রাজনৈতিক অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে দুর্নীতিগ্রস্ত, পরিবারতান্ত্রিক দলগুলি
ড. রাজলক্ষ্মী বসু
হবে না; তখন ‘চাণক্য উবাচ’ বড্ড প্রাসঙ্গিক ঠেকে। চাণক্য শ্লোকটি আরও প্রাসঙ্গিক ঠেকে যখন গত ২০ আগস্ট ভারতের সংসদে সংবিধান (১৩০তম সংশোধনী) বিল পেশ করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শা, এবং তারপরই দুর্লভ প্রতিবাদে দেখা গেল একজোট ইন্ডিজোট। যারা সততার ফাঁকা আওয়াজ দিয়ে দিন যাপন করে, তাদের কাছে এহেন সংশোধনী প্রস্তাবে রাজনৈতিক ইমেজ ডুবে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থেকে যায়। প্রস্তাবিত এই আইনের বিরোধিতায় তাদের দেওয়া রাজনৈতিক লেকচারগুলিও আগামীদিনে হাবুডুবু খাবে বা মুখ থুবড়ে পড়বে একথাও স্পষ্টভাবে বলা যায়। দুর্নীতিরাজ এবং নীতিহীন প্রশাসনিক কাঠামো বরদাস্ত করতে রাজি নয় একবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভূত নতুন ভারত। কিন্তু এই দেওয়াল লিখন পড়তে ব্যর্থ ইন্ডিজোট। তাদের পক্ষ থেকে একটাই রোল উঠতে দেখা যাচ্ছে- এই সংশোধনী অগণতান্ত্রিক, এই আইন হলো স্বৈরাচারের নমুনা, আইনটির অপপ্রয়োগ করবে কেন্দ্রীয় শাসককুল বা কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন শাসক দল, বাড়বে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার অপব্যবহার।
ভবিষ্যতে কেউ এই আইনের অপপ্রয়োগ করতে পারে, সেই কারণে আইনটিই প্রণয়নের প্রয়োজন নেই- এই যুক্তি শুধুমাত্র ভিত্তিহীন নয়, রীতিমতো হাস্যকর। কেন ‘দুর্নীতিমুক্ত দেশ’ হয়ে ওঠার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেবে না আজকের ভারত?
১৩০তম সংবিধান সংশোধনী বিল
চাণক্যের নীতিশাস্ত্রে উল্লেখিত হয়েছে- ‘অসম্ভবং ন বক্তব্যং প্রত্যক্ষমপি দৃশ্যতে শিলা তরতি পানীয়ং গীতং গায়তি বানরঃ।।’
অর্থাৎ শিলা জলে ভাসছে, বানর গান গাইছে- যদি দেখো বা প্রত্যক্ষ করো, তাও সেটা বোলো না, বা এইসব অসম্ভব বিষয়ে মনে যেন প্রত্যয় না জন্মায়। বর্তমানে ইন্ডিজোটের সততার কীর্তন যেন ঠিক তেমনটাই। তাদের ভাবসাব যেন সততার পরাকাষ্ঠা তারা। তাদের দাবি হলো দেশ তাদের হাতে সুরক্ষিত। যেমন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই নিজেকে সেই কোন কাল থেকে পোস্টারে, ব্যানারে লিখে চলেছেন- ‘সততার প্রতীক’। তারপর
যখন দেখা যায় যে, তার ক্যাবিনেট থেকে পঞ্চায়েত প্রধান সবাই নিয়মিত প্রতিযোগিতা করে দুর্নীতিতে শামিল হয়, বিভিন্ন মামলায় রাজ্য সরকারকে আদালতে একরকমভাবে বলতে হয়- আর চুরি আইনের অপপ্রয়োগ হলেও সেই অব্যবস্থা খুব কম সময়ের জন্যই বলীয়ান থাকে। কারণ দেশের বিচারব্যবস্থা স্বাধীন, স্বতন্ত্র এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত। তাই কোনো সরকার আইনের অপপ্রয়োগ করলেও সেই মিথ্যা অভিযোগ আদালতের দৃষ্টিতে মিথ্যা মামলা
