যাঁরা অঙ্গ সৃষ্টি করেননি তাঁরা জাতীয় মন্ত্রের অঙ্গহানি করেন কী করে?
বন্দে মাতরম্
নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়
কুরুসভায় পাঞ্চালী পিতামহ ভীষ্মকে প্রশ্ন করেছিলেন, যুধিষ্ঠির নিজে হেরে গিয়ে অন্যকে বাজি ধরেন কী করে? গঙ্গাপুত্রের কাছে কোনো সদুত্তর ছিল না। মুসলমান তোষণকে নজরে রেখে ১৯৩৭ সালে জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ভারতের জাতীয় মন্ত্র ‘বন্দে মাতরম্’কে ব্যবচ্ছেদ করে, তার অঙ্গহানি ঘটায়। এটা লজ্জার ও বেদনার। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাতে সায় দিয়েছিলেন বলে প্রচারিত হয়। গুরুদেব বিশ্বকবি। কিন্তু এ মন্ত্র তাঁর সৃষ্টি নয়। এ মন্ত্রের উদ্গাতা ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র। যে মন্ত্র ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্টি, যে মন্ত্র সে সময়ের কোনো কংগ্রেস নেতা সৃষ্টি করেননি, তার অঙ্গহানি ঘটানোর অধিকার
তারা পেলেন কী করে? সেই সময়েও কিছুটা রাজনৈতিক গা-জোয়ারি করেই সে অনধিকার চর্চা হয়েছিল। কোনো মন্ত্রের অঙ্গহানি বা ব্যবচ্ছেদের জন্য তার স্রষ্টার অনুমতির প্রয়োজন। কংগ্রেস নেতারা মন্ত্রের ২৪টি পঙ্ক্তির মধ্যে মাত্র ৬টি পঙ্ক্তি গাওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তার কারণ বাকি ১৮টি
পঙ্ক্তির প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে দুর্গাস্তব ও দুর্গাস্তোত্র। তাই বন্দে মাতরমের অঙ্গহানি ঘটিয়ে তারা দেশমাতৃকাকেই খণ্ডিত করেছিলেন, দেশাত্মবোধকে হত্যার প্রয়াস করেছিলেন।
মুসলমানদের মন পাওয়ার চেষ্টা কংগ্রেস আর বিদেশি বামেদের নতুন নয়। তাই উভয় দল ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকে মুছে যাচ্ছে। ইসলামে ‘আল্লা’ ভিন্ন অন্য বন্দনা নিষিদ্ধ। তা বলে সনাতন হিন্দুধর্ম দুর্গারূপে যে দেশমাতৃকাকে আরাধনা করে তাকে খণ্ডিত করতে হবে? এটা কুযুক্তি! উভয়ের অধিকার সংরক্ষিত। সনাতনী পরম্পরা তাই বলে। তাহলে কংগ্রেস নেতারা মুসলমানদের মাথাব্যথা উপশমের জন্য নিজেদের মাথা কাটলেন কেন? ভারতমাতার অঙ্গচ্ছেদ করলেন কেন?
