পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ধর্মঘট লক্ষ্যহীন নিমেষে ভরা
ড. রাজলক্ষ্মী বসু
পশ্চিমবঙ্গের দেওয়ালে দেওয়ালে অদৃশ্য কালিতে লেখা হয়েছে- অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষা ধর্মঘট। শিক্ষা যেসিস্টেমে দুর্মূল্য হয়, তার তখন নৈতিক চরিত্রের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে।বিচ্ছেদ ঘটে মনুষ্যত্বের উপকরণ থেকে। এই বাঙ্গালির একটা ইতিহাস দেওয়াল জুড়ে লেখা ছিল, তাহলো, ‘ধনীর চণ্ডীমণ্ডপে যে পাঠশালা বসিয়াছে গরিবের ছেলেরা বিনা বেতনে তাহাতে শিক্ষা পাইয়োছে।’ পশ্চিমবঙ্গে একসময় দারিদ্র্য প্রবল হয়, দেশ ভাগের পর অনেক টানাপোড়েন এইবাঙ্গালিদেরই সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার আত্মসম্ভ্রম ছিল। শিক্ষা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রণালী বদলেছে। আমাদের মনীষীরা অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পেতেন কিন্তু এত নীচু পর্যন্ত কল্পনা করতে পারেননি যেখানে রাজ্য শাসন প্রণালীর প্রধান উপকরণ একদিন হবে মিথ্যাচার আর দুর্নীতি। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এমন ক্ষমতা ধরেছে যেখানে শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি, মেধা তালিকা সববন্দোবস্ত্রে টাকা, ক্ষমতা, পক্ষপাতের পচা গন্ধ।দুর্নীতিতন্ত্রের মধ্যে রাজ্য প্রশাসনের শয়নগৃহ হলে কর্তৃপক্ষ একটুও লজ্জিত নয়। আমাদের লজ্জা, কারণ পশ্চিমবঙ্গ, ওয়েস্ট বেঙ্গল শুগলে টাইপ করলেই আপনা থেকেই দৃশ্যমান
হচ্ছে- টিচার রিক্রুন্টমেন্ট স্ক্যাম। ওবিসি কন্ট্রোভার্সি।দৃশ্যমান হচ্ছে- কলেজে আসন খালি। অটো সাবজেক্ট গুগল মহাশয় দেখাচ্ছে- এমবিবিএস, বিডিএস-এ ভর্তি থমকে। রাজ্যবাসীর রাগদ্বেষের সীমা টপকেছে এই আহ্লাদিত নৈরাজ্যে। রাজনৈতিক ক্ষমতা অনেক সময়ই বিরূপ সত্তাকে প্রশ্রয় দেয়।
িত জাতি শিক্ষক নিয়োগ অথবা শিক্ষার ঘরে এইমাত্রার আইনি ত্রুটি, নৈরাজ্য, অনাচার সংঘটিত করবে, যা রাজ্য শিক্ষা ভবিষ্যতকে অনিশ্চয়ের পথে থামাবে! ভেবেছিল কেউ? মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি পরিবর্তনের রুট মার্চ করতে করতে যেদিন ক্ষমতায় এসেছিলেন সেদিন তিনিও কি জানতেন তাঁকে তাঁরই প্রশাসনিক বেচালের জন্য সাংবাদিক সম্মেলনে বলতে হবে-আপাতত মেডিক্যাল ও ডেন্টাল মেডিক্যালে ভর্তি স্থগিত। আসলে স্থগিত পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাটাই। ক্ষোভ, বিরক্তি মুলতুবি রেখে অত্যুক্তি জ্ঞানে কর্তৃপক্ষ বলে দিল-আপাতত মূলতুবিভর্তি। কিন্তু একটা আলোচনা হলো না ছাত্রদের ভবিষ্যৎ কী হবে? ছাত্রদের স্বার্থ কীভাবে রক্ষা পাবে? শিক্ষার হাল, হার, মান, চর্চার আয়োজন ঠিক কী, তা নিয়ে একটা গণতান্ত্রিক সম্মেলন বা লোক সমীক্ষার সাহস আছে মুখ্যমন্ত্রী বা শিক্ষামন্ত্রীর! পলিটিক্যাল কাঁটাগাছ পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষার দুর্ভাগ্য।নতুনশিক্ষার্থী প্রজন্ম যতটা বলহীন হবে, নিঃসত্ত্ব হবে ততটাই কালকের তৃণমূল, যুব
