ভারতবাসীর জাতীয় প্রেরণা সার্ধশতবর্ষে বন্দে মাতরম্
গৌতম সরকার
ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বন্দে মাতরম্ এমনই একটি সংগীত তথা একটি ধ্বনি যার ইতিহাস শুধু এদেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বের কাছে এক অনন্য, স্বতন্ত্র তথা নজিরবিহীন। একটি গান যা নিজের কাব্যময়তা, গীতি-মাধুর্য, ধ্বনিঝংকার, ওজস্বী উচ্চারণে হয়ে উঠেছে নিখাদ দেশ-বন্দনার মহামন্ত্র। পরাধীন ভারতবর্ষে যে ধ্বনি একসময় হয়ে উঠেছিল বিপ্লবী তরুণদের কণ্ঠে এক জাগরণী মন্ত্র। এই গান এবং এতে ব্যবহৃত নামাঙ্কিত শব্দবন্ধকে কেন্দ্র করে আসমুদ্র হিমাচলব্যাপী যে জাগরণ দেখা গিয়েছিল তা এই দেশে আর অন্য কোনো দেশাত্মবোধক সংগীতকে ঘিরে দেখা যায় না। বিশ শতকের প্রথমার্ধে এই ধ্বনি
কেবলমাত্র এই দেশের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। ২২ আগস্ট ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে ইন্টারন্যাশনাল সোশালিস্ট কনফারেন্সে মাদাম ভিকাজী রুস্তম কামা, যাঁকে ‘ভারতের বিপ্লববাদের জননী’ বলা হতো, তিনি প্রকাশ করেন নিজের নক্শা করা ভারতের একটি জাতীয় পতাকা। ত্রিবর্ণ রঞ্জিত সেই পতাকার মধ্যভাগে লেখা ছিল ‘বন্দে মাতরম্’ শব্দবন্ধটি। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে মাদাম কামা জেনেভা থেকে প্রকাশ করেন ‘বন্দে মাতরম্’ নামাঙ্কিত একটি সাময়িক পত্র।
ঋষি অরবিন্দের কথায় ‘বন্দেমাতরম্’ হলো: ‘Vision of our Mother’। গান্ধীজী বলেছেন, ‘When we sing that ode to motherland, ‘Bande Mataram’, we sing it to be the whole of India।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন: ‘আমাদের বন্দে মাতরম্ মন্ত্র বাংলাদেশের বন্দনামন্ত্র নয়-এ হচ্ছে বিশ্বমাতার বন্দনা- সেই বন্দনার গান আজ যদি আমরা প্রথম উচ্চারণ করি তবে আগামী ভাবীযুগে একে একে সমস্ত দেশে এই মন্ত্র ধ্বনিত হয়ে
উঠবে।’
‘বন্দে মাতরম্’ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বদেশমন্ত্র তথা জাতীয় জাগরণের বীজমন্ত্র। এই ধ্বনিকে কণ্ঠে নিয়ে দেশের বীর বিপ্লবীরা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছিলেন। এঁদের মধ্যে আবার কেউ কেউ এই ধ্বনি উচ্চারণে হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে মৃত্যুবরণ করেছেন। সেই সময়
বহু স্বদেশি গানেও ‘বন্দে মাতরম্’ শব্দবন্ধটি বারে বারে এসেছে। ‘বন্দেমাতরম্’ ধ্বনিকে কেন্দ্র করে বহু নিষেধাজ্ঞা জারি করে ব্রিটিশ সরকার। তদানীন্তন সময়ে বিপিনচন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষ, মাদাম কামা এবং লালা লাজপত রাইয়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘বন্দে মাতরম্’ নামে তিনটি পৃথক সাময়িকপত্র। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের যুগে স্বদেশি গান গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করা, এমনকী প্রয়োজনে ভিক্ষাবৃত্তিকেও অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর উপদেশ মেনে কলকাতায় সেই সময় ‘বন্দে মাতরম সম্প্রদায়’ নামে গান গেয়ে ভিক্ষাসংগ্রহকারী একটি দলের প্রতিষ্ঠা হয়।
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এই সম্প্রদায়ের সভাপতি। সহ-সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং দীঘাপাচিয়ার কুমার শরৎকুমার রায়। ভিক্ষা সংগ্রহকারীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ভারতে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করা।
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীত। ‘আনন্দমঠ’-এর সন্তান সম্প্রদায় স্বদেশ প্রেরণার উদ্দীপন সংগীত হিসেবে গানটি কখনো এককভাবে আবার কখনো সমবেত ভাবে গেয়েছেন। উপন্যাসে ‘বন্দে মাতরম্’-এর প্রথম গায়ক
হলেন ভবানন্দ। ‘বন্দে মাতরম্’ শব্দবন্ধটির আক্ষরিক অর্থ ‘বন্দনা করি মায়ের’। ‘মা’ এখানে দেশমাতৃকা। তিনি বঙ্গজননী তথা সমগ্র ভারতজননী। বঙ্কিমচন্দ্রের মেজদাদা সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত বঙ্গদর্শন পত্রিকার চৈত্র ১২৮৭ বঙ্গাব্দ থেকে জ্যৈষ্ঠ: ১২৮৯ বঙ্গাব্দের বিভিন্ন সংখ্যায় ধারাবাহিক
