কলকাতা বি কে পাল পার্কে নৃত্যকালীমাতার পূজা
সপ্তর্ষি ঘোষ
উত্তর কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে বি কে পাল পার্কে সর্বজনীন নৃত্যকালীমাতার পূজা আজও সাড়ম্বরে উদ্যাপিত হয়। এই পূজা অনুষ্ঠিত হয় মহালয়ার এক মাস আগে ভাদ্র মাসের অমাবস্যায়। এই পূজা শুরুর নেপথ্যে এক জনশ্রুতির কথা জানা যায়। দ্বিশতাধিক বছর আগে শোভাবাজার অঞ্চলে গঙ্গা তীরবর্তী বেনিয়াটোলা স্নানের ঘাটে ‘মোহনটুনি’ নামে একজন শক্তি সাধিকার আবির্ভাব ঘটে। ধ্যানে এই সাধিকার মনে যে মূর্তির উদয় হয়, সেই মূর্তিই ‘নৃত্যকালী’ মাতা রূপে দুশো ছাপ্পান্ন বছর ধরে পূজিতা হচ্ছেন। সাধিকা ‘মোহনটুনি’কে নৃত্যকালী পূজার প্রতিষ্ঠাত্রী হিসেবে গণ্য করা হয়। শোভাবাজার আহিরিটোলা এলাকায় ‘মোহনটুনির ঘাট’ নামটিও সেই সন্ন্যাসিনীর স্মৃতি বহন করছে। ১১৭৭ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে (ইংরেজি ১৭৭০ সাল) নৃত্যকালীমাতার পূজার সূচনা হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।
নৃত্যকালীমাতার সঙ্গে অন্যান্য দেব-দেবীও আসীন। মধ্যস্থলে শায়িত মহাদেবের বক্ষে নৃত্যরতা মাতৃমূর্তি। দুই পাশে সহচরীদ্বয়- জয়া ও বিজয়া। সম্মুখে সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের প্রতীক ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং সিদ্ধিদাতা গণেশ। নৃত্যকালীমাতার সঙ্গে সকলেই পূজিত হন। এছাড়া শৌর্য বীর্যের প্রতীক হিসেবে দুই পাশে দুই ঘোড় সওয়ার, নৃত্যগীতের প্রতীক বেশ কয়েকটি পরি এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও সময়ানুবর্তিতার প্রতীক এক সুদৃশ্য চিল ঘড়ি দেবীর চালচিত্রের শোভাবর্ধন করছে। এরকম অভিনব মূর্তি খুব কম দৃষ্টিগোচর হয়।
বৈশাখ মাসে গন্ধেশ্বরী পূজার দিন কাঠামো পূজা হয় এবং রথযাত্রায় প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়। বর্তমান কাঠামোটি শতাধিক বছরের প্রাচীন বলে উদ্যোক্তাদের দাবি। একই পরিবারের মৃৎশিল্পীরা বংশপরম্পরায় প্রতিমা তৈরি করছেন। প্রতিমার সাজসজ্জাও মালাকারগণ পুরুষানুক্রমে করে আসছেন। সুষ্ঠুভাবে নৃত্যকালীমাতার পূজানুষ্ঠান সম্পন্ন করতে ১৩৭২ বঙ্গাব্দে একটি স্থায়ী ভাণ্ডার গঠন করা হয়েছে। অতীতে পূজায় ছাগ, মেঘ ও মহিষ বলিদানের প্রথা ছিল। ১৩১৪ বঙ্গাব্দ থেকে বলিপ্রথা বন্ধ হয়েছে।
শোভাবাজার অঞ্চলে বিভিন্ন স্থানে পূজা অনুষ্ঠিত হবার পরে ১৩৭১ বঙ্গাব্দ থেকে বি কে পাল পার্কে নৃত্যকালীমাতার পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২১ আগস্ট থেকে চারদিন ব্যাপী পূজানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। পূজাপ্রাঙ্গণে সপ্তাহব্যাপী মেলা বসবে। এবছর পূজা ২৫৭তম বর্ষে পদার্পণ করলো।
২৪ আগস্ট রবিবার সন্ধ্যায় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে মাতৃপ্রতিমা এলাকা পরিক্রমা করে আহিরিটোলা ঘাটে নিরঞ্জন হবে। পরম্পরা বজায় রেখে তরুণ কর্মীরা উৎসাহ সহকারে প্রতিমা কাঁধে করে গঙ্গাবক্ষে নিয়ে যায়। একই কাঠামোয় দুশো ছাপ্পান্ন বছর ধরে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেজন্য কাঠামো বিসর্জিত হয় না। নিরঞ্জনের আগে প্রতিমা বরণ এবং সিঁদুর খেলায় পল্লীর মহিলাদের অংশগ্রহণ নৃত্যকালীমাতার মাহাত্ম্য প্রকাশ করে।