বৈদিক সনাতন হিন্দুধর্মে ঋষিকা পরম্পরা
বন্দনা বিশ্বাস
বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদ থেকে (যজ্ঞীয় ব্যবহার-বিষয়ক ব্রাহ্মণ ও অরণ্যচারীদের প্রয়োজনীয় বেদ পঙ্ক্তি- সংকলন আরণ্যক হয়ে) জ্ঞানান্বেষী উপনিষদ পর্যন্ত বিস্তৃত হিন্দুশাস্ত্রাদির মন্ত্রদ্রষ্টা, প্রবক্তা বা রচয়িতা সকলে ঋষি বা ঋষিকা বলে পরিচিত। তপ বা গভীর ধ্যানের মাধ্যমে যাঁরা বৈদিক মন্ত্র উপলব্ধি করতে পারেন তাঁদের ঋষি বলা হয়। ধর্মজ্ঞানী ব্যক্তিরাই মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি। এঁরা বৈদিক মন্ত্র অনুধাবন করতে সক্ষম। ঋষিকা অর্থাৎ নারী ঋষি, যাঁরা বেদকে উপলব্ধি করেছেন, মন্ত্র রচনা করেছেন। এই সমস্ত বিদুষী নারী ধর্ম ও জ্ঞানের পথে সাধনায় রত থাকতেন। এঁরা বেদজ্ঞা, ব্রহ্মবাদিনী নামে পরিচিতা। এই সমস্ত বিদুষী নারীরা আধ্যাত্মিক জগতে বিশেষ স্থানের অধিকারিণী এবং বেদ সংকলনে পুরুষদের সঙ্গে সমান ভূমিকা পালন করেছেন। তবে বেদজ্ঞা নারীরা শুধুমাত্র বেদ রচনা নয়, বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও অংশ নিতেন। তাদের জ্ঞান ও শিক্ষা সমাজে খুবই সম্মানিত ছিল।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঋষিকা হলেন- অপালা, ঘোষা, লোপামুদ্রা, মৈত্রেয়ী, গার্গী, শ্রদ্ধা, জুহু, বাক, রোমাশা, সূর্যা ও রাত্রি। এঁরা ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনচর্চায় বিশেষভাবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং বিভিন্ন বৈদিক মন্ত্র রচনা করেন। এঁদের মধ্যে যাঁরা অবিবাহিত থেকে ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন চর্চা করতেন তাঁদের ব্রহ্মবাদিনী বলা হতো।
গার্গী: বৈদিক যুগের অন্যতম ঋষিকা ব্রহ্মবাদিনী গার্গী। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ অব্দে তাঁর জন্ম। তিনি ঋষি বাচকম্বীর কন্যা। গার্গীর প্রখর ও গভীর শাস্ত্রজ্ঞান, নির্ভীকভাবে শাস্ত্র আলোচনা এবং তর্কবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন ঋগ্বেদের টীকাকার। বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখা যায়, রাজা জনকের আয়োজিত শাস্ত্রার্থ যজ্ঞে ঋষি যাজ্ঞবন্ধ্যের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে তিনি অবতীর্ণ হন। প্রথমে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ক্রমশ প্রশ্নোত্তরের গভীরতা বাড়তে থাকে। বিদুষী গার্গী অন্তরীক্ষ, নক্ষত্রলোক, দেবলোক, ইন্দ্রলোক পেরিয়ে অবশেষে ব্রহ্মলোক নিয়ে প্রশ্ন করেন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে। এই পর্যায়ে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য গার্গীকে থামতে বলেন। স্মরণ করিয়ে দেন যে, বৈদিক প্রশ্নোত্তরের সীমা লঙ্ঘন হচ্ছে। ঋষি উদ্দালকের প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে গার্গী পুনরায় উঠে দাঁড়িয়ে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যকে আরও দুটি প্রশ্ন করার অনুমতি চান। প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়ে যাজ্ঞবল্ক্য জয়ী হলে বিদুষী গার্গীর জ্ঞান ও বিদ্যা সকলের নিকট ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে।
ঘোষা: ঋগ্বেদের একজন বিখ্যাত ঋষিকা হলেন ঘোষা। তাঁর জন্ম ঋষি অঙ্গিকার বংশে। ঋষিকা ঘোষার পিতার নাম কক্ষিবাণ। পিতামহ ছিলেন ঋষি দীর্ঘাত্মা। ছোটোবেলায় তিনি চর্মরোগে ভুগেছিলেন। দেববৈদ্য অশ্বনীকুমারদ্বয় তাঁকে চিকিৎসার দ্বারা সুস্থ করে তোলেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি অত্যন্ত বিদ্যানুরাগী। তিনি ছিলেন মন্ত্রদ্রষ্টা। তিনি ব্রহ্মের বক্তা বা ব্রহ্মবাদিনী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। যেহেতু অশ্বিনীকুমারদ্বয় তাঁকে সুস্থ করে তুলেছিলেন তাই তিনি তাদের প্রশংসায় ঋগ্বেদের দুটি স্তোত্র রচনা করেন। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৩৯-৪১তম সূক্তের তিনি স্রষ্টা।