ভাবে প্রকাশিত হয় ‘আনন্দমঠ’। এর মধ্যে চৈত্র ১২৮৭ বঙ্গাব্দে ‘আনন্দমঠ’-এর প্রথম খণ্ড দশম পরিচ্ছেদে প্রকাশিত হয় ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি। Bengal Library Cata- logue অনুসারে বঙ্গদর্শন-এর চৈত্র ১২৮৭ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০ জুলাই ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে। ‘আনন্দমঠ’ পৃথক
গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে।
তবে ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি বঙ্কিমচন্দ্র রচনা করেছিলেন ‘আনন্দমঠ’ রচনার প্রায় আটবছর আগে অক্টোবর ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে। আরও সঠিকভাবে নিরূপণে ওই বছর ১৮ অক্টোবরের পর কোনো একটি দিন। ওই বছর ১৮ অক্টোবর দুর্গাপূজার সপ্তমী ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের পৈতৃক ভিটে নৈহাটির কাঁটালপাড়ার বাড়িতে একসময় দুর্গাপূজার প্রচলন করেন তাঁর বাবা রায়বাহাদুর যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র কর্মসূত্রে মালদহের ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন পূজার ছুটিতে
বাড়িতে এসেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রের ছোটোভাই পূর্ণচন্দ্রের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় রেনেটি ঘরানার কীর্তন গায়ক বলহরি দাসের কণ্ঠে ‘এসো এসো বঁধু এসো, আধ আঁচরে বসো’ গানটি শুনে মুগ্ধ হয়ে যান এবং কিছুদিন পর বঙ্গদর্শন পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যায়, ১২৮১ বঙ্গাব্দে এই গানকে কেন্দ্র করে লেখেন ‘কমলাকান্ত’ গ্রন্থের অন্তর্গত ‘একটি গীত’ শীর্ষক একটি রচনা। ১২৮১ বঙ্গাব্দ অর্থে ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে বলহরি দাসের কণ্ঠে ওই কীর্তন শুনে সম্ভবত বঙ্কিমচন্দ্রের অন্তরে যে ভাবতন্ময় ঘটে, তাতে তিনি দেশমাতৃকার ভাবনায় ভাবিত হন। ফলে এই সময়টি ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীত রচনার পক্ষে একেবারেই উপযুক্ত।
‘আনন্দমঠ’ রচনার আগে বঙ্কিমচন্দ্র যে ‘বন্দে মাতরম্’ রচনা করেছিলেন এই সম্পর্কে পূর্ণচন্দ্রের লেখা ‘বঙ্কিমচন্দ্রের বাল্যকথা’ শীর্ষক স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়- বঙ্গদর্শন সম্পাদনাকালে ওই পত্রিকার কর্মাধ্যক্ষ রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় পত্রিকার একটি পৃষ্ঠাপূরণের প্রয়োজনের কথা সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্রকে জানান। ওই সময় ঘরে টেবিলের উপর ‘বন্দেমাতরম্’ গান লেখা একটি পৃষ্ঠা দেখে কর্মাধ্যক্ষ জানান যে, এই গীতটি নেহাত মন্দ হবে না। সম্পাদক বিরক্ত
হয়ে ওই কাগজটি সেই টেবিলের দেরাজের ভিতর রেখে দিয়ে কর্মাধ্যক্ষকে বলেছিলেন- ‘উহা ভালো কী মন্দ এখন তুমি বুঝিতে পারিবে না, কিছুকাল পরে উহা বুঝিতে পারিবে- আমি তখন জীবিত না থাকিবারই সম্ভব, তুমি থাকিতে পার।’ এ প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু দীনবন্ধু মিত্রের ছেলে ললিতচন্দ্র মিত্রর বর্ণনায়-” ‘বন্দে মাতরম’ রচিত হইবার পরে বঙ্কিমচন্দ্রের গৃহে তদানীন্তন সুকণ্ঠ গায়ক ভাটপাড়ার স্বর্গীয় যদুনাথ ভট্টাচার্য মহাশয়
ইহাতে সুরতাল সংযুক্ত করিয়া প্রথম গাইয়াছিলেন। সেইদিন বিখ্যাত ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রের কার্যাধ্যক্ষ পণ্ডিত শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় তথায় উপস্থিত
ছিলেন। কার্যানুরোধে বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের কীসে ‘বঙ্গদর্শনে’র পৃষ্ঠা সত্বর পূরিত হয়, সেই দিকেই লক্ষ্য ছিল। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রকে বলিয়াছিলেন, ‘গান যাহাই হউক, বন্দে মাতরম্ দ্বারা ‘বঙ্গদর্শন’-এর পেট ভরিবে না। আপনি একখানি উপন্যাস লিখিতে আরম্ভ করুন।’ তদুত্তরে বঙ্কিমচন্দ্র কহিয়াছিলেন, ‘এ গানের মর্ম তোমরা এখন বুঝিতে পারিবে না; যদি পঁচিশ বৎসর জীবিত থাক, তখন দেখিবে, এই গানে বঙ্গদেশ মাতিয়া উঠিবে।”
