ভারতে শক্তিসাধনার ইতিহাস
ড. অনিমেষ চক্রবর্তী
দেবী ত্রিপুরসুন্দরী অথবা ষোড়শী-দেবী কালিকাই ষোড়শী, আবার তিনিই ত্রিপুরসুন্দরী অথবা মহাত্রিপুরসুন্দরী। সর্বদা শ্রী প্রদান করেন বলে দেবীকে শ্রীবিদ্যাও বলা হয়। নারদপঞ্চরাত্র থেকে জানা যায়, একদা স্বর্গের অপ্সরাগণ কৈলাস পর্বতে শিবকে দর্শন করতে যান। শিব অপ্সরাদের সামনেই দেবীকে ‘কালী কালী’ বলে ডাকেন, এতে দেবী লজ্জা পেয়ে মনে মনে স্থির করেন তিনি কালীরূপ ত্যাগ করে গৌরীরূপ ধারণ করবেন। এই উদ্দেশ্যে দেবী কৈলাস থেকে অন্তর্হিতা হয়ে সুমেরু পর্বতের উত্তর পার্শ্বে অবস্থান করেন।
দেবর্ষি নারদ একদিন শিবের সঙ্গে দেখা করতে এসে দেবীর কথা জিজ্ঞেস করলেন এবং সুমেরু পর্বতে গিয়ে অনেক স্তবস্তুতি করে দেবীকে প্রসন্ন করলেন। দেবীর প্রশ্নের উত্তরে নারদ তাঁর স্বভাব অনুযায়ী দেবীকে বললেন যে, দেবাদিদেব আবার বিবাহের উদ্যোগ করছেন। মা তুমি গিয়ে তা বন্ধ করো। দেবী তখন অপূর্ব সুন্দরী রূপ ধারণ করে শিব সকাশে উপস্থিত হয়ে শিবের হৃদয়ে নিজের ছায়া দেখতে পেলেন। কিন্তু দেবী সেই ছায়ামূর্তিকে নিজের বলে চিনতে না পেরে মহেশ্বরকে নানাভাবে ক্ষোভ ব্যক্ত করেন। মহাদেব বললেন, দেবী ধ্যানস্থ হয়ে জ্ঞানদৃষ্টিতে দেখ আমার হৃদয়ের ওই ছায়াটি তোমারই। দেবী তখন তা দেখে শান্ত হলেন। দেবাদিদেব বললেন, দেবী ত্রিভুবনে সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ ধারণ করেছ বলে তুমি স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালে সর্বত্র সুন্দরী পঞ্চমীশ্রী এবং ত্রিপুরসুন্দরী নামে প্রসিদ্ধ হবে। সদা সর্বথা ষোড়শবর্ষীয়া বলে ষোড়শী নামেও জগতে বিখ্যাত হবে।
রক্ত, শুক্ল, মিশ্র এই ত্রিবিন্দু; মাতা, মান, মেয় তিন রূপ; ত্রিধাম সোম সূর্য অগ্নি; ত্রিপীঠ কামরূপ, জালন্ধর, পূর্ণগিরি; ত্রিশক্তি ইচ্ছা জ্ঞান ক্রিয়া। বান ইতর পর ত্রিলিঙ্গ অকথ নামক ত্রিধাভিন্ন মাতৃকাত্রিতর। ত্রিবিধাত্মক সর্বপ্রপঞ্চের আবির্ভাব ও তিরোভাব ভূমি বলে পরাশক্তিকে ত্রিপুরা নামে অভিহিত করা হয়। দেবীর মণ্ডল ত্রিকোণ, ভূপুর ত্রিরেখ, মন্ত্র এ্যক্ষর। তাঁর রূপও ত্রविধ। কুণ্ডলীশক্তি ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর, এই ত্রিদেবের সৃষ্টিতেই ত্রিবিধা হন।
দেবী সর্বদা শ্রী প্রদান করেন তাই তিনি শ্রীবিদ্যা। দেবী নির্গুণা বলে যোড়শী। এই দেবী ষোড়শীকেই মহা ত্রিপুরসুন্দরী বলা হয়।
