ভারতে শক্তিসাধনার ইতিহাস
ড. অনিমেষ চক্রবর্তী
ভারতে শক্তিপূজার ইতিহাস অতি প্রাচীন। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ভারতে শক্তিপূজা প্রচলিত। খ্রিস্টপূর্ব সাত হাজার বছরেরও আগে প্রাচীন রাজস্থানের সাম্ভর প্রভৃতি স্থানে কৃষিকাজের শুরুর নিদর্শন পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে (৭০০০- ৫০০০ খ্রিস্টপূর্ব) পূর্ব ও উত্তর ভারতে কৃষিকাজ ও ধান উৎপাদনের নিদর্শন
পাওয়া যায়। কৃষিজাত দ্রব্য গম, বার্লি, ধান, রাগি, তৈলবীজ, তুলা, মটর, খেসারি, কলাই, মসুর, মুগ প্রভৃতি উৎপাদনের নিদর্শন পাওয়া যায় পশ্চিম ও
মধ্যভারতে।
এই সময়ের মধ্যে মৃৎপাত্র, পাথরের কুড়ুল, মাটির বাড়ি, পশুপালন প্রভৃতির নিদর্শন পাওয়া যায়। ভারতের উত্তর পশ্চিমভাগ, উত্তর, পূর্ব, উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ প্রভৃতি সর্বত্র এর নির্দশন পাওয়া যায়। সরস্বতীর তীরে, বোলান নদীর তীরে এবং মেহরগড় ও তার আশেপাশে গ্রামীণ বসতির নিদর্শন পাওয়া যায়।
এই গ্রামীণ জীবনবোধ ও সংস্কৃতি থেকেই পরবর্তীকালে খ্রিস্টপূর্ব প্রায় তিনহাজার বছর আগে ভারতবর্ষে গড়ে উঠতে থাকে হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো, ধোলাবীরা, কালিবঙ্গান, লোথাল, নাল, আমরি প্রভৃতি নগর ও নাগরিক সভ্যতা। প্রায় দশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই সভ্যতার অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল প্রাথমিকভাবে কৃষিকাজ ও পশুপালন এবং পরবর্তীকালে কিছু শিল্পবস্তু নির্মাণ ও বাণিজ্য।
কৃষিকাজ আবিষ্কার করেছিল ভারতের মেয়েরাই। এরেনফেলস্ লিখেছেন, মেহগিনের মতে নব্যপ্রস্তর যুগে যে পাথরের কুড়ুল সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল তা তৈরি করেছিল ভারতের মেয়েরাই। হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োতে দেখা যায় মাতৃদেবতার আরাধনার প্রাবল্য। এর শুরু নব্যপ্রস্তর যুগে। আবার লোথাল, কালিবঙ্গান, রাখিগড়ি প্রভৃতি জায়গায় দেখা যায় অগ্নিকুণ্ড, শিবলিঙ্গ, পশুবলিদান, দুটি শিংযুক্ত দেবমূর্তি অথবা যোগীমূর্তি ধ্যানাসনে বসা। অশ্বত্থ পাতার ছবি পাওয়া যায়। স্বস্তিক চিহ্ন ও ছবি পাওয়া যায়। ষাঁড়ের মূর্তি পাওয়া যায়। ধ্যানাসনে বসা যোগীমুর্তি পশুপতি বা শিব বলে অনুমিত হয়। লিঙ্গ পূজার নিদর্শন পাওয়া যায়। মাতা পার্বতী অথবা মাতৃদেবীর পূজা হরপ্পা সভ্যতার অনেক আগে থেকে প্রচলিত ছিল। জোব উপত্যকায় মাতৃকাদেবী মূর্তির নিদর্শন পাওয়া যায়।
গাছের ছবি পাওয়া যায়। মন্দিরের নিদর্শন পাওয়া যায়। নাগের ছবি পাওয়া যায়। গাছের সঙ্গে নাগ, ভক্তিনম্র অবস্থায় বসা মানুষের পেছনে নাগ প্রভৃতির নিদর্শন পাওয়া যায়।
