। কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে কলমা পড়তে না পারা এবং কেবল হিন্দু হওয়ার অপরাধে ছাব্বিশজন হিন্দু হত্যার মূল মদতদাতাও পাকিস্তান। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রে স্থানীয় মুসলমানদের মজহবি জেহাদই সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা নিয়েছে। নিয়েছে এই কারণে যে তারাও মজহবে মুসলমান এবং সেটাই তাদের একমাত্র পরিচয়। কোনো মানবিকতা নয়, নয় গণতান্ত্রিক দেশের সহ-নাগরিকের প্রতি বিন্দুমাত্র দয়া-করুণা। তারা চালিত মজহবি জেহাদের আদর্শে, কোরান ও হাদিসে। এদেশের জনসংখ্যার আশি শতাংশ হিন্দুর দ্বারা কি এই হিংস্র সন্ত্রাসের এক শতাংশও সম্ভব? সম্ভব নয়। যদি তাই হতো তবে দেশের মুসলমান এতদিনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। পরিবর্তে মোল্লাবাদীরা হুমকি দিয়ে রেখেছেন ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারতে শরিয়ত আইন চালু করবে। আজ নয়, স্বাধীনতার আগেই হিন্দু- মুসলমানের এই স্বরূপ চিনেছিলেন শরৎচন্দ্র- ‘আজ মনে হয়, এ সংস্কার উহাদের (মুসলমানদের) মজ্জাগত হইয়া উঠিয়াছে। পাবনার বীভৎস ব্যাপারে অনেককেই বলতে শুনি, পশ্চিম হইতে মুসলমান মোল্লারা আসিয়া নিরীহ ও অশিক্ষিত মুসলমান প্রজাদের উত্তেজিত করিয়া দুষ্কার্য করিয়াছে। কিন্তু এমনিই যদি পশ্চিম হইতে হিন্দু পুরোহিতের দল আসিয়া, কোনো হিন্দুপ্রধান স্থানে এমনই নিরীহ ও নিরক্ষর চাষাভুষাদের এই বলিয়া উত্তেজিত করিবার চেষ্টা করেন যে নিরপরাধ মুসলমান প্রতিবেশীদের ঘরদোরে আগুন ধরাইয়া সম্পত্তি লুঠ করিয়া মেয়েদের অপমান অমর্যাদা করিতে হইবে, তা হইলে সেইসব নিরক্ষর হিন্দু কৃষকের দল তাঁহাদের পাগল বলিয়া গ্রাম হইতে দূর করিয়া দিতে এক মুহূর্ত ইতস্ততঃ করিবে না।’ এই হলো হিন্দু-মুসলমানের শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মাচরণের পার্থক্য। ছিল সেদিন, আজও আছে।
দেশের প্রায় কুড়ি কোটি মুসলমানের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকাকে দায়ী করে তাদের মজহব নিয়ন্ত্রিত খুন-ধর্ষণ-সন্ত্রাসকে লঘু করার চেষ্টা করেন কেউ কেউ। দেশের সকল নাগরিকের আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষার উন্নয়নের দাবিটা অন্যায্য নয়, তবে মজহবের সঙ্গে অশিক্ষাকে যুক্ত করে সন্ত্রাসের সমর্থন দেশদ্রোহিতার আর এক নাম। কথা সাহিত্যিকের বিশ্লেষণ-‘কিন্তু (মুসলমানদের), কেন এরূপ হয়? ইহা কি শুধু কেবল অশিক্ষারই ফল? শিক্ষা মানে যদি জানা হয়, তাহা হইলে চাষি-মজুরের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানে বেশি তারতম্য নাই। কিন্তু শিক্ষার তাৎপর্য যদি অন্তরের প্রসার ও হৃদয়ের কালচার হয়, তাহা হইলে বলিতে হইবে উভয় সম্প্রদায়ের তুলনাই হয় না।’