দেবী ষোড়শীকে আরাধনার আগে দেবী অন্নপূর্ণা ভৈরবী মন্ত্র, শ্রীবিদ্যামন্ত্র ও লোপামুদ্রা মন্ত্র সম্পর্কে জানা আবশ্যক। ষোড়শীদেবীর বীজবলী সর্বতন্ত্রে গোপিত। ব্রহ্মযামল, সিদ্ধযামল, রুদ্রযামল প্রভৃতি থেকে দেবী ষোড়শীর স্তবরাজি ও দেবীস্তোত্রের পর দেবীকবজ পাঠ বিধেয়। দেবী ষোড়শীর বাগভব, কামরাজ ও শক্তিবীজ এই তিনটি কুট বা বীজ আছে। দেবী ষোড়শীর কবচের দক্ষিণামূর্তি ঋষি, পঙ্ক্তি ছন্দ, ত্রিপুরসুন্দরী দেবতা, ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ লাভের জন্য এই কবচ পাঠ বিধেয়। এই দেবীকবচ দেবতাদেরও দুর্লভ। এই কবচ পাঠ করলে মানুষের সর্বসিদ্ধি এবং সর্বকামনা পূর্ণ হয়। ব্যাধিভয়, পাতকভয়, মহামারীভয় থাকে না। দরিদ্রতা থাকে না, এমনকী মৃত্যুরও বশীভূত হয় না। শ্রীবিদ্যা জপে এই কবচ জানা অপরিহার্য।
দেবী ভুবনেশ্বরী-দেবী এই বিশ্বভুবনের পালন করেন। সৃষ্টি- স্থিতি-লয় করেন, ভূত-বর্তমান-ভবিষ্যতের সর্বজ্ঞ ও সর্বনিয়ন্তা বলেই দেবীকে ভুবনেশ্বরী নামে ডাকা হয়। দেবী ভুবনেশ্বরী জগতের দুঃখকে সংহত করেন; ভয় ভীতি দূর করেন, সৃষ্টি করেন, আবার সৃষ্টির বীজসকল ক্রমশ খাদ্যের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকায় দেবী নখাগ্রের দ্বারা কুড়িয়ে রাখেন।
ভুবনানাং পালনত্বাদ্ভূবনেশী প্রকীর্তিতা। সৃষ্টিস্থিতিকরী দেবী ভুবনেশী প্রকীর্তিতা।।
-প্রাণতোষিণী, বসুমতী সং, পৃ.-৩৭৪
মহাদেবী মহাকালী যেমন, তেমনই দেবী ভুবনেশ্বরীও আধার পদ্মে শায়িতা কুলকুণ্ডলিনী শক্তির অভিন্ন রূপ। কুণ্ডলিনী শক্তির অখণ্ডস্বরূপ বিচ্ছুরিত হলে শরীরের অন্তর্দেশে পরাপশ্যন্তি মধ্যমা এবং বহির্দেশে বৈখরী প্রকাশিত হয়।
দেবী ভুবনেশ্বরীর শরীর শ্যামবর্ণ, কপালে অর্ধচন্দ্র, দেবী চতুর্ভুজা, চারহাতে বরমুদ্রা, রক্তোৎপল, পানপাত্র ও অভয়মুদ্রা। দেবী স্তনভারে নম্র। দেবীর গলদেশে মুক্তাহার, দেবী ত্রিনেত্রা, রক্তপদ্মের উপর বসে আছেন। শারদাতিলকে দেবীর বর্ণনা এরকম-
শ্যামাঙ্গীং শশীশেখরাং নিজকরৈদানং চরক্তোৎপলং রত্নাঢ্যং চষকংপরং ভয়হরং সংবিভ্রাতীং শাস্বতীম্। মুক্তাহারলসৎপয়োধরনতাং নেত্র ব্রায়োল্লাসিনীং বন্দেহহং সুরপুজিতাং হরবধূং রক্তারবিন্দস্থিতাম্।
দেবী ভৈরবী-দেবী ভৈরবী এই জগতের, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ভরণপোষণ, পালন করেন। সৃষ্টি সমূহের সকল ক্রিয়াকাণ্ডের পরিচালনা করেন এবং প্রলয় বা মহাপ্রলয়ের পর সৃষ্টির বীজসকল আবার বপন করেন এজন্যই দেবীকে ভৈরবী বলা হয়। দেবী কালভৈরবের ভার্যা। দেবী যমদুঃখ বিনাশ করেন।
দেবী ভৈরবীর অনেক রূপ ও অনেক নাম। ত্রিপুরা ভৈরবী, সম্পদপ্রদাভৈরবী, কৌলেশভৈরবী, সিদ্ধিকাভৈরবী, ভয়বিধ্বংসিনী ভৈরবী, চৈতন্যভৈরবী, কামেশ্বরীভৈরবী, ষটকূটাভৈরবী, নিত্যাভৈরবী, রুদ্রভৈরবী, ভুবনেশ্বরী ভৈরবী, অন্নপূর্ণেশ্বরীভৈরবী।
তপ্তকাঞ্চন বর্ণাভাং বালেন্দুকৃতশেখরাং। নবরত্ন প্রভাদীপ্ত মুকুটাং কুঙ্কুমারুণাং। ….সানন্দমুখলোলাক্ষীং মেখলাঢ্যাং নিতম্বিনীং। অন্নদানরতাং নিত্যাং ভূমিশ্রীভ্যামলঙ্কৃতাং।
