ভাঙা পা থেকে ভাষা আন্দোলন : চতুর্থবার ক্ষমতার লড়াইয়ে মমতার বাঙ্গালি প্রীতির মুখোশ
সাধন কুমার পাল
ভাঙা পায়ের খেলা মমতা ব্যানার্জি ২০২১ সালে দেখিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেই নাটক মমতা ব্যানার্জিকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। ২০২৫ সালে আবার এক নতুন নাটক। বাঙ্গালি ও বাংলাভাষা রক্ষার নাটক। তিনি আসলে পশ্চিম বাংলাভাষা ও বাঙ্গালি নিয়ে কখনোই ভাবেন না। সেরকম ভাবলে শুধু তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময়ে ৮২০০ বাংলা মাধ্যমের স্কুল বন্ধ হয়ে যেতো না। যেসব স্কুলে বাংলা শেখার কথা সেই বাঙ্গালিরা যাদের সামর্থ্য আছে তারা ইংরেজি মাধ্যম, হিন্দি মাধ্যমে গিয়ে ভর্তি হচ্ছে। তিনি যদি সত্যিই বাঙ্গালিদের কথা ভাবতেন তাহলে পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ ছেলে-মেয়ে অন্য রাজ্যে গিয়ে শুধু পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করার জন্য ভিড় জমাতো না। তিনি যদি বাংলাভাষা নিয়ে ভাবতেন তাহলে তিনি কেন হিন্দিতে ভাষণ দেন? অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কেন ইংরেজিতে ভাষণ দেন? তিনি ভাষা আন্দোলন ঘোষণা করতে গিয়ে যে কটা বাক্য বলেছেন তার মধ্যে ৫০ শতাংশ হিন্দি। তিনি যদি সত্যিই বাংলা নিয়ে ভাবতেন তাহলে গুজরাট থেকে ইউসুফ পাঠানকে এনে পশ্চিমবঙ্গের এমপি বানাতেন না, বিহার থেকে কীর্তি আজাদ, শত্রুঘ্ন সিনহাদের ধরে এনে বঙ্গের প্রতিনিধি বানাতেন না। তিনি যদি সত্যিই বাংলা নিয়ে ভাবতেন তাহলে অসম থেকে সুস্মিতা দেবকে, দিল্লি থেকে সাগরিকা ঘোষকে নিয়ে এসে পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রতিনিধি বানাতেন না। গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফ্যালেইরোকে তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভার সদস্য করে পাঠাতেন না। পশ্চিমবঙ্গে কি বাংলাভাষী মানুষ নেই? এটা কি মমতার বাংলা ও বাঙ্গালি প্রীতির নিদর্শন?
২৬ হাজার বাংলা মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকের চাকরি চলে গেছে। ৪২০০০ বাংলা মাধ্যমের প্রাথমিক স্কুলের চাকরি যায় যায় করছে। ইসলামপুরে রাজেশ, তাপস বাংলা শিক্ষকের দাবি করেছিল বলে পুলিশ তাদের গুলি করে মেরেছে। এরপরেও বলতে হবে মমতা ব্যানার্জি বাংলাভাষা ও বাঙ্গালিকে ভালোবাসেন। বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে আসা হিন্দু বাঙ্গালিদের নিশ্চিতভাবে ভারতের নাগরিক হিসেবে এ রাজ্যে বসবাস করার জন্য ২০১৯ সালে কেন্দ্র সিএএ আইন এনেছিল। মমতা ব্যানার্জি সেই আইনের সবচাইতে বেশি বিরোধিতা করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সেই নিয়ে প্রস্তাবও পাশ করিয়েছিলেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে মমতা ব্যানার্জি চান না বাঙ্গালিরা এরাজ্যে নিশ্চিন্তে নিরাপদে বাস করুক। প্যালেস্টাইন নিয়ে সোচ্চার হলেও বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নারকীয় অত্যাচার হলেও কোনোদিন একটি বাক্য মমতা ব্যানার্জি উচ্চারণ করেনি। অসমে এনআরসি যখন হয়েছিল তখন পশ্চিমবঙ্গের যেসব মেয়ে অসমে বিয়ে হয়েছে, তাঁদের ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশনের জন্য নিজের বাপের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে এসে ডিএম অফিস, এসডিও অফিসে ঘুরতে ঘুরতে ওদের চপ্পল ক্ষয় হয়ে গেছে তবুও তারা সেই ডকুমেন্ট পায়নি অর্থাৎ এই রাজ্যের প্রশাসন তাদেরকে কোনোভাবেই সহায়তা করেনি। যার ফলে অনেকেরই অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে।
একটু মনে করুন বাঙ্গালির দুর্গাপূজাতেও মমতা ব্যানার্জির বাঙ্গালি বিরোধিতার নিদর্শন মনে পড়ে কিনা। ২০১৭ সালে দশমী পড়েছিল ৩০ সেপ্টেম্বর। পরের দিন ১ অক্টোবর মহরম। মমতা ব্যানার্জি নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল, দশমীর দিন সন্ধে ৬টার পর থেকে ১ অক্টোবর পুরো দিন বিসর্জন বন্ধ থাকবে। ফের ২ থেকে ৪ অক্টোবর প্রতিমা নিরঞ্জন করা যাবে। বাঙ্গালির দুর্গাপূজাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার জন্য তিনি বিসর্জনের কার্নিভাল চালু করেছেন এবং তাতে মহরমের লাঠি খেলার মতো ইসলামি মজহবি ক্রিয়াকলাপের অনুমতি দিয়েছিলেন। এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যাবে যার থেকে প্রমাণ হয় তিনি পশ্চিমবঙ্গের এবং বাঙ্গালির প্রতি বিশেষ করে হিন্দু বাঙ্গালির প্রতি কতটা নির্মম নির্দয়। সেই মমতা ব্যানার্জি এখন আবার নাটক শুরু করেছেন এই রাজ্যের ও বাঙ্গালি প্রীতির। এই নাটকের উদ্দেশ্য চতুর্থবার পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসীন হওয়া।