এতো গেল সমস্যার কথা। সমস্যার গভীরে না গিয়ে কেবল পরিস্থিতি বিচার করে সমাধানের প্রবণতা-রোগ এদেশে দীর্ঘদিনের। একথা সত্য, দেশে বিশেষ করে বঙ্গদেশে আজকের যারা মুসলমান কয়েকশো বছর আগে পর্যন্ত তারা প্রত্যেকেই হিন্দু ছিল। ছিল মূলত অন্ত্যজ-শূদ্র শ্রেণীর। উৎপত্তি, আচরণ, সংস্কৃতি, চিন্তাগতভাবে তারা একই গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ। নৃতত্ত্ব এর স্বপক্ষে রায় দিলেও, এ দাবির সঙ্গে বাস্তবের মিল মাত্র কয়েক শতাংশ। সংস্কৃতিগত পরম্পরা বহনের ক্ষেত্রে মুসলমানদের কাছে মজহব এবং ইসলাম সংস্কৃতি প্রধান। আর সব মিথ্যা। ইসলাম কেবল এদেশে ধর্মগত পরিবর্তন ঘটায়নি। আচরণ, সংস্কৃতি এবং চিন্তার জগতেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলতে পেরেছে সফলভাবে। কোরান ও হাদিস নির্দেশিত মজহব চেতনা যে তাদের একমাত্র অনুকরণীয়, একথা দেশের মুসলমান সমাজ প্রতিজ্ঞার মতো করে পালন করলেও, ঠিক এর উলটো কথা বলেন মুখোশধারী কিছু ‘সেকুলার’ মানুষ। তাদের লক্ষ্য রাজনৈতিক, উদ্দেশ্য ইসলামের বিস্তারকে আরও সহজ করা। যেকোনোভাবে ‘হিন্দু-মুসলমানের মিলন’ চাই, চোখ-কান বন্ধ রেখে এই চিৎকার মূলত সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর পরিকল্পিত অপচেষ্টা। অপরদিকে হিন্দুদের ভিতর উঁচু-নীচু, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, বাঙ্গালি-বিহারি, গুজরাটি-তামিল প্রভৃতিতে বিভক্ত করে হিন্দু সমাজকে আলাদা করার পরিকল্পিত চেষ্টা সেই অভিসন্ধির একটি অংশ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখছেন- ‘হিন্দু মুসলমানের মিলন একটা গালভরা শব্দ, যুগে যুগে এমন অনেক গালভরা বাক্যই উদ্ভাসিত হইয়াছে, কিন্তু ওই গাল-ভরানোর অতিরিক্ত সে আর কোনো কাজেই আসে নাই। এ মোহ আমাদিগকে ত্যাগ করিতে হইবে। আজ বাঙ্গলার মুসলমানকে একথা বলিয়া লজ্জা দিবার চেষ্টা বৃথা যে, সাতপুরুষ পূর্বে তোমরা হিন্দু ছিলে; সুতরাং রক্ত-সম্বন্ধে তোমরা আমাদের জ্ঞাতি। জ্ঞাতিবধে মহাপাপ, অতএব কিঞ্চিৎ করুণা কর। এমন করিয়া দয়া ভিক্ষা ও মিলন-প্রয়াসের মতো অগৌরবের বস্তু আমি তো আর দেখিতে পাই না।’ এ ‘অগৌরব’ আর কতদিন বহন করবো আমরা?
সবার আগে হিন্দু সমাজের ভাবনা ও চিন্তাস্তরে পরিবর্তন আনতে হবে। হিন্দুধর্ম চেতনা এবং ধর্ম সংস্কৃতিতে অন্য সব উপাসনা পদ্ধতি সহ্য করার ক্ষমতা লালন করবে ঠিকই, সব ধর্মের সমন্বয়ে ভারতকে আরও শক্তিশালী করার প্রতিজ্ঞাও থাকবে নিশ্চিতভাবে। কারণ হিন্দুত্ব ও ভারতীয়ত্ব তো সমার্থক; হিন্দু সংস্কৃতি ভারতবাসীকে সেই শিক্ষাই দেয়। তবে মূল কথা হলো কয়েক শতাব্দী ধরে জমে থাকা সমস্যার সমাধান কেবল মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দুদের মিলন আকঙ্ক্ষা দ্বারা পূর্ণ হবে না। বরং হিন্দু সমাজের অন্তর্গত জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা ভুলে একত্রিত হওয়ার মধ্য দিয়েই সমাধানের উৎসমুখ খুলে যেতে পারে। ‘হিন্দুর সমস্যা এ নয় যে, কী করিয়া এই অস্বাভাবিক মিলন সংঘটিত হইবে; হিন্দুর সমস্যা এই যে, কী করিয়া তাহারা সঙ্ঘবদ্ধ হইতে পারিবেন এবং হিন্দুধর্মাবলম্বী যে-কোনো ব্যক্তিকেই ছোটো জাতি বলিয়া অপমান করিবার দুর্মতি তাঁহাদের কেমন করিয়া এবং কবে যাইবে।’ সেই সঙ্গে তিনি হিন্দু সমাজের ভাবনার জড়ত্বে কুঠারাঘাত করেছেন- ‘হিন্দু-মুসলমানের মিলন হইল না বলিয়া বুক চাপড়াইয়া কাঁদিয়া বেড়ানোই কাজ নয়। নিজেরা কান্না বন্ধ করিলেই তবে অন্য পক্ষ হইতে কাঁদিবার লোক পাওয়া যাইবে।’ এই পথই হোক সমগ্র হিন্দু সমাজের পথ।