-বৃ. তন্ত্রসারঃ, পঢ.-৩১৪-১৫
দেবী অন্নপূর্ণা ভৈরবী তাঁর সন্তানদের অন্নপান জোগান দেন। দেবী সর্বথা ভূমি ও শ্রীর সঙ্গে যুক্ত; এটাই দেবীর অলংকার। তিনিই নৃত্যশীল উদাস উদাত্ত মহাদেবকে অন্নদান করেন। সমস্ত জগৎ, সমস্ত জাতি, সমস্ত নরনারী দেশীয় অন্নের উপর নিরশীল। শারদীয়া দুর্গাপূজার পর কোনো কোনো জায়গায় দেবী অন্নপূর্ণা ভৈরবীর পূজা হয় অন্নকূট উৎসব নামে। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরও মা অন্নপূর্ণার মন্দির ভুবন বিখ্যাত।
দেবী প্রচণ্ডচণ্ডিকা অথবা দেবী ছিন্নমস্তা-দেবী ছিন্নমস্তার রূপকল্প ভারতের ধর্মের ইতিহাসে এক অতি অপূর্ব উপস্থাপনা। দেবী প্রচণ্ডচণ্ডিকা বা দেবী ছিন্নমস্তার রূপকল্পের সঙ্গে নাথতন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্রের সরাসরি মিল দেখতে পাওয়া যায়।
নারদপঞ্চরাত্র অনুসারে দেবী ছিন্নমস্তার একটি উদ্ভব কাহিনি এ প্রসঙ্গে বলা দরকার। একদিন দেবী পার্বতী ডাকিনী ও বর্ণিনী নামে দুই সহচরীকে নিয়ে মন্দাকিনীতে স্নান করতে যান। স্নানের পর তারা দেবীর কাছে খাদ্য চান। দেবী তাদের অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু তারা নিজমস্তক ছিন্ন করেন। তখন দেবীর গলদেশ থেকে তিনটি রক্তধারা প্রবাহিত হয়। দেবী বামদিকের রক্তধারা দেন ডাকিনীর মুখে, ডানদিকের রক্তধারা দেন বর্ণিনীর মুখে, আর মধ্যধারা নিজমুখে ধরেন। এই রক্তপানের কাজ শেষ করে তাঁরা যেমন এসেছিলেন তেমনই চলে গেলেন। দেবীর মুণ্ড ছিন্ন হওয়ায় দেবী ছিন্নমস্তা নামে জগতে প্রসিদ্ধি
লাভ করলেন।
দেবী ছিন্নমস্তা ভয়ঙ্করী করালবদনা হলেও দেবী সুপ্রসন্না ও বরপ্রদানকারী। দেবী নিজের মুণ্ড ছিন্ন করে সুষুম্না পথে প্রবাহিত ঊর্ধ্বগামী রাক্তধারা পান করছেন। মস্তকে সহস্রারে সেই রক্তধারা পরমশিবের সঙ্গে মিলিত হয়ে এক আনন্দ মহানন্দময় মুক্তি ও সিদ্ধি লাভ করছে।
আর ইড়া ও পিঙ্গলায় প্রবাহিত রক্তধারা পান করছে বর্ণিনী ও ডাকিনী। এই ইড়া ও পিঙ্গলা দিয়েই যত বাসনাময় জন্মমৃত্যু পাশ সম্ভূত আসা-যাওয়া। এই জায়গাতেই নাথদের চন্দ্র ও সূর্য তত্ত্ব (ইড়া ও পিঙ্গলা)। এটি রূদ্ধ হলে তবেই অমৃতলোকে যাত্রার পথ প্রশস্ত হয়। নাথদের এক হেঁয়ালিতে দেখা যায়-
চন্দা গোটা খুটা করিলেউ সুরজকে করিলেউ পাট নিতি নিতি ধোবী ধোবই ত্রিবেণীকে ঘাট।
অর্থাৎ চাঁদকে খুটা করা হয়েছে আর সূর্য যেন ধোবার কাপড় কাচার পাট বা পাটাতন। এই দুটো শক্ত ও স্থির হলেই ধোপা কাপড় কাচতে পারবে। কোথায় সে কাপড় কাচবে ত্রিবেণীর ঘাটে। ত্রিবেণী অর্থে প্রয়াগ, গঙ্গা, যমুনা, স্বরস্বতীর মিলনস্থল। মানব শরীরে এই স্থান হলো মূলাধার। ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্না নাড়ীর মিলনস্থল। মানব শরীরে এই তিনটিকেই গঙ্গা যমুনা সরস্বতী নামে ভারতীয় হিন্দু তন্ত্রে প্রতীকায়িত করা হয়।
