মহিষাসুরমর্দিনী মা দুর্গারই অপর নাম
মা জগদ্ধাত্রী
শেখর সেনগুপ্ত
মা আমাদের একজনই। ত্রিভুবনের কল্যাণেই তিনি তিনবার ত্রিমূর্তি ধারণ করেন এবং সামগ্রিকভাবে জীবজগৎকে পরিপূর্ণ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেন।
তিনিই মা দুর্গা, তিনিই মা কালী এবং তিনিই মা জগদ্ধাত্রী। মহিষাসুরকে বধ করবার পরবর্তীকালে মানব সমাজকে ন্যায় ও দয়ার আবহে টেনে আনবার জন্য সেই মা-ই জগদ্ধাত্রীর রূপ পরিগ্রহ করেন। মহিষাসুর বধের পরও জগৎ থেকে অনাচার, অত্যাচার দূর না হবার কারণে মায়ের পুনরায় আবির্ভাব। সেই লগ্নে মা কী রূপে আগমন করেন, তাঁর কাব্যিক বর্ণনা আমরা পাই কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের জগদ্ধাত্রী বর্ণনায়: সিংহস্কন্ধ সমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্। চতুর্ভুজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্।।
শঙ্খঙ্খশার্স সমাযুক্ত-বামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্। চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাশ্চং ধারয়ন্তীঞ্চ দক্ষিণ।। রক্তবস্ত্র পরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্। নারদাদ্যৈমুণিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।।
বঙ্গে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেছিলেন নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। বলপূর্বক টাকা আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় নবাব আলিবর্দি কৃষ্ণচন্দ্রকে কারারুদ্ধ করেছিলেন।
পরে বিজয়াদশমীর দিন অপ্রত্যাশিত মুক্তি পেয়ে তিনি যখন নৌকাযোগে নবদ্বীপ ফিরছিলেন, ভাবাবস্থায় দেখতে পান মাতা জগদ্ধাত্রীকে। মা বলছেন, ‘ঠিক
একমাস পর কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে আমাকে জগদ্ধাত্রীরূপে পূজা করবি। তুই তোর সম্মান, মান্যতা ও ক্ষমতা সবই ফিরে পাবি।’
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র মায়ের সেই নির্দেশ পালন করেন এবং বঙ্গের ইতিহাসে বিবিধ কৃতিত্বের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। পুরাণে উল্লেখ আছে যে, মহিষাসুরমর্দিনী মা দুর্গারই অপর একটি নাম জগদ্ধাত্রী। তিনিই শ্রীবিষ্ণুর যোগনিদ্রারূপিনী মা চণ্ডী। কার্তিক মাসের শুক্ল নবমীতে তাঁর পূজা। সেখানে তিনি দশভূজার বদলে চতুর্ভুজা। মহিষাসুর নেই। লক্ষ্মী ও সরস্বতীর পরিবর্তে রয়েছেন জয়া আর বিজয়া। কার্তিক-গণেশও অনুপস্থিত।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, স্বদেশ জননীর তিনটি রূপ। জগদ্ধাত্রী প্রাচীন ভারতমাতা, দুর্গা শত্রুদলনী জননী এবং মা কালী পরাধীনতার কালে সর্বরিক্তা
ভারতমাতা। দেবীর বাহন সিংহের পায়ের কাছে আছে একটি হস্তিমুণ্ড। ড. শশিভূষণ দাশগুপ্তর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’-এ উল্লেখ আছে, ‘…চণ্ডীর মধ্যেও দেবী জগদ্ধাত্রীর বিশ্বরূপের পরিচয় আমরা পাই। দৈত্যরাজ শুম্ভ দেবী কর্তৃক নিহত হলে স্বর্গের সকল দেব-দেবী একত্রিত হয়ে মা জগদ্ধাত্রীকে এই ভাষায় নিজেদের শ্রদ্ধা ও ভক্তিকে জ্ঞাপন করেন-
‘আধারভূতা জগৎত্ত্বমেকা মহীস্বরূপেণ যতঃ স্থিতাসি।’ অর্থাৎ আপনিই হলেন সেই দেবী, যিনি যুগে যুগে একাই ইহজগতের আশ্রয়স্বরূপা। নদীয়ার মহারাজা
কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮২) তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরে প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার বিশাল আয়োজন করেন। তদনুযায়ী প্রতি বছর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রীপূজা হয়ে আসছে। যিনি দুর্গা, তিনিই জগদ্ধাত্রী। প্রাচীন ব্যাবিলনের প্রতিটি নগরে একজন করে নগরপালিকা দেবীরূপে পূজ্যা ছিলেন। প্রত্যেক দেবীর রূপবর্ণনায় আমরা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় মাতা জগদ্ধাত্রীর। আদতে বিশ্বে মাতৃরূপিণী দেবী একজনই। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন নামে তাঁর পরিচিতি। এক দেবী দুর্গারই কত নাম! কাত্যায়নী, অপর্ণা, কৌশিকী ইত্যাদি। আদিতে হিন্দুরা কেবল মাতৃসাধনাই করতেন। শিবের আগমন অনেক পরে। দুর্গার অন্যতম নাম যে কাত্যায়নী, তার কারণ দূর অতীতে কাত্য নামক জনজাতিদের দ্বারা তিনি পূজিতা হলেন। কুশিক নরগোষ্ঠীর দ্বারা পূজিতা হতেন বলেই দুর্গার আর এক নাম কৌশিকী। আবার অসুরকে দলন করে জগতে শান্তি ও নিরাপত্তা এনছিলেন বলেই তিনি জদদ্ধাত্রী।
প্রাচীন গ্রিসের ইতিহাসেও অনুরূপ এক দেবীর সন্ধান পাওয়া যায়। নাম তাঁর ডিবন। এই দেবী আমাদের মা কালীর মতো একাধারে যেমন স্নেহময়ী, অন্যদিকে অপরাধীদের প্রতি ততটাই খঙ্গহস্ত। বিশ্বের প্রাচীন সভ্য দেশগুলির অন্যতম ভারতবর্ষ মাতৃসাধনার একটি শক্তপোক্ত স্থান। এখানে প্রকৃত মাতৃশক্তির
আরাধনা চলে। মিথ্যা ও চালবাজি এখানে ঘোরতর অপরাধরূপে চিহ্নিত। স্বয়ং ব্রহ্মা এহেন দেবীর প্রতি এই স্তব উচ্চারণ করেছেন- ত্বং স্বহা ত্বং স্বধা ত্বং হি কষটকারঃ স্বরাস্থিকা। সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা।।

