বঙ্কিমচন্দ্রের বড়দাদা শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ছোটো ছেলে শচীশচন্দ্র ‘বঙ্কিম-জীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন- “বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর দুই চারি বৎসর পূর্বে, একদা আমার ভগিনী (বঙ্কিমচন্দ্রের জ্যেষ্ঠকন্যা) তাঁহার পিতার নিটক ‘বন্দে মাতরম্’ গানের কথা তুলিয়াছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র বলিয়াছিলেন, ‘একদিন দেখিবে- বিশ ত্রিশ বৎসর পরে একদিন দেখিবে, সেই গান লইয়া বাঙ্গালা উন্মত্ত হইয়াছে-বাঙ্গালি মাতিয়াছে।’ বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর কিছুদিন পরে আমি এই গল্পটি আমার ভগিনীর নিকট শুনিয়াছিলাম।”
উপরিউক্ত তিনজন ব্যক্তির রচিত বক্তব্য থেকে দু’টি বিষয় সম্পর্কে সুনিশ্চিত হওয়া যায়। প্রথমত, বঙ্গদর্শন পত্রিকার একটি পৃষ্ঠা পূরণের প্রয়োজনে পত্রিকার কর্মাধ্যক্ষকে সেই সময় কেবলমাত্র ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি মুদ্রণের অনুমতি বঙ্কিমচন্দ্র দেননি।
দ্বিতীয়ত, ‘বন্দেমাতরম্’ গানটি রচনার পর বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং অনুভব করেছিলেন যে, এই গান আগামী কয়ক বছরের মধ্যেই স্বৈরাচারী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে দেশের জনসাধারণকে উদ্দীপিত করতে পারবে।
বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের পরেই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্রকে ব্রিটিশ প্রশাসন আকস্মিক ভাবে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের
সহ-সচিবের পদ থেকে সরিয়ে দেয়। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তাঁকে বদলি করা হয় একজায়গা থেকে দূরবর্তী অন্য কোনো জায়গায়। যেহেতু তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার মতো পর্যাপ্ত তথ্য ছিল না সরকার বাহাদুরের হাতে, তাই পরোক্ষ শাস্তির পথ অবলম্বন করে বঙ্কিমচন্দ্রকে সরকারের অসন্তোষ সম্পর্কে অবগত করা হয়। তবে দেশীয় জনমানসে এই বিষয়ে যাতে কোনো ক্ষোভ-বিক্ষোভ সৃষ্টি না হয় সেই জন্যই সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় যে
‘অ্যাসিস্টেন্ট সেক্রেটারি’ পদটি বিলোপ করা হয়েছে বলেই তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে।
ললিতচন্দ্র মিত্রের বর্ণনায় আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীতের প্রথম সুরারোপ করেন বঙ্কিমচন্দ্রের সংগীত শিক্ষক সেকালের প্রখ্যাত ধ্রুপদশিল্পী যদুনাথ ভট্টাচার্য বা যদুভট্ট। শোনা যায় ‘আনন্দমঠ’ প্রকাশের আগে গোপালচন্দ্র ধর ও ক্ষেত্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামে আরও দু’জন ব্যক্তি ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীতের সুরারোপ করেছিলেন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মার্চ ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি। সংগীত পরিচালনায় ছিলেন সংগীতাচার্য দেবকণ্ঠ বাগচী। ওই দিন অভিনেত্রী ও গায়িকা বনবিহারিণীর নেতৃত্বে ঝাঁপতালে নিবন্ধ তিলকামোদ রাগে সমবেতভাবে প্রথমবারের জন্য মঞ্চে গাওয়া হয় ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীত। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মার্চ সাবিত্রী লাইব্রেরির পঞ্চম বার্ষিক অধিবেশনের শেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
নিজের কণ্ঠে গেয়েছিলেন ‘বন্দে মাতরম্’; সম্ভবত সেটিই প্রথম কোনো প্রকাশ্য সভার রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে প্রথমবার ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীত পরিবেশন। সেই গানের সুর সংযোজনও করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। অমল হোম সম্পাদিত The Calcutta Munici- pal Gazette, Special Issue 1941-এ উল্লেখিত তথ্য থেকে জানা যায়, ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে উদ্বোধনের দিন রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দে মাতরম্’
