জয় করেও ভয় কেন দিদির?
ভীতুশ্রী দিদি,
রাগ করলেন নাকি! আপনার অনুপ্রেরণাতেই এই সম্বোধন। আপনি যেমন সব কিছুতেই ‘শ্রী’ যুক্ত করেন তেমনই করলাম। ‘শ্রী’ মানে সুন্দর। আর আপনার এই ভয়টা সত্যিই সুন্দর। কিন্তু আর কত ভয় পাবেন বলুন তো আপনি? ভোটার তালিকা নিয়ে ভয়, নানা মামলায় আদালতের রায় নিয়ে ভয়। সে নয় ঠিক আছে, কারণ সেই অন্যায়গুলো আপনি বা আপনার সরকার বা আপনার দল করেছে। কিন্তু দিদি কিন্তু ১৯৪৬ সালে তো তৃণমূল ছিল না। আপনারও তো মর্ত্যে আবির্ভাব হয়নি! তবে সেই ঘটনা নিয়ে সিনেমার ট্রেলার লঞ্চ কেন বন্ধ করে দিল আপনার পুলিশ? কলকাতায় ঠিক কী কী
ঘটেছিল ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট। যার জন্য ৭৮ বছর পরেও আপনি ভয় পাচ্ছেন?
পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস্’ চলচ্চিত্রের টিজার প্রকাশ্যে আসার পরেই তাঁর বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন আপনার দলের এক নেতা। আর কলকাতায় ট্রেলার প্রকাশ অনুষ্ঠান বানচাল করে দিল আপনার পুলিশ। সংবাদমাধ্যমের সামনে পরিচালক বিবেকের
সঙ্গে পুলিশ খারাপ ব্যবহার করেছে। একটা ট্রেলার লঞ্চ নিয়ে এতো ভয় কেন? ওই গণহত্যার খলনায়কের নাম হোসেন সইদ সুরাবর্দি। এটা ঐতিহাসিক সত্য। তবে কি সুরাবর্দির পরিচয় নিয়েই আপনার ভয়? দুধেল গাইয়েরা রেগে যেতে পারেন? কিন্তু ইতিহাস তো ইতিহাস। এই যে আপনি লন্ডনে গেলেন।
ওরা কত খাতির করল। তা বলে কি ব্রিটিশদের অত্যাচারের ইতিহাস বলা যাবে না! সাত খুন মাফ হয়ে গেল! সেটা তো নয়।
আপনার দল বলছে, ‘গুজরাট ফাইলস্’ কেন বানানো হয়নি। হয়েছে দিদি হয়েছে। অনেক হয়েছে। এখনই আমার যে কটা নাম মনে পড়ছে তার মধ্যে কাই পো চে, পারাযানিয়া, ফাইনাল সল্যুশন, ফিরাগ, দ্য সবরমতি রিপোর্ট অনেক ছবিই হয়েছে। প্রতিটি ছবিতেই নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। তবে তিনি মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়েও ছবিগুলি রমরমিয়ে চলেছে। কেউ বাধা দেয়নি। আর ‘বেঙ্গল ফাইলস্’ তো ৭৮ বছর আগের ঘটনা। তাহলে
ভয় কোথায়? তাছাড়া ক’দিন পরে ছবিটা যদি কোনো ওটিটি-তে চলে আসে তখন? বাধা দিতে পারবেন আপনি?
