তিনবিঘা থেকে শিলিগুড়ি করিডোের সীমান্তে নতুন আগুন, নিরাপত্তায় শৈথিল্য
সাধন কুমার পাল
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুসের উসকানিমূলক মন্তব্যের পর চিকেনস্ নেক অঞ্চলটি নতুন করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। ইউনুস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিকে (সেভেন সিস্টার্স) ‘স্থলবেষ্টিত’ বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশকে এই অঞ্চলে ‘সমুদ্রপথে প্রবেশের নিরিখে অভিভাবক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
ভারতের আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো, অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিলিগুড়ি করিডোরের কাছে লালমনিরহাটে ব্রিটিশ আমলের বিমানঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য চীনা বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে লালমনিরহাট বিমানঘাঁটির কাজ ২০২৫ সালের অক্টোবরের মধ্যে শুরু হতে পারে, যেখানে একটি পাকিস্তানি কোম্পানি উপ-ঠিকাদার হিসেবে থাকবে। ভারত-ভুটান-চীন ত্রি-জংশনের কাছে চীনের সম্প্রসারিত সামরিক পরিকাঠামো এই অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে। ২০১৭ সালের ডোকলাম অচলাবস্থা ভারতকে এই করিডোরের সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে বাধ্য করে। উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এই করিডোরের মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকটি তেল ও গ্যাস পাইপলাইন, বিদ্যুৎ গ্রিড এবং একটি একক রেলপথ এখনো কৌশলগত একটি উদ্বেগের বিষয়। কারণ এটি শত্রুপক্ষের লক্ষ্য হতে পারে। এই করিডোরটি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই ট্রানজিট ও বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন দশ লক্ষ যানবাহন-ট্রাক, বাস, এসইউভি, ব্যক্তিগত গাড়ি এই করিডোর ব্যবহার করে, যা ২, ৪০০ মেট্রিকটন পণ্য পরিবহণ এবং ১৪২ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ে সহায়ক।
চিকেনস্ নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং গড়ে ২২ কিলোমিটার প্রশস্ত অঞ্চল যা ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে আটটি রাজ্য- অরুণাচল প্রদেশ অসম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম ও ত্রিপুরা-কে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করে।
পশ্চিমাঞ্চলে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার পর ভারতীয় কূটনৈতিক এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য উত্তরবঙ্গ এবং সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মধ্যে একমাত্র সংযোগকারী অঞ্চল চিকেনস্ নেকের স্পর্শকাতরতা আবার একবার ভাবনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। শিলিগুড়ি করিডোরটি অসামরিক চলাচল এবং সামরিক সরবরাহ উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। চিকেনস্ নেকের দৈর্ঘ্যের এক প্রান্তে বিহারের কিষাণগঞ্জ এবং অন্য প্রান্তে শিলিগুড়ি অবস্থিত। এর সংকীর্ণতম স্থানের প্রস্থ ১৩ কিলোমিটার এবং প্রশস্ততম স্থানের প্রস্থ ২৩ কিলোমিটার।
এই রুটে যেকোনো বিঘ্ন ভারতের আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য সরাসরি হুমকি স্বরূপ। নেপাল ও বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত এই চিকেনস্ নেক অঞ্চলটি ভুটান ও চীনের খুবই কাছে অবস্থিত। এই জন্যই এর নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। চিকেনস্ নেকের নিরাপত্তার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এই ভূখণ্ডেই সম্প্রতি ‘অপারেশন তিস্তা প্রহার’ হয়ে গেল।
অপারেশন সিঁদুর শুরুর পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীদের ভার্চুয়াল বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠকের পর মিডিয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলতে শোনা গেছে, পুলিশকে বাংলাদেশ সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে। প্রশাসনের সূত্রও বলছে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ‘আমাদের সীমান্তে নজর রাখতে হবে, যাতে কেউ অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে প্রবেশ করতে না পারে, ট্রেন স্টেশনগুলিকেও নজরদারিতে রাখতে হবে।
রাজ্য সরকার জমি দেয়নি বলে এতদিন সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকার থানারগুলির পরিকাঠামোর দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যাবে যে আইনশৃঙ্খলা সামলে সীমান্তে বাড়তি নজর দেওয়া কার্যত অসম্ভব।