সংগীতটি পরিবেশন করেন। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল প্রয়াত হন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এরপর ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের দ্বাদশ অধিবেশনে উদ্বোধন সংগীত হিসেবে ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি পরিবেশন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রয়াণের পর এখন অবধি বহু জন বহু সুর দিয়েছেন, গানটি রেকর্ড করেছেন অসংখ্য সংগীত শিল্পী।
স্বাধীনতা সংগ্রাম যতই এগিয়েছে ততই ‘বন্দে মাতরম্’ গানটির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে হাজার হাজার ভারতবাসীর আবেগ ও আত্মত্যাগের স্মৃতি। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য, ভারত ছাড়ো আন্দোলন-সহ পরাধীন দেশে ছোটো-বড়ো যাবতীয় সরকারি নীতিবিরোধী সংগ্রামে বিপ্লবীদের স্বদেশপ্রেমের সঞ্জীবনী মন্ত্রই ছিল এই ‘বন্দে মাতরম্’। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের কথায়- ‘১৯০৫ থেকে ১৯৪৭ এই দীর্ঘ ও দুঃসাধ্য স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের দেশপ্রেমী সন্তানদের যুদ্ধ নিনাদ ছিল ‘বন্দে মাতরম্’ এবং ‘বন্দে মাতরম্’ মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে তারা হাজারে হাজারে ব্রিটিশ পুলিশের লাঠির সামনে দাঁড়িয়েছে অথবা ফাঁসির মঞ্চে উঠে গেছে…’।
অথচ একটা সময়ে এসে, সম্পূর্ণ সংকীর্ণ রাজনীতির কারণে গানটিকে ঘিরে শুরু হয় নানান বিতর্ক। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামসে ম্যাকডোনাল্ডের ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতির পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট ভারতীয় রাজনীতির নতুন প্রেক্ষাপটে লিগপন্থী মুসলমান সম্প্রদায় ক্রমশ পৌত্তলিকতার দোষে দুষ্ট ‘বন্দে মাতরম্’ গানটিকে দেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করার সপক্ষে তীব্র আপত্তি জানায়। কোনো কোনো সভায় মুসলমান ছাত্র ও
জনতার আপত্তির দরুন এই গান প্রকাশ্যে গাওয়াই দুঃসাধ্য হয়ে উঠতে লাগল। তাঁদের কাছে উপরন্তু এই গানটি ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের অন্তর্ভুক্ত আছে বলে ‘বন্দে মাতরম্’কে আরও আপত্তিজনক বলে মনে হয়। শুরু হলো ‘আনন্দমঠ’-এর বহু্যুৎসব। কলকাতার রাজপথে প্রকাশ্যে পোড়ানো হয় স্তূপীকৃত ‘আনন্দমঠ’ গ্রন্থ। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি এবং নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিতে এবিষয়ে আলোচনা করে ‘বন্দে মাতরম্’ গানটির অঙ্গচ্ছেদ করে তা সর্বজনগ্রাহ্য হয় কিনা তার প্রচেষ্টা শুরু হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ‘ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণ-ধারিণী/কমলা কমলদল
-বিহারিণী/ বাণী বিদ্যাদায়িনী/নমামি ত্বাং’ অংশটি বাদ দিয়ে একে সকলের গ্রহণযোগ্য করা যায় কিনা। সুভাষচন্দ্র বসু তখন সদ্য বিদেশ থেকে ফিরে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য কার্শিয়াঙে আছেন, সেখান থেকে ওই বছর ১৬ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এবং ২০ অক্টোবর ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে এই বিষয়ে তাঁদের মতামত জানতে চান। জওহরলাল নেহরু তখন কংগ্রেস সভাপতি। তিনি ২৫ অক্টোবর ১৯৩৭ কলকাতায় এসে
একান্তভাবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে আসেন। ২৬ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ একান্ত সচিবের মাধ্যমে ‘বন্দে মাতরম্’ নিয়ে তাঁর অভিমত জওহরলাল নেহরুকে লিখে পাঠান। যেখানে রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টতই বলেন যে, বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতকালে তিনি নিজে এই ‘বন্দে মাতরম্’ গানের প্রথম দুটি স্তবক সুর দিয়ে তাঁকে গেয়ে শোনান এবং ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দের কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশনেও তিনি ওই অংশটুকুই গেয়েছিলেন। ফলে ভারতীয় সংগীত হিসেবে
