বোল ব্যোম
কাঁওর নিয়ে বৈদ্যনাথে
নন্দলাল ভট্টাচার্য
শ্রাবণধারা অবিরাম। তারই মধ্যে গঙ্গায় ডুব দিচ্ছেন অগণন মানুষ। সতত দক্ষিণ-পূর্বে প্রবহমান গঙ্গা এই সুলতানগঞ্জে এসে উত্তর প্রবাহিনী। বিহারের ভাগলপুরের সুলতানগঞ্জের বর্তমান নাম অজগৈবীনাথ ধাম। গঙ্গোত্রী থেকে সমতলভূমে প্রবাহিত গঙ্গার স্বাভাবিক গতি দক্ষিণ-পূর্বে। উত্তরে প্রথম বাঁক হরিদ্বারে। তারপর দক্ষিণবাহিনী গঙ্গা উত্তরপ্রদেশের কাশীতে এসে উত্তরবাহিনী। সেখান থেকে এগোতে এগোতে ভৃগু থউরায় আবার উত্তরমুখী। উত্তরপ্রদেশের সীমানা পেরিয়ে বিহারে ঢুকে গঙ্গা ফের উত্তরে বাঁক নেয় পাটনার কাছে রাঢ় ও মুঙ্গেরে। সেখান থেকে ভাগলপুরের সুলতানগঞ্জে উত্তরবাহিনী গঙ্গার বুকে এক শৈলময় দ্বীপে প্রতিষ্ঠিত পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের অজগৈবীনাথ শিবমন্দির। অপার মহিমা এই শিবমন্দরের। সতত গঙ্গাধারায় নিস্নাত এই মন্দির।
সুমহান ঐতিহ্যের অধিকারী অজগৈবীনাথের শিব স্বয়ম্ভু। এই শিবের নামকরণের উৎস সম্পর্কে বলা হয় অজ ও গৈবীনাথ এই দুই শব্দের মিলনে স্থানের নাম অজগৈবীনাথ ধাম। অজ শব্দের অর্থ জন্ম রহিত বা অজেয় এবং গৈবীনাথ হলো শিবেরই একটি নাম।
শ্রীরামের পূজিত শিব
এই তীর্থ ও শিবমন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় সেই ত্রেতাযুগে। পৌরাণিক কাহিনি, রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আগে শ্রীরামচন্দ্র এখানেই শিবের আরাধনা করেন। এই মন্দির ছিল প্রাচীন ঋষিদেরও তপস্যার স্থল।
অজগৈবীনাথ শিবের মন্দিরটি পাথরের তৈরি। নাগরশৈলীতে তৈরি মন্দিরটি শতাব্দীর পর শতাব্দী নদীস্রোত, বন্যা ও খরা সহ্য করে আজও সেরকম অক্ষত অবিচল- সেটা ভারতীয় ভাস্কর্যের এক বিস্ময়। নৌকার মতো আকারের এই শিবমন্দিরে বিভিন্ন প্রাচীন দেব-দেবীর যেসব খোদাই ও প্রতীক রয়েছে তা প্রাথমিকভাবে এই মন্দির নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত প্রাচীন রাজবংশের পরিচয়ের কথাই মনে করিয়ে দেয়। অজগৈবীনাথ মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে নানা লোককাহিনি। বলা হয়, স্বয়ং শিব এই স্থানটিকে তাঁর বাসস্থান হিসেবে বেছে নেন। এখানে তিনি বিরাজমান অনাদিকাল থেকে।
বলা হয়, এখানেই ছিল জহ্নুমুনির আশ্রম। মাগঙ্গা চপলতার বশে তাঁর আশ্রমটি ভাসিয়ে নিতে গেলে জহ্নুমুনি গঙ্গাকে গিলে ফেলেন। পরে ভগীরথের প্রার্থনায় তুষ্ট হয়ে তাঁর জানুদেশ দিয়ে গঙ্গাকে মুক্তি দেন। সে কারণেই গঙ্গার আরেক নাম জাহ্নবী। সব মিলিয়ে মহাপুণ্যতীর্থ এই অজগৈবীনাথ ধাম সাধকদের সাধনার এক পুণ্যক্ষেত্র।
অজগৈবীনাথ সম্পর্কে এত কথা বলার অন্যতম কারণ, শ্রাবণ মাসে এই পুণ্যধাম থেকেই গঙ্গাজল বাঁকে করে প্রায় ১০৫ কিলোমিটার দূরে বৈদ্যনাথ ধামে হেঁটে নিয়ে যান পুণ্যার্থীরা। প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে বৈদ্যনাথ ধামে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী যেভাবে গঙ্গাজল নিয়ে যান, তা ‘কাঁওর যাত্রা’ নামেও প্রসিদ্ধ।