একরকম নারীমূর্তির কোলে সন্তান, আর একরকম নারীমূর্তির গর্ভে সন্তান এরকম মাটির মূর্তি হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতায় পাওয়া যায়। সন্তান কামনায় মেয়েরা ওইরকম সন্তানবতীর মূর্তি মানত করতো বলে মনে হয়। আজও ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে, মাতৃত্বের কামনায় মাতৃমূর্তি মানত করবার প্রথা দেখা যায়। সন্তান কামনা ছাড়াও এই মাতৃমূর্তিগুলির সঙ্গে ফসল কামনামূলক বিশ্বাসের যোগাযোগ থাকা সম্ভব বলেই মনে হয়।
শাক্ত ধ্যানধারণার কেন্দ্রে এক মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং সেই ব্যবস্থার কেন্দ্রে নারীশক্তির প্রাধান্য ছিল বলেই মনে হয়। কারণ সন্তান উৎপাদন ও পালন এবং কৃষি উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে মেয়েদেরই ছিল প্রধান দায়দায়িত্ব, যোগ্যতা ও প্রাধান্য। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে যে সকল উপাদান আবিষ্কৃত হয়েছে তা পুরোপুরি চরিত্রগতভাবে ভারতীয়। সম্প্রতি হরপ্পা সভ্যতাকেন্দ্রের রাখিগড়ি অঞ্চলের সমাধিক্ষেত্রে নারী দেহবশেষ ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় যে, এরা ছিলেনস্থানীয় মানুষ। বর্তমান কালের হরিয়াণার অধিবাসীদের মতোই তাঁদের শরীরের গঠন ছিল।
প্রাগৈতিহাসিক বা প্রাবৈদিক যুগে যেমন শিব-শক্তি উপাসনার চল ছিল, বৈদিক যুগেও তেমন শক্তিপূজা ছিল। ঋগ্বেদের দেবীসূক্ত ও রাত্রিসূক্ত এবং সামবেদের
রাত্রিসূক্ত থেকে বৈদিক যুগে শক্তিসাধনার জনপ্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। কোনো না কোনো পার্থিব প্রয়োজন মেটাবার তাগিদ থেকেই হয়তো শক্তিসাধনার উদ্ভব। মানত করে দেবীর কাছে কিছু কামনা করা হলো। কামনাপূরণ হবার পর সেই মানত পূরণ করার পালা। এর পেছনে আছে এক ধরনের বিশ্বাস ও অনুষ্ঠান। এই বিশ্বাসকে জাদুবিশ্বাসও বলা যায়।
ভিলেনডর্ফের ভেনাসমূর্তি, এস্টেস্ত্রা যে বসুমাতার মূর্তি কল্পনা করে এবং গ্রিক দেবলোকের আর্টোমিসও আদিতে বসুমাতা ছিলেন। প্রত্ন-প্রস্তর যুগের বিভিন্ন নারীমূর্তির ভেতর নারীজননাঙ্গকেই বড়ো করে দেখান হয়েছে, স্ফীত-স্তন সহ। মহেঞ্জোদাড়োর মানুষেরা এই জাতীয় যোনিমূর্তি (মাতৃমূর্তি বা দেবীমূর্তি) তৈরি করেছিল। কারণ এর পেছনে ছিল প্রজননের কামনা, সন্তানের কামনা। ছিল ধনোৎপাদনের কামনা। এমন মনে হয় কৃষিকাজের সাফল্য কামনাও ছিল।
হরপ্পায় পাওয়া সিলটি আমাদের বিস্ময় উদ্রেক করে এই ভেবে যে, একটি নারীমূর্তির দুটি পা দু’দিকে ছড়ানো, তার গর্ভের (মাতৃস্থান) ভেতর থেকে একটি লতা গজিয়েছে। হরপ্পার এই সিল থেকে সেই সময়ের মানুষের বিশ্বাস আর শ্রীশ্রীচণ্ডীর মূর্তি রহস্যে বলা (শাকম্ভরী শতাক্ষী স সৈব দুর্গা প্রকীর্তিতা। উমা গৌরী সতী চণ্ডী কালিকেশা চ পার্বতী।।) শ্লোকের অনেকাংশে মিল পাওয়া যায়। অর্থাৎ সেই প্রত্নপ্রস্তর যুগ ও তার আগে থেকেই নারী, নারী মাতৃস্থান এক