‘বন্দে মাতরম্’-এর প্রথম দুটি স্তবক গ্রহণ করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমর্থন লাভের পর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ২৮ অক্টোবর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জাতীয় সভাসমিতিতে ‘বন্দে মাতরম্’ গাওয়া হলে গানটির প্রথম দুটি স্তবকই গাওয়া হবে। তবে এই গানটির পরিবর্তে অন্য কোনো সর্বজনগ্রাহ্য গান পরিবেশনের পূর্ণস্বাধীনতাও উদ্যোক্তাদের থাকবে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এই ঐতিহাসিক প্রস্তাবের মুসাবিদা করেন জওহরলাল নেহরু।
বঙ্গের তদানীন্তন সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা তখন এক সভায় মিলিত হয়ে ‘বন্দে মাতরম্’-এর অঙ্গচ্ছেদের তীব্র নিন্দা করেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৭-এ ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীতের প্রথম দুটি স্তবক জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হলো ঠিকই কিন্তু মুসলিম লিগকে বিন্দুমাত্র সন্তুষ্ট করা গেল না। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে জিন্না যে এগারো দফা দাবি উত্থাপন করলেন, তার প্রথম দফাটিই ছিল: ‘বন্দে মাতরম্’ বর্জন। ‘The Bande Mataram song to be given up’। এর প্রায় দশ বছর পর ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর জওহরলাল নেহরু-সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের এই গানের প্রতি ঔদাসীন্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভার একটি অনুষ্ঠানে ভারতীয় প্রতিনিধিদের জাতীয় সংগীত পরিবেশ করার অনুরোধ করা হলে তাঁরা তৎকালীন ভারত সরকারের নির্দেশকে মান্যতা দিয়ে ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ গানটি পরিবেশন করেন। এরপর থেকে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বাদ্যসংগীত এবং বিদেশি দূতাবাসের অনুষ্ঠানগুলিতে এই ‘জনগণমন’ গানই ব্যবহৃত হতে থাকে।
এই নিয়ে স্বভাবতই নেহরু সরকারকে সারা দেশে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। ‘বন্দে মাতরম্’ সম্পর্কে কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ায় বলা হয়েছে- ‘The greatest and most enduring gift of the Swadeshi movement was Bande Mataram, the Uncrowned national anthem.’ এই ‘অনিভিষিক্ত জাতীয় সংগীতের অভিষেক’ যখন দেশ প্রত্যাশা করছে তখন তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় অসন্তোষ দিকে দিকে পুঞ্জীভূত হতে থাকলো। গণপরিষদের অধিবেশনের শুরুতে সুচেতা কৃপালনীর কণ্ঠে ‘বন্দে মাতরম্’-ই গাওয়া হয়েছিল। স্বাধীন ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত কোনটি হবে এই নিয়ে সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিলম্বিত হতে থাকে।
গণপরিষদের একাধিক সদস্যের চাপে অবশেষে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ২৫ আগস্ট একটি বিবৃতি দিয়ে ঘোষণা করেন যে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ সভার অধিবেশনে ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানের সুর বাদ্যযন্ত্রে বাজানো হয়েছিল, কারণ: ‘there was no proper murical rendering of any other national song which we could send abroad.’ তবে তিনি একথাও বলেন যে, ”Vande
Mataram’ is obviously and indisput- ably the premier national song of India, with a great historical tradi- tion and intimately connected with our struggle for freedom. That posi- tion is bound to retain and no other song can displace it.’
