স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় জনজাতিরা রেখেছে প্রখর প্রতিরোধের স্বাক্ষর
ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী জনজাতি সমাজ
নতুন ভারত নির্মাণেও তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন।
অংশুমান গঙ্গোপাধ্যায়
১৭৫৭ সালে সংঘটিত হয় পলাশীর যুদ্ধ। এই যুদ্ধে বঙ্গের নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে বাঙ্গলার শাসনক্ষমতা কবজা করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। পলাশীর প্রান্তরে ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় বলে অনেক ইতিহাসবিদ মতপোষণ করলেও ঐতিহাসিক সত্য এর বিপরীত। ১৭৫৭-র পর অনেকটা সময় অতিবাহিত হয় ভারতের পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ- প্রতিটি প্রান্তে ইংরেজ শাসন বলবৎ হতে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজ আগ্রাসন যত বেড়েছে, ততই দৃশ্যমান হয়েছে ইংরেজ অপশাসনের বিরুদ্ধে আপামর ভারতবাসী, বিশেষত জনজাতিদের ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। আবহমান কাল ধরে ভারতীয় জনজাতি সমাজ হলো ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। রামায়ণে নিষাদরাজ গুহককে
ভগবান শ্রীরামচন্দ্র আলিঙ্গন করেছেন। সুগ্রীবাদির সঙ্গে সখ্য স্থাপন করেছেন। শবরীর প্রতীক্ষা শেষ হয়েছে শ্রীভগবানের সাক্ষাৎ দর্শনে। মহাভারতে উল্লেখিত হয়েছে জনজাতিদের বীরত্বের গাথা। গুরু দ্রোণের সম্মুখে তাঁর গুরুদক্ষিণা উপস্থাপন করেছেন একলব্য। স্মরণাতীত কাল থেকেই ভারত জননীর এই বীর সন্তানেরা হলো দেশমাতৃকার অঙ্গরক্ষক। অরণ্যবাসী, গিরিবাসী, গুহাবাসী এই সকল জনজাতি ভারতের জল, জমি, জঙ্গলের প্রকৃত সংরক্ষক।
ইসলামি শাসনে ভারত জুড়ে নেমে আসে এক ভয়ংকর অন্ধকার যুগ। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সাধারণ মানুষের সঙ্গে নির্যাতিত হতে থাকে জনজাতি সমাজ। ইংরেজ শাসনে বনবাসী মানুষের ওপর নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার। ১৭৫৭-পরবর্তী পর্যায়ে ভারত জুড়ে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শুরু করে ‘কলোনিয়াল এক্সপানশন’ বা ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ। শুরু হয় ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন। বিভিন্ন রাজ্যের রাজপ্রাসাদ, কোষাগার লুঠ করে বিপুল ধনরত্ন সংগ্রহ করা ছাড়াও ব্রিটিশের চোখ পড়ে ভারতের বনজ ও খনিজ সম্পদ-সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলির ওপর। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয় জঙ্গল কাটাই। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য দখল করে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সমুদ্র বন্দর পর্যন্ত লুঠতরাজের সামগ্রী পরিবহণের জন্য রেলপথ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ভারত থেকে ধনসম্পদ লুঠ করে জাহাজে বোঝাই করে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হতো। রেলপথ স্থাপনের ক্ষেত্রে দু’টি রেললাইনের মাঝে স্লিপারের প্রয়োজন হয়। কাঠ দিয়ে তৈরি করা হতো স্লিপার। দেশজুড়ে এই রেলপথ স্থাপনের জন্য প্রয়োজন হয় প্রচুর কাঠের। এর জন্য শুরু হয় অরণ্য নিধন পর্ব। ইংরেজ প্রশাসনের নির্দেশে শুরু হয় ব্যাপক বৃক্ষচ্ছেদন। এছাড়াও রাজস্ব সংগ্রহের জন্য ভারতবাসীর ওপর শুরু হয় সীমাহীন অত্যাচার। জল, জমি, জঙ্গলের ওপর থেকে অধিকার হারিয়ে অরণ্যবাসী