পুণ্য শ্লোক, পবিত্র ঋষি
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
কল্যাণ গৌতম
পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী চিন্তাবিদেরা সব সময় প্রমাণ করতে চেয়েছেন, বিদ্যাসাগরকে ধর্ম-উদাসীন, মানবতাবাদী চরিত্র হিসেবে। তুলে ধরতে চেয়েছেন তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বকে। কিন্তু মূল সত্যিটা হলো, পরাধীন ভারতবর্ষে নিজেকে কীভাবে উপস্থাপন করলে দেশের সামাজিক সংস্কারের কাজ সুসম্পন্ন
হয়, সে ব্যাপারে তিনি বাস্তববাদী ছিলেন। সেই পথে যেতে হলে তিনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আপোশ করেছেন। আর তার জন্যই ধর্ম-আধারিত সমাজ সংস্কার করতে পেরেছেন। ‘ধর্ম বিযুক্ত বিদ্যাসাগর’ বলে কোনো কথা হয় না।
মনে রাখতে হবে, তিনি যখন কর্মজীবন শুরু করছেন (১৮৪১ সালের ২৯ ডিসেম্বর) কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রধান পণ্ডিতের পদে তার বছর ছয়েক আগে (১৮৩৫ সালে) মেকলে সাহেব ভারতীয় সনাতনী শিক্ষাব্যবস্থার ভিত নাড়িয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন ব্রিটিশ ভারতের চিন্তাচেতনা।
মেকলের নীতি অনুসরণ করে ভারতে ব্রিটিশরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তারা হিন্দুধর্মের অনুসারী পাঠ যথাসম্ভব পাঠ্যসূচিতে রাখবে না, হিন্দুধর্মের গরিমা-প্রকাশক কোনো পাঠ্য তো নয়ই। চাকরি জীবনের প্রথমে এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই বিদ্যাসাগরকে আমরা বিশেষভাবে প্রকাশ হতে দেখি। কেউ কখনো
অস্বীকার করতে পারবেন না, বিদ্যাসাগরের আনা নবজাগরণ ছিল হিন্দু-নবজাগরণ। তিনি হিন্দু ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন, নিজের আরব্ধ কাজ করার জন্য শাস্ত্রীয় যুক্তি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বহু রচনাই হিন্দুধর্ম আধারিত।
অনুবাদক বিদ্যাসাগরের প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ হিসেবে আমরা ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭) নামটি জানলেও আমরা অনেকেই জানি না, তাঁর প্রথম অনুবাদ ছিল ‘বাসুদেবচরিত’। নমুনা যা পাওয়া গেছে, অসাধারণ সুললিত ছিল এই গ্রন্থ, অনুবাদ-কর্মের প্রথম পরীক্ষা, লিপিচাতুর্য আর ভাষা-সৌন্দর্যে অতুলনীয়। এর পাণ্ডুলিপিটি রচিত হয় সম্ভবত ফোর্ট ইউলিয়াম কলেজে চাকুরিরত অবস্থায় (১৮৪২-১৮৪৬ এর মধ্যে)। বিদ্যাসাগর জীবনীকার বিহারীলাল সরকার অনুমান করেছিলেন, এ আখ্যানে হিন্দু ধর্মগ্রন্থের কাহিনি গৃহীত হয়েছিল বলে ফোর্ট উলিয়াম কর্তৃপক্ষ এটি কলেজের পাঠ্য গ্রন্থরূপে গ্রহণ ও প্রকাশ করতে সম্মত হয়নি। বাংলা সাহিত্যের তন্নিষ্ঠ গবেষক অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও স্বীকার করেছেন, ‘বাসুদেবচরিত’ বিদ্যাসাগরের প্রথম গদ্যগ্রন্থ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পরে