শক্তির আধার বলে কল্পিত। সমস্ত উৎপাদনশীলতার উৎস, সন্তান, সমস্ত উদ্ভিদ, প্রাণী, ঔষধি, সকল রকম চিন্তার উৎস এবং আনন্দের উৎস বলে মানুষ কল্পনা করে এসেছে। দেবী রহস্যের সঙ্গে উৎপাদন প্রক্রিয়া, উদ্ভিদ জগৎ, কৃষি জগৎ, অন্ন (অন্নম্ প্রাণঃ) বস্ত্রের সংস্থান ও উৎপাদনের সম্পর্ক আছে বলেই দেবীর নাম হয় শাকম্ভরী, দেবীর নাম হয় অন্নপূর্ণা। সেই পরমেশ্বরী শাকম্ভরী উজ্জ্বল কান্তিযুক্তা, শতনয়না। তিনিই দুর্গা নামে প্রসিদ্ধা। শাকম্ভরী দেবীকে স্তব, ধ্যান, জপ, পূজা ও প্রণাম করলে শীঘ্র অনুপানরূপ অমৃত ফল লাভ হয়। আজও ফসল বোনার আগে, ভূমি কর্ষণের আগে ঘরের বউ-মেয়েরা অতি গোপনে মনের বাসনা জানিয়ে পূজো করে আসে শস্যক্ষেতের দেবীকে, প্রার্থনা জানায় উর্বর শস্যের। আবার ফসল ওঠার পর, গ্রামের একধারে কোনো এক রাতে দেবীর মূর্তি তৈরি করে পূজা করা হয়। গোটা গ্রাম তাতে যোগ দেয়। বিশ্বাস এই যে, দেবী সমস্ত ফসল রক্ষা করবেন। ভারতের ও বিশেষত বঙ্গের বিভিন্ন ব্রত যেমন ভাদো ব্রত, শস্পাতার ব্রত এবং আরও নানা ব্রতে এই কৃষি, ফসল, সন্তান, সুখ সমৃদ্ধির সাফল্য কামনার কথাই বিবৃত। এই ব্রতগুলির অনেকাংশই বেদের চেয়েও পুরনো। মেয়েদের দ্বারা তৈরি এবং মেয়েদের ব্রত।
এই জগৎ, এই প্রাণীজগৎ, এই উদ্ভিদজগৎ সমস্ত কিছুই দেবীর প্রকাশ। দেবী থেকেই সব সৃষ্ট। মার্কণ্ডেয় পুরাণে আছে, দেবী বলছেন- ‘আত্মদেহসমুদ্ভবৈ’। দেবী থেকেই এই জগতের সৃষ্টি এবং তিনি এই জগতের ভেতরেই বাস করেন। দেবীই দেশ ও জগৎ হয়েছেন। আবার তিনিই দেশমাতৃকা ও জগৎমাতৃকা রূপে পূজিতা।
এই প্রসঙ্গে দুর্গাপূজার কথা একটু বলা যায়। দুর্গা আদিতে ছিলেন শস্যদেবী। শস্য বপন (রোপণ), শস্য আহরণের মধ্যেই ছিল দেবীপূজার আয়োজন। দুর্গাপূজায় নবপত্রিকার পূজা একটি আবশ্যিক অঙ্গ। এই অনুষ্ঠানটি অবশ্যই কৃষি ও উদ্ভিদ জগতের সঙ্গে সম্পর্কিত। রম্ভা, কচ্চি, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মান ও ধানের পাতা দিয়ে নবপত্রিকা তৈরি কর হয়। এই নয়টি উদ্ভিদের প্রত্যেকটিকেই এক একজন দেবী বলে কল্পনা করা হয়। নবপত্রিকা স্থাপন এবং দুর্গাপূজার এই পর্যায়ে কৃষি ও উদ্ভিদ জগতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক চোখে পড়ে। সর্বতোভদ্রমণ্ডল যন্ত্র অঙ্কিত বেদীর মধ্যে অষ্টদল পদ্মের উপর এক অঞ্জলি শুক্লধান্য প্রদান করে ঘট বসাতে হয়। ঘটে শুদ্ধজল বা তীর্থজল, পঞ্চরত্ন, নবরত্ন, সুবর্ণ প্রদান করতে হয়। ঘটের মুখে পঞ্চপল্লব যথা-আম, অশ্বত্থ, অশোক, বট, ডম্বরপল্লব দিতে হয়। তার উপরে একসরা আতপ তণ্ডুল, তার উপরে স্বস্তিক অঙ্কিত সশীষ ডাব, তারপর
