ভারতীয় সংস্কৃতির আত্মা ভারতমাতা
ধর্মানন্দ দেব
ভারতের সংবিধান প্রণীত হওয়ার বহু আগেই ভারতমাতা এই ভূখণ্ডের আত্মা ও চেতনায় বিরাজমান ছিলেন। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সৃষ্টি নন, বরং যুগ যুগ ধরে জাতীয় কল্পনার গভীরে এক সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক মাতৃমূর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সম্প্রতি কেরালার একটি সরকারি অনুষ্ঠানে ভারতমাতার প্রতিচ্ছবিকে ঘিরে বিতর্ক সেই পুরনো প্রশ্নকে নতুন করে সামনে এনেছে- সংস্কৃতির মূল স্তম্ভকে কি সেকুলারিজমের অজুহাতে অস্বীকার করা যায়?
ভূমিকে মা রূপে কল্পনা করা ভারতীয় সংস্কৃতির চিরন্তন ঐতিহ্য। এটি কোনো ঔপনিবেশিক বা সাম্প্রদায়িক নির্মাণ নয়। অথর্ববেদে বলা হয়েছে, ‘মাতা ভূমিঃ পুত্রোহহং পৃথিব্যাঃ’- পৃথিবী আমার মাতা, আমি তাঁর পুত্র। ঋগ্বেদের দেবীসূক্তে দেশকে এক নারী শক্তি হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে- ‘অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসূনাং।’ রামায়ণে উচ্চারিত হয়েছে- ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।’ এই ঐতিহ্য ভারতমাতার স্বরূপে রূপান্তরিত হয়েছে।
ভারতমাতার আবেগময় ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর লেখা আনন্দমঠ উপন্যাসে ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি ভারতীয়দের জন্য এক আন্দোলনের মন্ত্র হয়ে উঠেছিল- ‘সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাং শস্যশ্যামলাং মাতরম্।’ এই গানের মাধ্যমে মাতৃভূমিকে উর্বর, কল্যাণময় ও শস্যশ্যামলা রূপে উপস্থাপন করা হয়, যা ধর্ম, জাতপাত ও ভাষার ঊর্ধ্বে উঠে একটি অভিন্ন আবেগের অভিমুখ তৈরি করেছিল। এই গান ভূমিকে পবিত্র প্রতীক হিসেবে স্থাপন করে, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেনি। ভারতমাতাকে তাই কেবল ধর্মীয় নয়, বরং একটি সংস্কৃতিগত প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। আজও এই গান আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে সম্মানিত। স্বামী বিবেকানন্দ ভারতমাতার মধ্যে দেখেছিলেন আধ্যাত্মিক শক্তি ও জাতীয় সেবার মিশ্রণ। তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী পঞ্চাশ বছর ভারতমাতাই হোক আমাদের একমাত্র আরাধ্য।’ তাঁর ভাষায়- ‘Let all other vain gods disappear for the time from our minds. This is the only god that is awaken- our own race- everywhere his hands, every- where his feet, everywhere his ears, he covers everything.’ এই আহ্বান নিছক কোনো রূপক নয়- এটি ছিল এক জীবন্ত শক্তির উপাসনা, এক বাস্তব চেতনার প্রতীক। স্বামী বিবেকানন্দের কাছে ভারতমাতা কোনো কল্পকথা নয়, বরং জাতির মূর্ত প্রতীক, যিনি তাঁর সন্তানদের কাছে দাবি করেন সেবা, আত্মনিবেদন ও পুনর্জাগরণ।