তন্ত্রে সাধনায় দেহ ও দেহভাণ্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৌদ্ধ সহজিয়ারাও কোনো তত্ত্বকেই দেহের বাইরে মনে করেন না। সরহপাদের দোহায় আছে-
এথথু সে সুরসরি যমুনা হথথু সে গঙ্গা-সাঅরু। এথথু প আগ বণারসি এথথু সে চন্দ দিবাঅরু।।
-এখানে এই দেহেই সুরেশ্বরী গঙ্গা ও যমুনা। এখানেই গঙ্গাসাগর তীর্থ। এখানেই প্রয়াগরাজ বারাণসী। এখানেই চন্দ্র দিবাকর। সর্বত্রই উজান পথে যাওয়ার কথা। এই জীবনতরীকে উজান পথে, উলটো পথে টেনে নিতে হবে। এখানেই দেবী কৃপা প্রয়োজন, তাহলেই শুদ্ধ মন, শুদ্ধ বুদ্ধি হয়। মা মহামায়ার সাধন, ওই কুণ্ডলিনীই কালী, মা মহামায়া। তিনিই হিন্দু তন্ত্র অনুসারে দেশ হয়েছেন, জগৎ হয়েছেন। তিনিই দশমহাবিদ্যা, তিনিই ভারতমাতা, তাঁর কৃপাছাড়া হবে না। দেবী ধূমাবতী-দেবী ধূমাবতীর উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নরকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। দু-একটি উল্লেখযোগ্য।
স্বতন্ত্রতন্ত্র থেকে জানা যায়-সকল কিছু সংহার করার মানসে দেবী প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে প্রজাপতি দক্ষের যজ্ঞকুণ্ডে নিজদেহ আহুতি দিলেন এবং তার ফলে বিরাট ধূমরাশি উৎপন্ন হলো। সেই ধূম থেকেই সর্বশত্রু সংহারিণী দেবী ধূমাবতীর উদ্ভব হলো।
নারদ পঞ্চরাত্র থেকে দেবী ধূমাবতীর আর একটি উদ্ভব কাহিনি পাওয়া যায়। একদা দেবী দেবাদিদেব মহাদেবকে বললেন, আমি ক্ষুধায় অত্যন্ত পীড়িত, আমাকে খেতে দাও। শিব তাঁকে অপেক্ষা করতে বললেন। বারংবার বলার পর দেবী আর অপেক্ষা করতে না পেরে স্বামীকে ধরে মুখে পুরে দিলেন। মুহূর্ত মধ্যে দেবীর দেহ থেকে ধূমরাশি উদ্ভুত হলো। শিব মায়ার দ্বারা পুনরায় দেহ ধারণ করে বললেন-দেবী শাখা সিঁদুর পরিত্যাগ করো। তোমার শরীর ধূম দ্বারা ব্যাপ্ত হবার জন্য তোমাকে ধূমাবতী বলা হবে।
আবার আর এক জায়গায় দেখা যায়, দেবী মহামায়া ধূমাবতী ধূম্রাসুর বিনাশিনী। দেবী ধূম্ররূপা চতুর্বর্গফলপ্রদা।
দেবী বগলামুখী-স্বতন্ত্রতন্ত্র থেকে জানা যায়- সত্যযুগে অতি প্রবলভাবে বায়ু প্রবাহিত হবার ফলে বিশ্বচরাচর ধ্বংসপ্রাপ্ত হবার আশঙ্কা তৈরি হয়। এই বায়ুবেগ রোধ করার জন্য বিষ্ণু তপস্যা দ্বারা দেবী মহাত্রিপুরাসুন্দরীকে প্রীত করেন এবং দেবীর কৃপায় বায়ুবেগ রূদ্ধ হয়ে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসে।
দেবী স্তম্ভন (রূদ্ধ) বা রোধ কারকতা বিষয়েই আরাধিতা। যেকোনো রকম বায়ুবিকার থেকেই তিনি ভক্তকে রক্ষা করেন।