ঋষি অরবিন্দ তাঁর সহধর্মিণী মৃণালিনীদেবীকে লিখেছিলেন, দেশকে তিনি ‘মা’ বলে জানেন ও মানেন। ‘কর্মযোগিন’ পত্রিকায় তিনি বন্দে মাতরমের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। পাহাড়-পর্বত, নদী, মাঠঘাট আর জঙ্গল দিয়ে সেই ‘মা’কে ব্যাখ্যা করা যায় না। আর তাঁর বুকের ওপর বসে যদি কোনো রাক্ষস রক্তপান করে, তবে তাঁর সন্তানরা তা মেনে নেবেন না। ঋষি অরবিন্দর আদর্শে উদ্বুদ্ধ বিপ্লবীরা অত্যাচারী ব্রিটিশ রাজভৃত্যদের বিরুদ্ধে গোপনে সশস্ত্র বিপ্লব পরিচালনার সংকল্প গ্রহণ করেন। দৃঢ়প্রত্যয়ী বিপ্লবীরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আলিপুর বোমা মামলায় শ্রী অরবিন্দের এক বছরের নির্জন কারাবাস হয়। তিনি লিখেছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম জেল-ডাইরি ‘কারাকাহিনী’। এরপর পুলিশি নজর এড়িয়ে ফরাসি উপনিবেশ পণ্ডিচেরি থেকে ১৯১৪
পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছিলেন বিপ্লবী কার্যকলাপ। অর্থ ও অস্ত্রের অভাবে পরে পিছিয়ে আসতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একদম সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, দলীয় স্বার্থ রক্ষায় কংগ্রেস সে সময় বন্দে মাতরমের বলি চড়িয়েছিল। জওহরলাল নেহরু কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন বন্দে মাতরমের অঙ্গহানি ঘটানো হয়। হন্যে হয়ে মুসলমান তোষণের ব্যাখ্যা খুঁজতে ‘গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ এর অনুমোদন দিয়েছেন’- এহেন তত্ত্বও খাড়া করেছিল। তারা এসব রাস্তা নেওয়ার কারণে কবি বুদ্ধদেব বসুকে সে দুঃখের কথা লিখেছিলেন গুরুদেব। নেতাজী সুভাষচন্দ্রকেও পড়তে হয়েছিল বিড়ম্বনায়। এই ঘটনার কয়েক মাস পরেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সভাপতি হন সুভাষচন্দ্র। ওয়ার্কিং কমিটিতে নেহরুপন্থীরা দলে ভারী হওয়ায় নেহরুর সভাপতিত্বে গৃহীত বন্দে মাতরমকে খণ্ডিত করার প্রস্তাব খারিজ করা সম্ভবপর হয়নি। হতে পারে সামাজিক, সাম্প্রদায়িক সমন্বয় ভারতের সনাতনী ভাবধারার অংশ। কিন্তু তা শিরোধার্য হলেও জাতীয় মাতৃমন্ত্রকে খণ্ডিত করা অসমীচীন। ঐতিহাসিক সব্যসাচী ভট্টাচার্য তাই সঠিক লিখেছিলেন যে, বন্দে মাতরম্ নিছক কোনো জাতীয় গান নয়, যাকে কেবল বইয়ের পাতার মধ্যে আটকে রাখা যাবে। বন্দে মাতরম্ সেই অনন্যসাধারণ, অনুপম জাতীয় ভাবনা ও আবেগ যা বইয়ের পাতার বাইরে বিকশিত হয়েছে। এর কোনো বিকল্প নেই। (তথ্যসূত্র- ‘বন্দে মাতরম্: দ্য বায়োগ্রাফি অফ এ সং’)।
কেবল মুসলমান স্বার্থে এত বড়ো ঐতিহাসিক ভুল সেই সময়ে সংঘটিত হয়। ঋষি বঙ্কিম প্রয়াত হন তার ৪৩ বছর আগে (১৮৯৪)। বেঁচে থাকলে তাঁর সৃষ্ট মন্ত্রের অঙ্গচ্ছেদ তিনি যে মেনে নিতেন- এ এক নিছক কষ্টকল্পনা। কোনো কবি এরকম অনুমোদন দিয়েছেন তারও তেমন কোনো নজির নেই। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মুসলমান তোষণকে ভারতের রক্তে মেশানোর চেষ্টা করেছে কংগ্রেস ও বিদেশি বামেরা। নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে ব্যবহৃত হতে চেয়েছে তারা। যে ভুল সে সময়ের কংগ্রেস নেতারা করেছিলেন এবার তা শুধরে নেওয়ার সময় এসেছে। তাই ঋষি অরবিন্দ রচিত দুর্গাস্তোত্র দিয়েই ইতি টানছি- “মাতঃ দুর্গে।। সিংহবাহিনী সর্বশক্তিদায়িনী মাতঃ শিবপ্রিয়ে।। বীরমার্গপ্রদর্শিনী এসো। আর বিসর্জন করিব না।। এসো মাতঃ আমাদের মনে প্রাণে শরীরে প্রকাশ হও।।”

