হলাহলের জ্বালা কমাতেই
সমুদ্র-মন্থনের সে এক প্রলয়লগ্ন। অমৃতের পরিবর্তে উঠল হলাহল। বাসুকীর চোখ-মুখ দিয়ে নির্গত বিষবাষ্পে হতচেতন প্রায় দেবতা ও অসুররা। মন্থনরজ্জু বাসুকী যে হলাহলের কারণ একথা জানা থাকলেও ব্যাপারটা উপেক্ষা করেছিল সুরাসুর উভয়েই। অথবা সেটাই ছিল অনিবার্য। এবং সেটাও ছিল বিষ্ণুর এক কূটচাল। শ্রীবিষ্ণু জানতেন, মন্থনের সময় বাসুকীর মুখ থেকে নির্গত হবে হলাহল। তাই অসুরদের বিভ্রান্ত করতে মন্থনের সময় দেবতাদের নিয়ে তিনি ধরেন বাসুকীর মাথার দিকটা। অসুররা ভাবে সাপের লেজের দিকটা অশুভ। তাই তাদের সমবেত প্রতিবাদ, এ হবে না, বাসুকীর মুখের দিকটা ধরবে তারা।
এটাই তো চাইছিলেন বিষ্ণু। তাই কোনো তর্কে না গিয়ে বলেন, বেশ তাই হোক। দেবতারা ধরলেন বাসুকীর লেজের দিক আর অসুররা মুখের দিক। তাই বাসুকীর মুখ থেকে নির্গত হলাহলে অসুররাই হতচেতন হয়।
তবে একা অসুররা নয়, সারা বিশ্বচরাচরই যেন নীল হয়ে ওঠে বিষে। জগৎকে বাঁচাতে মহাদেব পান করেন সেই হলাহল। বিষের ক্রিয়ায় নীল হয়ে যায় তার কণ্ঠ। তাই তাঁর নাম হয় নীলকণ্ঠ।
হলাহল থেকে রক্ষা পেল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। কিন্তু বিষের জ্বালায় জ্বলতে থাকে শিবের দেহ। তাঁর সেই জ্বালা কমাতে তাঁর ভক্ত রাবণ বাঁকে করে গঙ্গাজল এনে ঢালেন রামেশ্বরে জ্যোতির্লিঙ্গ শিবের মাথায়। উপশম হয় সব জ্বালার। সেটা ছিল একটা শ্রাবণ মাস।
পুরাণ কথা, তারপর থেকেই শুরু শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় জলঢালার বা শিবের জলাভিষেকের জন্য শিবভক্তদের এই ‘কাঁওর যাত্রা’। জল আনার এই পদযাত্রায় এখন যোগ দেন ভারত ও নেপালের লক্ষ লক্ষ শিবভক্ত। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, ২০২৩ এবং ২০২৪-এ হরিদ্বারে শিবের এই জলাভিষেকে
যোগ দেওয়ার জন্য প্রায় তিন কোটি ভক্তের সমাবেশ ঘটে।
কিংবদন্তী, নীলকণ্ঠ মহাদেবকে বিষের জ্বালা থেকে মুক্ত করার জন্য ত্রেতা যুগে কেবল রাবণ নন, পরশুরামও বাঁকে করে গঙ্গাজল এনে পুরামহাদেব মন্দিরে শিবলিঙ্গে জল ঢালেন।
রাবণ বা পরশুরামের পায়ে হেঁটে গঙ্গা জল এনে শিবের মাথায় ঢালার এই ঘটনার পর থেকেই শিব ভক্তরা শ্রাবণ মাসে হন জলযাত্রী। খালিপায়ে গঙ্গাজল বাঁকে করে গঙ্গা অথবা কোনো পুণ্যতোয়া থেকে জল এনে ঢালেন শিবলিঙ্গে। ভারত জুড়েই হয় শিবের এই জলাভিষেক যাত্রা। এইসব যাত্রার মধ্যে নানা
কারণেই বিহারের সুলতানগঞ্জে বা অজগৈবীনাথ ধাম থেকে উত্তরবাহিনী গঙ্গাজল আনার ‘কাঁওরযাত্রা’ এক ভিন্নমাত্রা পেয়েছে।
যুবা থেকে বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, এমনকী বালক-বালিকারাও গৈরিক বসনে সেজে সুলতানগঞ্জ থেকে গঙ্গাজল নিয়ে বাঁকে করে বৈদ্যনাথধামে। তাঁদের ‘বোল ব্যোম’ ধ্বনিতে মুখর হয় আকাশ-বাতাস।
শ্রাবণেই কেন?
