পশ্চিমবঙ্গে জেহাদিদের ভয়ে পুলিশ নিজেই আজ আতঙ্কিত
মণীন্দ্রনাথ সাহা
পশ্চিমবঙ্গের আকাশ আজ শাসকদলের দুর্নীতির কালো মেঘে আচ্ছাদিত। বিষাক্ত হয়ে গিয়েছে মানুষের মন। সামাজিক সম্পর্কগুলি ক্লিশে হতে হতে এমনই হয়ে উঠেছে যে, আজ তারা পাশের বাড়ির আপদে বিপদেও নির্লিপ্ত। এই সবকিছুর জন্য দায়ী এরাজ্যের সর্বগ্রাসী রাজনীতি। তাই পরিবর্তন ছাড়া পশ্চিমবঙ্গকে বাঁচানোর কোনো পথ আর নেই। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির বর্তমান অভিমুখ এক লাগামছাড়া, বাঁধনহীন ও বিকারগ্রস্ততায় ভরপুর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এরাজ্যের রাজনীতি অভিযোজন করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই সে পথ আঁকড়ে ধরেই একইভাবে শাসনরথের গতিকে ধরে রেখেছে। সঙ্গে শুরু করা হয়েছে জেহাদিদের দ্বারা হিন্দুদের ওপর আক্রমণের ব্যাপক চক্রান্ত।
শুরু করেছে মালদহ দিয়ে। তারপর মুর্শিদাবাদ হয়ে মহেশতলায় পৌঁছেছে। কী আশ্চর্য মিল তাই না? তিনটি জায়গার নামের প্রথম অক্ষর ‘ম’ দিয়ে শুরু। আবার অপরাধীরা অপরাধ করছে ‘ম’-এ মমতার শাসনকালে। উপরন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই আক্রমণকারীরা গোদা বাংলায় যাকে বলে মুসলমান আর আক্রান্তরা হিন্দু। এছাড়া অপূর্ব মিল রয়েছে মমতার সঙ্গে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী শাসক মহম্মদ ইউনুসের। দুই শাসক যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। উভয়ের লক্ষ্য হিন্দু নির্যাতন, হিন্দু নিধন, হিন্দুদের প্রতি প্রবল ঘৃণা।
এইসব হামলার প্রতিবাদে বঙ্গীয় হিন্দু সুরক্ষা মঞ্চের পক্ষ থেকে এরাজ্যে হিন্দুদের সুরক্ষার দাবিতে গত ১৭ জুন তুলসী সম্মানযাত্রা সম্পন্ন করেছে। তুলসীমঞ্চ নিয়ে মিছিলে বিভিন্ন হিন্দু সংগঠন অংশ নিয়েছে বঙ্গীয় হিন্দু সুরক্ষা মঞ্চের আহ্বানে।
কয়েকদিন আগে মহেশতলায় জেহাদিদের হামলায় আক্রান্ত হয় হিন্দুরা। একটি মন্দিরের পাশে থাকা তুলসীমঞ্চ ভেঙে ফেলা হয়। জেহাদিদের ব্যাপক তাণ্ডবের সাক্ষী থাকে মহেশতলার রবীন্দ্রনগর থানা এলাকা। দোকানপাট ভাঙচুরের পাশাপাশি থানার পাশে থাকা মোটরবাইক জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অশান্তি থামাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে পুলিশও। পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর, পুলিশ কর্তাদের লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছোঁড়া হয়েছে। পাথর ছোঁড়া হয়েছে হিন্দুদের বাড়িতেও। মালদহ থেকে মহেশতলা প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুলিশ থেকেছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়।
ঘটনার প্রতিবাদে বিজেপি বিধায়কদের সঙ্গে করে তুলসীমঞ্চ নিয়ে মিছিল করে রাজভবন পৌঁছান রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। পাশাপাশি বঙ্গ বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদারও তুলসীমঞ্চ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালীঘাটের বাড়ির সামনে প্রতিবাদ করে গ্রেপ্তারবরণ করেন।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে হিন্দুদের ওপর হামলা চালানোর সাহস পাচ্ছে কোথা থেকে রাজ্যের জেহাদিরা মুসলমান? এ প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অনেকেই বলছেন— বহুদিন আগে বলা পাকিস্তানি নাগরিক এক্রামুল্লার মতে- ‘ভারতের মধ্যে পঞ্চমবাহিনীর সাহসেই জেহাদিরা বলীয়ান। তার প্রমাণ পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক অতীতে পাকিস্তানের সংসদে আলোচনা থেকে। সেখানে বলা হয়েছিল- ‘যতদিন ভারতে অখিলেশ যাদব, কংগ্রেস, সিপিএম, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষ এবং দলের লোকেরা থাকবে ততদিন পাকিস্তানের কোনো চিন্তা নেই।’ এছাড়া বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আমলে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি হিজবুত তাহেরি মহম্মদ ইউনুসের আমলে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রকাশ্যে বলেছে— ‘আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অনুরোধ করব, তিনি ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গকে স্বাধীন করার জন্য ভারত সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করুন। আমরা আপনাকে সবরকম সাহায্য করব।’ এখানে আরও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এরাজ্যের জেহাদিরা কাদের জন্য এত সাহস পায়?
