বারো হাজার বছরের প্রাচীন এক নিত্য পূজাস্থল বাঘোর
দেবাশিস চৌধুরী
নৃতাত্ত্বিক মতে আপার প্যালিওলিথিক যুগের শেষ ভাগঅর্থাৎ এখন থেকে আট বা দশ থেকে বারো হাজার বছর আগে যখন হোমো সেপিয়েন্স শিকারি
সংগ্রাহক থেকে ধীরে ধীরে কৃষিকার্যে ও পশুপালনে প্রবেশ করছে সেই সময়ে হোমো সেপিয়েন্সের তৈরি বিভিন্ন প্রত্নসামগ্রী অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। মনে রাখতে হবে, তখনও কিন্তু ‘ভাষা’ পরিপূর্ণ রূপ পায়নি, হোমো সেপিয়েন্স শুধুমাত্র ‘কথা’ বলতে পারতো। এই আপার প্যালিওলিথিক যুগের প্রত্নস্থলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে তুরস্কের গোবেকলি তেপে নিয়ে। কিছু গবেষক এই প্রত্নস্থলটিকে উপাসনাস্থল মনে করেন ঠিকই কিন্তু উপাসনার প্রথা
কীরকম ছিল, উপাস্য কে বা কারা ছিলেন, তাঁরা পুরুষ নাকি মহিলা, সাকার না নিরাকার তার সঠিক হদিশ দিতে ইতিহাসবিদরা অক্ষম। তাছাড়া এই
প্রত্নক্ষেত্রটি আজ সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত অর্থাৎ এই প্রত্নস্থলের উপাসনার ধারাবাহিকতা বহুদিন আগেই লুপ্ত হয়ে গেছে।
বিদেশ থেকে এবার ভারতবর্ষের দিকে তাকলে দেখা যাবে, আপার প্যালিওলিথিক যুগের প্রত্নস্থল বললে প্রথমেই উঠে আসে মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকার নাম। এই ভীমবেটকা থেকে প্রায় ছয়শো কিলোমিটার পূর্ব দিকে সোন নদের উপত্যকায় ১৯৮০ সাল নাগাদ আবিষ্কৃত হয় আপার প্যালিওলিথিক যুগের একটি
প্রত্নস্থল যার নাম বাঘোর। মধ্যপ্রদেশের সিদ্ধি জেলার একটি ব্লকের নাম বাঘোর আর এই ব্লকের নামেই প্রত্নক্ষেত্রটির নামকরণ হয়েছে। প্রত্নক্ষেত্রটি তিনটি ভাগে বিভক্ত বাঘোর-১, বাঘোর-২ এবং বাঘোর-৩। আজকের বিষয় শুধুমাত্র বাঘোর-১ কে নিয়ে। কৈমুর রেঞ্জের পাদদেশে ছবির মতো এক গ্রামের নাম
কেরাই। এই কেরাই গ্রামেই রয়েছে বাঘোর-১ নামক প্রত্নক্ষেত্রটি।
এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটির প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের অধ্যাপক জি আর শর্মা এবং ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির জে ডি ক্লার্কের যৌথ নির্দেশনায় এবং জে এন পাল
ও জে এম কেনোয়ারের সহায়তায় ১৯৮০ সাল নাগাদ এই বাঘোর-১-এ প্রথম খননকার্য চালানো হয়। খননকাজের শুরুতে প্রচুর পরিমাণে পাথরের বর্জ্য এবং তার সঙ্গে নানা রকমের ব্যাকড্ ব্লেড, গ্রাইন্ডিং স্টোন, রিং স্টোন, মাইক্রোলিথ ইত্যাদি বেরিয়ে আসার কারণে প্রথমে মনে হয়েছিল এই জায়গাটি নিছক পাথরের অস্ত্রশস্ত্র তৈরির জায়গা। কিন্তু পরে সব কিছু অপসারিত হলে একটি বৃত্তাকার পাথরের বেদীর দেখা মেলে আর এই বেদীটির উপর বেলেপাথরের তৈরি ত্রিভুজাকৃতির একটি বস্তুর সন্ধান পাওয়া যায়। এটি লম্বায় হাতের তালুর থেকে সামান্য বড়ো, চওড়া হাতের পাঞ্জার মতো, আর উচ্চতা ইঞ্চি দুয়েকের মতো। এই বস্তুটিই ‘বাঘোর স্টোন’ নামে বিখ্যাত।