হিসেবেই পরিগণিত হয়। এদিকে রাহুল গান্ধী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা একটি ইতিবাচক সংস্কারের বিরোধিতা করছেন এই যুক্তিতে অনড় থেকে যে, যদি কখনও ভবিষ্যতে এই আইনের অপপ্রয়োগ হয়। গণতন্ত্রের পীঠস্থান হলো- সংসদ। সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে ‘ফ্লোর বিলংস্ টু দ্য অপোজিশন’। অর্থাৎ দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষার্থে সংসদের অভ্যন্তরে বিরোধী স্বর সর্বদা গুরুত্ব পাবে। ভারতের সংসদে বর্তমান বিরোধী দলগুলির জোট বা ইন্ডিজোটের পক্ষ থেকে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষায় জোর দেওয়ার বিষয়টি ভারতীয় গণতন্ত্রের শক্তি প্রমাণ করার পরিবর্তে যেন বেশি করে নানা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। কী রয়েছে এই বিলে? কোন কোন ফাঁক আবিষ্কার করে বিরোধিতা চলছে ১৩০তম সংবিধান (সংশোধনী) বিলের? এক কথায় এ হলো- গ্রেপ্তারির পর ৩০ দিনের বেশি কারাবাস হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মন্ত্রীপদ অপসারণের বিধান। যদি কেন্দ্র বা রাজ্যের কোনো মন্ত্রী, এমনকী প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী বা বিধানসভা-যুক্ত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের কোনো মন্ত্রী কোনো গুরুতর অপরাধে যদি ধারাবাহিকভাবে ৩০ দিন হেফাজতে থাকেন, তবে ৩১তম দিনে তাঁর মন্ত্রিত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে খারিজ হবে। এই ক্ষেত্রে ‘গুরুতর অপরাধ’ বলতে বোঝানো হচ্ছে সেই অপরাধ, যার সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছর বা তার বেশি সময়ের কারাদণ্ড। দেশবাসী এতদিন দেখতে অভ্যস্ত ছিল যে, জেলে বসেও দুর্নীতি বা নানা অপরাধে অভিযুক্ত নেতাদের মন্ত্রীপদ বহাল থাকত। জেলে থেকেও মন্ত্রীপদে বহাল থাকা নেতারা নির্বাচনে লড়ার পথ খোলা পেত। উপরন্তু ‘সিমপ্যাথি ভোট’-এর খেলা চলত। এই আইন পাশ হলে জেলে ঢুকে জামিন না পেলে তো মন্ত্রীপদটাই যে থাকবে না! তাই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষ থেকে এই আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিরোধিতার হাওয়া বর্তমানে তুঙ্গে। দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-নেত্রীরা যে তাদের দলগুলির সম্পদ, তা আবারও প্রমাণ করল ইন্ডিজোট। এই নেতাদের তাদের বড্ড প্রয়োজন। এই সংশোধনীর কোনো ধারা বা উপধারায় কিন্তু উল্লেখিত হয়নি যে, গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে ৩০ দিন হাজতে থাকার ফলে পদ খোয়ানো মন্ত্রী আর কখনও কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। অর্থাৎ তিনি যদি সত্যিই জনপ্রিয় হোন, বা কোনো ষড়যন্ত্রের কারণে তার মন্ত্রিত্ব খোয়া গিয়ে থাকে, তবে কিন্তু জনপ্রতিনিধি হিসেবে তার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকছে। সততা ও জনপ্রিয়তার জোরে তিনি তার গ্রহণযোগ্যতা ফের প্রমাণ করতে পারবেন। নির্বাচনে পুনরায় জয়ী হওয়ার পথ তার সামনে উন্মুক্ত থাকছে। তা না হলে ইন্দিরা গান্ধী থেকে লালুপ্রসাদ যাদব, কানিমোঝি থেকে কংগ্রেস নেতা অর্জুন সিংহ- এরকম অসংখ্য জনপ্রতিনিধি ও হেভিওয়েট নেতা-মন্ত্রী নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে সাজা পাওয়ার পর জেল থেকে বেরিয়ে পুনরায় জয়ী হতে পারতেন কি? ধরে নিতে হবে যে, হাজতে যাওয়ার আগে তাদের জনপ্রিয়তা ছিল। তাই নানা অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও পরবর্তী পর্যায়ে তাদের জনপ্রিয়তায় কিন্তু ভাটা পড়েনি। জেল থেকে বেরিয়েও তারা লাভ করেছেন বিপুল জনসমর্থন। তাহলে আজ রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়গে, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা কেন এত বিচলিত?
