পাঁশকুড়ায় ভট্টাচার্য পরিবারের পাঁচশো বছরের প্রাচীন দুর্গাপূজা
জয়জো্যতি ভট্টাচার্য
পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ার ভট্টাচার্য পরিবারে প্রায় পাঁচশো বছর ধরে হয়ে আসছে দুর্গাপূজা। প্রথম দিকে পূজা হতো নবপত্রিকায়। পরে শুরু হয় মৃন্ময়ী মূর্তিতে চিন্ময়ীর আরাধনা।
এ বাড়িতে দুর্গার সঙ্গে লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ তো থাকেনেই, থাকেন জয়া-বিজয়াও। দেবী মায়ের সঙ্গে পূজা হয় তাঁদেরও। বলিদান প্রথা নেই। নেই চণ্ডীপাঠের নিয়মও। তবে সন্ধিপূজা হয়, যদিও ১০৮ দীপদানের রীতি নেই।
মায়ের ভোগরাগ হয় রাতে। দেবীর নাকে রয়েছে তিলক, তাই তাঁর হয় নিরামিষ ভোগ। তবে সন্ধিপূজায় মাকে নিবেদন করা হয় আমিষ ভোগ। জ্যান্ত মাছ কেটে রান্না করে দিতে হয়। পূজার দিনগুলিতে প্রসাদ পান কয়েকশো ভক্ত। দেবী দর্শনে আসেন দূরদূরান্তের লোকজনও। তাঁদের বিশ্বাস, ভট্টাচার্য বাড়ির দেবী খুবই জাগ্রত। কায়মনোবাক্যে কিছু চাইলে দেবী কাউকে বিমুখ করেন না।
এক সময় বংশ পরম্পরায় ঠাকুর গড়ত এক মৃৎশিল্পীর পরিবার। গত চল্লিশ বছর ধরে প্রতিমা তৈরি করছেন তমলুকের মঙ্গল মিস্ত্রি। তিনি বলেন, ‘ভট্টাচার্য বাড়ির মায়ের চক্ষুদান করার পরে আমি অন্যান্য প্রতিমার কাজ করি। এখানকার মা খুব জাগ্রত।’ এই পূজার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে স্থানীয় সিংহ পরিবার। এই পরিবারের প্রবীণ সদস্য দিবাকর সিংহ বলেন, ‘এখানে খুব নিষ্ঠা সহকারে পূজা হয়। মা খুবই জাগ্রত।’ স্থানীয় বাসিন্দা চণ্ডীদাস ঘোষাল বলেন, ‘এই পূজা ঠিক কত বছরের পুরানো, তা জানি না। তবে আমরাও বাবা-কাকাদের কাছে শুনেছি, এই বাড়ির পূজা বহু পুরানো। মা খুবই জাগ্রত।’ ভট্টাচার্য পরিবারের সদস্যরাই পূজা করেন। বর্তমানে পূজা করেন গুরুদাস ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘আমিও জানি না ঠিক কত বছরের পুরানো পূজা। তবে শুনেছি, প্রায় পাঁচশো বছর ধরে পূজা হয়ে আসছে এই পরিবারে।’ তিনিই জানান, গুরুদেবের কথামতো বংশরক্ষার উদ্দেশ্যেই এই পরিবারে পূজা শুরু হয়েছিল। সেই থেকে এখানে পূজা হয়ে আসছে এ বাড়িতে। বাড়িতে নিত্য পুজা হয় নারায়ণের। এই নারায়ণের মন্দিরের পাশেই মায়ের মন্দির। অবশ্য মন্দির বলতে যা বোঝায়, তেমন নয়। জমিদার বাড়ির ধাঁচে তৈরি চণ্ডীমণ্ডপ। আগে ছিল মাটির। পরে হয়েছে পাকা। সেই মণ্ডপেই আরাধনা হয় দেবী চন্ডীর। চণ্ডীমণ্ডপের সামনেই রয়েছে একটা শিউলি গাছ। শারদ প্রাতে ঝরে পড়ে রাশি রাশি শিউলি। মৃদু গন্ধে ভরে উঠে চারিদিক। আকাশে ভেসে বেড়ায় পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। মহালয়ার ভোরে মায়ের আগমনী বার্তা ঘোষণা করে শাঁখে ফুঁ দেন গাঁয়ের বধূরা। পূজার আগে আগে ভট্টাচার্য বাড়ির সামনে উড়ে বেড়ায় একটা নীলকণ্ঠ পাখি। মায়ের আগমনী বার্তা বয়ে আনে বুঝি। দশমীতে পান্তা ভাত খেয়ে ভট্টাচার্য বাড়ির দেবী ফিরে যান কৈলাসে। এদিন মাকে পান্তা ভাতের সঙ্গে শাকভাজা ও দই দেওয়ার প্রথা প্রচলিত। দেবী ফিরে যাওয়ার পরপরই কোথায় যেন হারিয়ে যায় নীলকণ্ঠ পাখিটাও। পাখিটার দেখা মেলে ঠিক এক বছর পরে, আবারও মহালয়ার ভোরে। ভট্টাচার্যদের প্রতিবেশীদের বিভিন্ন বাড়ির বহু পুরানো রেডিয়োতে তখন বেজে চলে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জলদগম্ভীর কণ্ঠের সেই চিরন্তনী বাণী, আশ্বিনের শারদ প্রাতে…।