মালদহের ঐতিহ্যমণ্ডিত রামকেলি মেলা
দীপশুভ্র পণ্ডিত
‘গৌড়ের নিকটে গঙ্গাতীরে এক গ্রাম। ব্রাহ্মণ সমাজ তার রামকেলি নাম।।’ বৃন্দাবন দাস রচিত চৈতন্যভাগবত (অন্ত্যখণ্ড) গ্রন্থে রামকেলির উল্লেখ পাওয়া যায়। ইতিহাসের গন্ধমাখা এই গ্রামকের ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু মানুষের গন্তব্য হতেই পারে। তবে রামকেলি মহোৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঐতিহ্য আর মাহাত্ম্য। সঙ্গে প্রচুর জনশ্রুতি আর লোকগাথা। তাই এই মেলার আকর্ষণ অনিবার।
পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার ইংরেজবাজার থানার একটি সমৃদ্ধিশালী গ্রাম এই রামকলি। ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ পাওয়া না গেলেও কথিত যে শ্রীরামচন্দ্র তাঁর শ্বশুরবাড়ি মিথিলা যাওয়ার সময় পুণ্ডুদেশ (তখনকার নাম), বর্তমানে মালদহে কিছুদিন যাপন করেছিলেন। সেখানে কালিন্দী নদীর তীরে আমবাগানে শ্রীরামচন্দ্র আমের স্বাদে-গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে ফলকেলি শুরু করেছিলেন। শ্রীরামচন্দ্র আম নিয়ে কেলি করায় এই স্থানের নাম হয়ে যায় রামকেলি। ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৫১৫) শ্রীচৈতন্যদেবের রামকেলি গ্রামে আগমন হয়। হরিনাম প্রচারে শ্রীচৈতন্যদেব বেরিয়ে আসেন ওড়িশায়। সেখান থেকে মথুরা-বৃন্দাবন যাওয়ার পথে গৌড়ে আসেন তিনি। তখন রামকেলি গ্রামে দিন তিনেক ছিলেন। সময়টা ছিল জুন মাসের মাঝামাঝি জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তি। তখন হোসেন শাহ্ তৎকালীন গৌড়ের সুলতান। তার দু’জন রাজকর্মচারী সনাতন ও রূপকে কৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিলেন মহাপ্রভু। সনাতন গোস্বামীর পূর্বনাম ছিল অমর এবং রূপ গোস্বামীর নাম ছিল সন্তোষ।
ভারতে সবাই পিতৃপিণ্ড দেওয়ার কথা জানে। কিন্তু একমাত্র রামকেলিতে মেলার প্রথম দিনে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড থেকে প্রচুর মহিলা ভক্ত আসেন এবং এটাই সম্ভবত একমাত্র ভারতের অন্যতম স্থান যেখানে মাতৃ পিণ্ডদান করা হয়। মহিলারাই পিণ্ডদান করেন। এই পিণ্ডদান কেবল রামকেলি মেলার সময় হয়ে থাকে। সকাল ৫টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত এই পিণ্ডদান চলে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আগমন উপলক্ষ্যে প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তিতে রামকেলিতে বিরাট মেলা বসে। ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই মেলা চলে আসছে। এই মেলা চলে সাতদিন ধরে। বৈষ্ণব সমাজে রামকেলি মেলা গুপ্ত বৃন্দাবন মেলা নামে পরিচিত।
রামকেলি মেলা বিখ্যাত আর একটা কারণে। বৈষ্ণব সমাজের বিয়ের জন্য। প্রাচীনকালে রূপ সাগরের উত্তরপাড়ে এক বিস্তৃত চাতালে বৈষ্ণব বৈষ্ণবীদের মিলন উৎসব হতো। বৈষ্ণবীরা কাপড় দিয়ে নিজেদের আবৃত করে রাখতেন। ফলে বৈষ্ণবরা তাঁদের চেহারা দেখতে পেতেন না। শুধু বাঁ হাতের কড়ে আঙুল (মতান্তরে অনামিকা) দেখে বৈষ্ণবী নির্বাচন করা হতো। এখন মালাবদল (কণ্ঠী বদল) করে গান্ধর্ব মতে বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রচলন আছে। আষাঢ় মাসের প্রথম ও দ্বিতীয় দিন মন্দির প্রাঙ্গণে কীর্তন, পালাগান, বাউলগানের আসর বসে।