আসলে মনে হয় মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় আসার জন্য যা করছেন জেনে বুঝেই করছেন। তিনি ভালো করেই জানেন যে অনুপ্রবেশকারীদের ভোটে ক্ষমতায় আসার অর্থ হিন্দু বাঙ্গালির কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়া। কারণ আজকে বিরোধীরা যা বলছে তিনি ২০০৫ সালে সেই একই কথা বলেছিলেন। তিনিই ২০০৫ সালে ভারতের সংসদে অনুপ্রবেশের বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন।
২০০৫ সালের ৪ আগস্ট, তিনি লোকসভায় বলেছিলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ এক বিপর্যয়ের রূপ নিয়েছে।’ সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের একটা ইস্যু তুলতে গিয়েছিলাম যে ইস্যু এই রাজ্যের মানুষকে খুব ভাবাচ্ছে। আগামী দিন রাজের মানুষ আর এখানে থাকতে পারবে কিনা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অনুপ্রবেশের ইস্যু নিয়ে রাজ্যপাল বলছেন যে এটা টাইম বোমার মতো। হোম মিনিস্ট্রি থেকে শুরু করে সবাই বলছেন অনুপ্রবেশ বিষয়টা এমনও হয়ে গেছে যে ছাত্র যুব থেকে শুরু করে রাজ্যের মানুষের বাঁচার জায়গা নেই।’
মমতা ব্যানার্জি ভালো করেই জানেন সময়ের সঙ্গে সেই টাইম বোমা ভয়ংকর শক্তিশালী হয়েছে। কারণ তিনি ক্ষমতায় এসে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেননি। বরং তিনি দশ হাজার মাদ্রাসার স্বীকৃতি দিয়ে এই অনুপ্রবেশকারীদের ভিত্তি আরও শক্ত করেছেন। শিমুলিয়া বা খাগড়াগড়ের ঘটনা এই কথাই প্রমাণ করে। বাংলাদেশের সরকারি মদতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই ভারতের অন্য রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতজুড়েই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হচ্ছে। শুধু বিজেপি শাসিত রাজ্য নয় তামিলনাড়ু ও কেরালার মতো ইন্ডিজোটের আওতায় থাকা রাজ্যগুলিতেও এই ধড়পাকড় শুরু হয়েছে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি মরিয়া হয়ে উঠেছেন এই অনুপ্রবেশকারীদের রক্ষা করার জন্য। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, মমতা ব্যানার্জি কি একাত্তর সালের পূর্ব পাকিস্তানের মতো বাঙ্গালি আবেগ উসকে দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন? একাত্তরের সেই বাঙ্গালি আবেগ ছিল পাকিস্তানের কবজা থেকে পূর্ববঙ্গকে
আলাদা করার আন্দোলন। সেই ইতিহাসের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলতে হবে এবার মমতা ব্যানার্জির ভাষা আন্দোলন অবশ্যই ‘ভারতের বিরুদ্ধে’, ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গকে পৃথক করার জন্য।
একাত্তরে বাঙ্গালি আবেগ তৈরি হয়েছিল, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম ছিল যার পরিণাম। সেদিন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাংলাভাষী মাত্রই সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। জন্ম নিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু কিছুদিন বাদেই হিন্দু বাঙ্গালিরা বুঝলেন বিরাট ভুল হয়ে গেছে সেই আন্দোলনে নিজেদের উজাড় করে দিয়ে। সেই বাঙ্গালি আবেগ ছিল আসলে স্থানীয় মুসলমানদের ক্ষমতা দখলের লড়াই। সেই ক্ষমতা অর্জনের পর হিন্দুদের উপর শুরু হয়েছিল চরম অত্যাচার, যে অত্যাচার এখনো চলছে। সেই বাংলাদেশ এখন একটি কট্টর ইসলামি দেশ, যেখানে কোনো বাঙ্গালি আবেগ নেই। রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতি সেদেশে মুছে দেওয়া হচ্ছে।