স্বাধীনতার পরে হিন্দু-শূন্য পাকিস্তান, পরম শূন্যের দিকে এগোনো বাংলাদেশের হিন্দুদের দীর্ঘদিনের চেনা সেই আর্তনাদই এখন শোনা যাচ্ছে সুতি, সামশেরগঞ্জ, ধুলিয়ান-সহ মুসলমান সংখ্যাগুরু জেলাগুলোতে। নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে যেতে হাতজোড় করে মুসলমানদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা করছে হিন্দুরা।
হিন্দু রমণী কাঁদতে কাঁদতে বলছেন- ‘আমার সন্তানের চেয়েও ছোটো, এত দিনের প্রতিবেশী মুসলমান ছেলেটি আমাকে বলছে-তোমার সম্ভ্রম দাও, আমি তোমার স্বামীকে ফিরিয়ে দেব।’ আজকের মালদায় নারীর সম্ভ্রম নেই, চোদ্দ পুরুষের ভিটে-বসতবাড়ি নেই, ধ্বংসাবশেষ হয়ে জেগে আছে কালী-শীতলা-দুর্গা প্রতিমা, মন্দিরের দালান। মুসলমানদের এইসব সন্ত্রাস-রক্তচক্ষুর সামনে সেই কবে থেকে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে সমগ্র হিন্দুসমাজ। তার কি কিছুমাত্র পরিবর্তন ঘটেছে? তিনি লিখছেন- ‘অত্যাচার ও অনাচারের বিবরণ সকল স্থান সংগ্রহ করিয়া এই কথাটাই কেবল বলিতেছি-তুমি এই আমাকে মারিলে, এই আমার দেবতার হাত-পা ভাঙ্গিলে, এই আমার মন্দির ধ্বংস করিলে, এই আমার মহিলাকে হরণ করিলে, এবং এ সকল তোমার ভারি অন্যায়, ও ইহাতে আমরা যারপরনাই ব্যথিত হইয়া হাহাকার করিতেছি। এসকল তুমি না থামাইলে আমরা আর তিষ্ঠিতে পারি না। বাস্তবিক ইহার অধিক আমরা কি কিছু বলি, না করি?’
অন্ধকার যুগের অবসান একদিন হবে। সময় বুঝে নেবে সব হিসেব। সেই সময় হয়তো সমাগত। আজকের এই কালবেলায় দাঁড়িয়ে হিন্দুদের করণীয় অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করে যেতে ভোলেনি তাঁর লেখা। ‘আমরা নিঃসংশয়ে স্থির করিয়াছি যে, যেমন করিয়াই হউক মিলন করিবার ভার আমাদের (হিন্দুদের) এবং অত্যাচার নিবারণ করিবার ভার তাহাদের (মুসলমানদের)। কিন্তু, বস্তুত হওয়া উচিত ঠিক বিপরীত। অত্যাচার থামাইবার ভার গ্রহণ করা উচিত নিজেদের এবং হিন্দু-মুসলমান-মিলন বলিয়া যদি কিছু থাকে তো সে সম্পন্ন করিবার ভার দেওয়া উচিত মুসলমানদের ‘পরে।’
গণতান্ত্রিক পরিসরে সমাধানের দায় সব ধর্মের মানুষের।
আক্রমণকারী যেহেতু মুসলমান, সুতরাং লাগাতার এ হত্যালীলা থামানোর মুখ্য দায় তাদেরই নিতে হবে। অথচ গোটা মুসলমান সম্প্রদায় ও নেতাদের ভাবনা, প্রথমত তারা মুসলমান তারপর বাঙ্গালি, কাশ্মীরি, গুজরাটি, কংগ্রেসি, তৃণমূলি, কমিউনিস্ট এবং সম্ভবত সবশেষে ভারতীয়। সে কথা প্রকাশ্যে জোর গলায় জাহির করে নিজ নিজ অবস্থান পোক্ত করেছেন হুমায়ুন কবির, ফিরহাদ হাকিম, আসাদুদ্দিন ওয়েসিদের মতো কেউ কেউ। অনেকেই প্রশ্ন করেন ধর্মহীন, ধর্মনিরপেক্ষ অনেক হিন্দু নেতা দেশে আছেন যারা