তৃণমূল কংগ্রেস শক্তিশালী, নীতিহীন ক্যাডার পাবে। তাই একটা সাংবাদিক সম্মেলনে ফটাফট বলে দিলেই হলো- আপাতত ভর্তি স্থগিত। রাজ্যের শিক্ষার উন্নতিতো দূর, গতিটাই প্রতিহত।শিক্ষক পরিকাঠামো নির্জীব।
শিক্ষক দুর্নীতি, ২০১৬ স্কুল সার্ভিস কমিশন এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রশাসনিক মদতে অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়া- মহামান্য শীর্ষ আদালতের নির্দেশে ২৬ হাজারেরও বেশি শিক্ষক, অশিক্ষকের চাকরি বাতিল। মহামান্য শীর্ষ আদালত বারবার নির্দেশ দিয়েছেন আসল’অযোগ্য’দের রাজ্য সরকার নির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করুক-তবেই ‘প্রকৃত’ যোগ্যদেরবিষয়ে বিবেচনার অবকাশ থাকবে আদালতের। রাজ্য সরকার কিছুতেই তা করল না, সেখানেও স্থগিত মুড়ি মিছরি পৃথক করার কাজ। মুড়িমিছরি পৃথক করে দেখালেই যে প্রশ্ন আসবে, যদি পৃথক করাই গেল, তবে একাকার হলো কীভাবে?কার অনুপ্রেরণায় দলে দলে ‘অযোগ্য’ শিক্ষক,সাদা খাতাজমা দিয়ে চাকরি করা শিক্ষক বা বলা উচিত তৃণমুলের দয়ায় ছদ্মবেশীশিক্ষকরা সিস্টেমে অনুপ্রবেশ করেছিল? কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বের হবে। তাই যাক যোগ্যদের চাকরি। তবুও নকল শিক্ষকদের চিহ্নিত করল না রাজ্য সরকার। এই যে ২৬ হাজার পদ শূন্য, তার উপর আগে থেকেই প্রতি
স্কুলেশিক্ষক ঘাটতি। ঘাটতির উপরআরও ঘাটতিতে একবারও আলোচনা হয়েছে কারা নেবেনক্লাস? কীভাবে চলবে পঠনপাঠন? আপাত চলমান কর্মরত শিক্ষক পিছু ক্লাস, পড়ানোর সময় ঘণ্টা ঠিক কতক্ষণ, তার একটা শ্বেতপত্র প্রকাশের ক্ষমতাআছেএইক্ষমতাসীন শাসকদলের? প্রশ্ন করলেই ফিরিস্তি ছুটবে এত স্কুল বানিয়েছি, টিনের চালার স্কুল আজ দো-তলা। ওই দো-তলাটাই যেন কাল হয়েছে শিক্ষার। শিক্ষক নেই, নকল শিক্ষক, ছাত্র ভর্তির হালটাও তথৈবচ। একটার পর একটা সরকারি বাংলামাধ্যম স্কুলে অর্ধেক ছাত্র আসনও শিক্ষাবর্ষে ভরে না।
শিক্ষা নৈরাজ্য বেঁধে ছেঁদে,নিয়মবিরুদ্ধতাকে স্বাভাবিক রাখার জন্য একটা মুখোশ তো দরকার। তার জন্য রয়েছে ওই নীলসাদা ফাঁকা কক্ষের বাহ্যিক ঝকঝকে স্কুলবাড়িগুলি। সংকটের মুখে কলেজগুলি। যদি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধীনের কলেজের সংকট দেখি-আতঙ্কিত হতে হবে। মোট ৪৬টি ডিগ্রি কলেজের ৭৪ হাজার ৩৮১টি আসনে ভর্তির জন্য আবেদন জমা হয়েছে ২৪ হাজার। যদি সব আবেদনকারী ভর্তিও হন তাহলেও ফাঁকাআসন থাকতে পারে ৫০ হাজার। আবেদনের সময়সীমা বেড়ে হলো ৬ জুলাই। তারপর ১৫ জুলাই। এযেন লোকাল রুটের বাস।যাত্রী ডেকে ডেকে আসন ভরবে, তারপর চালক খৈনি টিপে গাড়ি ছাড়বে। সোজাকথা; ছেলেপুলে লেখাপড়ায় আগ্রহ হারাচ্ছে। অলিতেগলিতে বলতে শুনছি-এইতো দশা, চাকরি পাওয়ার বদলে হওয়া