জনজাতি সমাজ অনেক জায়গায় উদ্বাস্তু হয়ে পড়তে থাকে। অরণ্যাঞ্চল থেকে তাঁরা উচ্ছেদ হতে থাকে। একটি অরণ্য থেকে তাঁরা উচ্ছেদ হয়ে অন্য অরণ্যে আশ্রয় নিলেও সেখানেও তাঁদের ওপর নেমে আসে ব্রিটিশ শাসকদের চরম নির্যাতন। জাতিবিদ্বেষী, বর্ণবিদ্বেষী ব্রিটিশ শাসক এবং তাদের মোসাহেবদের পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেওয়া অপশাসনের বিরুদ্ধে ১৭৫৭ সালের পর থেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ভারতীয় জনজাতি সমাজ। বিভিন্ন সময়কালে বিভিন্ন জনজাতি সম্প্রদায় ব্রিটিশ শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গড়ে তুলেছে সশস্ত্র প্রতিরোধ। আবহমানকাল ধরে প্রকৃতির কোলে জন্ম নেওয়া থেকে বেড়ে ওঠা জনজাতিদের জন্মসিদ্ধ অধিকার ছিল ভারতের বনভূমির ওপর। ভারতে ব্রিটিশ শাসন বলবৎ হলে বনভূমির ওপর তাঁদের স্বাভাবিক অধিকার হারায় জনজাতিরা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রকোপে তাঁদের ওপর চলতে থাকা অর্থনৈতিক শোষণ মাত্রাছাড়া হলে পরাধীন ভারতের ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে (বর্তমান বিহার, ঝাড়খণ্ড ও বঙ্গপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল) ১৭৭১ সালে প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে সাঁওতালরা। প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, ব্রিটিশ শাসনে ১৭৭০ সালে বঙ্গপ্রদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত এই বিদ্রোহের রেশ ছড়িয়ে পড়ে সাঁওতাল পরগনা জুড়ে। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন তিলকা মাঝি। জনজাতি সমাজ তাঁকে ‘মাঝি বাবা’ অভিধায় ভূষিত করে। তিনি হলেন ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী যিনি সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা ছাড়াও ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনজাতিদের সংগঠিত করেছিলেন। জমি লুঠ, জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার থেকে জনজাতিদের বঞ্চিত করা এবং বলপূর্বক খাজনা আদায়ের নির্মম পন্থা অবলম্বন করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তার বিরুদ্ধে তিলকা মাঝির নেতৃত্বে শুরু হয় ‘খেরওয়াড় বিদ্রোহ’। ১৭৭৮ সালে ১৩০০ জন সাঁওতাল বিদ্রোহীকে নিয়ে ঝটিকা আক্রমণ শানিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রামগড় ব্যাটেলিয়নের ক্যান্টনমেন্ট কবজা করে নেন এবং কোম্পানির ট্রেজারি অধিকার করে সেই অর্থ জনগণের মধ্যে বিতরণ করেন। ১৭৮৪ সালে তাঁর ছোঁড়া তিরে ভাগলপুর ও রাজমহলের ইংরেজ কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট অগাস্টাস ক্লিভল্যান্ড নিহত হন। এরপর তিলকপুরের জঙ্গলে তিলকা মাঝি ও তাঁর সঙ্গীদের ঘেরাও করে ইংরেজ সেনাবাহিনী। একটানা অনেক দিন প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পর আহত ও রক্তাক্ত অবস্থায় ধরা পড়েন তিলকা মাঝি। বিদ্রোহের শাস্তিস্বরূপ তাঁকে ছুটন্ত ঘোড়ার পেছনে বেঁধে দেওয়া হয়। এই নৃশংস পদ্ধতিতেও তাঁর মৃত্যু না হলে তাঁকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয় ভাগলপুর শহরে। ভারতজননীর বীর সন্তান তিলকা মাঝি হলেন ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম বীরগতিপ্রাপ্ত সৈনিক।