দেবী বগলামুখী গম্ভীরাকৃতি, সর্বদা মদোন্মত্তা। সুবর্ণের মতো কান্তিযুক্ত দেহ, চারহাত ও ত্রিনয়ন। দেবীর স্তনযুগল দৃঢ় ও স্থূল। দেবী পীতবস্ত্র পরিধান করে হেমকুণ্ডলে বিভূষিত হয়ে রত্ন সিংহাসনের উপরে পদ্মাসনে উপবিষ্টা। দেবীর কপালে পীতবর্ণ অর্ধচন্দ্র। ডানদিকের দুইহাতে মুদ্গর ও পাশ। বামদিকের দুই হাতে মদনাসুরের জিহ্বা ও বজ্র। দেবীর অঙ্গের ভূষণ সকলও পীতবর্ণ ও ভীষণাকার।
-গম্ভীরাঞ্চ মদোন্মত্তাং স্বর্ণকান্তি সমপ্রভাং চতুর্ভুজাং ত্রিনয়নাং কমলাসন সংস্থিতাং। মুদ্গরং দক্ষিণে পাশং বামে জিহ্বাঞ্চ বজ্রকং। পীতাম্বরধরাং দেবীং দৃঢ়পীনপয়োধরাং। হেমকুণ্ডলভূষাঞ্চ পীতচন্দ্রাদ্ধশেখরাং। পীতভীষণপুষাঞ্চ রত্নসিংহাসনে স্থিতাং।
-বৃহৎ তন্ত্রসারঃ, পৃ. ৪৬৬ দেবী মাতঙ্গী-দেবী সকল সময় সকল বিপদ থেকে তাঁর ভক্তদের বাঁচান। দেবীর মদশীলত্বের জন্য এবং তিনি মতঙ্গাসুরকে বিনাশ করেছিলেন বলে দেবীকে মাতঙ্গী নামে অভিহিত করা হয়।
ছয় রকমের মাতঙ্গীর নাম পাওয়া যায়। যথা-দেবী মাতঙ্গী, দেবী উচ্ছিষ্টচাণ্ডালিনী বা দেবী উচ্ছিষ্ট মাতঙ্গী; দেবী সুমুখী-মাতঙ্গী; দেবী কর্ণমাতঙ্গী, দেবী বশ্যমাতঙ্গী, দেবী রাজমাতঙ্গী।
দেবী কমলা বা দেবী লক্ষ্মী-দেবী কমলা এবং দেবী লক্ষ্মী একই দেবী। তবে দেবী যদি বৈকুণ্ঠবাসিনী হন, তাঁকে বলা হয় কমলা, অন্যদিকে দেবী পাতালবাসিনী হলে তিনি দেবী লক্ষ্মী নামে বিভূষিতা। কুব্জিকাতন্ত্রে বলা হয়েছে-
বৈকুণ্ঠবাসিনী দেবী কমলা চ প্রকীর্তিতা। পাতালবাসিনী দেবী লক্ষ্মীরূপা চ সুন্দরী। দেবী লক্ষ্মী সকল রকম সম্পদ ও সৌভাগ্য প্রদান করেন।
স্বতন্ত্রতন্ত্র অনুসারে এই দেবীই ক্ষীরোদসমুদ্র মন্থনের থেকে উঠেছিলেন এবং বিষ্ণুবক্ষস্থিতা পদ্মাসনগতা রমা ইনিই। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে এই দেবী থেকে কোলাসুর বিনাশিনী মহামাতঙ্গী নামক কলা উৎপন্ন হন। ফাল্গুনমাসের শুক্র বা মঙ্গলবারে একাদশী তিথিতে সকল সৌভাগ্যদায়িনী দেবী মহালক্ষ্মী প্রকাশিত হন।
পুরাব্রহ্মাজগৎ স্রষ্ঠুং তপোহতপ্যত দারুণম্। তপসা তস্য সন্তুষ্টা শক্তি সা পরমেশ্বরী। চৈত্রশুক্লনবম্যান্ত উৎপন্না তারিণী স্বয়ম্। ক্রোধরাত্রিঃ সমাখ্যাতা সর্বশক্তিময়ী শিবা। জাতা তস্যাং মহালক্ষ্মীঃ সর্বসৌভাগ্যদায়িনী।
মাতৃমূর্তি রচনার এই যে প্রেরণা, এই যে প্রবণতা, এসব শুধুমাত্র শাশ্বত বা সনাতন ধর্মীয় বৃত্তির স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ নয়। আসলে এর সঙ্গে রয়েছে জীবনধারণ সংক্রান্ত পার্থিব প্রয়োজন ও নিরাপত্তার তাগিদ। সেই প্রয়োজনের তাগিদেই সুদূর অতীতে ভারতবর্ষে ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এক জাতীয় ধ্যানধারণা ও বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল। মাতৃসাধনা, কুলকুণ্ডলিনী সাধনা, যোগসাধনা, লতা সাধনা, দশমহাবিদ্যা সাধনা প্রভৃতি সবই মাতৃসাধনা। এই মাতৃকামূর্তি ও মাতৃসাধনা সম্ভবত প্রাথমিকভাবে মেয়েদের দ্বারাই উদ্ভুত হয়েছিল।