কিন্তু এরাজ্যে সবচেয়ে লজ্জার যে বিষয়টি তা হলো পুলিশের ভূমিকা। ২০১১ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে জেহাদিদের দ্বারা পুলিশ যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে তা নজিরবিহীন। সারা বিশ্ব পশ্চিমবঙ্গের পুলিশকে কখনো দেখেছে টেবিলের নীচে লুকোতে, কখনো আলমারির ফাঁকে। কখনো পুলিশের পশ্চাদ্দেশে উড়ন্ত লুঙ্গির ছুটন্ত লাথি পড়তে, কখনো-বা ইট-পাথরের ঘায়ে পুলিশকে রক্তাক্ত হতে। যা অন্য কোনো রাজ্যে ঘটে না। তবুও পুলিশ নির্বিকার। এবারেও দেখা গেছে- পুলিশের লাঠি নিয়ে যেখানে জেহাদিদের দিকে তেড়ে যাওয়ার কথা কিংবা বন্দুক থেকে গুলি ছোঁড়ার কথা সেখানে পুলিশ সাদা রুমাল উড়িয়ে জেহাদিদেরকে শান্তির বার্তা দিতে।
পুলিশের এই করুণ দশা দেখে অনেকেই বলেন, একটা সময় ছিল পুলিশ কর্তব্য পালন করতে গিয়ে মার খেলে সাধারণ মানুষের কষ্ট হতো। এখন কেন জানি না পুলিশ মারখেলে সাধারণ মানুষের মনে সামান্যটুকুও সহানুভূতি জাগে না। হয়তো এরজন্য তারা নিজেরাই দায়ী। কারণ বর্তমানের পুলিশ ভুলেই গেছে যে, তারাও ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ স্তম্ভের একটি স্তম্ভ। অথচ একসময় পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের যথেষ্ট সাহস এবং অপরাধীদের শায়েস্তা করার নজির রয়েছে এই পশ্চিমবঙ্গে। এটা তারা করতে পেরেছে কেবলমাত্র অফিসারদের নির্ভীকতা ও আক্রমণকারীদের থেকে আক্রান্তদের রক্ষায় তাঁদের দৃঢ়চেতা ভূমিকার জন্য। তার কয়েকটি উদাহরণ এখানে প্রাসঙ্গিক হবে।
(১) ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টে কলকাতায় হিন্দুনিধনের দিন এন্টালি, কড়েয়া, বেনেপুকুর, খিদিরপুর, এলাকার হিন্দু বাসিন্দারা আক্রান্ত হয়ে প্রাণরক্ষায় কোনো থানার পুলিশের সাহায্য পায়নি। ডিসি ডিডি হীরেন সরকার ডিসি হেডকোয়ার্সের ঘরে গিয়ে জানতে চাইলেন, কেন আক্রান্ত নাগরিকরা পুলিশের সাহায্য পাচ্ছে না? সেখানে কোনো সদুত্তর না পেয়ে হীরেন সরকার দুটি জিপ বোঝাই গুর্খা আর্মড পুলিশ নিয়ে খিদিরপুর চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি আগ্নিসংযোগ ও হত্যায় রত আক্রমণকারীদের ‘Shoot to kill’ নির্দেশ দিয়ে অবরুদ্ধ অসহায় হিন্দুদের উদ্ধার করে ভবানীপুরে নিরাপদ অঞ্চলে স্থানান্তরিত করলেন। লালবাজারে কন্ট্রোলরুমে হীরেন সরকার ফিরে আসতেই বঙ্গের ক্রুদ্ধ মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দি তাঁর মুখোমুখি। তাঁর প্রশ্ন ছিল- বিনা নির্দেশে হীরেন সরকার কেন খিদিরপুর গিয়েছিলেন? ততোধিক ক্রুদ্ধ হীরেনবাবু জবাব দিয়েছিলেন যে, পুলিশি আইনে নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষায় তিনি দায়বদ্ধ। সুতরাং ওই দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন মাত্র।
ঠিক এই একই দায়িত্ব কেন নোয়াখালিতে পুলিশ পালন করেনি, সেই প্রশ্ন করেছিলেন গান্ধীজী জেলা শাসককে, ১৯৪৬-এর নভেম্বরে নোয়াখালির মাটিতে পা রেখে। (২) পুলিশের সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে সমাজের কাছে একটা ভূমিকা, একটা দায়বদ্ধতা আছে এবং এই দায়বদ্ধতা কিন্তু আগাগোড়া ফৌজদারি দণ্ডবিধি আইনে নির্দিষ্ট করা আছে। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত থানার বড়বাবুদের স্মরণ রাখা উচিত তাঁদেরই একজন পূর্বসুরির কথা। তিনি ছিলেন মালদহ জেলার গাজোল থানার বড়বাবু মিহিরেশ বর্মণ।
১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে গাজোল থানার বাবুপুর এলাকায় ফসলের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে গণ্ডগোলের জন্য সিপিএম সমর্থক কয়েকজন ভাগচাষি জমির মালিকের বাড়িতে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে দু’জন মহিলাকে ধর্ষণ করে এবং এক মহিলা-সহ তিনজনকে খুন করে ওই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। গাজোল থানার বড়বাবু ধর্ষণ, খুন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তার করেন। সিপিআইএম নেতা জ্যোতি বসু তখন দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। পার্টির লোকেদের মারফত এই খবর শুনে তিনি সরাসরি মিহিরেশবাবুকে ফোন করেন তাঁর দলের ওই চারজনকে জামিনে ছেড়ে দিতে। মিহিরেশবাবু সঙ্গে সঙ্গে জ্যোতিবাবুকে জানিয়ে দেন, যে অপরাধের জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাতে আইন মোতাবেক জামিন দেওয়া যায় না।
পরে জ্যোতিবাবু স্বরাষ্ট্রদপ্তরের জয়েন্ট সেক্রেটারিকে দিয়ে বড়বাবুকে নির্দেশ পাঠান যে, পুলিশ যেন আদালতে অভিযুক্তদের জামিনের আবেদনের বিরোধিতা না করে। কিন্তু বড়বাবু সেই নির্দেশও পালন করতে অস্বীকার করেন। এর কয়েকদিন পর মিহিরেশ বর্মণকে দ্রুত বদলির নির্দেশ দেন মালদহের পুলিশ সুপার। মিহিরেশবাবু বদলির নির্দেশ পেয়ে হাইকোর্টে যেতে মনস্থ করেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায় খবরের কাগজ মারফত খবরটি জেনে মালদহ সফরে যান এবং মিহিরেশবাবুকে মালদহের সার্কিট হাউসে ডেকে পাঠান। অজয়বাবু ঘটনার পুরো সরকারি ফাইলটি দেখে মালদহের পুলিশ সুপারকে মিহিরেশবাবুর বদলির আদেশ বাতিলের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিজে ওই ফাইলে সই করেন। পরবর্তী কর্মজীবনে মহিরেশ বর্মণ তাঁর সেই আইন মোতাবেক দৃঢ়তার জন্য সিনিয়র অফিসারদের কাছে শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন।
(৩) যুক্তফ্রন্ট সরকারের সামনে জ্যোতি বসু পুলিশমন্ত্রী থাকাকালীন রাজা পুলিশের শীর্ষকর্তা ছিলেন উপানন্দবাবু। আজকের মতোই পশ্চিমবঙ্গ তখন রাজনৈতিক হানাহানিতে রক্তাক্ত। কোলিয়ারিতে এক শ্রমিক নেতার খুনের ঘটনায় পুলিশ সিপিএমের কয়েকজন ক্যাডারকে গ্রেপ্তার
করলে ক্ষিপ্ত জ্যোতিবাবু উপানন্দবাবুকে ডেকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কী ব্যাপার? পুলিশ আমাদের লোকজনকে ধরছে কেন?’ পুলিশকর্তা উপানন্দবাবু জবাবে বলেছিলেন- ‘ধৃতদের নাম এফআইআর-এ আছে। পুলিশ সঠিক কাজই করেছে।’ জ্যোতিবাবু পালটা কোনো প্রশ্ন করতে পারেননি।
পুলিশের সঙ্গে প্রশাসন সহযোগিতা করলে এবং পুলিশকে অপরাধ দমনে ব্যবস্থা নেওয়ার স্বাধীনতা দিলে অপরাধীদের শায়েস্তা করার মানসিকতা ও যোগ্যতা বহু পুলিশের মধ্যে এখনো রয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব যদি পুলিশের হাতে বেড়ি পরিয়ে রাখে, তাহলে পুলিশের করার কিছু থাকে না।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মনে করে পুলিশের পিটুনি খাওয়া শুধু পুলিশের লজ্জা নয়, এ লজ্জা শাসকেরও। কারণ পুলিশকে মেরুদণ্ডহীন করে তোলার পিছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী এই শাসকই। সাধারণ মানুষ মনে করে স্বকীয়তা বজায় রাখতে এবং নিজেদের ভাবমূর্তি ফেরাতে কড়া পদক্ষেপ নিয়ে এই লজ্জাজনক ঘটনার অবসান ঘটাবে বর্তমান প্রশাসন। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের পদস্থ আধিকারিকরাও পুলিশি আইনের সহায়তায় নিজেদের শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলবেন। এটা শুধু রাজ্যের জন্য নয়, গোটা সমাজের জন্যই অত্যন্ত জরুরি।