ছোটনাগপুর অঞ্চলের সিংভূম, মানভূমে ব্রিটিশদের শোষণ, রাজস্ব বৃদ্ধি এবং পরম্পরাগত জীবিকা ও জীবনযাত্রায় ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপের কারণে ১৮৩১-৩২ সালে সংঘটিত হয় কোলবিদ্রোহ। বুধু ভগত, জোয়া ভগত, সুই মুণ্ডা, বিন্দ্রাই মানকি, সিংরাই মানকি প্রমুখ বীর জনজাতি যোদ্ধা কোল জনজাতিদের এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। বিদ্রোহীরা ইংরেজ শাসকদের দুর্গ ও প্রাসাদ দখল করে। কোল জনজাতি সম্প্রদায়ের অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে ব্রিটিশরা নির্মমভাবে এই বিদ্রোহ দমন করে। কিন্তু এই বিদ্রোহ ভবিষ্যতে জনজাতি সমাজের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ধারাটিকে প্রভূত শক্তি দান করে।
১৭৬৬ থেকে ১৮৩৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে বঙ্গভূমিতে সংঘটিত হয় চুয়াড় বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের অন্যতম বৃহৎ কৃষক বিদ্রোহ। বঙ্গভূমির জঙ্গলমহল অঞ্চলের (মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, সিংভূম, মানভূম ও ধলভূমের) ভূমিজ অধিবাসীরা স্থানীয় জমিদারদের অধীনে পাইকের কাজ করতেন। কাজের বিনিময়ে ওই অঞ্চলের জায়গা-জমির অধিকার তাঁরা ভোগ করতেন। চাষাবাদ, পশুপালন এবং পশুশিকারের সঙ্গে তাঁরা জড়িত থাকলেও তাঁরা স্বভাবে ছিলেন ক্ষত্রিয়, যুদ্ধবিগ্রহে তাঁরা ছিলেন দক্ষ। বঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের জমির ওপর চড়া ভূমিরাজস্ব ধার্য করার ফলে স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে এই পাইক, বরকন্দাজরাও জঙ্গলমহল জুড়ে বিদ্রোহ করেন। অন্ত্যজ জনজাতিদের এই কৃষক বিদ্রোহকে ব্রিটিশরা
ঘৃণাভরে ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’ নাম দেয়। ১৭৬৬ সালে ঘাটশিলায় ধলভূমের ভূমিজ রাজা জগন্নাথ সিংহ প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রানি শিরোমণির নেতৃত্বে সংঘটিত এই বিদ্রোহের ইতিহাস চিরস্মরণীয়। এই বিদ্রোহের নেত্রী রানি শিরোমণিকে ১৭৯৯ সালে বন্দি করে ইংরেজ প্রশাসন। ১৮৩২-৩৪ সালে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে গঙ্গা নারায়ণ সিংহের নেতৃত্বে সংঘটিত ভূমিজ বিদ্রোহও চুয়াড় বিদ্রোহের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। কোম্পানির সেনাদল নির্মম অত্যাচার করে এই বিদ্রোহ দমন করেছিল। নৃশংসভাবে বিদ্রোহীদের হত্যা করে তারা। গাছের ডালে বিদ্রোহীদের ফাঁসি দিয়ে তাঁদের মৃতদেহ ঝুলিয়ে রেখে ত্রাস সৃষ্টি করা হয় গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে।
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের আগে ১৮৫৫ সালে ছোটনাগপুর মালভূমির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সিধু মুর্মু, কানু মুর্মুর নেতৃত্বে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ফেটে পড়ে সাঁওতালরা। ভারতের ইতিহাসে এই ঘটনা ‘হুল বিদ্রোহ’ বা ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর আদায়-সহ অকথ্য নির্যাতন, স্থানীয় ভূস্বামী ও সুদখোর মহাজনদের অত্যাচার এবং এই সরকার-সাহুকার-জমিন্দার-এর অশুভ চক্রের শোষণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে স্থানীয় জনজাতি সমাজ। ১৮৫৫ সালের ৩০ জুন এই বিদ্রোহের সূত্রপাত হওয়ার কারণে স্বাধীন ভারতে এই দিনটিকে ‘হুল দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। সিধু-কানুদের ঘোষিত এই বিদ্রোহে তাঁদের সঙ্গী ছিলেন- চাঁদ, ভৈরব, ফুলো, ঝানো প্রমুখ নেতা-নেত্রী। বিদ্রোহীদের প্রবল প্রতিরোধে ইংরেজ সেনা পালিয়ে গিয়ে পাকুড় দুর্গে আশ্রয় নেয়। এরপর ছোটনাগপুর অঞ্চল জুড়ে মার্শাল ল’ জারি করে বীভৎস অত্যাচার শুরু করে