বস্ত্র প্রদান করতে হয়। সিঁদুর দিয়ে স্বস্তিক অঙ্কন করে ভূমি স্পর্শ করে পাঠ করতে হয় ওঁ ভুরসি, ভূমিরস্যদিতিরসি, বিশ্বধায়া বিশ্ব ভুবনস্য ধত্রী, পৃথিবীং যচ্ছ, পৃথিবীং দৃগুহ, পৃথিবীং মাহিগুঁসীঃ।।
বলা হচ্ছে-দেবী, তুমি বিশ্বভুবনের ধাত্রী, এই ধরিত্রীর ধাত্রী, এই পৃথিবী প্রকৃতি
তোমা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে, এবং তুমি এই সৃষ্টির সঙ্গেই বাস করো। তোমাকে আমরা এখানে আবাহন করছি। এখানে প্রয়োজনীয় সকল কিছু কৃষি ও
উদ্ভিদজগৎ থেকে নেওয়া। নবপত্রিকাকে দুর্গাপ্রতিমার ডান দিকে অতি যত্নে সসম্মানে স্থাপন করা হয়। নবপত্রিকার প্রতিটি বৃক্ষকে এক একটি দেবতার প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়।
নমঃ। রম্ভা-ওঁ হ্রী রম্ভাধিষ্ঠাত্র্যৈ ব্রহ্মান্যৈ নমঃ।
কচ্চি-ওঁ হ্রী কচ্চ্যধিষ্ঠাত্র্যৈ কালিকায়ৈ হরিদ্রা-ওঁ হ্রী হরিদ্রাধিষ্ঠাত্র্যৈ দুর্গায়ৈ নমঃ।
জয়ন্তি-ওঁ হ্রী জয়ন্ত্যধিষ্ঠাত্র্যৈ কার্তিক্যে নমঃ।
বিল্ব-ওঁ হাঁ বিল্বাধিষ্ঠাত্র্যৈ শিবায়ৈ নমঃ। দাড়িম্য-ওঁ হ্রী দাড়িমাধিষ্ঠাত্র্যৈ শিবায়ৈ নমঃ।
অশোক-ওঁ হ্রী অশোকাধিষ্ঠাত্র্যৈ শোকরহিতায়ৈ নমঃ। নমঃ।
মান-ওঁ হ্রী মানধিষ্ঠাত্র্যৈ চামুণ্ডায়ৈ নমঃ।
ধান-ওঁ হ্রী ধান্যাধিষ্ঠাত্র্যৈ মহালক্ষ্যৈ নমঃ।
ওঁ হাঁ নবপত্রিকাবাসিন্যৈ দুর্গায়ৈ নমঃ। নবপত্রিকার অধিষ্ঠাত্রী দেবীদুর্গা। তিনি এই কৃষিভিত্তিক জনজীবনে সমস্তরকম ধন ও সফলতার অধিষ্ঠাত্রী ও প্রতীক। তিনি এই সকল কিছুর ভেতর বাস করেন। তাঁর থেকেই উদ্ভিদ সৃষ্টি এবং তিনিও উদ্ভিদ থেকে সৃষ্ট। কুল্লুকভট্ট মনুস্মৃতির ব্যাখ্যায় বলেছেন, শ্রুতি দুই রকম-বৈদিক ও তান্ত্রিক। শক্তি সাধনার সঙ্গে শাক্ত দার্শনিক তত্ত্ব সম্পৃক্ত। প্রত্যক্ষভাবে শক্তিসাধনা বলতে তান্ত্রিক সাধনাকেই বোঝায়। শক্তিসাধনা সাধককে দেহে ও মনে শক্তিশালী করে তোলে। সাধনার ধাপগুলি হলো-সাধক, সাধ্য ও সাধনোপায়। শক্তিসাধনা প্রধানত গৃহস্থের সাধনা। ব্রহ্মজ্ঞানপরায়ণ ব্রহ্মানিষ্ঠ গৃহস্থ সাধককে বলা হয় গৃহাবধূত, আর সর্ব্বোচ্চ স্তরের শক্তি সাধককে বলা হয় কুলাবধূত। কুলাবধূত প্রত্যক্ষ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে হংস বা পরমহংস হয়ে যান। তন্ত্রশাস্ত্রে তাঁকেই সাক্ষাৎ শিবস্বরূপ বলা হয়েছে।
পশু, বীর ও দিব্যভাবের মধ্যে শক্তি সাধনার সর্বোচ্চ স্তর দিব্যভাবের সাধনা। স্থান অথবা চরিত্র বিশেষে তন্ত্রের তিনটি প্রধান সম্প্রদায়-গৌড়ীয়, কেরলীয়, কাশ্মীরি। পরব্রহ্মাস্বরূপিনী মহাশক্তি শক্তি সাধনার সাধ্যা। তাঁকেই বিভিন্ন সাধনোপায়ের মাধ্যমে পাবার চেষ্টাই হচ্ছে সাধকের সাধনা। এই শক্তি মহাশক্তির বহুরূপ। তিনি সর্বদেবময়ী। তবে প্রধানত দশমহাবিদ্যারূপেই তিনি শক্তিসাধনায় সাধিত হন। এই দশমহাবিদ্যা বলতে-কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী,
ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী, কমলা। (কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী। ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা।। বগলা সিদ্ধবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা। এতা দশ মহাবিদ্যাঃ সিদ্ধবিদ্যাঃ প্রকীর্তিতাঃ।।)। দশমহাবিদ্যার মধ্যে আবার কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরীর সাধনা বিশেষভাবে প্রচলিত। দশমহাবিদ্যার দেবী কালী এবং গৃহস্থ-পূজিতা দেবী দক্ষিণাকালীর রূপকল্পনা ও পূজাপদ্ধতি সম্পূর্ণ পৃথক। দশমহাবিদ্যা তত্ত্বে বর্ণিত দেবী কালীর সাধনার একমাত্র অধিকার সূক্ষ্মশরীরে অবস্থানকারী উচ্চকোটির সাধকদের।
মহাবিদ্যা আদ্যাশক্তি কালী। সকল বর্ণ একসঙ্গে মিলিত হয়ে হয় কৃষ্ণবর্ণ। কৃষ্ণবর্ণ লয়াত্মিকা শক্তি। মহাপ্রলয়ে বিশ্বপ্রপঞ্চ মহাকালী বা মহাপ্রকৃতিতে লয় হয়।
সাংখ্যকার মহর্ষি কপিলের মতে- কলন অর্থে গ্রাস করা। আবার কলন অর্থে স্পন্দিত হওয়া, স্বরূপচ্যুত হওয়া, কুণ্ডলিনী থেকে পরা, পশ্যন্তী, মধ্যমা ও বৈখরী অবস্থায় রূপান্তরিত হওয়া বোঝায়।
দক্ষিণ ভারতে কালী বা মহাকালী শ্রীবিদ্যা, ললিতা বা ষোড়শী নামে পরিচিতা। কাশ্মীরের ‘শ্রীনগর’ হলো শ্রীবিদ্যা সাধনার একটি প্রাচীন কেন্দ্র। মহাকাল
সংহিতা অনুসারে কামকলাকালী একদিক থেকে ভদ্রকালী বা শ্মশানকালী কিংবা গুহ্যকালী। মহাকালসংহিতা মতে কালী নয় রকমের যথা-দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, শ্মশানকালী, কালকালী, গুহ্যকালী, কামকলাকালী, ধনকালী, সিদ্ধকালী ও চণ্ডকালী।
শক্তিসাধনা সম্পর্কিত বিভিন্ন উপায় তন্ত্রে নির্দিষ্ট হয়েছে। প্রথমে দীক্ষাগ্রহণ, তারপর জপ, তারপর পূজা। তবে দীক্ষালাভ, জপ, পূজা প্রভৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন মত ও পথ আছে।
যন্ত্র দেবতার প্রতীক শুধু নয়, দেবতার রূপ, দেবীর অবয়ব, দেবীর শরীর। দেবী সাধকের ভাব ও ভক্তি অনুযায়ী যন্ত্রে প্রকাশমান হন। দশমহাবিদ্যার প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন যন্ত্র আছে। এ সাধনা দেবীকৃপা হলে সম্ভব। কথামৃতে আছে- ‘সাধ্য-সাধনার পর কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হন। ঈড়া, পিঙ্গলা, আর
সুষুম্না নাড়ী- সুষুম্নার মধ্যে ছটি পদ্ম আছে। ঈড়া, পিঙ্গলার গতি বা শক্তিপ্রবাহ নিম্নাভিমুখী। একমাত্র সুষুম্না ঊর্ধ্বগতিসম্পন্ন। সুষুম্নার সর্বনীচে মূলাধার, তারপর স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা। এইগুলিকে ষট্চক্র বল হয়।
কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হলে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর-এইসব পদ্ম ক্রমে পার হয়ে হৃদয়মধ্যে অনাহত পদ্ম, সেখানে এসে অবস্থান করে। তখন চৈতন্য হয় আর জ্যোতি দর্শন হয়।