কংগ্রেসের বরং উচিত এই বিলকে দু’হাত তুলে সমর্থন করা। ইউপিএ-২ সরকারের আমলে ২০১৩ সালে সংসদে পাশ হয় লোকপাল বিল। সেই আইন প্রণয়নের রাজনৈতিক কৃতিত্ব তারা অহরহ দাবি করে থাকে। এক্ষেত্রে মনে করাতে হবে কংগ্রেসের আসল চরিত্র।১৯৬৮ সালে বিশিষ্ট আইনজীবী শান্তিভূষণ প্রথম লোকপাল বিলের প্রস্তাব রেখেছিলেন। ১৯৬৯ সালে চতুর্থ লোকসভায় তা পাশ হলেও রাজ্যসভায় তা আটকে গিয়েছিল। তাই ২০১৩ সালে লোকপাল বিল পাশের বিষয়টি কোনোভাবেই কংগ্রেসি কৃতিত্ব নয়, তা এক স্বতঃস্ফূর্ত জন-আন্দোলনের ফসল। নিজের রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটিয়ে যে অরবিন্দ কেজরিওয়াল আজ দুর্নীতির সমুদ্র মন্থন করলেন, তিনি কিন্তু সেই সময়ে আন্না হাজারের নেতৃত্বে পরিচালিত ‘জন-লোকপাল বিল’ আন্দোলনের একজন সৈনিক ছিলেন। প্রশাসনিক দুর্নীতির জন্য তো কেবলমাত্র আমলা বা আধিকারিকরা দায়ী হন না। দায়ী থাকেন বিভাগীয় মন্ত্রীও। আর্থিক দুর্নীতি বা কেলেঙ্কারির যে ঘটনাগুলিকে সাধারণত ‘স্ক্যাম’ বলা হয়, সেই ব্যাপারগুলি হলো রাষ্ট্রবোধের পরিপন্থী। ‘পাবলিক মানি’ বা সরকারি অর্থ লুঠ তো নিজের দেশকেই লুঠ। কিন্তু সেই লুঠের মাধ্যমে অর্জিত বা সঞ্চিত অর্থ তো আধিকারিকরা একা উপভোগ করেন না। তাই তদন্তকারী সংস্থা কিংবা বিচারবিভাগ
কান ধরে টানলে স্বাভাবিকভাবেই মাথাকেও তো আসতেই হবে। লোকপাল বিল পাশ যদি ঠিক পদক্ষেপ হয়, তবে ১৩০তম সংবিধান সংশোধনীটা তো আরও বেশি ঠিক। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তো অভিযুক্ত বা সাজাপ্রাপ্ত আধিকারিক তার প্রোমোশন, বেতন কাঠামো ইত্যাদি অনেক কিছুতেই নানা ধাক্কা খান। ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’-এর আইনি সংজ্ঞায় তাদের সঙ্গে তো মন্ত্রীরাও অন্তর্ভুক্ত। তাহলে একজন অভিযুক্ত মন্ত্রী কেন হাজত এবং মন্ত্রীপদ দুটোই সমান্তরালভাবে ভোগ করবেন? বিরোধী জোটের দাবি হলো ৩০ দিন হাজতবাসের পর, ৩১ দিনের মাথায় অভিযুক্ত মন্ত্রী যদি জেল থেকে ফেরেন, তবে তার মন্ত্রীপদ যেন বহাল থাকে। আবারও তাকে মালা পরিয়ে, জিন্দাবাদ বলে মন্ত্রীর চেয়ারে যেন বসানো যায়। নৈতিকতাহীন, সুবিধাবাদী রাজনীতির পাঁকে নিমজ্জিত রাহুল গান্ধীদের কাছে তাদের এহেন দাবি কিন্তু মোটেই কোনো অসঙ্গত দাবি নয়। তাদের দাবির স্বপক্ষে গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তি রয়েছে কি? এটা তাদের দাবি না আবদার? ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত ‘করাপশন পারসেপশন্স ইনডেক্স’ বা দুর্নীতি সূচকে যখন ওপরের দিকে স্থানলাভ করে ভারত, বিশেষত এই ধরনের আন্তর্জাতিক সংস্থার চোখে দুর্নীতিতে যখন ভুটানকেও টপকে যায় আমাদের দেশ, তখন তো এই বিরোধী কণ্ঠগুলোই চেঁচামেচি শুরু করে সবার আগে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে তখন সবাই একমত হয় যে, দুর্নীতির পাঁকে ডুবে যাচ্ছে আমাদের দেশ। কিন্তু দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার উপায় অনুসন্ধান কেন্দ্রীয় সরকার শুরু করতেই এত হইচই কেন? ২০১৪ সালে এই রাহুল গান্ধীই তো কেন্দ্রের দিকে আঙ্গুল তুলে বলেন যে, ছ’টি অ্যান্টি-করাপশন বিল থমকে রয়েছে। নৈতিকতার স্বঘোষিত মুখপাত্র রাহুল গান্ধী মাঝে মাঝেই বলেন- কে বা কারা আনল ‘রাইট টু ইনফরমেশন অ্যাক্ট’?
‘জুডিশিয়াল অ্যাকাউন্টেবিলিটি বিল, ২০১০’ থেকে ‘হুইসল্ব্লো য়ার্স প্রোটেকশন বিল, ২০১১’, ‘দ্য রাইট অফ সিটিজেন্স ফর টাইম বাউন্ড ডেলিভারি অফ গুডস্ অ্যান্ড সার্ভিসেস অ্যান্ড রিড্রেসাল অফ দেয়ার গ্রিভান্সেস্ বিল, ২০১১’ (বা ‘সিটিজেন্স চার্টার বিল’) ইত্যাদির বিষয়ে নাকি রাহুল গান্ধী সেই সময়ে সরব ছিলেন। তাহলে আজ এই সংবিধান (সংশোধনী) বিলে আপত্তি কেন? বাস্তব সত্য হলো সেদিনের লোকপাল বিলটাই ছিল কংগ্রেসের কাছে চরম
অস্বস্তির। সেই বিল পাশ নিয়ে ওই সময়ে রাজনৈতিকভাবে এক বিষম অবস্থানে পড়ে কংগ্রেস। ইউপিএ-২ সরকারের পক্ষে ঠিক কতটা সমর্থন ছিল সেদিন? সংসদের নিম্নকক্ষ অর্থাৎ লোকসভায় ১১ ঘণ্টার ম্যারাথন সেশন চলেছিল ২৭ ডিসেম্বর, ২০১১-র দিন। সেদিন অতক্ষণ অধিবেশন চললেও ‘দ্য লোকপাল অ্যান্ড লোকায়ুক্তাজ বিল, ২০১১’-র পক্ষে ২৭৩টি ভোট জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছিল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-২ সরকার। স্পিকার মীরা কুমারের কাছে আবেদন গেল কিছু ধারা প্রত্যাহারের। সেদিন ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্য ছিল- ‘স্যাড ডে ফর ডেমোক্রেসি!’ লোকসভা এই বিল অনুমোদন করলেও ২৯ ডিসেম্বর, ২০১১- এই বিল হোঁচট খায় রাজ্যসভায়। ২০১২ সালের ২১ মে পর্যালোচনার জন্য বিলটিকে রাজ্যসভার সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হয়। তখন তার মাথায় রয়েছেন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা সত্যব্রত চতুর্বেদী। তিনি এই বিলে বহু সংযোজন, বিয়োজন, সংশোধন ইত্যাদি করেন। সেদিন এই বিলকে সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি তো সমর্থন করেইনি। এমনকী নিজেদের সর্বহারার দল বলে দাবি করা বামপন্থী দলগুলিরও সমর্থন