ব্রিটিশ প্রশাসন এবং কয়েক হাজার সাঁওতাল জনজাতির মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। সিধু-কানু ইংরেজ সেনার হাতে ধরা পড়েন। তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রশাসনিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনজাতি সমাজের এই তীব্র আন্দোলন ও প্রতিরোধস্পৃহা দেখে শঙ্কিত হয় ব্রিটিশ প্রশাসন। শোষণতন্ত্রের হাত থেকে ভূমিপুত্র জনজাতিদের আংশিকভাবে সুরক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যে তারা ‘সাঁওতাল পরগনা টেন্যান্সি অ্যাক্ট’ নামক একটি আইন প্রণয়ন করে। অধিকার রক্ষার স্বার্থে সংঘটিত জনজাতি সমাজের সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে প্রতি বছর ৩০ জুন দিনটি ‘হুল দিবস’ হিসেবে উদ্যাপিত হয়।
এরপরেও অব্যাহত থাকে জনজাতি সমাজের ওপর ব্রিটিশ সরকার এবং বহিরাগত কুসীদজীবী, মহাজনদের শোষণ, ভূমি ও বন অধিকার হরণ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবিচার। এর বিরুদ্ধে ১৮৯৯-১৯০০ সালে রাঁচির দক্ষিণ দিকে, ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে ভগবান বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে ঘোষিত হয়- ‘উলগুলান’। মুণ্ডা বিদ্রোহকে ‘উলগুলান’ বলা হয়। এর অর্থ ‘বিপজ্জনক অবস্থা’ বা ‘বিদ্রোহ’। ১৮৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ
প্রেসিডেন্সির রাঁচি জেলায় (অধুনা ঝাড়খণ্ডের খুন্তি জেলায়) উলিহাতু গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বীরসা মুণ্ডা। ব্রিটিশ সরকার, স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও খ্রিস্টান মিশনারিদের থেকে জনজাতিদের বাসভূমি ও বনাঞ্চলের ওপর অধিকার, তাঁদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং সাংস্কৃতিক স্বাধিকার ছিনিয়ে নিয়ে স্বশাসন (অবুয়া দিশম, অবুয়া রাজ) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মরণপণ সংগ্রামে ব্রতী হন ভগবান বীরসা মুণ্ডা। পূর্ব ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ওড়িশা) জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এই বিদ্রোহ। ১৮৯৫ সালে ভগবান বীরসা মুণ্ডাকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ
সরকার। তাঁর দু’বছর কারাদণ্ড হয়। কারামুক্তির পর ১৮৯৮ সালে তিনি মুণ্ডা জনজাতি সমাজের সঙ্গে স্থানীয় মন্দিরগুলির সংযোগস্থাপনে উদ্যোগী হন। ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির মূলধারা থেকে জনজাতি সমাজকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্রিয় খ্রিস্টান মিশনারিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই শুরু করেন ভগবান বীরসা মুণ্ডা। ১৮৯৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি জনজাতির সম্প্রদায়ের প্রায় ৭০০০ মানুষকে সংগঠিত করে ‘উলগুলান’-এর ডাক দেন এবং জমিদার, জায়গিরদার,
ঠিকাদারদের শাসন, খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা ধর্মান্তরণ ইত্যাদি শেষ করার সংকল্পগ্রহণ করেন। তিনি জানান যে, ব্রিটিশ নিধন হলো তাঁর মূল লক্ষ্য, জনজাতি সম্প্রদায়ের কোনো মানুষের ক্ষতি তাঁরা করবেন না। ভগবান বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে থানাগুলির ওপর আক্রমণ চলতে থাকে। তাঁকে ধরার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার। ১৯০০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি চক্রধরপুরের জামকোপাইয়ের জঙ্গল থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে ব্রিটিশ পুলিশ। তাঁর সঙ্গে ধরা পড়া জনজাতি যোদ্ধাদের ফাঁসির সাজা-সহ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের সাজা ঘোষণা হয়। কারান্তরালে প্রবল নির্যাতনের কারণে