প্রশ্ন, শ্রাবণেই কেন জল ঢালা হয় শিবের মাথায়? পুরাণকথা, শ্রাবণ হলো শিবের অন্যতম প্রিয় মাস। এই মাসেই শিবের আবির্ভাব হয়, এমনটাই ভক্তদের বিশ্বাস। বিশ্বাস, এই মাসে শিবের মাথায় জল ঢাললে পূর্ণ হয় সকলের সব কামনা।
এই শ্রাবণের মাহাত্ম্য সম্পর্কে রয়েছে নানা কাহিনি ও জনশ্রুতি। বলা হয়, এই শ্রাবণেই হয়েছিল সমুদ্র মন্থন এবং এই মাসেই হলাহল পান করে শিব হন নীলকণ্ঠ।
আরেক কাহিনি, দক্ষযজ্ঞে দেহত্যাগের পর সতী হিমালয় গৃহে পার্বতী হয়ে জন্মান। এই শ্রাবণেই হয়েছিল শিব-পার্বতীর পুনর্মিলন। অর্থাৎ এ মাসেই হয়েছিল তাঁদের বিয়ে।
কেউ কেউ বলেন, এই শ্রাবণেই মহাদেব শ্বশুরবাড়িতে আসেন এবং তখন তাঁকে করা হয় নানাভাবে আপ্যায়ন। সে কথা স্মরণেই শ্রাবণে করা হয় শিবের জলাভিষেক।
অন্য কথায়, শিব কথা দিয়েছিলেন প্রজাপতি দক্ষকে, শ্রাবণ মাসে তিনি থাকবেন তাঁর বাড়িতে। তাই এ মাসের এতো গুরুত্ব। প্রচলিত ধারণা, শ্রাবণ মাসে শিব-পার্বতী এই মরলোকে ভ্রমণ করে ভক্তদের মঙ্গল করেন। সে কারণেই এই মাসে করা হয় শিবের বিশেষ পূজা।
অন্যান্য নানা বিষয়ের সঙ্গে এই শ্রাবণই হলো পুণ্য চাতুর্মাস্য ব্রত পালনের সূচনা মাস। দশনামী পরম্পরার সন্ন্যাসী ও সাধকরা চাতুর্মাস্য পালন করে থাকেন। চাতুর্মাস্য ব্রত পালন অন্যান্যদের পক্ষে সম্ভবপর নয়। সেই কারণেও বিশেষ করে গৃহী ভক্তরা এই মাসে শিবের আশীর্বাদ কামনায় তাঁর মাথায় জল ঢালেন।
শ্রাবণ মাসের বিভিন্ন দিনের মধ্যে সোমবার আবার বিশেষ মাহাত্ম্যযুক্ত। সোমবারই শিব-পার্বতী একসঙ্গে থাকেন বলে দিনটির গুরুত্ব ভক্তদের কাছে অনেক বেশি।
বৈদ্যনাথ ধাম
মধুবার সোমবার। বিশ্বাস, সোমবারেই আবির্ভূত হন শিব- মহেশ্বর। তাই এই পুণ্যবারে শিবের মাথায় জল ঢাললে অশেষ পুণ্য লাভ হয়। আর সে কারণেই বর্তমান ঝাড়খণ্ডের বৈদ্যনাথধামে নামে পুণ্যার্থীদের ঢল। অবশ্য সারা ভারতেই শিবভক্তদের কাছে শ্রাবণ মাস অতি পুণ্যমাস। প্রায় সর্বত্রই শিব মন্দিরগুলিতে ওই সময় দেখা যায় ভক্তদের ভিড়। কিন্তু নানা কারণেই বৈদ্যনাথ ধামে শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য পুণ্যার্থীরা যে অশেষ কৃষ্ণতা পালন করেন তা এক বিস্ময়। প্রায় ১০৫ কিলোমিটার দূর থেকে পদব্রজে গঙ্গাজল এনে বৈদ্যনাথ ধামে শিবের মাথায় জল ঢালেন তাঁরা।
শাস্ত্রমতে পূজিত শিবলিঙ্গের মধ্যে জ্যোতির্লিঙ্গগুলির রয়েছে বিশেষ মাহাত্ম্য। পুরাণমতে সারা দেশে রয়েছে ৬৪টি জ্যোতির্লিঙ্গ। এর মধ্যে বিখ্যাত হলো ১২টি।
সেই বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম বৈদ্যনাথ ধামের বৈদ্যনাথ। জ্যোতির্লিঙ্গগুলির মধ্যে বঙ্গপ্রদেশের সবচেয়ে কাছের শৈবতীর্থ হলো বৈদ্যনাথ ধাম। স্বভাবতই এই তীর্থ সম্পর্কে বঙ্গবাসীদের রয়েছে বিশেষ আগ্রহ। তবে শ্রাবণ মাসে বৈদ্যনাথে জল ঢালার জন্য শতাধিক কিলোমিটারের যে পদযাত্রা বা ‘কাঁওরযাত্রা’ হয়