অর্কেস্ট্রায় সুরযোজনার ক্ষেত্রে ‘বন্দে মাতরম্’-এর অপেক্ষা ‘জনগণমন’ অধিকতর উপযোগী- এই সমস্যার সমাধানের জন্য ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র সুরেশচন্দ্র মজুমদার এবং পুনার মাস্টার কৃষ্ণরাও তাঁদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় তাঁরা প্রমাণ করলেন যে, ‘বন্দে মাতরম্’-ও
অর্কেস্ট্রায় সাফল্যের সঙ্গে গীত হতে পারে। এই বাদানুবাদের নিরসনের জন্য গণপরিষদ একটি ‘জাতীয় সংগীত নির্ধারণ কমিটি’ গঠন করে। ওই কমিটি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে সুপারিশ করে ‘বন্দে মাতরম্’ ও ‘জনগণমন’ এই দুটি গানকেই জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেওয়া হোক। তবে এই কমিটি একথাও জানায় যে, ‘বন্দে মাতরম্’ গাওয়া হবে কণ্ঠসংগীত হিসেবে। তবে এই বিষয়টি গণপরিষদের আলোচ্য সূচিতে থাকলেও শেষপর্যন্ত তা অনালোচিতই থেকে যায়। অবশেষে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ নভেম্বর ভারতীয় সংবিধান রচনার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার প্রায় দু-মাস পরে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি গণপরিষদের শেষ অধিবেশনে ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ পরিষদের সভাপতিরূপে একটি বিবৃতি দেন:
“The composition consisting of the words and music known as Janaganamana is the National An- them of India subject to such alter- ation in the words as the Government may authorise as occasion arises; and the song Vande Mataram’ which
was played a historic Part in the struggle for Indian Frendom shall be honoured equally with Janaganamana and shall have equal status with it (Applause). I hope this will satisfy the members.”
উপরিউক্ত বিবৃতি অনুযায়ী ‘জনগণমন’ স্বাধীন ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত হলেও ‘বন্দে মাতরম্’ সমভাবেই সম্মানিত এবং ‘জনগণমন’-র সমমর্যাদায় ভূষিত। ২০২২-এর ৫ নভেম্বর দিল্লি হাইকোর্টে এক জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে জমা দেওয়া হলফনামায় বলা হয় “জাতীয় সংগীত ও জাতীয় স্তোত্রের মর্যাদা সমান। তাই প্রতিটি নাগরিকের উচিত ‘বন্দে মাতরম্’ ও ‘জনগণমন’- এর প্রতি সমান সম্মান প্রদর্শন
করা।”
১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বন্দে মাতরম্’ সংগীতের সার্ধশতবর্ষের সূচনা হয় ২০২৪-এর অক্টোবরে আর এই
বছর অক্টোবরে এর বর্ষপূর্তি। ‘বন্দে মাতরম্’-এর সৃষ্টি, ব্যাপ্তি, নানা বিতর্ক পরিশেষে রাষ্ট্রীয় সংগীতের মর্যাদা প্রাপ্তি ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় যতটুকু ধারণা করা যায়, তা হলো এই গান হলো আমাদের জাতীয় প্রেরণা। যে গান কণ্ঠে নিয়ে অসংখ্য বীর বিপ্লবীর আত্মত্যাগ ও আত্মবলিদানের বিনিময়ে এসেছে আমাদের এই স্বাধীনতা। স্বাধীনতার ৭৯তম বর্ষে প্রতিটি ভারতীয় নাগরিককে যে অঙ্গীকারের শপথ নিতে হবে, তা হলো- রাষ্ট্রের স্বাধীনতার মর্যদা রক্ষা করার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সংগীতের মর্যাদাকেও যথোচিতভাবে রক্ষা করে চলার।

