১৯০০ সালের ৯ জুন ভগবান বীরসা মুণ্ডা শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে ‘ধরতী আবা’ অভিধায় ভূষিত করে ভারতীয় জনজাতি সমাজ। তাঁর মরণপণ আন্দোলন ও সংগ্রামের ফলে ১৯০৮ সালে ‘ছোটনাগপুর টেন্যান্সি অ্যাক্ট’ প্রণয়নে বাধ্য হয় ব্রিটিশ প্রশাসন, যা ‘খুন্তকাট্টি’ বা স্থানীয় জনজাতিদের ভূমি অধিকারকে স্বীকৃতিদান করে এবং বেথ বেগারি প্রথা (জোরপূর্বক শ্রম) বিলুপ্ত করে। ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২১ সাল থেকে ‘১৫ নভেম্বর’ অর্থাৎ ভগবান বীরসা মুণ্ডার জন্মদিন- ‘জনজাতীয় গৌরব দিবস’ হিসেবে উদ্যাপিত হচ্ছে। ভারতজননীর মহান সন্তান ভগবান বীরসা মুণ্ডার জন্মসার্ধশতবর্ষ এই বছর দেশজুড়ে উদ্যাপিত হচ্ছে। তাঁর বীরত্ব, তাঁর আত্মবলিদান স্মরণ করাই হোক ভারতবাসীর ধ্যেয় ও লক্ষ্য।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার জনজাতি উন্নয়নে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকার তার উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রকের মাধ্যমে নীতি প্রণয়ণ ও পরিকল্পনায় যিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষা প্রদান এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সুলভ করেছে। জনজাতিদের জন্য বিভিন্ন ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার সুলভ করেছে। জনজাতিদের জন্য বিভিন্ন আর্থিক সহায়তা প্রকল্প ও বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছে। সামাজিক সুরক্ষার জন্য অটল পেনশন যোজনা চালু করেছে। গত একাদশকে কয়েক কোটি জনজাতি সমাজের মানুষকে দরিদ্র সীমার বাইরে এনেছে। বর্তমানে জনজাতি কল্যাণের জন্য নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের জন্য নীতি আয়োগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বীরগতিপ্রাপ্ত জনজাতি যোদ্ধাদের বীরগাথা স্মরণ, শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং জনজাতি সমাজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির লক্ষ্যে বালাসাহেব দেশপাণ্ডের নেতৃত্বে ১৯৫২ সাল থেকে শুরু হয় ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’-এর কাজ। অশিক্ষা ও দারিদ্র্যের কারণে ধর্মান্তরণের শিকার জনজাতিরা যাতে ভারতীয় জনজীবনের মূলধারা থেকে কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে- সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে কল্যাণ আশ্রমের কার্যকর্তাদের আত্মত্যাগও বিশেষ স্মরণীয়। প্রতিষ্ঠার দিন থেকে এখনও পর্যন্ত তাঁদের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে জনজাতি সমাজের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে এবং হচ্ছে। আগামীদিনে অনেক কাজ বাকি।
ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী জনজাতি সমাজ নতুন ভারত নির্মাণেও তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মু। জনজাতি সমাজের আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়ন আগামীদিনে ‘বিকশিত ভারত’ নির্মাণে সহায়ক হবে।

