আর এই পাণ্ডুলিপিটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিদ্যাসাগর নিজে তা পরে প্রকাশ করতে চেয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন এবং জীবনীকারদের দেখিয়ে ছিলেন। অর্থাৎ জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা যায় না, এই বোধে হয়তো বিদ্যাসাগর নিজেকে পরবর্তী সময়ে পরিচালিত করে থাকবেন। তারই অনুভবে নিজের জীবনের লক্ষ্য স্থির করে থাকবেন। হিন্দুধর্মের প্রচার করতে গিয়ে সাহেবদের চটালে, তাঁর সমাজসংস্কারের কাজ পাছে বাধা পায়, সেজন্য অন্যভাবে হিন্দুধর্মের সামীপ্যে সান্নিধ্যে বিরাজ করবেন।
তখন প্রগতিশীলতা মানেই ছিল ব্রাহ্ম হয়ে যাওয়া, কিন্তু বিদ্যাসাগরকে ব্রাহ্ম হতে দেখিনি আমরা। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, অক্ষয় কুমার দত্ত প্রমুখ ব্রাহ্ম মনীষীর সঙ্গে তাঁর চির ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও তিনি হিন্দুই থেকে গেছেন। বরং প্রিয়পাত্র শিবনাথ শাস্ত্রী ব্রাহ্ম হয়ে গেলে তা তাঁকে বিশেষভাবে পীড়িত,
ব্যথিত করেছিল।
বিদ্যাসাগরের লেখা চিঠিপত্রের শীর্ষে অবশ্যই স্থান পেত ‘শ্রীহরি শরণম্’। এটা দেখবার মতো ব্যাপার। শুধুই কি আচার পালন! হিন্দুধর্মের প্রতি অকারণ বিদ্বেষ ও কটূক্তি তিনি কখনোই মেনে নেননি। একসময় সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারক একটি মামলার রায়দানের সময় প্রসঙ্গ-বহির্ভূতভাবে হিন্দুধর্ম
সম্পর্কে কটুকথা বলেছিলেন, অশালীন কথা বলেছিলেন; তার প্রবল প্রতিবাদ করেছিলেন বিদ্যাসাগর, গর্জে উঠেছিলেন তিনি। কলকাতায় রাজা রাধাকান্ত দেবের প্রাসাদে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সভায় নেতৃত্ব দিলেন বিদ্যাসাগর। পাঁচ হাজার গণ্যমান্য মানুষের স্বাক্ষর সংবলিত একটি চিঠি পাঠালেন ইংল্যান্ডের ব্রিটিশ সেক্রেটারিয়েটে। চিঠির গুরুত্ব অনুভব করে ব্রিটিশ সেক্রেটারিয়েট ভারত সরকারকে নির্দেশ দিল, সুপ্রিম কোর্টের সেই বিচারককে সতর্ক করে দিতে হবে। জয় হলো বিদ্যাসাগরের, জয় হলো হিন্দুর।
হিন্দুধর্মে যে দশটি মানবিক গুণ থাকলে যিনি যথার্থ ধার্মিক হতে পারেন, তার সমস্ত গুণই বিদ্যাসাগরের মধ্যে আমরা দেখতে পাই- ধৃতি, ক্ষমা, দম, অস্তেয়, শৌচ, ইন্দ্রিয় নিগ্রহ, ধী, বিদ্যা, সত্য, অক্রোধ। যদি তাই হয় তবে তিনি অবশ্যই হিন্দু, অবশ্যই ধার্মিক। ব্যিদাসাগর গীতার উপদেশ অনুসারে
চলবার কথা উচ্চারণ করেছেন। তাঁর স্নেহধন্য ও পারিবারিক চিকিৎসক ডাক্তার অমূল্য চরণ বসু (১৮৬২-১৮৯৮; ১৮৮৬ সালে কলকাতা মেডিক্যাল স্কুল থেকে এমবি উত্তীর্ণ) একবার বিদ্যাসাগরের ধর্মবোধ ও কর্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘গীতার উপদেশ অনুসারে চললেই ভালো হয়।’
কোনো এক ভয়াবহ লঞ্চডুবিতে প্রায় ৮০০ জন আরোহীর মৃত্যু হলে তিনি সখেদে বলে উঠেছিলেন, ‘দুনিয়ার মালিকের কি এই কাজ?’