মালদহ শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার হলেও এটা সম্পূর্ণ গ্রামীণ মেলা। জ্যৈষ্ঠ মাসের সংক্রান্তি থেকে পরবর্তী সাত দিন ধরে চলে ইতিহাস প্রসিদ্ধ এই মেলা। প্রতি বছর কয়েক লক্ষ মানুষের সমাবেশ হয় এই মেলায়। এর জেরে গমগম করে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের এই গৌড়ভূমি। কোনো এক সময় এই মেলায় শুধুমাত্র আঙুল দেখে জীবনসঙ্গিনী নির্বাচন করতেন বৈষ্ণবরা। সেই কারণে এই মেলার আরও এক নাম গুপ্ত বৃন্দাবন। মেলায় ছোটো-বড়ো মিলিয়ে প্রায় হাজারের উপরে দোকান বসে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এই মেলায় অংশগ্রহণ করেন। যেহেতু গ্রীষ্মের মেলা, তাই এই মেলার প্রধান আকর্ষণ আম। জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তির আগেই বর্ষা এসে যাওয়ায় বৃষ্টি ও কাদা এই মেলার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কাদা মেখেই মেলায় ভিড় করেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। রামকেলিতে মেলা ছাড়াও কিছু দর্শনীয় স্থান আছে। এর মধ্যে সনাতন গোস্বামীর প্রতিষ্ঠিত মদনমোহন জিউ মন্দির উল্লেখযোগ্য। এছাড়া এই মন্দিরের পূর্ব কদম ও তমালগাছের তলায় পাথরের ওপর মহাপ্রভুর যুগল পদচিহ্ন প্রতিষ্ঠিত। এই পদচিহ্ন সংরক্ষণের জন্য রয়েছে একটি ছোটো মন্দির। এখানে মন্দির কর্তৃপক্ষকে বললে, তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে দেখান মহাপ্রভুর পদচিহ্ন। এখানে এসে এই সুযোগ কেউ হাতছাড়া করেন না। মদনমোহন জিউ মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে রূপ সাগর, উত্তর পূর্বে সনাতন সাগর। স্থানীয়ভাবে এটা সনাতন দীঘি নামে পরিচিত। এছাড়াও রয়েছে শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ড, শ্রীরাধার অষ্টসখীকুণ্ড।
এই মেলায় ছুঁয়ে দেখা যায় রসকদম্বের রসে অবগাহন করা গৌড়ীয় ইতিহাস। কদমফুলের মতো দেখতে এই মিষ্টি আজও বহন করছে চৈতন্যদেবের কেলিকদম্ব গাছের স্মৃতি। আজ টাঁড়ার খাজা, মনোহরার জায়গা দখল করেছে হালফিল ক্যাডবেরি মিষ্টি, বেকড্ রসোগল্লা, আরও কত কী। কিন্তু এত কিছুর পরেও মালদার রসকদম্ব এখনো টিকে রয়েছে। মালদহে সবচেয়ে পুরোনো মিষ্টি টাঁড়ার খাজা। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন বঙ্গের রাজধানী গৌড়ের শেষ সুতলান ছিলেন সুলেমান কররানি। কররানির বংশধরেরা রাজধানীকে টাঁড়ায় সরিয়ে নেয়। সেই সময় জয়নগর থেকে এক মৌলবি টাঁড়ায় এসে খাজা তৈরি শুরু করে। সুলতানি আমলের সেই খাজা এখন আর তৈরি হয় না। আঙুরের মতো দেখতে মনাক্কা মিষ্টিও নেই। নেই ছোটো কুলের মতো দেখতে মনোহরাও। কিন্তু এখনো আছে শুধু রসকদম্ব। জনশ্রুতি, শ্রীচৈতন্যদেব নাকি ভালোবাসতেন এই মিষ্টি। ইতিহাস ও পরম্পরার এক আশ্চর্য মিলনস্থল এই রামকেলি।