ছিল না এই বিলে। শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাশ হয় এই বিলটি। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাভ করে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি কার্যকর হয় ‘দ্য লোকপাল অ্যান্ড লোকায়ুক্তাজ অ্যাক্ট, ২০১৩’। যারা সেদিন লোকপাল বিলের নিন্দা করেছিল, আজ তারাই সংবিধান (১৩০তম সংশোধনী) বিলের বিরোধিতা করবে, এটা হয়তো স্বাভাবিক। এই আইনটি প্রণীত হলে পরিবারতান্ত্রিক আঞ্চলিক দলগুলির একটি সমস্যা রয়েছে। এই দলগুলির শীর্ষস্থানে ক্ষমতাসীন
থাকে এক-একটি পরিবার। রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দলীয় শীর্ষস্থান কুক্ষিগত রাখে এই পরিবারগুলি। বিভিন্ন রাজ্যে তারা ক্ষমতায় এলে সেই পরিবারের সদস্যরাই মুখ্যমন্ত্রী হয়ে থাকেন। কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে এই পরিবারতন্ত্রের বিষয়টিতে নেহরু পরিবারের যোগ রয়েছে। এই পরিবার থেকে তিনজন ব্যক্তি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কংগ্রেস দলের মূল ক্ষমতা এই পরিবারটির হাতেই কেন্দ্রীভূত। এখন কোনো আঞ্চলিক, পরিবারতান্ত্রিক দলের রাজনৈতিক প্রধান যদি সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন থাকেন এবং কোনো গুরুতর অভিযোগে কারাবন্দি হয়ে ৩০ দিনের মধ্যে জামিন না পান, তবে এই আইনের কারণে তার মুখ্যমন্ত্রিত্ব চলে যাবে। সেক্ষেত্রে তার পরিবারের মধ্যে থেকে কোনো রাজনৈতিক উত্তরসূরী বা উপযুক্ত কোনো বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধান সেই দল না পেলে রাজ্যে সরকার ধরে রাখা তাদের কাছে অসম্ভব তো হবেই, উলটে আঞ্চলিক দলটির রাজনৈতিক অস্তিত্ব সংকট উপস্থিত হতে পারে।
একটা বিলের কিছু ধারা-উপধারা সংশোধন করার প্রস্তাব বিরোধীদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হতেই পারে, কিন্তু অতি অবশ্যই তাতে যুক্তির ধার থাকা জরুরি। কিন্তু আইনের অপপ্রয়োগ হবে ভেবে আইনটাই তৈরি হবে না, এহেন বিরোধিতা আরও বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়। আইনের অপপ্রয়োগ যখনই সামনে এসেছে, তখনই সংশোধনীর মাধ্যমে তাতে উপধারা যোগ হয়েছে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে। বহুমাত্রিক দেশ ভারতে নানা মুনির নানা মত হওয়াটাই স্বাভাবিক। কোনো বিষয়ে একাধিক মত বা ভিন্নমত থাকলেও তার সঙ্গে যুক্তির মেলবন্ধন হওয়া কিন্তু বাঞ্ছনীয়। লালকৃষ্ণ আদবাণীর বিরুদ্ধে যে মুহূর্তে হাওয়ালা স্ক্যামের অভিযোগ উঠেছিল, সেই মুহূর্তে তিনি বলেছিলেন- ‘নিড টু মেইন্টেন প্রোবিটি ইন পাবলিক লাইফ, আই রিজাইন’। ১৯৯৬-এ তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠলে তিনি তখনই সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেন। তিনি পরের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করলেন না। দলীয় কোনো পদেও থাকলেন
না।