চাকরি চলে গেলহাজারে হাজারে।কী হবে পড়ে। তবুও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় যা, বা আগ্রহকিন্তু স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ও উচ্চশিক্ষার থেকেমুখ ফেরাচ্ছে,
বিশ্বাস হারাচ্ছে অধিকাংশ ছাত্র। এর দায় নেবে না রাজ্য সরকার? শিক্ষা দুর্নীতির জন্যইতো শিক্ষায় এমন অনাস্থা, শিক্ষার এমন ছিন্নবিচ্ছিন্ন দশা।
পড়ুয়াদের মনের দশা ঠিক যেন মধ্যযুগের কবিতাটার মতো- ‘লিখিবো পড়িবো মরিবো দুঃখে, মৎস্য মারিব খাইবো সুখে।।’
কী হবে পড়ে? গ্রাম মফস্সল জেলার সাধারণ বাড়ির শতশত ছাত্র-ছাত্রীর এখন এটাই মনের দশা। উত্তরোত্তর ব্যাপ্যমান শিক্ষা দুর্নীতিই এরজন্য সম্পূর্ণ দায়ী।মমতা ব্যানার্জিকী সুন্দর বলছেন-অনপ্রসর শ্রেণী তালিকা (ওবিসি লিস্ট) জটের জন্য আপাতত মেডিক্যালে, ডেন্টালে ভর্তিবন্ধ। পুরো বিষয়টাই এখন আদালতের কাঠগড়ায়।কীরায় শেষমেশ প্রকাশিত হয় ভারতের মহামান্য শীর্ষ আদালতের পক্ষ থেকে তা নিশ্চিত আমাদের দেখার অপেক্ষায় থাকছে। শুনানির পর শুনানি।রাজ্যের শীর্ষ আদালত থেকে তা ভারতের শীর্ষ আদালতে কড়া নাড়ছে। শিক্ষক নিয়োগ মামলা থেকে ওবিসি সার্টিফিকেট প্রতিটি বিষয়েই কেন মহামান্য শীর্ষ আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে? এটাইতো সবচেয়ে বড়ো নৈতিক অধঃপতনের সুচক। সংকট সেটাই যেটা প্রশাসনিক জোরে কাজ সম্পন্ন
হয় না। হয় না, কারণ প্রশাসন নিজেই ভক্ষক। মমতা ব্যানার্জি নিজেও জানেন ২০১২-তে যে নতুন তালিকাভুক্ত ওবিসি গঠন আনেন তা তোষণের স্বার্থবুদ্ধিতেই। যেখানে মুসলমান ভোটব্যাংক মজবুত করার লক্ষ্যেই ওই ওবিসি তালিকার বদল।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস কমিশন রাজ্যের ওবিসি সংরক্ষণ রিভিউ করেছে বলে মমতা ব্যানার্জি সাফাই দিচ্ছেন এবং আইনত এক্সিকিউটিভ পাওয়ারে রাজ্য সরকার ওবিসি তালিকা নিশ্চয়ই বদল, সংযোজন সংশোধন করলে পারে। সবটা মেনেই বলা, সেই সংযোজন, সংশোধন একপেশে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছিল। সেই সংযোজন, বিবর্তন, পরিবর্তন আদৌ নিরপেক্ষ ছিল না। ওবিসি-এ ক্যাটাগরি যা ১০ শতাংশ সংরক্ষণ ধরে, তার ৮১টি কমিউনিটির ৫৬টিই মুসলমান। একইভাবে ওবিসি-বিযা ৭ শতাংশ সংরক্ষণ ধরে, তার ৯৯টিকমিউনিটির মধ্যে ৪১টি মুসলমানদের। অর্থাৎ মোট ১৮০টি কমিউনিটির ৯৭টিই মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত। এখানে সংরক্ষণেও মুসলমান তোষণের নমুনা দেখা যাচ্ছে, কারণ সকলের নিজের ভোটব্যাংকের প্রতি দায়বদ্ধ।
তৃশমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সমিরুল ইসলাম এই সংযোজনের পর বলেন এমন ঘটনা ‘ঐতিহাসিক’ এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এ এক দৃষ্টান্তহবে। মহামান্য কলকাতা শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ৭৭টি ক্যাটাগরিকে রাজ্যের দেওয়া ওবিসি শংসাপত্র নিয়ে গভীর প্রশ্ন এবং জটিলতার উত্থান। মমতা ব্যানার্জি যেন Sachar Commitee Report ২০০৬-কেই শিখণ্ডি করছেন। কোনো ‘Sweet will’কি আদৌ আছে এই ওবিসি তালিকার? সেই প্রশ্ন থেকেই মহামান্য কলকাতা শীর্ষ আদালত ১২ লক্ষের ওপর ওবিসি সার্টিফিকেট বাতিল করেন যা ২০১০ সালের পর থেকে সংযোজিত।
খুবস্বাভাবিকভাবেই রাজ্য সরকার দেশের শীর্ষ আদালতেরদ্বারস্থ। কিন্তু ক্ষতিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই ছাত্রদেরই। আদালতে মামলা স্থগিত,ছাত্র ভর্তির ভবিষ্যৎটাও স্থগিত। মুখ্যমন্ত্রীর যুক্তি,যতক্ষণ না আদালতের নির্দেশে ওবিসি তালিকার জট কাটে ততক্ষণ সবাই ছুটিতে থাক। এমবিবিএস, বিডিএস- প্রথম বর্ষের কাউন্সিলিং স্থগিত অনির্দিষ্টকালের জন্য। একটা ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে তো দেওয়াইযায়। কিন্তু তার ব্যাখ্যা, তার ফলাফল, তার প্রভাবটা যে কতটা অনিশ্চিতের দিকে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ঠেলে দেয়, তা কিন্তু ভুল করেও চর্চা হয় না। ওবিসিসার্টিফিকেটেও ‘সুবিধা’ দেওয়া হয়েছিল কিছু বিশেষ শ্রেণীকে, তাই আজ অনিশ্চিত অনেক ছাত্রের পঠনপাঠন।শিক্ষা প্রসঙ্গে আইনস্টাইন ১৯২৬ সালে আমস্টারডামে (প্রকাশিত হয় Mein Weltbild Amsterdam:
querido verlag 1934) লিখেছেন- Individuals in question are men ofthe highest reputation, esteemed and respected everywhere, nevertheless the impression remains…
ঠিক সে সময়েই এই প্রান্তে বাঙ্গালিরা বলছেন, ‘প্রথমত এই কথা আমাদিগকে ভালো করিয়া বুঝিতে হইবে-কর্তৃপক্ষ যদি কোনো আশঙ্কা রাখিয়া আমাদের মধ্যে ঐক্যের পথগুলিকে যথাসম্ভব রোধ করিতে উদ্যত হইয়া থাকেন, সে আশঙ্কা কীরূপ প্রতিবাদের দ্বারা আমরা দুর করিতেপারি।’ বর্তমান রাজ্য সরকার অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে রাজ্যবাসীকে সব গঠনমূলক কাজের থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য দূরে রেখেছে। শিক্ষারসব প্রক্রিয়া স্থগিত রেখেছে। সবকিছু স্থগিত রেখে যখন সরকার চলে তখন তা শাসকতন্ত্র। তা আবার যদি একনায়কতন্ত্র হয় তখন তো স্বেচ্ছাচারিতা। শিক্ষাব্যবস্থার নিদ্রাবেশ লক্ষ্যহীন নিমেষে ভরা।