আবার অন্যদিকে আদিম মানুষের ভেতর নানারকম সামাজিক অনুষ্ঠানে অথবা নৃত্যগীতের সময় কারও ভেতর এক তীব্র মানসিক শক্তি বা আবেগের স্ফূরণ দেখা যায়। যার ফলে তিনি তার মানসলোকে ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান দেখতে পান এবং কিছু কিছু বলতেও পারেন যা ভবিষ্যতে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। এইরকম অবস্থাকে এক যোগযুক্ত অবস্থা বলেই পরবর্তীতে বলা হয়েছে।
মহেঞ্জোদারোতে যেমন যোনি মূর্তি পাওয়া গেছে, তেমন একটি যোগীর মূর্তিও পাওয়া গেছে। যোগের ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান মূর্তি পাওয়া গেছে। এগুলি দেবমূর্তি হতে পারে। একটি সিলমোহরে নারী জননাঙ্গ থেকে একটি লতা বা গাছ বেরিয়েছে। একে প্রকৃতি ও প্রকৃতির উৎপাদিকা শক্তি, এবং জগৎ প্রসবকারিণী ও জগৎ পালনকারিণী শক্তির পরিচায়াকও বলা চলে।
আবার অন্যদিকে ঋগ্বেদের বিভিন্ন সূক্ত থেকে জানা যায় ঋষি বা মুনি বা যোগী অনেকেই ছিলেন, যাঁরা অতীন্দ্রিয় পদার্থ দর্শন করতে পারতেন। এঁরা পিঙ্গলবর্ণ বস্ত্র পরিধান করতেন। তাঁরা ছিলেন তপস্বী এবং জপতপের শক্তি ও মহিমায় উদ্ভাসিত, উন্নত ও শক্তিমান হয়ে তাঁরা বায়ুপথে গমনাগমন করতে পারতেন। তাঁরা বাতাসের গতিতে চলতে পারতেন। যথা-
মুনয়ো বাতরশনাঃ পিশঙ্গা বসতে মলা। বাতস্যানু ঘ্রাজিং যন্তি যদ্দেবাসো অবিক্ষত।
-ঋগ্বেদ, ১০, ১৩৬, ২
এইসব যোগী ও মুনিগণ লৌকিকতা ও সামাজিকতার বাইরে ছিলেন। খানিকটা উন্মাদের মতো আচরণ করতেন। (পরমযোগী হয় বালকবৎ, পিশাচবৎ, উন্মাদবৎ)। এঁরা বলতেন আমরা উপাসনা করি বলেই বায়ু, জল, পৃথিবী অবস্থান করছে। মানুষেরা আমাদের শুধু শরীররূপ দেখতে পায়, আমাদের দেখতে পায় না। (অর্থাৎ আমি আত্মা, পরমাত্মার আংশবিশেষ)। যথা- উন্মাদিতা মৌনেয়েন বাতা আ তস্থিমা বয়ম্ শরীরেদস্মাকং যুয়ং মর্তাসো অভি পশ্যথ।
-ঋগ্বেদ; ১০, ১৩৬, ৩ এঁরা বায়ুপথে চলাচল করতে পারতেন ও রুদ্রের সঙ্গে বসে বিষপান করতেন। (গাঁজা, ভাঙ, ধুতরো পান করতেন বোধ হয়।)
যথা-
বায়ুরস্মা উপামন্থৎ পিনষ্টি স্মা কুনংনমা। কেশী বিষস্য পাত্রেণ যরুদ্রেণা পিবৎসহ। -ঋগ্বেদ, ১০.১৩৬.৭