এই বাঘোর স্টোনটি যখন উদ্ধার হয় দেখা গেল এটি দুটি টুকরোয় বিভক্ত হয়ে আছে আর গায়ে হলুদ, লাল ও কালো রঙের প্রলেপ রয়েছে। তবে এই হলুদ রংটি বেলেপাথরের স্বাভাবিক রং বলেই মনে হয়। এই ত্রিভুজাকৃতি পাথরটির এক পিঠে আবার জ্যামিতিক আকারে ত্রিকোণাকৃতির নিখুঁত খোদাই করা হয়েছে যার সঙ্গে মিল রয়েছে বর্তমান সময়ের শক্তি-যন্ত্রমের। পাথরটি উদ্ধার করার পর সমস্যা দেখা দিল এটি জোড়া লাগানো নিয়ে। উদ্ধারকারীরা বুঝতে পারছিলেন না কীভাবে জুড়তে হবে। সন্নিকটের কেরাই গ্রামবাসীরা, যাঁরা মূলত কোল ও বৈগা জনগোষ্ঠীর মানুষ তাঁদেরকে সমস্যার কথা বলতেই তাঁরা
সমাধান করে দিলেন আর এটাও জানালেন প্রত্নক্ষেত্রটির কাছেই বাঁধানো বেদীর উপর তাঁরা এই ধরনের পাথরে বংশপরম্পরায় পুজো করে আসছেন। এরপর গবেষণাকারী দলটি পাথরটি সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসে এবং পাথরটির স্ট্র্যাটিগ্রাফি করা হলে জানা যায় এর বয়স ১১,৮৭০ বছর (+/-120 YBP)। এরপর ১৯৮৩ সাল নাগাদ জানানো হয় এই বাঘোর স্টোনটি মাতৃ উপাসনার সঙ্গে সম্পর্কিত।
এখন প্রশ্ন, তাহলে বাঘোর-১ বা কেরাই উপাসনা স্থলে নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা কীভাবে প্রমাণ হচ্ছে? প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে এই প্রতিবেদকের
অভিজ্ঞতালব্ধ কিছু কথা না বললে বিষয়টি সম্যক বোঝা যাবে না। আজ থেকে বছর তিনেক আগে যখন প্রথম বাঘোর স্টোনের কথা শুনি তখন থেকেই কেরাই গিয়ে নিজের চোখে সবকিছু দেখার ইচ্ছা হয়। প্রথমে ভেবেছিলাম এটি আমেরিকার কোনো মিউজিয়মে হয়তো আছে। কিন্তু আবার ভাবলাম এতবড়ো একটা প্রত্নবস্তু কি ভারত সরকার বিদেশে যেতে দেবে? এরপর দিল্লি মিউজিয়মে খবর নিই এবং হতাশ হই। এরপর ভাবলাম বিষয়টির সঙ্গে যখন এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি যুক্ত তাহলে এলাহাবাদ মিউজিয়ামে থাকলেও থাকতে পারে। সম্পূর্ণ অনুমানের উপর ভরসা করে অক্টোবর সস্ত্রীক প্রয়াগরাজ রওনা দিই।
চন্দ্রশেখর আজাদ পার্কের পাশে এলাহাবাদ মিউজিয়ামে এসে একজন আধিকারিকের কাছে বাঘোর স্টোন সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে উত্তর এল নেতিবাচক। উনি
পরামর্শ দিলেন একবার এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটিতে খোঁজ করে দেখতে। তবে এখানে আসাটা বৃথা যায়নি। বাঘোর-২ অথবা বাঘোর-৩ সাইটের দুটি প্রত্নবস্তু
দেখলাম, একটি 30,000 – 15,000 BCE-র বিলুপ্ত প্রজাতির হাতির চোয়ালের ফসিল আর 1.5 Million BCE-এর বাইসনের মাথার ফসিল, যদিও এদের
পরিচিতি হিসেবে শুধুই সোন ভ্যালির উল্লেখ রয়েছে। পরের গন্তব্য ইউনিভার্সিটি। মিউজিয়ম থেকে বেশ কিছুটা দূরে ইউনিভার্সিটির দুই নম্বর গেট। গেট