১৯০৫ সালে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতমাতার প্রথম চিত্ররূপ আঁকলেন, যেখানে তাঁকে গেরুয়া মাতার এক শাস্ত্র-সংস্কৃতি-শ্রমনির্ভর রূপকে তুলে ধরেছিল, যা আজও সমানভাবে জনপ্রিয়। ১৯০৯ সালে সুব্রহ্মণ্য ভারতী বিজয়া পত্রিকার প্রচ্ছদে ভারতমাতাকে ভারতের মানচিত্রের উপর দাঁড়িয়ে চারটি শিশুকে স্নেহে আশ্রয় দিতে দেখা যায়- যারা দেশের প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতীক। এই ধারাবাহিক চেতনার প্রতিফলন পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতভাগ্যবিধাতা কবিতায়ও। চতুর্থ স্তবকে তিনি ভারতমাতাকে একজন সজাগ, করুণাময়ী অভিভাবক হিসেবে তুলে ধরেন- ‘জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে। …স্নেহময়ী তুমি মাতা।’ এই চিত্র জাতির গভীর সাংস্কৃতিক সংকটে মাতৃরূপে ভারতের অভিভাবকত্বকে প্রকাশ করে।
১৯৩৬ সালের ২৫ অক্টোবর গান্ধীজী বারাণসীতে ‘ভারতমাতা মন্দির’ উদ্বোধন করেন। সেখানে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, জৈন, পার্সি, বৌদ্ধ ও হরিজনদের এক বিশাল সমাবেশে গান্ধীজী বলেন, ‘এই মন্দিরে কোনো দেব-দেবীর মূর্তি নেই, এখানে আছে কেবল ভারতের মানচিত্র। মাতৃভূমিকে উৎসর্গ করাই এই মন্দিরের একমাত্র লক্ষ্য।’ তিনি আহ্বান জানান সবাইকে, মায়ের চরণে বিভেদ ভুলে নিঃস্বার্থ সেবা উৎসর্গ করতে।
স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ‘ভারতমাতা কী জয়’ স্লোগান ছিল সর্বজনগ্রাহ্য। জওহরলাল নেহরু The Discovery of India গ্রন্থে লেখেন, তিনি প্রায়শই সভায় প্রশ্ন করতেন- ‘ভারতমাতা মানে কী?’ তিনি নিজেই ব্যাখ্যা দিতেন- ‘ভারতমাতা বলতে আমরা বুঝি দেশের কোটি কোটি মানুষ… এই বিপুল জনগোষ্ঠীই হলেন ভারতের প্রকৃত রূপ।’ এই ব্যাখ্যা ভারতমাতাকে কোনো প্রতিমা বা ধর্মীয় ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে জীবন্ত জনসত্তার প্রতীক করে তোলে।
তাই যদি বলা হয়, সংবিধানে উল্লেখ না থাকায় ভারতমাতার কোনো সরকারি বৈধতা নেই, তাহলে সেটা হবে জাতীয় জীবনের একটি দৈন্যপীড়িত, সংকীর্ণ ও ইতিহাসবিচ্ছিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ ভারতমাতার অস্তিত্ব ১৯৪৭ সালের বহু আগের। তিনি কোনো আইনত প্রতীক নন, বরং এক সভ্যতাগত চেতনার আধার। তাঁর বৈধতা কোনো সংবিধানের পাতায় নয়, বরং ভারতীয় জনমানসে শতাব্দী ধরে গেঁথে থাকা সংস্কৃতির গভীর আবেগে নিহিত।
আজ যারা বলেন, ভারতমাতা ‘ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী, তারা আদতে ভুল বুঝছেন- তিনি কোনো ধর্মের প্রতীক নন, বরং ভারতের পবিত্র ভূগোল,
জাতীয় সংগ্রাম ও ভবিষ্যতের একাত্মতাবোধের প্রতীক। তাঁর চিত্রকে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে নিষিদ্ধ করা ধর্মনিরপেক্ষতা নয়- এটি সভ্যতার স্মৃতিলোপ, এক গভীর আত্মবিস্মৃতির লক্ষণ।
ভারতমাতা সংবিধানকে প্রশ্ন করেন না- তিনি তাকে জীবনীশক্তি দেন। ভারতমাতা কোনো আইনসিদ্ধ অনুমোদনের অপেক্ষায় নেই, কারণ তিনি হলেন ভারতীয় আত্মা, যা থেকে সংবিধান অর্থ পায়। যেমন সংবিধানে জাতীয় সংগীত, জাতীয় পশুর উল্লেখ নেই- তেমনি ভারতমাতাও
সাংবিধানিক শিরোনামে না থেকেও আমাদের জাতীয় অভিজ্ঞান ও আত্মপরিচয়ের অপরিহার্য অংশ।
ভারতমাতার বিরোধিতা মানে ভারতের সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার অস্বীকৃতি। তাঁকে বিতর্কিত করা মানে দেশকে এক সামাজিক চুক্তিতে রূপান্তর করা,
যেখানে হৃদয়, ইতিহাস ও চেতনার জন্য কোনো স্থান নেই। কিন্তু আমাদের গণতন্ত্র যদি তার মূল চেতনাকে, মূল আত্মাকে ভুলে যায়, তবে তার শরীর হয়তো টিকে থাকবে, কিন্তু আত্মা হারিয়ে যাবে। তাই ভারতমাতার প্রত্যাখ্যান নয়, গর্বের সঙ্গে বলতে হবে- বন্দে মাতরম্। ভারতমাতা কি জয়!