শ্রীরামকৃষ্ণ বারবার বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করলে, ঠাকুরের ভক্তেরা অভিমত প্রকাশ করে বলেন, বিদ্যাসাগর ঈশ্বর মানেন না, তিনি নাস্তিক। শ্রীরামকৃষ্ণ মত প্রকাশ করে বলেন, ঈশ্বরের আশীর্বাদ না থাকলে কোনো মানুষ এমন জায়গায় পৌঁছাতে পারেন না। তিনি কলকাতার বাদুড়বাগানে বিদ্যাসাগরের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছিলেন।
নানান সমাজ সংস্কারের কাজে তিনি শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা ও তার সুলুকসন্ধান করেছিলেন, গভীরে গিয়েই পাঠ করেছিলেন শাস্ত্রীয় আপ্তবাক্য। কিন্তু তবুও তিনি নিরীশ্বরবাদী। বলা হয়ে থাকে বুদ্ধের পর বিদ্যাসাগরই প্রথম ভারতীয় মনীষা যিনি ঈশ্বর নিয়ে চিন্তা করেননি। গৌতমবুদ্ধ যেখানে হিন্দুদের দশাবতারের একজন হয়ে উঠলেন, তবে কেনই-বা ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ঈশ্বরচন্দ্র’ হয়ে উঠবেন না? যিনি কর্মফলের আশা না করে নিষ্কাম কর্ম করে গেছেন এবং অক্ষয় মনুষ্যত্বের অধিকারী ছিলেন। গীতার উপর আস্থা রেখেছিলেন, তিনি তো কর্মযোগী হিন্দু সন্ন্যাসীই হবেন! তাই নয় কী?
বিদ্যাসাগরের জীবনে আরও একটি ঘটনা থেকে মনে হয়, তিনি ব্রাহ্ম কিংবা খ্রিস্টান মহিলাদের তুলনায় হিন্দু মহিলাদের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব করেছিলেন। ১৮৬৬ সালে স্ত্রী শিক্ষাবিদ মেরি কার্পেন্টার ভারতে আসেন। তিনি বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করে তাঁর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বেথুন স্কুলে একটি শিক্ষিকা-শিক্ষণ বিদ্যালয় স্থাপন করতে চাইলেন। কারণ এতদিন বালিকা বিদ্যালয়ে পুরুষেরা পড়াতেন।
বিদ্যাসাগর প্রথমে কার্পেন্টারকে সঙ্গ দিলেও পরে প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মত দিলেন। যুক্তি ছিল সমকালীন সামাজিক পরিস্থিতিতে উপযুক্ত বয়স্কা মেয়ে পাওয়া যাবে না। বিপুল সামাজিক বাধা আসবে তাদের প্রতি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটা তো হিন্দু ঘরের মেয়েদের জন্য সত্য। শিক্ষিকা হিসেবে তো ব্রাহ্ম মহিলারাও
আসতে পারতেন; খ্রিস্টান মহিলারাও আসতে পারতেন, তাদের জন্য তো সত্য নয়। তারা তো অনেকেই শিক্ষিতও ছিলেন, সামাজিক বাধাও পেতেন না সেভাবে। তাহলে কী বিদ্যাসাগর মনে করেছিলেন, শিক্ষিকা হিসেবে হিন্দু মেয়েরা সুযোগ না পেলে, শিক্ষা জগতে ব্রাহ্ম ও খ্রিস্টান শিক্ষিকারা দাপিয়ে বেড়াবে? ধর্মীয় প্রভাব ফেলবে? একজন হিন্দু পুরুষকে শিক্ষা দেওয়া আর একজন হিন্দু