দিয়ে ঢুকতে যেতে নিরাপত্তারক্ষীদের বাধা। আসার উদ্দেশ্য বলাতে তাঁদের একজন ভিতরে গিয়ে আমাদের ভিতরে আসার অনুমতি নিয়ে এসে তবে ঢুকতে দিলেন। গেট থেকে সোজা রাস্তা ধরে বেশ কিছুটা হাঁটলে সংস্কৃত বিভাগ আর এই উলটোদিকেই প্রাচীন ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং পুরাতত্ত্ব বিভাগ। বিভাগে ঢোকার সময় আবারও একপ্রস্থ জিজ্ঞাসাবাদ। বিভাগীয় নিরাপত্তাকর্মীদের সন্তুষ্ট করার পর HOD-র সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেলাম। প্রধান অধ্যাপক এবং আর একজন অধ্যাপক মিলে প্রায় আধঘণ্টার মতো জিজ্ঞাসাবাদ করে আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর এন্ট্রি-ফি ও ফোটোগ্রাফি-ফি মিটিয়ে মিউজিয়ামে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। মিউজিয়ামটির দ্বিতলে একটি কাঁচের বাক্সের ভিতর অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে রক্ষিত রয়েছে বিশ্বের প্রাচীনতম শক্তিযন্ত্রম-‘বাঘোর স্টোন’।
তিন বছর ধরে খোঁজার পর যখন অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছলাম সেই অনুভূতি প্রকাশ করার মতো ভাষা জানা নেই। দু’হাত জোড় করে অশ্রুসজল চোখে বেশ কিছুক্ষণ শুধু তাকিয়েই ছিলাম। যন্ত্রমটিকে বাক্সের মধ্যে বাঘোর-১ থেকে প্রাপ্ত অন্যান্য প্রত্নসামগ্রীর সঙ্গে রাখা হলেও তা অপেক্ষাকৃত উঁচু পাটাতনে লাল ও কালো রঙের গদির উপর ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে রাখা হয়েছে। এখনও এর গায়ে ফ্যাকাশে হয়ে আসা লাল ও কালো রঙের চিহ্ন স্পষ্ট দেখা যায়। তবে এটি কিন্তু উপুড় করা অবস্থায় আছে অর্থাৎ এর একটি দিকই দেখা যায়। অপর দিকটি দেখতে হলে মিউজিয়াম গ্যালারির ছবি থেকে দেখতে হবে। উপুড়
করে রাখার প্রথম কারণ হিন্দু সনাতন ভাবধারা অনুযায়ী কোনো বাতিল বা খণ্ডিত, মূর্তি হোক বা যন্ত্রম, যা বর্তমানে পূজিত নয় তাকে যদি বিসর্জন না দিয়ে ঘরে রেখে দিতে হয় তো এইভাবেই রাখার নিয়ম। দ্বিতীয় কারণ, যন্ত্রমটি আবিষ্কারের সময় যে অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল ঠিক সেই ভাবেই রাখা হয়েছে। সচক্ষে দেখার পর উপলব্ধি হলো কেন এলাহাবাদ ও ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির গবেষকরা ১৯৮৩ সালে জানিয়েছিল এই পাথরটি মাতৃ উপাসনার সঙ্গে সম্পর্কিত।
৯ অক্টোবর প্রয়াগরাজ পর্ব শেষ করে ১১ অক্টোবর চলে এলাম কেরাই বা বাঘোর-১। কৈমুর রেঞ্জের পাদদেশে এই গ্রামে আমরা দুজনই বোধহয় প্রথম বাঙ্গালি পর্যটক। রাস্তার বাঁদিকে মাঠের মধ্যে সিমেন্ট বাঁধানো আয়তাকার চাতালের এক প্রান্তে একটি প্রস্তর নির্মিত ফুট দেড়েকের মাতৃমূর্তি যা ‘কেরাই কি মাঈ’ নামে পরিচিত। এই মূর্তিটির সামনে গোলাকৃতির সিমেন্ট বাঁধানো চাতালের উপর স্তূপীকৃত করে রাখা রয়েছে বিভিন্ন আকৃতির পাথরের ব্লক। প্রতিটি ব্লকের এক পিঠে জ্যামিতিক আকারের খোদাই যেমনটি বাঘোর স্টোনে আছে। একটি ব্লকের সঙ্গে অপর ব্লকের খোদাইয়ের মধ্যে কিন্তু মিলের চেয়ে অমিল