অপালা: ঋষি আবির কন্যা অপালা। তিনি প্রমাণ করেছেন যে নারীরা শুধুমাত্র গৃহিণী নন, বরং জ্ঞানচর্চা, তপস্যা ও দর্শনে পুরুষদের সমকক্ষ বা
কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগিয়েই ছিলেন। তিনি একজন ব্যতিক্রমী নারী। সমাজের বক্রদৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আধ্যাত্মিক জ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করেছিলেন। ঋগ্বেদের অষ্টম মণ্ডলের ৮০তম সূক্তে তাঁর নাম পাওয়া যায়। তিনি ঋগ্বেদের সাধিকা হিসেবে পরিচিত। তার রচিত ঋগ্বেদের মন্ত্রসমূহ আজও মানবীয় দুর্বলতা, ঈশ্বর ভক্তি এবং নারীর আত্মিক শক্তির সাক্ষ্য বহন করে। নারীর নিজস্ব চেতনা ও ভোগান্তির বর্ণনা আছে তাঁর রচিত মন্ত্রে।
বাক: মহর্ষি অস্তূণের কন্যা বাক। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের দশম অনুবাকের ১২৫তম সূক্তের স্রষ্টা তিনি। এই সূক্তে মোট আটটি মন্ত্র রয়েছে। প্রথম ও তৃতীয় থেকে অষ্টম মন্ত্র ত্রিষ্টুপ ছন্দে এবং দ্বিতীয় মন্ত্রটি অপতী ছন্দে রচিত। এই সূক্তের মন্ত্রগুলোকে একত্রে ‘বৈদিক দেবীসূক্তম্’ বলা হয়। ঋষিকা বাকের নামানুসারে এটি ‘বাকসূক্তম্’ নামে পরিচিত।
রোমশা: অন্যতম বিদুষী নারী রোমাশা। তাঁর পিতা বৃহস্পতি এবং স্বামী ঋষি ভাবভ্য। ঋষিকা রোমাশা ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের ১২৬তম সূক্তের ৭তম মন্ত্রের দ্রষ্টা।
শ্রদ্ধা: বিদুষী শ্রদ্ধা ছিলেন কামায়নী গোত্রের। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৫১তম মন্ত্রের ঋষি হিসেবে তিনি প্রসিদ্ধ। মন্ত্রগুলোতে মনুষ্য জীবনের ধর্ম ও জীবনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও ভালোবাসার গুরুত্ব অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
সূর্যা: ঋগ্বেদে উল্লিখিত অন্যতম বিদুষী। তার পিতার নাম সবিত্রা। দশম মণ্ডলের ৮৫তম সূক্তে এই মহান নারীর উল্লেখ রয়েছে। বিয়ের বহু মন্ত্রের রচয়িতা তিনি। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে নারীর সম্মান ও মর্যাদার অত্যন্ত সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায় ঋষি সূর্যার মন্ত্রে।
মৈত্রেয়ী: বৃহদারণ্যক উপনিষদে মৈত্রেয়ীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন যাজ্ঞবন্ধ্যের পত্নী। তিনি আত্মজ্ঞানকেই চূড়ান্ত বলেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ‘ন হি অতঃ কামায় পতিঃ প্রিয়ো ভবতি, আত্মনস্তু কামায় পতিঃ প্রিয়ো ভবতি’- অর্থাৎ আত্মার কারণে সমস্ত কিছু প্রিয় হয়।
লোপামুদ্রা: ঋগ্বেদ ও মহাভারতে লোপামুদ্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন ঋষি অগস্ত্যের পত্নী। তিনি নিজের জীবনের কামনা, দাম্পত্য সম্পর্ক এবং আধ্যাত্মিক অন্বেষণকে সংযুক্ত করে মন্ত্র রচনা করেছেন।
ব্রহ্মবাদিনী বিশ্ববারা: দেবগণের স্তব উচ্চারণ করে ঋত্বিকের কার্য সম্পাদন করেছেন। তাঁর রচিত তৃতীয় ঋকে তিনি দাম্পত্য-সম্বন্ধ শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য অগ্নিদেবের নিকট প্রার্থনা করেছেন। তাঁর রচিত ঋকগুলি শব্দ মাধুর্যে ও ভাবসম্পদে এত সুন্দর যে পড়লে বিমুগ্ধ হতে হয়। ঋগ্বেদের ১২৫।১ দেবী সূক্তে তাঁর বিখ্যাত বাণী:
‘অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাভ্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ’- অর্থাৎ তিনি নিজেকে বিশ্বশক্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন। এটি নারীর আত্মবোধের এক অসাধারণ প্রকাশ।
বৈদিক ঋষিকারা প্রমাণ করে গেছেন যে, নারী কোনো সীমায় আবদ্ধ নন। তাঁরা মানবজাতির আধ্যাত্মিক উন্নতিতে, ধর্মীয় গঠনশীলতায় এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় সমান পারদর্শী। তাঁদের জীবন শৈলী, সাধনা আজও আধুনিক নারী সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা।
গ্রন্থসূত্র: উদ্বোধন পত্রিকায় মহারাজদের আলোচনামূলক লেখা ও হিন্দু ধর্ম ও দর্শন বিষয়ক লেখা। ঋকবেদের ঋষিকাগণ-রাধাগোবিন্দ বসু। বৈদিক সাহিত্য ও নারী-জ্ঞানেন্দ্রমোহন চক্রবর্তী।

