তাতে বঙ্গবাসী প্রায় নগণ্য। তা সত্ত্বেও বঙ্গবাসীর কাছে বৈদ্যনাথ ধামের রয়েছে সবিশেষ মর্যাদা। রয়েছে এই মন্দির সম্পর্কে প্রবল আগ্রহ।
বৈদ্যনাথ ধামে এই জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরটি কবে নির্মিত হয়েছে সে সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য নেই। কিংবদন্তী, এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা। মন্দিরটির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্র।
পুরাণ কাহিনি, রাবণের তপস্যায় তুষ্ট হন মহেশ্বর। বর প্রার্থনা করতে বলেন তিনি রাবণকে। রাবণ অন্য কোনো বর নয়, কৈলাস থেকে একটি শিবলিঙ্গ নিয়ে যেতে চান লঙ্কায়। আপাত নিরীহ এই প্রার্থনায় সঙ্গে সঙ্গে রাজি মহাদেব। কিন্তু তাতে প্রমাদ গোনেন দেবতারা। শিবলিঙ্গ লঙ্কায় নিয়ে গেলে রাবণ হয়ে উঠবেন
তুলনাহীন ক্ষমতায় অধিকারী। তাতে বিপন্ন হবে ধর্ম। তাই মহাদেবকে ওই বর প্রত্যাহার করার জন্য প্রার্থনা জানান দেবতারা।
মহাদেব বলেন, যে কথা তিনি দিয়েছেন তা প্রত্যাহার করার কোনো কথাই ওঠে না। তবে রাবণ যাতে শিবলিঙ্গটি নিয়ে যেতে না পারেন, তার একটা ব্যবস্থা তিনি করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তাঁর চাই দেবতাদের সাহায্য।
দেবতারা এক কথায় রাজি। মহাদেব তখন বরুণদেবকে বলেন, তুমি রাবণের উদরে প্রবেশ করে তীব্র প্রস্রাব বেগ সৃষ্টি করো। অন্যদিকে রাবণকে বলেন, দেখো বাপু, শিবলিঙ্গ তুমি লঙ্কায় নিয়ে যেতে পারো অবশ্যই। তবে আমার একটি শর্ত আছে।
রাবণের সবিস্ময় জিজ্ঞাসা, শর্ত! কী আপনার শর্ত! বলুন, আমি সব কিছুই মানতে প্রস্তুত। মহাদেব বলেন, না, তেমন কঠিন কোনো শর্ত নয়। কৈলাস থেকে এই শিবলিঙ্গ নিয়ে তুমি সোজা যাবে লঙ্কায়। পথে কোথাও নামাবে না এটি। সাবধান, যদি কোথাও নামাও, তাহলে সেখানেই থেকে যাবে এই শিবলিঙ্গ। তখন হাজার চেষ্টা করলেও আর নড়াতে পারবে না এটিকে। তাই পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু নির্ভর করছে তোমার উপর।
সেই শর্তে রাজি হন রাবণ। স্নান করে পবিত্রভাবে তিনি গ্রহণ করেন ‘কামনা লিঙ্গ’। তারপর কৈলাস থেকে যাত্রা করেন লঙ্কার উদ্দেশ। তাঁর সেই যাত্রাপথে শ্রীবিষ্ণু তাঁর সামনে হাজির হন এক রাখালবালকের বেশে। বলেন নাম তাঁর বৈজু গদরিয়া। বৈজুর সঙ্গে কথা বলে খুবই খুশি হন রাবণ। এই সময় তাঁর প্রস্রাব পায়। বৈজুকে বিশ্বাস করে ‘কামনা লিঙ্গ’ মূর্তিটি ধরার জন্য অনুরোধ করেন। বলেন, ভুলেও মুর্তিটি মাটিতে রাখবে না। বৈজু বলে ভয় নেই, তুমি যাও তোমার কাজ সেরে এসো।