বেশি। দেখলে অবাক হতে হয় এখানকার পাথরগুলির গায়ে খোদাই করা জ্যামিতিক আকারগুলি যা একান্তই গুহ্য মাতৃপূজার যন্ত্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখান থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় তিনশো মিটার দূরে রয়েছে বাঘোর-১ প্রত্নক্ষেত্রটি। কিন্তু বর্তমানে জায়গাটি জলে পরিপূর্ণ। গরমকালে জল শুকিয়ে গেলে প্রত্নক্ষেত্রটি দেখা যায়। প্রশ্ন হলো, বাঘোর-১ বা কেরাই উপাসনা স্থলে নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা কীভাবে প্রমাণ হচ্ছে? এক কথায় উত্তর দিতে হলে বলতে হয় ‘স্থান মাহাত্ম্য’। কালের প্রভাবে বা বিধর্মী আক্রমণে কোনো ধর্মীয় স্থানের বিগ্রহ বা মন্দির যখন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, পরবর্তী সময়ে মূল পরিসরে অথবা সন্নিকটে পুনরায় তা স্থাপিত হলে তখনও কিন্তু তীর্থের আদি মর্যাদা অক্ষুণ্ণই থাকে। উদাহরণস্বরূপ, অযোধ্যার শ্রীরাম মন্দির, গুজরাটের সোমনাথ মন্দির বা
কাশীর বাবা বিশ্বনাথ মন্দিরের ইতিহাস দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। কেরাইয়ের ক্ষেত্রে দুটি সম্ভবনা থাকতে পারে। প্রথমটি হলো আজও যেখানে পূজা
হয়ে চলেছে, সেখানেই বাঘোর স্টোনটির পূজা হতো। কোনো একসময়ে তা ভেঙ্গে গেলে বাঘোর-১ প্রত্নস্থলে পাথরটিকে বিসর্জন বা সমাধি দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় সম্ভাবনা হচ্ছে বাঘোর-১ প্রত্নস্থলের ভিতরেই পাথরটির পূজা হতো। পাথরটি ভেঙ্গে গেলে ওইস্থানেই তা উল্টিয়ে বিসর্জিত করে পাশের নতুন স্থানটি পুজোর জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, দ্বিতীয় সম্ভাবনাটির সুযোগ বেশি। প্রসঙ্গক্রমে একটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি, বাঘোর স্টোনটির স্ট্র্যাটিগ্রাফি করা হলেও অপর পাথরগুলি যা আজও পূজা হয়ে চলেছে তার কিন্তু স্ট্র্যাটিগ্রাফি করা হয়নি। তাই এই পাথরগুলিও যে বাঘোর স্টোনের সমসাময়িক তা বলা এখনই উচিত হবে না। তবে এরজন্য প্রায় ১২,০০০ বছরের প্রাচীন বিশ্বের প্রথম মাতৃ-আরাধনা স্থলের স্থানমাহাত্ম্য কোনো অংশে ক্ষুণ্ণ হয় না। তুরস্কের গোবেকলি তেপের সঙ্গে আমাদের দেশের কেরাই বা বাঘোর-১ এর এটাই মূল পার্থক্য। যেমন হরপ্পা সভ্যতাতে মন্দির না
পাওয়া গেলেও আধ্যাত্মিকতার ছাপ পাওয়া যায়। অথচ সমসাময়িক অন্য সভ্যতায় বড়ো বড়ো স্থাপত্য পাওয়া গেছে। হিন্দু সনাতনী ভাবধারায় আড়ম্বরের থেকে আধ্যাত্মিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তাই বড়ো বড়ো স্থাপত্য অহমিকার প্রতীক হতে পারে, ভক্তির নয়।

