২০১৬-তেও ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা এবং মহারাষ্ট্র সরকারের মন্ত্রী একনাথ খড়সে তাঁর বিরুদ্ধে জমি সংক্রান্ত দুর্নীতি অভিযোগ উঠতেই পদ ছাড়েন। দুর্নীতির অভিযোগ আসতেই তাঁদের পদ ছাড়ার বিষয়টিকে মহিমান্বিত করার উদ্দেশ্যে কিন্তু এই উদাহরণগুলির তুলে ধরা হচ্ছে না। কারণ তা কখনোই কোনো গৌরবের পর্ব নয়। কিন্তু গুরুতর অভিযোগ উঠলে পদ ছাড়াটা বাধ্যতামূলক করলে আশা করা যায় যে, দেশজুড়ে দুর্নীতি বা অপরাধমূলক কাজ কমবে। এই সংবিধান সংশোধনী আইনটির একটি ‘ডেটারেন্ট এফেক্ট’ রয়েছে। পদ যেতে পারে এই ভয় তখনই কাজ করে যখন নৈতিকতায় ভক্তি থাকে না। নীচে ‘সত্যমেব জয়তে’ বাণীটি সংবলিত অশোক স্তম্ভ হলো ভারতের জাতীয় প্রতীক। সেখানে মুণ্ডক উপনিষদ হতে সংগৃহীত এই বাণীটি খোদিত থাকার পরও যখন এমন বিল পেশ করার দরকার পড়ে, তখন এটা নিশ্চিতভাবে বোঝা যায় যে, সরকার বা প্রশাসনের অনেক উচ্চস্তরে দুর্নীতি এবং নানা অপরাধ
সংঘটিত হয়। দেশে ও সমাজে দুর্নীতি তখনই মাত্রাছাড়া হয়, যখন গণতান্ত্রিক পরিসর ধ্বংস হতে থাকে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রিত হলে দেশের গণতন্ত্র মজবুত হয়। দুর্নীতি দমন এবং দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় এইরকম শক্ত আইন প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে কী নেই, এই পদক্ষেপ ঠিক নাকি ভুল- সেই বিষয়ে দেশবাসীর কী মত তা জানতে পশ্চিমি দেশগুলির কায়দায় একটি অনলাইন রেফারেন্ডাম আয়োজিত হলে দেখা যাবে সাধারণ মানুষ হইহই করে এই আইনকে সমর্থন করবে। কারণ রাহুল গান্ধী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্তদের বাড়ির লোকজন বাদে বাকি সব মানুষ তো প্রতিনিয়ত সরকারি দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক অনিয়মের শিকার হন। তাই কিছু মুষ্টিমেয় লোকজন বাদে সংবিধান (১৩০তম সংশোধনী) বিলে ১০০ শতাংশ সমর্থন দেবে দেশের সকলেই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে পরিচালিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধ শেষ হলে কফিন কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজের বিরুদ্ধে। ২০০১ সালে সেই প্রতিবাদে ক্যাবিনেট
সদস্যপদ ছেঁড়া চপ্পলের মতো নাকি ফেলে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে আজ কেন এই বিলের প্রতি ধিক্কার? তিনি কি ‘সততার প্রতীক’ সেজেছিলেন বা সাজার চেষ্টা করেছিলেন সেদিন? গণতন্ত্রে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর থাকবেই। তাই প্রতিবাদটা থাক। বরং আরও বেশি বেশি করে প্রতিবাদ হোক। যে প্রতিবাদে নিজেদের দুর্বলতাটাই প্রমাণ হয়, তা রাজনীতিতে হয়তো তেমন একটা লাভজনক নয়।