আবার অন্যদিকে ভারতবর্ষে নব্যপ্রস্তর যুগ ও তার পরবর্তী সময়ে কৃষি উৎপাদন, কৃষিকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান সন্তান ও মাতৃপ্রাধান্য, তা থেকেই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের জাদুবিশ্বাস। কৃষি উৎপাদন ও সন্তান উৎপাদন এবং এই সংক্রান্ত নানা বিষয়ের জন্য সমগ্র সমাজ ও জাতি মেয়েদের উপরই নির্ভর করেছে। তন্ত্রের দেবী তাই সর্বশক্তির আধার। সকল মায়াশক্তি প্রকৃতি শক্তি। আধিদৈবিক, আধিভৌতিক ও আধ্যাত্মিক সকল রকম অসুবিধার নিরসনকারী দেবী শক্তি। তাই তন্ত্রে খপুষ্প, স্বয়ম্ভূকুসুম, কুণ্ডোদ্ভব, গোলোদ্ভব, বজ্রপুষ্প এসব বিষয়ের ব্যবহার। আর যন্ত্র বলে যেটা বলা হয় (সর্বতভদ্রমণ্ডলযন্ত্রম,
চৈতন্যভৈরবীযন্ত্রম, নিত্যযন্ত্রম্ প্রভৃতি) তা দেবীর মাতৃস্থানেরই চিত্রায়িত পূজনীয় রূপ। মানবীয় ফলপ্রসূতা ও প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার সম্পর্ক, জাদুবিশ্বাস এসব থেকেই তন্ত্রে লতা, কুসুম, পুষ্প, পদ্ম, (অষ্টদল, ষোড়শদল, দ্বিদল, সহস্রদল, শতদল প্রভৃতি পদ্ম) বীথিকা এসব পরিভাষা তৈরি হয়েছে।
শস্যবৃদ্ধির কামনায় ভারতবর্ষে অনেক জায়গায় মেয়েরা অতি গোপনে, খালি পায়ে ফসল ক্ষেতের পাশে গিয়ে হাঁটে। খালিপায়ে এলোচুলে দৌড়ে তিনবার ক্ষেত প্রদক্ষিণ করে; জুলুদের মধ্যেও এরকম প্রথা আছে। গ্রিক পূজায় অনুষ্ঠানে পূজারিণীরা খালিপায়ে এলোচুলে হাঁটে। অন্তঃসত্ত্বা মেয়েরা গাছ লাগায়। গাছের প্রথম ফল খেতে দেওয়া হয় তাদের। অনেক জায়গায় ফসল ক্ষেতের পাশে গিয়ে নারী পুরুষ রাত্রিবাস করে, এরকম নানা প্রথা দেখা যায়।
গৌড়বঙ্গে একজাতীয় কৃষিজীবী মানুষের ভেতর প্রথা আছে কার্তিক মাসের অমবস্যায়, কালীপূজার রাতে, বাড়ির বউ মেয়েরা নগ্ন হয়ে দুটো কাঠি দিয়ে কুলো বাজায় এবং বাজাতে বাজাতে, নাচতে নাচতে বাড়ি প্রদক্ষিণ করে অতি গোপনে। এসব প্রার্থনার সঙ্গে নগ্নতার কী সম্পর্ক; এ প্রশ্ন স্বাভাবিক। কিন্তু ওই এক বিশ্বাস, জাদুবিশ্বাস। এভাবেই, তাদের মনে বিশ্বাসের শক্তিকে তীব্র করে, আর এসবের লক্ষ্য থাকে দেবী কালিকার কৃপা লাভ। এরকম প্রচুর অনুষ্ঠানের উদাহরণ দেওয়া যায়।
ভারতবর্ষে এক প্রাচীন, অতি প্রাচীন যোগ সাধন পদ্ধতি প্রথম থেকেই বিদ্যমান। আবার প্রাকৃতিক উৎপাদন, শস্য, অন্ন, সন্তান কামনাও প্রথম থেকেই বিদ্যমান। পৃথিবীর সর্বত্রই বিদ্যমান। যে শক্তির নিম্নগামিতায় সন্তান, গৃহসুখ, কামনা বাসনা তৈরি হয়। সেই শক্তিরই ঊর্ধ্বগামিতায় সহস্রার চক্রে শিব-শক্তির মিলনে মুক্তির আস্বাদ পাওয়া যায়। এই সমন্বয়ী তত্ত্বের কথাই ব্যাখ্যা করে, হিন্দুতন্ত্র, নাথতন্ত্র, সহজিয়াতন্ত্র, বৈষ্ণবতন্ত্র, বৌদ্ধতন্ত্র প্রভৃতি। এগুলি সবই প্রকৃতপক্ষে হিন্দু সাধনার বিভিন্ন দিক ও ধারা। ভারতে শক্তি সাধনার ধারণা ও ব্যাখ্যা ভারতীয় জীবনবোধের ব্যাখ্যা। ভারতের জনসমাজে মহাশক্তির এই দুই ধারার সমন্বয়ী চরিত্রের ও বৈশিষ্ট্যের ভেতর দিয়েই ক্রমঅগ্রসরমান। দেবী দশমহাবিদ্যা ভারতের হিন্দুতন্ত্রের এক অপূর্ব সৃষ্টি। ভূক্তি ও মুক্তির মেলবন্ধন।
