মনসা পূজা ও রাঢ় অঞ্চল
প্রবীর কুমার রায়
নাগেদের অর্থাৎ সাপের দেবী হিসেবে মনসা পূজা বরেন্দ্রভূমিতে আষাঢ়ের নাগপঞ্চমীতে শুরু হয় ও শ্রাবণ মাস ছাপিয়ে ভাদ্র মাসে তার সমাপ্তি ঘটে। পুরাণে মা মনসার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে মনসা, ঋষি কাশ্যপ ও নাগ মাতা কদ্রু কন্যা।কিন্তু পুরাণে মনসা অনেকটাব্রাত্য। দেবী হিসেবে পুজা পাননি। আমরা এখন যে মনসা দেবী দেখি তার সৃষ্টি ১৪০০-১৭০০ খ্রিস্টাব্দেরমধ্যে মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতাদের হাত ধরে। এখানে মনসা শিব কন্যা,বাসুকি নাগের ভগিনী, জরৎকারু মুনির স্ত্রী ও আস্তিক মুনির মা। এখানে মনসা বণিক চাঁদ সওদাগরের হাতে পুজিতা ও সমগ্র বরেন্দ্রভূমিতে সমাদৃতা।
এতো গেল বরেন্দ্র বঙ্গের কথাযার একটা বড়ো অংশ অধুনা বাংলাদেশ। মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়িতারা প্রায় সকলেই বরেন্দ্র ভূমির। কিন্তু আজকের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে মনসা পুজার সঙ্গে রাঢ় অঞ্চলের সম্পর্ক।রাঢ় অঞ্চল বলতে বোঝায় বীরভূম জেলার পশ্চিমাংশ, ঝাড়গ্রাম-সহ সমগ্র পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, সাবেক পুরুলিয়া জেলা ও বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের পশ্চিমবঙ্গ সংলগ্ন অঞ্চল সমূহ। রাঢ় অঞ্চলে মনসা দেবী হচ্ছেন ঘরের কন্যা। এখানে দেবী উর্বরতা ও প্রজননের প্রতীক। এই অঞ্চল ছোটো ছোটো পাহাড়,টিলা,জঙ্গল, লেক, পাহাড়ি ধরনা দিয়ে সাজানো প্রকৃতিরঅপরূপ সৃষ্টি। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সর্প ভীতি। তাই একমাত্র শ্রাবণ মাসের সংক্রাস্তিতে এই রাঢ় অঞ্চলে মহা ধুমধাম সহকারে মনসা পূজা হয়ে থাকে। এই অঞ্চলে বসবাস করেন কুর্মি সম্প্রদায়ের বৃহৎ অংশ শবর, বাউরি, ভূমিজ,মুদি,কোরা, সাঁওতাল, কুমোর,তামবুলি ও সরাক সম্প্রদায়।আর আছে অল্পসংখ্যক মৈথিলী, বরেন্দ্র ও উৎকল ব্রাহ্মাণ। উৎকল ব্রাহ্মাণদের পদবী হচ্ছে দাস, পাত্র, দেওঘরিয়া, বেলথরিয়া ইত্যাদি।
কালক্রমে স্থানীয় সামন্ত রাজা,জমিদারদের হাত ধরে মনসা পূজা এইসব অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। শহর-প্রাম সর্বত্রই আড়ম্বরের সঙ্গে মনসা পূজা হয়ে থাকে। তবে শহরের তুলনায় প্রামাঞ্চলে উন্মাদনা বেশিদেখাযায়। এই পূজাকে কেন্দ্র করে নতুন জামাকাপড় কেনার চল আছে। উন্মাদনায় টুসুর পরেই এই পূজার স্থান। এই পূজা মূলত গৃহস্থের বাড়িভিত্তিক ও কোথাও কোথাও ক্লাবভিত্তিক হয়ে থাকে। পূজার উপকরণে যেখানে যে জিনিস পাওয়া যায় সে দিয়েই হয়ে থাকে। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এখানকার মনসা পূজাতে ব্রাহ্মাণ পুরোহিত বাধ্যতামূলক নয়। গৃহকর্তাবা গৃহকর্ত্রী পূজারি হতে পারেন। এই পুরোহিতকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘দেছরি’। তবে তিনি পূজা করবেন বা ঘট ভরার জন্য পুকুরে, নদীতেবা ঝরনায় জল আনতে যাবেন তাদের নতুন বা শুদ্ধ বস্ত্র পরিধান ও উপবাস থাকা বাধ্যতামূলক। আর পূজার মন্ত্র মূলত স্থানীয় ভাষার সুরে মনসামঙ্গলের পাঁচালী। এই পূজার আর একটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে বলি প্রথা, যা বাধ্যতামূলক।মূলত হাঁস বলি হয়ে থাকে। এছাড়াও অর্থবানগৃহস্থের বাড়িতে অথবা দেবতার কাছেমানত থাকলে ভেড়া, পাঠাও বলিহয়ে থাকে। তবে পাঠা থেকে ভেড়া বলির প্রচলন বেশি। রাঢ় অঞ্চলে মনসা পূজা আর একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পান্না ব্রত।
শ্রাবণমাসের সংক্রান্তিতে সূর্যাস্তের পর রাত্রেমনসা পুজাহয়ে থাকে। পূজা সমাপনে হবে বলিদান। বলির শুরুতে অবশ্যই থাকবে আখ, চাল কুমড়ো বলি। তারপর পশু বলি। পরের দিন এই রান্না করা মাংস খেয়ে ব্রত বা উপবাস ভাঙা বাধ্যতামুলক। এই প্রথাকে বলা হয় পান্না। এইকাজটি খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করা হয়।
সাধারণত সংক্রান্তির দিন দুপুর দুটোর পরে অফিস কাছারি ফাঁকা হতে থাকে ও পরের দিন অফিসে উপস্থিতির হার নাই বললেই চলে। বিকাল থেকেই বেসরকারি যানবাহন চলাচল বন্ধ হতে থাকে ও পরের দিন বেশিরভাগ বেসরকারি যান চলে না, দোকান, হোটেল খোলা থাকে না। কর্মচারীদের পূর্ণ ছুটি। এর কারণ হচ্ছে আরাম করে দেবীর কাছে উৎসর্গকৃত মাংস ভক্ষণ। যাতে সাপের কামড়ানো থেকে মা রক্ষা করেন।
লক্ষ্য করুন বিদ্যার দেবী সরস্বতীর মতোই মা মনসার বাহন হচ্ছে হাঁস।অথচ মনসা পূজার রাত্রে হাজার হাজার হাঁস বলি হয়ে থাকে।আরও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ওইসব পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় হাঁস চাষ হয় না। পুরো হাঁস রপ্তানি হয় উত্তরবঙ্গ থেকে। বিশেষ করে মালদার গাজোল, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, দিনাজপুর জেলা থেকে। পাঁঠা, ভেড়া স্থানীয়। এসব অঞ্চলে আগে অধিকাংশ অধিবাসী ছিলেন অর্থনৈতিকভাবে অনেকটাই দুর্বল তাই হয়তো পাঁঠাবা ভেড়ার পরিবর্তে ব্যাপক হারে হাঁসবলি দেওয়ার রেওয়াজ চালু হয়েছে। উত্তরবঙ্গে রাজবংশী তথা পলিয়াসম্প্রদায়ের মধ্যে কোথাও কোথাও হাঁস বলি দেখা যায়। তবে বর্তমানে মনসা পূজা বৃহত্তর রাঢ় অঞ্চলে সার্বজনীন উৎসবের রূপ নিয়েছে।