ভুলে যাওয়া এক ইতিহাস
ভোলানাথ সেনের ‘প্রাচীন কাহিনী’
ড. চন্দ্রশেখর মণ্ডল
কলকাতা-কেন্দ্রিক তথাকথিত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের ভীরুতা ও মেরুদণ্ডহীনতার একটি ইতিহাস স্মরণের জন্যই আজকের এই নিবন্ধের অবতারণা। সেই লোকটা ছিলেন শিক্ষিত, নিপাট এক ভদ্রলোক। সাতে-পাঁচে না থাকা লেখক-বাঙ্গালি। এবং অবশ্যই ধর্মে হিন্দু। কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের ব্যবসা করেন, সঙ্গে লেখালেখি। ‘সেন ব্রাদার্স’-এর কর্ণধার ও প্রকাশক। ভোলানাথ সেন। সকালে নিজের দোকানে প্রতিদিনের কাজকর্ম করছিলেন দুই কর্মচারী সতীশ ও হরিদাসকে নিয়ে। তখনই ঘটে গেল ঘটনাটা। দিনের বেলায় কলকাতার প্রকাশ্য রাজপথে ঘটলো নৃশংস ভয়ংকর হত্যালীলা। লাহোর ও পঞ্জাব থেকে আসা আবদুল্লা খান ও আমির আহমেদ নামে দুই জেহাদি যুবক প্রবল হিংস্রতায় ছোরার আঘাতে ভোলানাথ সেন ও তার দুই সহকারীকে হত্যা করে ফেলল। তখন ভিড়ে থিক থিক করছিল প্রতিদিনের ব্যস্ত বই-বাজার কলেজস্ট্রিট।
ঘটনা ১৯৩১ সালের ৭ মে। ‘অপরাধ’ বড্ড বাড়াবাড়ি অবশ্য। ‘প্রাচীন কাহিনী’ নামে একটি পুস্তক রচনা করে ফেলা। লেখক ও প্রকাশক ‘সেন ব্রাদার্স’-এর ভোলানাথ সেন। বইটি তৎকালীন সময়ে সরকার অনুমোদিত গল্পের আকারে বিশ্ব ইতিহাস বোঝানোর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পাঠ্য ছিল। বইটিতে ছিল যিশুখ্রিস্ট, হযরত মহম্মদ প্রভৃতি বিশ্বের বিভিন্ন মানুষের মহানুভবতার ভালো ভালো কথা। তবে চটি আকারের সেই বইটিতে ছাপা হয়েছিল হিব্রু বাইবেলে
বর্ণিত দেবদূত গাব্রিয়েলের সঙ্গে হযরত মহম্মদের আলাপচারিতার একটি ‘সামান্য ছবি’। নিজের আঁকা নয়, লেখক ভোলানাথ সেন ছবিটি সংগ্রহ করেছিলেন ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে। সত্যিই তো এত আস্পর্ধা! হযরত মহম্মদকে ছবিতে আঁকা! হিংস্র জেহাদিরা খোঁজ নিল না, এই ছবি কোনো ভারতীয়রও আঁকা নয়, এঁকেছিলেন পঞ্চদশ শতকের এক তুর্কি শিল্পী। ছবিটি ইসলামি মজহবি গ্রন্থ কোরানের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এডিশনে অন্তর্ভুক্ত।
তবে এ-ঘটনা নতুন নয়। সেই হাদিসের সময়কাল থেকেই এমনি নৃশংসতা বহন করছে ইসলামি জেহাদিরা। ভারত এর সাক্ষী হয়েছে বহু আগেই। ১৯২৩ সালে ‘রঙ্গীলা রসুল’ নামে একটি বই প্রকাশ হয়। বিষয় হযরত মহম্মদের ব্যক্তিগত জীবন। বইটিতে হযরত মহম্মদের তেরো স্ত্রী এবং দুই দাসীর রঙিন জীবনের কথা চিত্রিত হয়েছে। পরিকল্পিত ভাবে মুসলমানদের উসকানো শুরু হলো- এ বই ইসলাম ও নবী’কে খাটো করার জন্য লেখা হয়েছে। অনেক বিতর্কের পর সবশেষে বিচারের আওতায় আসে প্রসঙ্গটি। হাইকোর্ট রায় দেয়, এ পুস্তকে কোনো ভুল নেই, কারণ বিষয়টি হাদিস ও সীরাত গ্রন্থে উল্লেখিত। বইয়ের লেখকের নাম জানা না গেলেও প্রকাশক ছিলেন রাজপাল মালহোত্রা।