প্রকাশ্যে গোমাংস খেয়ে নিজেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রমাণ দেন। অথচ কোথাও কি কোনো মুসলমান নেতা আছে যারা শুয়োরের মাংস খেয়ে নিজেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ঘোষণার সাহস নাই দেখাক, অন্তত একতরফা এই হিংসাকে ধর্মীয় সন্ত্রাস বলার ‘গণতান্ত্রিক সৌজন্য’ দেখাবে! না নেই। কিন্তু কেন? তারাও তো শিক্ষা পেয়েছে। সবাইতো মাদ্রাসার পাঠ নেয়নি। তারাও ভারতে জন্মেছে, বড়ো হয়েছে ভারতের সব সুবিধা নিয়ে। কারণটা বোধহয় খুব স্পষ্ট। সবকিছুর ঊর্ধ্বেই তাদের মজহব এবং সেই গ্রন্থের নির্দেশ। ব্যতিক্রম কেউ নয়। পাঁচশো টাকার বিনিময়ে পাথর ছোঁড়া কিশোর, প্রতিবেশী রমণীর সম্ভ্রম খুবলে নেওয়া যুবক, পৃথিবীর সব কাফের নারীকে গনিমতের মাল ভাবা ‘বলিষ্ঠ পুরুষ’, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক, অধ্যাপক, কবি, সাহিত্যিক। একই প্রশ্ন সেদিনও ছিল। শরৎচন্দ্র সব স্তরের মুসলমানের চরিত্রের মুখোশ টেনে খুলেছেন এবং জোরালো অক্ষরে ব্যক্ত করেছেন কোনো রাখঢাক না রেখেই- ‘হিন্দু নারী হরণের ব্যাপারে সংবাদপত্রওয়ালা প্রায়ই দেখি প্রশ্ন করেন, মুসলমান নেতারা নীরব কেন? তাঁহাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা যে পুনঃ পুনঃ এত বড়ো অপরাধ করিতেছে, তথাপি প্রতিবাদ করিতেছে না। কীসের জন্য? মুখ বুজিয়া নিঃশব্দ থাকার অর্থ কী? কিন্তু আমার তো মনে হয় অর্থ অতিশয় প্রাঞ্জল। তাঁহারা শুধু অতি বিনয়বশতই মুখ ফুটিয়া বলিতে পারেন না, বাপু, আপত্তি করব কী, সময় এবং সুযোগ পেলেও কাজে লেগে যেতে পারি।’
দেশে ইসলামের আগমনের সময়কাল থেকেই সমাজের অন্তরে-অন্দরে লুকিয়ে থাকা এই ভয়ংকর রোগ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পাওয়া খুব সহজ নয়। সহজ নয়, ২০৪৭ সালের মধ্যে দেশে শরিয়ত আইন লাগুর হুমকি দেওয়া মোল্লাবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করা। তবে সে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে নিরন্তরভাবে। এবং শুরুটা এখনই করতে হবে। হয়তো এখন সেই মানুষ সংখ্যায় কম, নেহাত হাতে গোনা কয়েকজন। তবে রাস্তা খুঁজতে হবে পরিষ্কার মন, পরিচ্ছন্ন ভাবনা থেকে। যে কাজটা শরৎচন্দ্র শুরু করেছিলেন প্রায় একশো বছর আগে, সেটা আমাদেরই সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব নিতে হবে। অনেক টিপ্পনী, অনেক আক্রমণ, অনেক বিরোধিতা থাকবে এবং থাকবে স্বাভাবিক কারণেই। তবু এ-কাজ বন্ধ করার অর্থ নিশ্চিত ধ্বংসের প্রস্তুতি নেওয়া। হার-না-মানা সে জেদের ভাষা জুগিয়েছেন স্বয়ং শরৎচন্দ্র। ‘আমেরিকা যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করিয়েছিল, তখন দেশের অর্ধেকের বেশি লোকে তো ইংরাজের পক্ষেই ছিল। আয়ার্লন্ডের মুক্তিযজ্ঞে কয়জনে যোগ দিয়াছিল? যে বলশেভিক গভর্নমেন্ট আজ রুশিয়ার শাসনদণ্ড পরিচালনা করিতেছে, দেশের লোকসংখ্যার অনুপাতে সে তো এখনো শতকে একজনও পৌঁছে নাই। মানুষ তো গোরু-ঘোড়া নয়, কেবলমাত্র ভিড়ের পরিমাণ দেখিয়াই সত্যাসত্য নির্ধারিত হয় না, হয় শুধু তাহার তপস্যার একাগ্রতার বিচার করিয়া।’ তিনি বুঝেছিলেন, আমরা বুঝবো কবে?
সূত্র: ১৯২৬ সালে প্রকাশিত কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’।