কোচবিহার : মোট সীমান্ত ৫০০ কিলোমিটার, অসুরক্ষিত সীমান্ত ৫০ কিলোমিটার। সীমান্ত এলাকায় কোনো কোনো থানা এবং ফাঁড়িতে কত পুলিশকর্মী : সিতাই ২৫, কুচলিবাড়ি ৩১, মেখলিগঞ্জ ২০, সাহেবগঞ্জ ৩০, দিনহাটা ৩৮, হলদিবাড়ি ২২, মাথাভাঙ্গা ১৬ + (কনস্টেবল কত, জানায়নি থানা), তুফানগঞ্জ ৩১, চর বালাভূত ফাঁড়ি ৪, নয়ারহাট ফাঁড়ি ১৪, শীতলকুচি ২১। জলপাইগুড়ি : মোট সীমান্ত ৯৪ কিলোমিটার, অসুরক্ষিত সীমান্ত ১৯ কিলোমিটার, সীমান্ত এলাকায় কোন কোন থানা এবং ফাঁড়িতে কত পুলিশকর্মী, রাজগঞ্জ থানা ৩২, মানিকগঞ্জ ১৩, নিউ জলপাইগুড়ি ৫৮। দার্জিলিং, মোট সীমান্ত ২১ কিলোমিটার, অসুরক্ষিত সীমান্ত ৪,৫-৫ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় কোন কোন থানা এবং ফাঁড়িতে কত পুলিশকর্মী- ফাঁসিদেওয়া থানা ৩৫।
উত্তর দিনাজপুর : মোট সীমান্ত প্রায় ২২৭ কিলোমিটার, অসুরক্ষিত সীমান্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার, সীমান্ত এলাকায় কোন কোন থানা এবং ফাঁড়িতে কত পুলিশকর্মী : কালিয়াগঞ্জ ৬৪, হেমতাবাদ তথ্য মেলেনি, ভাটোল ফাঁড় ১৫, করণদিঘি ১৯, রসাখোয়া ফাঁড়ি ৪, গোয়ালপোখর থানা ৩০, চোপড়া থানার তথ্য মেলেনি। ইসলামপুর থানা, রামগঞ্জ ফাঁড়ি ৩৫, পাটাগড়া ফাঁড়ি ৩২ জন।
দক্ষিণ দিনাজপুর: মোট সীমান্ত ২৫২ কিলোমিটার, অসুরক্ষিত সীমান্ত, ৩০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় কোন কোন থানা এবং ফাঁড়িতে কত পুলিশকর্মী। বালুরঘাট ৫৯, হিলি ২২, পতিরাম ২৩, কুমারগঞ্জ ২৬, তপন ২৯, গঙ্গারামপুর ৪৬, কুশমণ্ডি থানা ৩৩।
মালদহ: মোট সীমান্ত ১৭২ কিলোমিটার, অসুরক্ষিত সীমান্ত ৩২ কিলোমিটার। সীমান্ত এলাকায় কোন কোন থানা এবং ফাঁড়িতে কত পুলিশকর্মী বৈষ্ণবনগর থানা ২০, বামনগোলা ৮, হবিবপুর ১৩, ইংরেজবাজার ২৭, মালদা ১৯, (সব জায়গাতেই টহলদারি ভ্যান আছে) শিলিগুড়ি করিডরের লাগোয়া অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব উদ্বেগের বিষয়। : এই অঞ্চলের ৯৯ শতাংশ সীমানা পাঁচটি প্রতিবেশী দেশ— চীন, মায়ানমার, বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে যুক্ত। স্বাভাবিক ভাবেই করিডোরের মধ্য দিয়ে স্থলসীমার বাকি ১ শতাংশ অঞ্চলের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পথের উপর যে কোনো আক্রমণ বা অবরোধের ফলে উত্তর-পূর্ব ভারতের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের দিনাজপুরের রংপুর বিভাগে চীনা শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি উদ্বেগজনক ঘটনা। এই পরিকাঠামোগত প্রকল্পগুলি কৌশলগত বা সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হতে পারে, যা শিলিগুড়ি করিডোরের অস্বস্তিকরভাবে কাছাকাছি। পূর্ব নেপালে, বিশেষ করে করিডোরের কাছাকাছি প্রকল্পগুলিচীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের বিষয়টি ভারত ও নেপালের মধ্যে উন্মুক্ত সীমান্তের কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
কোচবিহার জেলার মেখলিগঞ্জে তিনবিঘা করিডোর (১৭৮ মিটার × ৮৫ মিটার) সমগ্র দেশের নিরাপত্তার জন্য শিলিগুড়ি করিডরের মতোই আরেকটি বিপজ্জনক এলাকা। এই করিডোর দিয়ে বাংলাদেশের মূলভূখণ্ড থেকে ভারতের ভিতরে থাকা বাংলাদেশের ছিটমহল আঙ্গারপোতা ও দহগ্রামে ওই দেশের বাসিন্দারা অবাধে যাতায়াত করে।
আঙ্গারপোতা ও দহগ্রামের চারদিকে কোনোরকম বেড়া নেই। এই ছিটমহলগুলি থেকে মেখলিগঞ্জ পুরএলাকা পায়ে হেঁটে বড়োজোর মিনিট দশেকের পথ হবে। এই পথে অবৈধ অনুপ্রবেশ প্রতিদিনের ঘটনা। তিনবিঘা করিডর চালু হওয়ার পর থেকে নিরন্তর এই অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। শিলিগুড়ি করিডোরের নিরাপত্তা নিয়ে যতটা সাজোসাজো রব রয়েছে তিনবিঘা করিডর নিয়ে সরকার ততটাই নীরব। বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে বিতাড়নের পর অনুপ্রবেশ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সীমান্তে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অভিযোগ, সীমান্তে সক্রিয় চোরাকারবারী ও দেশ বিরোধীদের অবৈধ কারবার রাজ্যে ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান আয়ের উৎস।
সেজন্য বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি ভাষায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মতো বিএসএফ-কে গালমন্দ করা, সেই সঙ্গে সীমান্ত সুরক্ষায় রাজ্য সরকারের দায় অস্বীকার করা মুখ্যমন্ত্রী মমতা এবং তাঁর দলের নেতা-মন্ত্রীদের প্রতিদিনের রাজনৈতিক কর্মসূচির অঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে সীমান্ত নিরাপত্তার শিথিলতা সমগ্র দেশের নিরাপত্তার জন্যই অশনিসংকেত। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের কারণে বছরের পর বছর ধরে শিলিগুড়ি করিডোরের জনসংখ্যার পরিবর্তন হয়েছে এবং ভারতের শত্রুরা ওই অনুপ্রবেশকারীদের ব্যবহার করে এলাকায় সমস্যা তৈরি করার চেষ্টা করতে পারে। সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে থাকলেও শিলিগুড়ি করিডোর, তিনবিঘা করিডোর বা সীমান্ত এলাকার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। সেজন্য সীমান্ত সুরক্ষার কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারের মধ্যে যথার্থ সমন্বয় সেইসঙ্গে প্রয়োজন জনসচেতনতা। সমস্ত দেশের নিরাপত্তার কথা ভেবে সীমান্ত এলাকার থানাগুলিকে ঢেলে সাজাতে হবে। কেন্দ্র সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।