বিচারব্যবস্থাকে তোয়াক্কা না করে স্বাভাবিকভাবে ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী হত্যা করা হলো ‘রঙ্গীলা রসুল’-এর প্রকাশ রাজপাল মালহোত্রাকে। বইয়ের ভক্ত-অনুরাগী সেজে বাড়িতে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করল, ‘কোরান’ ও ‘হাদিস’-এ অনুপ্রাণিত ইলিমুদ্দিন নামে এক জেহাদি যুবক। এই অন্যায় ও নৃশংস হত্যার পরও এই জেহাদি গোটা মুসলমান সম্প্রদায়ের কাছে বীরের মর্যাদা পেয়েছিল। তার পক্ষে মামলা লড়েছিলেন পাকিস্তানের জন্মদাতা আইনজীবী আলি জিন্না। খুনির প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’র লেখক স্যার মহম্মদ ইকবাল। চতুরতার সাহায্যে বিরুদ্ধে মতকে হত্যা করা ইসলামের হাদিসের এই নির্ভুল নির্দেশ, মজহবটার জন্ম থেকেই অনুসরণ হয়ে আসছে। ইহুদি কবি কাব ইবনে আশরাফের হত্যাও হযরত মহম্মদ একইভাবে কবির অনুরাগী সাজিয়ে, মিথ্যা পরিচয় দিয়ে করিয়েছিলেন। হাদিসেই সে কথা লেখা আছে। আসলে কথায় কথায় কেউ কেউ কাটমোল্লারা কী বলল, তা ইসলামের কথা নয়- এমন দাবি করেন। খুন-ধর্ষণ-সন্ত্রাস- ধর্মান্তরণ ইসলামের কোরান ও হাদিসের বিষয় নয় বলে আসল বিষয় থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা করেন কেউ কেউ। সেইসব ভীতু, মেরুদণ্ডহীন, ধান্দাবাজ, শিক্ষিত, তথাকথিত হিন্দু-বুদ্ধিজীবীদের উন্নত ইসলামি মজহবি সন্ত্রাসীদের প্রকৃতি বোঝা
ও বোঝানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহায্য ও সতর্কবাণী স্মরণ করানো প্রয়োজন। ১৯৩৯ সালে অমিতা সেনকে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন- ‘হিন্দুর লেখা সাহিত্যে হিন্দুর মনোভাব প্রকাশ পেয়ে থাকে বলে আজকাল মুসলমানেরা নালিশ করছে। এর একমাত্র প্রতিকারের উপায় হিন্দু সাহিত্যিকদের ধরে ধরে মুসলমান করে দেওয়া।’ ভেতরটা কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো করে সেই চিঠিতেই এর পরে তিনি লিখছেন- ‘আমরা তো শেষ প্রহরে এসে পৌঁছেছি, এখন সমস্যাটা তোদেরই স্কন্দে এসে চাপবে। হরিজনরা মুসলমান হওয়ার জন্য কোমর বাঁধছে, তারপরে তোদের পালা আসবে। কোরানের তরজমা যদি হাতের কাছে থাকে তাহলে এখন থেকেই পড়তে শুরু করে দে!’
তবে এক্ষেত্রে মুসলমানরা কিন্তু একেবারে এককাট্টা। নিজেদের মজহবের দোহাই দিয়ে খুন-ধর্ষণ-সন্ত্রাসের পক্ষে সাফাই দেওয়ার জন্য প্রায় সকলেই
মানসিকতায় জেহাদি। বাইরের প্রকাশে চালাকেরা নীরব, তবে তারা অবশ্যই সমর্থক। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সঠিক রোগ ধরতে পেরেছিলেন- ‘হিন্দু নারী হরণের ব্যাপারে সংবাদপত্রগুলো প্রায়ই দেখি প্রশ্ন করে মুসলমান নেতারা নীরব কেন? তাহাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা যে পুনঃ পুনঃ এত বড়ো অপরাধ করিতেছে, তথাপি প্রতিবাদ করিতেছে না কীসের জন্য? মুখ বুজিয়া নিঃশব্দ থাকার অর্থ কী? কিন্তু মনে হয় অর্থ অতিশয় প্রাঞ্জল। তাহারা শুধু অতি বিনয়বশতই মুখ ফুটিয়া বলিতে পারে না- বাবু, আপত্তি করব কী, সময় ও সুযোগ পেলে ও-কাজে আমরাও লেগে যেতে পারি।’