বিশুদ্ধ চক্র পঞ্চম ভূমি। এখানে মন উঠলে কেবল ঈশ্বর কথা বলতে আর শুনতে প্রাণ ব্যাকুল হয়। এই চক্রের স্থান কণ্ঠ।
তারপর ষষ্ঠভূমি। আজ্ঞাচক্র দ্বিদল পদ্ম। এখানে কুলকুণ্ডলিনী এলে ঈশ্বরের রূপ দর্শন হয়। তারপর সপ্তমভূমি। সহস্রার পদ্ম। সেখানে কুণ্ডলিনী গেলে সমাধি হয়। সহস্রারে সচ্চিদানন্দ শিব শক্তির সাথে মিলিত হন। শিব-শক্তির মিলন। (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-৩ আগস্ট, ১৮৮৪, ২০শে শ্রাবণ) কুলকুণ্ডলিনীর অর্থ অব্যক্তা শক্তি। এই কামকলা শক্তি। কামকলা অর্থে অব্যক্ত ও সৃষ্টিবীজরূপিণী। কাম অর্থে শিব বা পরম শিব আর কলা অর্থে বিমর্শ শক্তি অর্থাৎ কালী।
কুণ্ডলিনীই কামকলা। কারণ অবস্থায় এই শক্তি বিশ্বের সকল প্রাণী ও পদার্থের মধ্যে নিহিত। তন্ত্রে এই শক্তি তেজোময় বিদ্যুল্লতাকারা; এই কুণ্ডলিনীই ইচ্ছা, জ্ঞান, ক্রিয়ারূপিণী (অগ্নি, চন্দ্র, সূর্য) শক্তি। সত্ত্ব,
রজঃ, তমো তিনগুণের মিলন। এই জন্যই বিমর্শশক্তি কলা ত্রিগুণাত্মিকা। মা, ত্রিগুণ স্বরূপিণী মা।
কালিকাপুরাণে আছে-প্রবাসে, পথে, দুর্গমস্থানে স্থানের অলাভে, জলে নিরুদ্ধাবস্থায়, সকল অবস্থায় জ্ঞানী দেবী মহামায়ার মানসী পূজা করবে। মনে মনে
হৃদয় মধ্যে যোগপীঠের ধ্যান করে সেই যোগপীঠেই পূজার অনুষ্ঠান করবে।
তন্ত্রের মূলকথা, মা মহামায়ার কৃপায় সদ্গুরু লাভ করা, আর সদ্গুরুর প্রসাদে মুক্তিলাভ। তন্ত্রে আছে অপরোক্ষ তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারাই মোক্ষ প্রাপ্তি হয়। তন্ত্র এক অসাধারণ আধ্যাত্মিক দর্শন। আসল কথা হলো শ্রীগুরুর প্রসাদে মুক্তিলাভ।
আরাধনায় দেবী সন্তুষ্ট হলেই সাধকের মনে, সাধকের চিদাকাশে উজ্জ্বল সূর্যের মতো বিচাররূপতা সাধককে দান করেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত থেকে জানা যায়- তিনি গাইছেন ফলহারিণী পূজা দিবসে-
‘তুমি স্বর্গ, তুমি মর্ত্য মা, তুমি যে পাতাল।
তোমা হতে হরি ব্রহ্মা, দ্বাদশ গোপাল। দশমহাবিদ্যা মাতা দশ অবতার। এবার কোনরূপে আমায় করিতে হবে পার।’
সর্বদেবময়ী পরাশক্তি। মহানির্বাণতন্ত্রে সদাশিব বলছেন, দেবী, তুমি কালী, তারিণী, দুর্গা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ধূমাবতী, বগলা, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, অন্নপূর্ণা, বাগদেবী ও কমলালয়া। তুমি সর্বশক্তিস্বরূপা।
দেবীপূজায়, তন্ত্রশাস্ত্রে ভাবই প্রধান। ভাব থাকলেই দেবীকৃপা লাভ হয়। ভাবে মুক্তিলাভ হয়, কুলবৃদ্ধি গোত্রবৃদ্ধি হয়। ভাবের দ্বারা জ্ঞান উৎপন্ন হয়, সেই জ্ঞান থেকে মোক্ষলাভ হয়। ভাব সর্বশাস্ত্রের গূঢ় বস্তু। সাধক যখন সমস্তের মূলভূত দেবীভাব লাভ করেন তখন তাঁর সর্বসিদ্ধি লাভ হয়। (ক্রমশ)

