দিদি, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, কলকাতায় কোনো দাঙ্গা হয়নি ১৯৪৬ সালে। সেটা ছিল ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস’। নির্মম হিন্দু নরসংহার। সেই সময়ে কলকাতায় যত মানুষের নিধন হয়, যত সম্পত্তি ধ্বংস হয়, অতীতে তার নজির মেলে না। ওই ঘটনার পরেই মুসলিম লিগ এবং জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা ব্রিটিশের দেশভাগের পরিকল্পনায় সায় দেয়। কমিউনিস্ট ও কংগ্রেস সমর্থন দিলেও তৃণমূল সেই সময়ে দেশভাগে সমর্থন দেয়নি। কারণ, আপনারা তো ছিলেনই না।
মুসলিম লিগ আগেই ১৬ আগস্ট ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে ঘোষণা করে। হত্যালীলা শুরুর দিন বঙ্গপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে ট্রাফিক
নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। ১৬ আগস্ট দুপুরের পর থেকেই পরিস্থিতির উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল পুলিশ। বিকেল তিনটের মধ্যে পুলিশ কমিশনার ফোন করে গভর্নরকে অনুরোধ করেন সেনা নামাতে। অনুরোধ খারিজ করা হয়। অনেকে এটাও বলেন যে সুরাবর্দির নির্দেশ মতোই কাজ করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার সিক্সস্মিথ।
দিদি, কলকাতা পুরসভা তখন প্রতি শনিবার একটি করে গেজেট প্রকাশ করত। তার ৪৫তম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ২৪ আগস্ট, ১৯৪৬। সেখানে যা লেখা রয়েছে তাতে কলকাতা, হাওড়ার রাস্তা থেকে মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল ৩ হাজার ৪৬৮টি। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন মৃত্যুর সংখ্যা কোনোমতেই ১০ হাজারের কম ছিল না।
কলকাতায় প্রতিরোধ গড়ার ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। শুনেছি বিবেকের ছবিতে সেই কাহিনি রয়েছে। পারিবারিক মাংসের ব্যবসা থাকায় তিনি ‘গোপাল পাঁঠা’ নামে বেশি পরিচিত। প্রতিরোধ গড়তে তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। ঐতিহাসিক রমশেচন্দ্র মজুমদারের ‘হিস্টোরি অব মর্ডান বেঙ্গল’, পার্ট-২ থেকে জানা যায়, ১৯৪৬-এর ১৫ আগস্ট রাতেই মুসলিম লিগের গুন্ডা বাহিনী কলকাতার মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে
মিছিল করে জেহাদের ডাক দেয় এবং ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগান তোলে। একই রকম বর্ণনা পাওয়া যায়, কলকাতার সুরঞ্জন দাসের ‘Communal Riots in Bengal 1905-1947’ গ্রন্থে। কলকাতার বিভিন্ন পার্কের রেলিং ভেঙে সেই লোহা দিয়ে অস্ত্র বানানো হয়। কামারদের দিয়ে ছোরা, বল্লম ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করিয়ে নেওয়া হয়, ছোরাছুরি শান দেওয়ার কাজ চলতে থাকে।
মুসলমান ছাত্রদের হোস্টেলে কেরোসিন, মেথিলেটেড স্পিরিট ও অস্ত্র জমা করা হয়। মুসলমানদের দোকানে দাগ দিয়ে রাখা হয়, যাতে সেগুলো লুঠপাটের শিকার না হয়। মুসলিম লিগ সরকারের তরফ থেকে লিগ ক্যাডারদের পেট্রোল ও কেরোসিন জোগান দেওয়া হয়। ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় (আশ্বিন, ১৩৫৩) লেখা হয় কীভাবে আক্রমণ হয়েছিল। বলা হয়, মুসলমানদের পক্ষ থেকে একতরফা নরহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিকাণ্ডের ‘পর হিন্দু ও অন্যান্য লোকেরা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয় এবং যেখানে সম্ভব সেখানেই তারা প্রতিশোধ গ্রহণ করে।’
আমি বলি কী, ভয় যখন পাচ্ছেন তখন সব কিছু একেবারে নির্মূল করে দিন। শুধু এই নতুন ছবিটা নয়, পারলে বাকি যে বইগুলোর কথা লিখলাম সেগুলো নিষিদ্ধ করে দিন। দিদি, আপনাকে বলে রাখি, ইতিহাস ভুলিয়ে দিয়ে পারলে জাতির মেরুদণ্ড বেঁকে যায়। কিনে নিন দিদি, কিনে নিন। ভাতা দিয়ে দিয়ে
বাঙ্গালির শিরদাঁড়া কিনে নিন।