সরল বিশ্বাসে তার হাতে কামনা লিঙ্গ তুলে রাবণ শৌচ ইত্যাদি ক্রিয়াকর্ম শেষে করেন সূর্যপ্রণাম। সব কিছু সেরে মনের আনন্দে ফেরেন রাবণ। ফিরে অবাক এবং আতঙ্কিত রাবণ। নেই সেই বালক, বৈজু। সে উধাও হয়েছে শিবলিঙ্গটি মাটিতে রেখে। এস্তে রাবণ তুলতে যান সেই শিবলিঙ্গ। পারেন না। প্রথমে হালকা ভাবেই চেষ্টা করেছিলেন। শেষ সর্বশক্তি দিয়ে লিঙ্গটি তুলতে যান। কিন্তু সেই কামনা লিঙ্গ একবারে অচল। মনে হয় তার গোড়া পাতাল ভেদ করে চলে গেছে অনেক অনেক নীচে। বহু চেষ্টাতেও শিবলিঙ্গটি তুলতে না পেরে বুড়ো আঙুল দিয়ে তাঁর মাথায় জোরে চাপ দেন। তাতে আংশিক ক্ষতি হয় শিবলিঙ্গটির।
চলে যান রাবণ। তারপর দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা এখানে মন্দির তৈরি করে দেন। রাবণের আনা শিবলিঙ্গের ওপর মন্দির বলে বৈদ্যনাথ ধামটি রাবণেশ্বর ধাম নামেও পরিচিত। সাধারণত শিব মন্দিরের মাথায় থাকে একটি ত্রিশূল। কিন্তু বৈদ্যনাথ মন্দিরের মাথায় রয়েছে পাঁচটি ত্রিশূল।
জ্যোতির্লিঙ্গের কথা
বৈদ্যনাথ ধামের শিবলিঙ্গটি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। শিব পুরাণের মতে, একবার ব্রহ্মা ও বিষ্ণু জড়িয়ে পড়েন এক দ্বন্দ্বে। দু’জনেই নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করেন। তা নিয়েই বাদানুবাদ। সেই সময় শিব এক আলোক স্তম্ভ রূপে আবির্ভূত হন সেখানে। সেই স্তম্ভের আদি অন্ত জানার জন্য ব্রহ্মা ও বিষ্ণু যথাক্রমে উপরে ও নীচের দিকে যাত্রা শুরু করেন। বহুদিন পরে আদি অন্তের হদিশ না পেয়ে ফিরে আসেন দু’জনেই। ব্রহ্মা কিন্তু মিথ্যে বলে দাবি করেন তিনি পৌঁছেছিলেন স্তম্ভের মাথায়। ব্রহ্মার মিথ্যাভাষণে ক্রুদ্ধ শিব অভিশাপ দেন, জগতে ব্রহ্মা আর কখনো পূজা পাবেন না। আর বিষ্ণু হবেন জগদ্বন্দনীয়।
শিবের এই আলোক স্তম্ভটি জগতে জ্যোতির্লিঙ্গ হিসেবে পরিচিত।
বৈদ্যনাথ ধাম শক্তিপীঠও বৈদ্যনাথ কেবল মহা শিবতীর্থ নয়, বৈদ্যনাথ আবার শক্তিপীঠও। সুদর্শন চক্রে খণ্ডবিখণ্ডিত সতীর হৃদয় পড়েছিল এই বৈদ্যনাথে। সে কারণে এটি একান্ন সতীপীঠের অন্যতম। আর সে কারেণই একই সঙ্গে শিব ও শক্তির আরাধনার জন্য ভক্তরা ছুটে আসেন বৈদ্যনাথ ধামে।
সব কামনা পূর্তির আশায় সুদূর অজগৈবীনাথধাম থেকে পায়ে হেঁটে গঙ্গাজল বয়ে এনে শিবের জলাভিষেক করেন লক্ষ লক্ষ ভক্ত শ্রাবণের সোমবারগুলিতে।
পুনশ্চ:
ভক্তরা বছরের পর বছর বাঁকে জল নিয়ে যান শিবতীর্থগুলিতে। কিন্তু ২০২৫-এ ভক্তি ও বিশ্বাসের এক নতুন নজির গড়েছেন একুশ বছরের হরনাম প্রসাদ। এক অভূতপূর্ব ‘কাঁওর যাত্রা’ করেছেন তিনি। ১০৫ দিন ধরে হেঁটে জব্বলপুর থেকে অমরনাথে গিয়ে শিবের মাথায় জল ঢেলেছেন তিনি। অতিক্রম করেছেন ১৭০০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ। বলেছেন, এক দৈবী ও ঐতিহাসিক পদযাত্রা— তথা শিবের জলাভিষেকের এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা।