প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দ্রুত এগিয়ে চলেছে ভারত
আনন্দ মোহন দাস
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে স্বদেশি উৎপাদন নীতি গ্রহণ করার ফলে এবং মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত অর্থনীতির অগ্রগতির সঙ্গে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও লক্ষণীয় ভাবে এগিয়ে চলেছে।
অপারেশন সিঁদুরের সাফল্য প্রমাণ করে ভারত এখন প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অনেক বেশি শক্তিশালী। এর পিছনে অন্যতম কারণ প্রতিরক্ষা বিভাগের নীতির আমূল পরিবর্তন এবং আত্মনির্ভর ভারত গড়তে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে স্বদেশিয়ানা। ২০১৪ সালের পর ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে গেছে যেখানে নিত্য নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে নতুন উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে সেনাবাহিনীর অগ্রগতিতে দেশ এগিয়ে চলেছে।
আত্মনির্ভর ভারত গড়তে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে স্বদেশি উৎপাদন কেন্দ্রীয় সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই ক্ষেত্রে একসময় ভারত বিশ্বের এক নম্বর অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। কিন্তু আজ ভারত প্রায় ২৩৬০০ কোটি টাকার অস্ত্রশস্ত্র রপ্তানি করছে। এটি একটি শুভ সূচনা বলা যায়। ট্যাঙ্ক ও ফাইটার জেট ছাড়াও প্রতিরক্ষা গবেষণাগার, স্টার্ট আপ ও অসামরিক শিল্পের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র উৎপাদনে দেশ অগ্রসর হয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে মিসাইল ম্যান ড. এপিজে আবদুল কালামের স্বপ্ন সার্থক হতে চলেছে। বর্তমানে রাশিয়া, আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইজরায়েল-সহ বিশ্বের অনেক দেশ ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আমদানিকারক দেশের তকমা ছেড়ে ভারত এখন রপ্তানিকারক দেশ
হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
বহু দশক ব্যাপী ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন সরকারি সংস্থা হিন্দুস্তান অ্যারোনোটিক্স লিমিটেড এবং ভারত ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু সরকারি আমলাতান্ত্রিক লাল ফিতের বাঁধনে এই ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে গতি ছিল না। যার ফলে গতানুগতিক প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনেও মন্থর গতি ছিল। কিন্তু বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের আমলে এখানে আমূল পরিবর্তন ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে গতি এসেছে। ২০২৩-২৪ আর্থিক বছরে প্রতিরক্ষা উৎপাদন ১ লক্ষ ২৭ হাজার কোটিতে পৌঁছে গেছে যা ২০১৪-১৫ সালের ইসরো চেয়ে ১৭৪ শতাংশ বেশি। মেক ইন ইন্ডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে এবং ডিআরডিও মিলিতভাবে ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে অনেক এগিয়ে গেছে। অপারেশন সিঁদুর অভিযান সারা ভারতের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে এবং মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পের সফলতা অনুভব করেছে। আজ প্রমাণিত হয়েছে যে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ দেশের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটা সময় ছিল, যখন ভারত তার প্রতিরক্ষা ও সামরিক সরঞ্জামের প্রয়োজনে অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে সেই অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে আত্মনির্ভর হওয়া খুব আবশ্যক। কারণ ঘাড়ের কাছে পাকিস্তান ও চীন নিঃশ্বাস ফেলছে। এছাড়াও দেশের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি এবং আত্মসম্মানের ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারি ক্ষেত্রের প্রযুক্তি, উৎসাহ ও পেশাদারি অভিজ্ঞতা এই ক্ষেত্রে গতি বাড়িয়েছে। প্রাইভেট স্যাটেলাইটের মাধ্যমে নজরদারির ক্ষেত্রে দেশের অগ্রগতি বেড়েছে। ২০২০ সালে The Defence Innova-tion Organisation (DIO) প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এর ফলে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে গবেষণা, প্রযুক্তির ব্যবহারে গতি এসেছে। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আধুনিকীকরণের ফলে উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত উল্লেখযোগ্য ভাবে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে এগিয়ে গেছে। শুরুতে মাত্র ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ক্রমবর্ধমান উন্নতির মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণ অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের তৈরি ক্ষেপণাস্ত্রগুলি বিশ্বের বাজারে সমাদৃত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে অপারেশন সিঁদুর সফল অভিযানে ক্ষেপণাস্ত্রগুলির কার্যকারিতা বিশ্বের সামনে প্রমাণিত হয়েছে। এমনকী চীন থেকে কেনা পাকিস্তানের বিমানগুলি ভারতীয় মিসাইল দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ধরাশায়ী হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আকাশ মিসাইল যে কোনো জায়গা থেকে বহু সংখ্যক লক্ষ্য ভেদ এবং ট্র্যাক করতে পারে। এটি ৭০ কিলোমিটার আগে থেকেই মিসাইলের খোঁজ পায় এবং ৩০ কিলোমিটার এরিয়ার মধ্যেই ধ্বংস করতে পারে। সাম্প্রতিক অভিযানে ভারতের সামরিক বাহিনীর ক্ষেত্রে ‘আকাশ ও S-400 মিসাইল’ উভয়েই কার্যকর ভূমিকা নিয়ে নির্ভেদ্য দেওয়ালের মতো দাঁড়িয়েছে। এখন ভারতের ‘আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্রের সাফল্য সন্দেহের ঊর্ধ্বে প্রমাণিত হয়েছে। ভারত এখন বিশ্বের অন্ন্যান্য দেশ থেকে ব্যাপক অর্ডার পাওয়ার আশা করতে পারে। এমনকী ২০০ ক্ষেপণাস্ত্রের অর্ডার পেলে ভারত ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব অর্জন করতে পারে। পাকিস্তান-ভারত দ্বন্দ্বে ব্রহ্মোস সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইলের ভূমিকা রণনীতির একেবারে কেন্দ্রস্থলে ছিল যা ১০ মে, ২০২৫ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। পাকিস্তান দ্বারা ভারতের আকাশ সীমা লঙ্ঘনের প্রতিশোধে ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানের ভিতরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে। ২০০১ সালের ১২ জুন ব্রহ্মোসের সফল উৎক্ষেপণের পর সাম্প্রতিককালের অপারেশন সিঁদুর অভিযানের কার্যকারিতা প্রথম প্রমাণিত হলো। ভারত ও রাশিয়া যৌথভাবে তৈরি করেছে দ্বি-পর্যায় ব্রহ্মোস মিসাইল। প্রথম পর্বে সুপারসনিক গতি বৃদ্ধি হয় এবং দ্বিতীয় পর্বে শব্দের গতির তিন গুণ গতিতে মিসাইল পৃথক হয়ে লক্ষ্যে আঘাত করে।
যদিও এই ব্রহ্মোস রাশিয়া ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে তৈরি যা বিশ্বের বাজারে চাহিদা তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে। অপারেশন সিঁদুরের পর আন্তর্জাতিক স্তরে নতুন বাজার ও চাহিদা পূরণ করতে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সক্ষম হবে নতুন এই ক্ষেপণাস্ত্র। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতের এই সাফল্যে চীন ও তুরস্ক সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। কারণ ভারতীয় সেনাবাহিনী নিজের তৈরি অস্ত্রে সফলভাবে লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস সক্ষম হয়েছে এবং ভারতের ক্ষতির লক্ষ্যে পাকিস্তানের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করেছে। ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সমস্ত লক্ষ্যস্থলে নির্ভুল ও নিখুঁতভাবে আঘাত করেছে এবং এর ফলে ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের বিশ্বাসযোগ্যতা আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যে লক্ষ্য করা গেছে যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানি কেবলমাত্র কয়েকটি দেশের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। আমেরিকা, রাশিয়া ও ফ্রান্স এবিষয়ে আগে থেকেই এগিয়ে রয়েছে। কিন্তু ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, তুর্কি ও ইজরায়েল এক্ষেত্রে বর্তমানে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। কয়েকটি তথ্য থেকে ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে স্বদেশি উৎপাদনের ক্ষমতা এবং রপ্তানি সম্পর্কে অবগত হওয়া যাবে।
২০২৩-২৪ আর্থিক বর্ষে ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন ১২৭০০০ কোটিতে পৌঁছেছে যা ২০১৪-১৫ সালের চেয়ে ১৭৪ শতাংশ বেশি। এটি সম্ভব হয়েছে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগের ফলে। ২০২৩-২৪ আর্থিক বর্ষে গত এক দশকে ভারত প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে রপ্তানির পরিমাণ ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২১০৮৩ কোটি টাকা হয়েছে। ২০২৯ সালের মধ্যে ভারত সরকার প্রতিরক্ষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে ৩ লক্ষ কোটি টাকা এবং রপ্তানির পরিমাণ ধার্য করেছে ৫০০০০ কোটি টাকা। প্রতিরক্ষা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উত্তরপ্রদেশ ও তামিলনাড়ুতে দুটি Defence Industrial Corridor (DIC) স্থাপন করা হয়েছে। এর জন্য ইতিমধ্যে ৮৬৫৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ২৫৩টি মউ স্বাক্ষর হয়েছে যার দ্বারা ৫৩৪৩৯ কোটি টাকা সম্ভাব্য বিনিয়োগ হবে বলে আশা করা যায়।
বর্তমানে ৬৫ শতাংশ প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম দেশের মধ্যে উৎপাদন হয়ে থাকে। এর আগে প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ক্ষেত্রে ৬৫-৭০ শতাংশ আমদানির উপর ভারতকে নির্ভর করতে হতো। বেসরকারি ক্ষেত্রও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এবং মোট প্রতিরক্ষা উৎপাদনের ২১ শতাংশ তারা পূর্ণ করছে। তুলনামূলক বিচারে দেখা যায় দেশের প্রতিরক্ষা রপ্তানি গত এক দশক ২১ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৪-২০১৪ পর্যন্ত এক দশকে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৩১২ কোটি টাকা। ২০১৪-২০২৪ অবধি এক দশকে তা দাঁড়িয়েছে ৮৮৩১৯ কোটি টাকা যা এক কথায় অভূতপূর্ব। ২০২২-২৩ অর্থ বছরে প্রতিরক্ষা রপ্তানি ছিল ১৫৯২০ কোটি টাকা যা ৩২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৩-২৪ সালে একবছরে দাঁড়ায় ২১০৮৩ কোটি টাকা। ভারত এখন ১০০টির বেশি দেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানি করছে। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি দেশের কথা উল্লেখ করা যায়। (১) ফিলিপিন্স- ব্রহ্মোস সুপারসনিক এবং ক্রুজ মিসাইল, (২) মরিশাস- আডভ্যানসড লাইট হেলিকপ্টার, এএলএইচ-২২৮ এয়ারক্রাফট, (৩) ফ্রান্স-সফয়ার ও ইলেকট্রনিক, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, (৪) আমেরিকা- এয়ারক্রাফটের পার্টস এবং হেলিকপ্টার। ভারতের অর্থনীতির অগ্রগতির সঙ্গে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও ভারত লক্ষণীয় ভাবে এগিয়ে চলেছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে স্বদেশি উৎপাদন নীতি গ্রহণ করার ফলে এবং মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। আশা করা যায় আগামী ২০২৯ সালের মধ্যে দেশ প্রতিরক্ষায় উন্নত দেশগুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্বয়ংভর হয়ে উঠবে।□