বড়ো আশ্চর্য লাগে সংস্কৃতিবান, রবীন্দ্রপ্রেমী হিন্দু বাঙ্গালি কেমন তুমুল চতুরতায় ‘ভোলানাথ সেন হত্যা মামলা ১৯৩১’ বিষয়টি লুকিয়ে রেখেছেন এতদিন। মুসলমান সম্প্রদায় এই নৃশংস হত্যার কোনো প্রতিবাদ করেছিল কিনা ইতিহাসে খুঁজে না পাওয়া গেলেও, এই দুই সন্ত্রাসীকে মুসলমানরা সেদিন বীরের সম্মান দিয়েছিল। এদের দেখার জন্য মুসলমান নর-নারী প্রতিদিন লাইন লাগাতো আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। বঙ্গের পরবর্তীকালের প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক এই সন্ত্রাসীদের পক্ষে লড়েছিলেন হাইকোর্টে। এই খুনিদের বাঁচাতে কোর্টে উপস্থিত হয়েছিলেন কলকাতা মাদ্রাসার তৎকালীন অধ্যক্ষ রায়বাহাদুর হিদায়েত হুসেন। বিচারপতির সামনে অধ্যক্ষ সাহেব সেদিন জোর গলায় বলেছিলেন- ‘মহম্মদের ছবি তাঁর বইতে ব্যবহার করে ভোলানাথ সেন ইসলামকে অপমান করেছেন এবং সেই অপরাধ শাস্তিযোগ্য।’ হত্যাকারীদের নয় বরং যাদের হত্যা করা হলো তাদের শাস্তির পক্ষেই সেদিন জোরালো বক্তব্য পেশ করেছিলেন উচ্চশিক্ষিত একজন অধ্যক্ষ। কারণ তাঁর মজহব যে ইসলাম, আর হত্যাকারীও মুসলমান। সরকারি কৌসুলি আশ্চর্য হয়ে বলেছিলেন- ‘ভোলানাথ সেন যে ছবিটা বইতে ব্যবহার করেছেন, গভর্নমেন্ট হাউসে সেই ছবির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আপনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন, মি. হুসেন?’ উত্তরে এই অধ্যক্ষ সাহেব বলেছিলেন- ‘উপস্থিত থাকা না থাকা বিষয় নয়, এটা ইসলামের অপমানের বিষয়।’
বিচারক উইলিয়ামস্ দু’জন হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ডের সাজা শুনিয়েছিল। তারপরও তাদের মৃত্যুদণ্ড রদ করার জন্য বঙ্গের বিধানসভার সদস্য স্যার আব্দুল্লা সুরাওয়ার্দি, ঘুজনভি ও আশারাফ আলি প্রভৃতি ব্যানিংহ্যাম প্যালেসে টেলিগ্রাম করেছিলেন। আর্জি ছিল হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড রদ করার। ইংরেজ বিচারব্যবস্থা দীর্ঘদিন চলার পর অবশেষে দুই হত্যাকারীর ফাঁসি হয়ে যায় ১৯৩২ সালের ১০ মার্চ। দীর্ঘ এই পর্বে কিংবা তারও পরবর্তী কোনো সময়ে নিরপরাধ, উচ্চশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, মুক্তচিন্তক ভোলানাথ সেনের হত্যার প্রতিবাদ কোনো হিন্দুর পক্ষ থেকে হয়েছিল কিনা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আজও কলেজ স্ট্রিটে কোথাও ভোলানাথ সেনের কোনো মূর্তি নেই। নেই তাঁর নামে একটা ছোটোখাটো রাস্তাও। শিক্ষায় মুক্ত চিন্তার প্রসারের অগ্রণী এই মানুষটির নির্মম মৃত্যুর ইতিহাস সুকৌশলে ভুলিয়ে রেখেছে তথাকথিত শিক্ষিত অগ্রণী বাঙ্গালিরা। আসলে এরাই ভেতরে ভেতরে মজহবি সন্ত্রাসবাদকে লালন পালনকারী বুদ্ধিজীবী।
হয়তো এটাই সত্যি যে, শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী বলে জাহির করা এই বাঙ্গালিরা ইতিহাসটা আরও ভালো করে জানে এবং অন্য সবার চেয়ে বেশি করেই জানে। আর জানে বলেই তাদের কলম থমকে রয়েছে। গলার স্বর চেপে গেছে। জানে বলেই বিবেক-বুদ্ধি বন্দক দিয়েছে অন্যের কাছে। কারণ ভোলানাথ সেনের মতো তাদেরও টুক করে কখন ঘাড় থেকে মাথা আলাদা হয়ে যায়! সেই তুমুল ভয়ই আসল কারণ। ভয় ইসলামি জেহাদকে। সে ভয় তাদের পিছু ছাড়েনি আজও।