নারীকে শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে অনেক তফাত। শিক্ষিকা হিসেবে হিন্দু নারীর মধ্যে হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি অশ্রদ্ধা বা বিরূপ চিন্তন তৈরি করে দিলে তা হিন্দু সমাজে দীর্ঘকালীন ক্ষতি করে দিতে পারে, এটা পরিষ্কারভাবে হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। তাই সেই ফাঁদে পা দেননি।
বিদ্যাসাগর যুক্তি দেখালেন, বিধবা বিবাহে বিধবা মেয়ে ঘর পাচ্ছে, কিন্তু নতুন বিদ্যালয়ে ঘরের মেয়ে বাইরে আসার সুচনা হবে। এটা কয়েক বছরের শিক্ষা লাভের বিষয় নয়। বিদ্যাসাগর বুঝেছিলেন তা সমাজের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ এখানে যদি হিন্দু সম্পন্ন ঘরের কোনো মেয়ে আসে, তার বিধবা
হবার সম্ভাবনাই বেশি। বিদ্যাসাগরের কাছে বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল, বিধবা বিবাহের ফলশ্রুতিতে বিধবা আপন ঘর পাক। তাঁর নিজের উক্তি ‘বিধবা বিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম। এজন্মে ইহা অপেক্ষা কোনো সৎকর্ম করিতে পারিবো, তাহার সম্ভাবনা নাই। এ বিষয়ের জন্য সর্বস্বান্ত হইয়াছি এবং আবশ্যক হইলে প্রাণান্তস্বীকারেও পরাম্মুখ নহি।’ সৎকর্ম করা হিন্দুধর্মের এক পবিত্র কাজ। বিদ্যাসাগর শুধু সমাজ সংস্কারক নন, তিনি হিন্দু ধর্মের
অভিমত ও প্রথা মেনে চলার পন্থী এক সংস্কারক।
বিদ্যাসাগরের ধর্মে মতি না থাকার পশ্চাতে একটি মনস্তাত্ত্বিক নিবৃত্তি হয়তো কাজ করে থাকবে। যে গরিব ঘরের ছেলেটি জানতেন তার ঠাকুরদা (পণ্ডিত রামজয় তর্কভূষণ) সন্ন্যাসী হয়ে ঘর ছেড়েছেন; ঠাকুমা (দুর্গাদেবী) প্রবল দুরবস্থায় পড়েছেন তার ছয় ছেলে-মেয়ে নিয়ে; সুতো কেটে বাজারে বিক্রি
করে যে মহিলাকে সংসার চালাতে হয়; যার ১৫ বছরের ছেলেকে কাজ জোটাতে গিয়ে কলকাতার পথে পথে চলতে গিয়ে ক্ষুধায় মূর্ছা যেতে হয়, সেই পরিবারের একজন সংবেদনশীল অতল জ্ঞানী সংস্কৃতজ্ঞ ব্যক্তি অথচ মানব দরদির ধর্মে বিশেষ মতি থাকলে, ‘ঘর পোড়া গোরুর সিঁদুরে মেঘ দেখে
ডরানো’-র মতো অবস্থা হয় পরিবারের। তিনি নিজেও সদাসর্বদা খেয়াল রাখেন, অধ্যাত্মিক উপলব্ধির চরম দর্শন যেন তাকে অন্তত গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী না করে তোলে। আর বিদ্যাসাগর তো সন্ন্যাসীই ছিলেন; মননে, কর্মে বাস্তববোধে।
প্রাচীন ঋষিদের মতো যার প্রজ্ঞা আর পাণ্ডিত্য, মানুষের জন্য যার অপরিমিত দয়া বাঙ্গালি রমণীর মতো কোমল করে তোলে, তিনি হিন্দু সন্ন্যাসী না হয়ে যান না। তিনি পুণ্যশ্লোক, তিনি পবিত্র ঋষি।