মমতা ব্যানার্জি মুসলমান ভোটব্যাংকের সাহায্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে ঠিক একই ধরনের বাঙ্গালি আবেগ তৈরি করে গ্রেটার বাংলাদেশের নীলনকশা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। নির্বাচনে জেতার জন্য আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত মুখ্যমন্ত্রীর হাতে আর কোনো অস্ত্র নেই। ফলে কাল্পনিক বাঙ্গালি আবেগ উসকে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে কাশ্মীর বানিয়ে হলেও তিনি ভোটে জিততে বদ্ধপরিকর। এহেন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের আগে বলছেন ভাষা আন্দোলন হবে। ভাবুন, ভালোভাবে ভাবুন, নিজের সমস্ত দুর্নীতি, কুকীর্তি, ব্যর্থতা, রাজ্যটাকে উচ্ছন্নে পাঠানোর ট্র্যাক রেকর্ড সবকিছুকে ঢেকে দেওয়ার জন্য নতুন সুযোগ ‘বাংলাভাষা বিপন্ন’ জিগির তোলা।
মুখ্যমন্ত্রী শুধুমাত্র চটকদারি রাজনীতি করে ভোটে জেতার জন্য অনুপ্রবেশকারীদের সহায়তা করছেন এরকম মনে করার কারণ নেই, কেননা বিগত দিনে তিনি অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছেন যার থেকে বলা যায় তিনি সুস্পষ্টভাবেই অনুপ্রবেশকারী মুসলমানদের সহায়তা নিয়েই বছরের পর বছর পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চান। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন সেই ঐতিহাসিক দিন যেদিন বঙ্গের আইন সভায় ভোটাভুটি সম্পন্ন হয়। সেদিন রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সমস্ত বাঙ্গালি হিন্দু রাজনৈতিক নেতা তাঁদের ঐক্য প্রদর্শন করেন। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তারা ভোট দেন হিন্দু বাঙ্গালির পৃথক রাজ্যের পক্ষে। জন্ম নেয় পশ্চিমবঙ্গ নামে ভারতবর্ষের এই অঙ্গরাজ্য। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠা দিবস ঐতিহাসিক এই ২০ জুন তারিখটিকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রী উঠেপড়ে লেগেছেন।
২০২১ সালে ২০ জুন রাজভবনে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালিত হবে এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সে সময় রাজভবনের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্যপালকে চিঠি লিখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসকে চিঠি লেখেন তিনি। লেখেন, ‘আমি মর্মাহত যে আপনি ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠাদিবস পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ এই ধরনের অনুষ্ঠান না করার জন্য রাজ্যপালকে অনুরোধ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি এখনো বলে থাকেন ২০ জুন নাকি বঙ্গ বিভাগের দিন। মমতা ব্যানার্জির কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই যে, সেদিন বঙ্গ ভাগ হয়ে পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি না হলে হিন্দুরা কোথায় যেতো?
সেদিন জিন্নার দল মুসলিম লিগও অখণ্ড বঙ্গের পক্ষে ছিল। মমতা ব্যানার্জির রাজনীতির ধারা বলছে তিনি মুসলিম লিগের সেই অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্ব নিয়েছেন। সেজন্যই তিনি হিন্দু বাঙ্গালির রক্ষাকবচ নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করছেন এবং বাংলাদেশের স্লোগান ‘জয় বাংলা’ পশ্চিমবঙ্গের স্লোগানে পরিণত করেছেন।
শুধু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান নয়, ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবসের বিরোধিতা করে তিনি ‘পহেলা বৈশাখ’ পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠা দিবস পালন, সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের জন্য পৃথক রাজ্য সংগীত চালু করতে চাইছেন। তাঁর প্রত্যেকটা পদক্ষেপ ধাপে ধাপে বাংলাদেশের জেহাদি শক্তির স্বপ্নের বৃহত্তর বাংলাদেশের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।
এখন শুধু মমতা ব্যানার্জির প্রয়োজন এই ভাষা আন্দোলনের নামে সেই আবুল বরকত, ওহিদুল ইসলাম, আব্দুস সামাদের মতো কয়েকজন শহিদ। তাহলেই কেল্লাফতে। সেরকম কিছু ঘটলে ২০২৬-এ মমতা ব্যানার্জিকে ক্ষমতায় আসা থেকে কেউ আটকাবে সেই সাধ্য কার? এজন্য যারা তৃণমূল করছেন, নাটুকে ভাষা আন্দোলনে যাচ্ছেন, তারা সাবধান থাকবেন। দু’ চারটা লাশ ফেলে মমতা ব্যানার্জি যে ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করবেন না তার কিন্তু কোনো নিশ্চয়তা নেই।