ভক্তের (সন্তানের) ভাব অনুসারে দেবী লীলাময়ী, নিত্য ক্রিয়াশীল। তিনি সকল প্রার্থনা, সকল কামনা, বাসনা, সকল রকম চিন্তা ও ভাবের ভেতর সূক্ষ্ম ও স্থূল রূপে বিরাজ করছেন। আবার সাধক ও যোগী হৃদয়ে ও জীবনে তিনি কুলকুণ্ডলিনীরূপে অনন্ত শাশ্বত পরমশিব ও পরমাত্মার দিকে গমনশীল শক্তি, মহাশক্তি, মহাবিদ্যা। তিনিই দেবী শাকম্ভরী। তিনি চণ্ডী, তিনিই দুর্গা, সকল শক্তিপূজার সাথ্যা তিনিই। তিনিই কালী তিনিই ব্রহ্ম। ততোহহমকিলং লোকমাত্মদেহ সমুদ্ভবৈঃ ভবিষ্যামি সুরাঃ শাকৈরাবৃষ্টৈ প্রাণধারকৈঃ।। শাকম্ভরীতি বিখ্যাতিং তদা যাস্যামহং ভুবি।
-মার্কণ্ডেয় পুরাণম্, ৯২, ৪৩-৪ হিন্দুতন্ত্র, বৌদ্ধতন্ত্র, নাথতন্ত্র, বৈষ্ণবতন্ত্র, সহজিয়া, আউল, বাউল সকলের সাধনবস্তু ভিন্ন ভিন্ন রূপে, ভিন্ন ভিন্ন প্রবচনে ওই একই-মা মহামায়া অথবা কুলকুণ্ডলিনী কামকলা ও তার ঊর্ধ্বগামিতা। পরম শিবই পরমাত্মা। এখানেই সমাধি। একেই উলটা সাধন, উজান বাওয়া, গোপন কথা বা গোপন তত্ত্ব, অচিনপাখি প্রভৃতি নানা নামে, নানাভাবে বিভিন্ন গানে কথায় সাধন প্রসঙ্গে বলা হয়। এই সকল কিছুর মূলতন্ত্রী মা মহামায়া। তিনি মহাশক্তি, মা আদ্যাশক্তি কুলকুণ্ডলিনীরূপে সাধক জীবনে অধিষ্ঠিতা। তিনিই সর্বত্র দশমহাবিদ্যারূপে বিরাজিতা। তিনিই জগৎ হয়েছেন। আবার তিনিই এই জগতের মধ্যে বাস করেন। মায়ের কথা বলতে যে আনন্দ তা কোনো ভাষা দিয়েই বোঝান যায় না। তয়া বিসৃজ্যতে বিশ্বং জগদেতচ্চরাচরম্সৈ ষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে।। সা বিদ্যা পরমা মুক্তেহেতুভূতা সনাতনী। সংসার বন্ধহেতুশ্চ সৈব সর্বেশ্বরেশ্বরী।।
-শ্রীশ্রীচণ্ডী, ১:৫৬-৫৮ কৃষিভিত্তিক উৎপাদনশীলতা ও নারীপ্রাধান্য, মাতৃকেন্দ্রিক সমাজ ও মাতৃপ্রাধান্য প্রভৃতি থেকেই সম্ভবত মাতৃকামূর্তি ও মাতৃকা উপাসনা গড়ে উঠেছিল ভারতবর্ষে, বহু প্রাচীন যুগে নব্য প্রস্তর যুগের সমসময়ে। কৃষি উৎপাদন ও মানবীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে শিব ও শক্তি উপাসনা ভারতবর্ষে উচ্চস্থানে বিরাজমান।
এর পাশাপাশি বিকশিত হয়েছিল ভারতের এক যোগ সাধন ব্যবস্থার ধারা। ভারতের ধর্ম ইতিহাসে এই দুইয়ের মেলবন্ধন হয়েছে ভারতের হিন্দু তন্ত্রে ও শক্তি সাধনায়। এর সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে দেবীর প্রতি নানা পূজা ও ব্রত, বিশ্বাস, জাদুবিশ্বাস ও ভাব। ভারতবর্ষের সকল তন্ত্রে এই ধারণা ও সাধনার কথাই বিবৃত। ভারতের মাতৃসাধকেরা যুগ যুগ ধরে এই মাতৃসাধনাকে পুষ্ট ও বিকশিত করেছেন। এই দেবীই একাধারে দেশমাতৃকা ও ভারতমাতা। তিনি ভুক্তি ও মুক্তি দুই প্রদান করেন। আনন্দ প্রদান করেন মা আনন্দময়ী, তাঁর সন্তানকে ও সাধককে।

















